Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  আমার পুজো

য শো ধ রা   রা য় চৌ ধু রী

Yashodhara Ray Chaudhuri2

শশার টুকরো প্রসাদে কী করে মিষ্টি হয়ে যায় এত...

বিকেল অব্দি লেখাপড়া করতে হল আজ। পঞ্চমী পঞ্চমী সবাই বললে কী হবে, মা তো ছাড়বে না। মা সকালের দিকে সেলাইকল চালিয়ে আমার জামা শেষ করছেন। বড্ড তাড়া। দিদির জামা আছে, মামাতো দিদির জামা। সব শেষ হবার পর আমার জামা। বার বার মা পরিয়ে দেখে নিচ্ছেন মাপ ঠিক আছে ত? কিন্তু একটুও ভাল্লাগে না। সব বছর মা কেন যে নিজে জামা বানান, কখনো কিনে দেন না রেডিমেড। বন্ধুদের কারুর এবার স্ল্যাক্স হয়েছে, কারুর ববিপ্রিন্টের ফ্রক। কেনা জামার ফ্যাশন কত! আমি তা নিয়েও কিছু বলতাম না, যদি না মহালয়ার আগে পরে আকাশ এত মনমরা আর অন্ধকার না হয়ে উঠত রোজ একটু করে। ঝুপ করে সাড়ে পাঁচটায় অন্ধকার নামে, আর আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে ডাক ছেড়ে।

পাড়ার মোড়ে বাঁশ বাঁধা শুরুর সময় থেকে বুক দুরুদুরু, মহালয়ায় শুরুটা শুনে ঘুমিয়ে পড়ে আবার শেষের দিকে জেগে উঠে প্রতিবারই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলাটায় ওর গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু তা বাদ দিলে, আর মায়ের এই ঘর্ঘর করে সেলাই কল চালানো বাদ দিলে, আমার একটুও পুজো পুজো লাগছে না। ইশকুল খুললে অ্যানুয়াল পরীক্ষা, মা তিনটে অনুশীলনী শেষ করতে বলেছে আর দশমিকের ফুটকি ব্যাপারটাই আমার জঘন্য লাগে। মা বলে ফুটকি সরে যাবে, দশ দিয়ে গুণ করলে ডান দিকে সরবে আর দশ দিয়ে ভাগ করলে বাঁ দিকে। তা এসব গুণ আর ভাগ করার দরকারটাই কী বাপু!

ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলা তিন নম্বর স্টেট বাসে চেপে রাজাবাজারে দিদুর বাড়ি যাওয়ার আগে অব্দি নিস্তার নেই। তারপর চারদিন অবিশ্যি পড়াশুনো তাকে, আর বারো তেরোজন মাসতুতো মামাতো ভাইবোনের সঙ্গে চুটিয়ে হল্লা! কিন্তু সে ত এখনো পুরো ২৪ ঘন্টা পরের কথা। পাশের বাড়ি থেকে বিবিধ ভারতীতে কী দারুণ একটা গান ভেসে আসছে। মন কোথায় দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। দূরে দূরে, কাছে কাছে, এখানে ওখানে, খুঁজেছি তোমায়…

হঠাৎ মনমরা নিভে আসা বিকেলের ঘরটায় ষাট পাওয়ারের হলদে ডুম বাতি জ্বেলে দিয়ে মায়ের আবির্ভাব। এই, তোর জামাটা বড্ড প্লেন লাগছে। চল কালী কাটরা থেকে লেস আর অ্যাপ্লিকের ফুল কিনতে যাই। বোতামও ফুরিয়ে গেছে। এক পাতা টিপ বোতাম। আর ম্যাচিং গলার হার কিনে দেব তোদের দু’বোনকে।

বেরোতেই মনের মধ্যে প্রজাপতি উড়তে লাগল আমার। সংঘশ্রীর পুজোটা দেখব না? তাহলে চল সংঘশ্রী সংঘমিত্র করে কাটরা সেরে একবার মুদিয়ালি ঘুরে আসি। ফেরার সময় মুক্তদল দেখব।

হাজরা মোড়ে ফুচকাও খাওয়ালো মা। মায়ের গম্ভীর সদা চিন্তিত মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। দিদির আর আমার একটা করে ঝুটো মুক্তোর লম্বা মালা, মা বললেন এ লাইন ড্রেসের সঙ্গে ভাল লাগবে। চিকনের প্লেন জামায় রঙিন অ্যাপ্লিকের ফুল লাগানো থাকবে বুকের বাঁদিকে। তলায় লেস। অ্যাপ্লিকটাও প্রজাপতি।

