প্র চ্ছ দ কা হি নী
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমকাহিনীগুলো প্রেম ছাড়াও আরো অনেককিছুকে আঁকড়ে রাখে। আসলে তারা প্রত্যেকেই অপ্রেমকে দূরে রাখার এক একটি দুরন্ত ম্যানুয়াল। না, এই কথাগুলো বিখ্যাত কেউ বলেননি। অ্যান্টিপ্রেম শব্দটা সাদা কাগজের উপর লিখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারই হঠাৎ মনে এল…
“যুবতী কিছু জানেনা, শুধু
প্রেমের কথা ব’লে
দেহ আমার সাজিয়েছিল
প্রাচীন বল্কলে
আমিও পরিবর্তে তার
রেখেছি সব কথা:
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি
আগুন, প্রবণতা”
(শঙ্খ ঘোষ, কবিতা: প্রতিহিংসা, কাব্যগ্রন্থ: নিহিত পাতালছায়া)
কী জানে না যুবতী? কী তার জানা শ্রেয় ছিল?না জেনে কী করেছে? তার কি আর একটু দায়িত্বশীল হওয়ার কথা ছিল?তা না হয়ে নিছক প্রেমের কথা বলাটা তার উচিত হয়নি? তার ফলে কী হয়েছে? তার প্রেমিকের দেহ প্রাচীন বল্কলে সেজে উঠেছে৷ প্রাচীন বল্কলটি কীসের পরিচায়ক?বন্ধনের, বাধ্যবাধকতার, একমুখীনতার– প্রেমের পরিণতি হিসেবে যে সমস্ত সংস্কার সময়লালিত? পরিবর্তে প্রেমিকটি কী করেছে? নিছক প্রেমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বল্কলে বেঁধে ফেলার খেসারত দিতে বাধ্য করেছে যুবতীটিকে। অগ্নিস্নাত হয়ে তাকে শিকার হতে হয়েছে দহনপ্রবণতার।
প্রশ্ন হল– আমরা এই উচ্চারণ কোন ঘরে রাখব? বিরহের মেদুরতা বা মেলানকলি তো এর নেই, নেই তথাকথিত প্রেমের সমর্পণ বা আকুলতাও। প্রেমের খানিক বিপ্রতীপে এর অবস্থান, যদিও বিরহের পথ ধরে নিষ্ক্রমণের অভীপ্সার কোনো পরিচয়ও তেমনভাবে মেলে না। যেটা মেলে তা এক অভিযোগপ্রবণতা; অন্তর্লীন ক্ষোভ — মানুষটাকে পেয়েও না পাওয়ার, পুরোটা না পাওয়ার, পুরোটা পেয়েও ধরে রাখতে না পারার, বা যেমন করে যেমন রূপে পাওয়ার ইচ্ছে ছিল তেমন করে না পাওয়ার। ঘর্ষণে ঘর্ষণে সংঘাতের অনিবার্য ফুলকিরা উড়তে থাকে, যে কাঠের টুকরো দুটো ভেবেছিল ‘নাই, রস নাই’ তারাই পরিণত হয় দারুন চকমকি দুটো পাথরে, আবিষ্কৃত হয় আগুন আর এই আগুনেই হয়তো উজ্জ্বল স্নানে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে তাদের প্রেম। আরো একবার কালের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে। এই দ্রোহ, এই তর্জনী উত্তোলনকারী আপাত সন্ত্রাসের নামই অ্যান্টিপ্রেম, অ্যান্টিহিরোর মতোই যার অভাবে প্রেম তার ভাস্বর রূপটার সঙ্গে আলাপে অক্ষম রয়ে যায়।
“চাব না তোমার চোখে আঁখিজল পাবো আশা করি
রাখিবারে চিরদিন স্মৃতিরে করুণারসে ভরি।……
ভুলে যাওয়া কথাগুলি কানে কানে করায়ে স্মরণ
দিব না মন্থর করি ওই তব চঞ্চল চরণ
তারপরে যেয়ো তুমি চলে
ঝরাপাতা দ্রুতপদে দ’লে
নীড়ে ফেরা পাখি যবে অস্ফুট কাকলিরবে
দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে।”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতা: শেষ বসন্ত, কাব্যগ্রন্থ: পূরবী)
