প ছ ন্দে র ব ই
করোনা ডায়েরি
দেবদাস আচার্য
প্রকাশক: জীবনকুচি
‘করোনা’– এক মারণ ভাইরাস।প্রায় দুটো বছর আমাদের সকলের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে এই শব্দটি। গৃহবন্দি থেকেছে মানুষ, দূরত্ব বেড়েছে পরস্পরের। ‘মাক্স’,’স্যানিটাইজার’, ‘সামাজিক-মানসিক দূরত্ব’ শব্দগুলি আমাদের নিত্যসঙ্গী হলো। জীবনযাত্রা চূর্ণ হয়ে গেল,নতুন জীবনচেতনা এনে দিল আমাদের। নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকল সমগ্র পৃথিবীবাসী।”আতঙ্কে ভাসছে দুনিয়া/বিমূঢ় এ পৃথিবীর মন ভালো নেই/অস্পৃশ্য হয়ে গেল পরস্পর/ মানুষ।”দেবদাস আচার্যের কথায় ‘কালের প্রহার সইতে হচ্ছে আমাদের’।বাংলা কবিতার আচার্য দেবদাসের ডায়েরির পাতা ভরে উঠলো নতুন অভিজ্ঞতার ফসলে।করোনাকালে দেবদাস লিখে ফেললেন একগুচ্ছ কবিতা। ইতিহাসের দলিল হয়ে উঠলো এইসব কবিতা।২০টি কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘জীবনকুচি’ পত্রিকায়। বাকি ২২টি কবিতা ‘কবিতীর্থ’,’নিরন্তর’,’কোরক’ এবং ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতাগুলি একত্রিত করে ‘জীবনকুচি’ প্রকাশ করল দেবদাসের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘করোনা ডায়েরি’। আমার মনে হয় বাংলা কবিতায় এই কাব্যগ্রন্থ বিশেষ সংযোজন।
“সভ্যতা কি ফুরিয়ে আসছে?
অদৃশ্য এ কোন শত্রু
মানুষের সাজিয়ে-রাখা অস্ত্রভাণ্ডার পরোয়াই করে না
আমার স্ত্রী আজও
বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলেছে
কাল তুলতে পারবে তো?
ভয় হয় ভুল করে
আমার স্ত্রী যদি
ঈশ্বরের পা ছুঁয়ে দেয়”
এত ভয় এত শঙ্কা নিয়ে দীর্ঘ সময় আমাদের বেঁচে থাকা– কিন্তু এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? কবি তো বাঁচতে চান, আমাদের মনে বেঁচে থাকার সুর রোপণ করতে চান– এক কণা জীবনও জীবনই। করোনার আক্রমণ চলছে বিশ্বময়,দিন কাটছে মাথার কাছে নিবু নিবু আলোর মতন।দুর্ভাগ্যবশত কবি দেখছেন এই অসহায় পৃথিবীর মুমূর্ষু-কাল। বিমূঢ় পৃথিবীর মন ভালো নেই, অস্পৃশ্য হয়ে গেল পরস্পর মানুষ।”মানুষ মানুষকে দেখে ভয় পাচ্ছে/মানুষ মানুষকে দেখে/পালিয়ে যাচ্ছে/মানুষই শত্রু আজ/মানুষের/ এ কোন সময়।” মুখোশটাই মুখ, হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার ঘন-ঘন হাত ধুচ্ছি,মন ততই অপরিষ্কার হচ্ছে। পরস্পর পরস্পরের দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে রয়েছি। সভ্যতার এপ্রকার অন্ধকার দেখব ভাবেননি কবি। চারিদিকে করোনার নির্মম প্রহার। সারাদিন নানা রঙের ফুল দেখে সময় কাটালেও একসময় সেই ফুলেও ক্লান্তি আসে, ‘কত দেখব আর’। কেবল বাঁচার জন্য ক্রমে অসামাজিক হয়ে ওঠা–
“সভ্যতা মনস্তাপে ভুগছে এখন
পথ একটাই
একা হয়ে বাঁচো
একা
অসামাজিক।”
“এ কোন দুঃসময়/মানুষ দেখলে মানুষ/দূরে সরে যায়।”
শিল্প-বিপ্লবের আগের সেই ছায়ামাখা দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায় কবির। করোনা ঠেলতে ঠেলতে আমাদের তিনশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।”মনে মনে পৌঁছে গেছি রোমান্সের যুগে…হাপর-হাতুড়ি, নিড়িনি-কোদাল,কুমোরের চাকি,ছায়া- ছায়া নির্মল বাতাস,আঙিনায় মনসামঙ্গল।”
পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা,কষ্ট কবিকে ব্যথিত করে। নিজের দেশেই পরিযায়ী হয়ে যায় অসংখ্য মানুষ।দুঃস্বপ্নের রক্তে-মাখা রুটি লাইনে ছড়ানো থাকে। রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে রুটি আর অপঘাতে মৃত শ্রমিকের দেহ। তবু তো হাঁটতেই হবে রেলপথধরে হাজার হাজার মাইল।কবি দেবদাস লিখছেন–
“মনে পড়ে সেই কিশোরীর কথা
লকডাউনের সময় মে তার অক্ষম রিক্ সাচালক পিতাকে
দেড় হাজার কিলোমিটার পথ
নিরুপায় হয়ে
তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে
বিহারের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল
কোন ভাষায় তার স্তুতি করব, জানিনা
তাকে
স্যালুট”
ঘরবন্দী পৃথিবী কিন্তু প্রকৃতি উল্লসিত, যেন বহুকাল পর নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা পেয়েছে সে। কিন্তু মানুষ সে কী করে থাকবে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে? কাছে না-গিয়ে,কথা না বলে,হাতের উপর হাত না- রেখে? কবি দেবদাস লেখেন–
“ময়ূর নাচছে রাজপথে
কালো মেঘ আকাশ ছুঁয়েছে
পুব-আকাশে হালকা রামধনু
জন্মাবধি এত নৈঃশব্দ্যে থাকিনি
পৃথিবী কি চুপ-চাপ ঘুমোতে চলেছে!
জন-কোলাহলহীন আকাশ-বাতাস
ভুতুড়ে শহরের বাগান-বাড়িতে রয়েছি
এত শান্ত তবু,
মন বলে– পালাই পালাই।”
কিন্তু পালাবে কোথায়?আশার যে মৃত্যু নেই, এই পৃথিবী আলোকিত হবে পুনরায়। আমরা আশায় বুক বাঁধি। মানুষের জয় হবে মানুষের জয় হবে জানি।অতিমারির মহাশ্মশান রোজ বড় হলেও কবির মতো আমিও দেখতে পাই, “এখনও জলঙ্গীনদী/ কুলুকুলু বয়/এখনও পাখিরা খেলা করে/ মেঘ সরে গেলে চাঁদ জোছনা ছড়ায়/শ্মশানে করবীগাছ/ নিঃসঙ্গ,তবু/উৎফুল্ল ফুল ফুটে আছে।”