সুখ দুঃখের দোলায় করে এভাবেই আসত আমার পুজো। একটা সময় ছিল, যখন ঘটে সশীষ ডাব, পাঁচ আম্রপল্লব দিয়ে, সিঁদুরের ফোটা দিয়ে মাঙ্গলিক চিহ্ন এঁকে আমার দিদু দুর্গাপুজো পালন করতেন বাড়িতে। বরিশাল থেকে আনা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মা দুর্গার একচালা প্রতিমার আঁকা ছবির দু’রঙা ছাপাই প্রিন্টটা, বাঁধানো। সে কোনকালের ক্যালেন্ডার থেকে কাটা ছবিই বুঝি বা। দেশভাগের পর চলে আসার সময়ে বড় বড় কাঠের পরাত, তামার পরাত, কোশাকুশি আর দু’তিনটি এমন পটের ছবি, এনেছিলেন দিদিমা। কাঠের পিঁড়ি ধুয়ে, তাতে চালগুঁড়োর আল্পনা দিয়ে ষষ্ঠীর দিন তৈরি করা হত বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে ঠাকুরের আসন। পেছনে দিদুর অতিপ্রাচীন গোলাপি আর বেগুনি রঙের বেনারসি টাঙানো হত। জরিটিও তার কালচে হয়ে এসেছে। এই আমাদের আশৈশবের ‘পুজো’। দিদিমার আট ছেলেমেয়ে সতেরো নাতিনাতনি। নানা শহরে ছড়িয়ে আছি আমরা এই বৃহৎ পরিবার। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে অন্তত দশজন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসবেই পুজোতে। তখনও কাজিন কথাটা অত চলেনা। ভাইবোনদের চোখে হারাই। তারাই ভয়ানক টানাটানি করে পড়ি দেশের ফেলুদা। বসবার ঘরের ঢালাও মাদুরে বসে শারদ সংখ্যা দেশ হাতে নিয়ে প্রথমেই ফেলুদা তারপর অন্য কিছু। দিদিরা ফেলুদায় আঙুল রেখে সমরেশ বসু আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বড়দের’ লেখাগুলো পড়তে থাকে মায়েদের মামাদের লুকিয়ে। শারদ আনন্দমেলাও ততদিনে এসে গিয়েছে, আমরা শঙ্কু আগে শেষ করেই কাকাবাবু বা গোগোলে চলে যেতে পারি।

ওদিকে দাদু শুদ্ধ বস্ত্রে ছোট্ট লাল শ্রী শ্রী চন্ডীর বই নিয়ে বসেছেন। সনাতন ধর্মের প্রতি দাদুর আস্থা, কিন্তু আমাদের হুটোপাটিতে কোন বাধা নেই। দাদু পড়ছেন মধুকৈটভ বা মহিষাসুর, শুম্ভ নিশুম্ভ বধের অংশ। আমরা বড় হতে হতে আরো দু’তিনটি শ্রী শ্রী চন্ডী হাতে নিয়ে বসে পড়ে নিচ্ছি টীকা ও অনুবাদে এক আশ্চর্য রোমহর্ষক, অ্যাকশন প্যাকড গল্প, যা নাকি এক সুপার ওয়োম্যানের গল্পকে হার মানায়। রোজ দু’তিন ঘন্টা পাঠের আগে শিউলি ফুল গেঁথে তুলছি আর সেদিনের মত পাঠ শেষ হলেই লুটোপুটি করে খাচ্ছি মিষ্টি আর ফল প্রসাদ। শশার টুকরো প্রসাদে কী করে মিষ্টি হয়ে যায় এত, আজো এর রহস্য বুঝিনি।

তারপর দুপুরে কোনদিন খিচুড়ি কোনদিন মাংস-পোলাও, বাকি সময়টা হুল্লোড় আড্ডা। তারপর সন্ধেবেলা আরেক সেট নতুন জামা পরে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, মামার হাত ধরে। গুনতে গুনতে যাওয়া আর অনেক রাতে ফেরার সময়ে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসা। সরু কাগজের স্ট্র দিয়ে কোকাকোলা বা ক্যাম্পাকোলা খাওয়া, বছরে দু’তিন বারের বেশি জুটত না তাও। কখনো বা আইসক্রিম। চিকেন রোল। এগ চিকেন রোল হলে তো স্বর্গ নেমে আসত পৃথিবীতে।

পুজো মানে আমার কাছে অন্য কিচ্ছু না। নতুন জামা নতুন জুতো এসবের ফাঁকে, আসল জায়গাটা বুকের মধ্যে থিরথির এক কাঁপন। ছোটবেলা। আত্মীয়স্বজন। খাওয়াদাওয়া। আর, ঝিমধরা হেমন্তের সন্ধে নেমে আসা, পাড়ায় হ্যালো হ্যালো মাইকটেস্টিং। মধ্যেখানে গোটা দিন জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় বাজতে থাকা মাইকের অমায়িক গান, পুজোর নতুন বেসিক ডিস্ক, সদ্য বেরনো সিনেমার গানের জাদু। সেই স্বর্ণময় সত্তরের দশকের গানগুলো সব। আর ডি বর্মনে, হেমন্তে লতায় আশায় সলিলে মাখোমাখো।

আরও পড়ুন...