কবিতাটির রচনাকাল ২১শে নভেম্বর ১৯২৪। কবি তখন ‘বিজয়া’ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায়, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়ারিসে সফররত। নিমগ্ন পাঠকের মনে এই কবিতা যেন ছায়া ফেলে এক বিদায়লগ্নের — এক প্রিয় মানুষের সঙ্গে অনিবার্য বিচ্ছেদের। বিচ্ছেদের ক্ষণ যত ঘনিয়ে আসে অবচেতনের অভিযোগের তির ছুটে যায় অভিযুক্তের দিকে, নালিশ ওঠে তার “চঞ্চল চরণ”-এর প্রতি, ” “আঁখিজল” মোচনের অনীহার প্রতি। কবিমানসে অ্যান্টিপ্রেমের এই অস্থিরতা আমাদের শুধু সচকিত নয়, মুগ্ধও করে।
বিরহ নয়, ঝটিতে অ্যান্টিপ্রেমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন জীবনানন্দ দাশ:
“অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, / অনেক কমলা রঙের রোদ; / আর তুমি ছিলে; / তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না, / খুঁজি না।”
(কবিতা: নগ্ন নির্জন হাত, কাব্যগ্রন্থ: বনলতা সেন )
‘দেখি না’ অবধি যা ছিল বিরহের উচ্চারণ, ইচ্ছাকৃত ‘খুঁজি না’-য় কবিমানসের অভিমানহত মুখটা সটান সামনে চলে এল, প্রাধান্য পেল অ্যান্টিপ্রেম। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুদর্শনা’ কবিতায় রূঢ়তা অন্য মাত্রা পায়:
“এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন / তোমার শরীর; তুমি দান করোনি তো; / সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে / সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।”
এই রূঢ়তাও যেন কবি অতিক্রম করে যান একই কাব্যগ্রন্থের ‘ইহাদেরই কানে’ কবিতায় — শামিল হন অ্যান্টিপ্রেমিক যুবকদের অন্তর্লীন বেদনায়:
“একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে — একবার বেদনার পানে / অনেক কবিতা লিখে চলে গেল যুবকের দল; / পৃথিবীর পথে পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে / শুনিল আধেক কথা; — এইসব বধির নিশ্চল / সোনার পিত্তলমূর্তি: তবু আহা ইহাদেরি কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল, / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে, একবার বেদনার পানে।”
কবির নির্জন শ্লেষে ‘মূর্খ সসম্মানে’ শব্দবন্ধের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
অ্যান্টিপ্রেমসঞ্জাত অনুযোগ প্রায়শই পুঞ্জীভূত হয় প্রিয় মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশের অনীহার কারণে — নিরর্থক আত্মাভিমানের পরতে পরতে। অমিয় চক্রবর্তীর কথায়:
“গতিময় ফুলবৃন্ত, চলন্ত বকুল / এনেছিলে স্তব্ধতার ভুল — / সুরভি কোরক ওগো, অনিন্দ্য প্রেমের পুষ্পভার / — কোথাও চিহ্নই নেই আর।।”
(কবিতা: স্রোতস্বিনী, কাব্যগ্রন্থ: পুষ্পিত ইমেজ)
সত্যিই কি চিহ্ন থাকে না? তবে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর আইকনিক ‘শাশ্বতী’-তে কেন বলেন:
“স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি সম / সে রোমরাজির কোমলতা ঘাসে ঘাসে; / পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম; / কিন্তু সে আজ আর কারে ভালবাসে। / স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে / আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা…”
(কাব্যগ্রন্থ: অর্কেস্ট্রা)
নিসর্গের বর্ণ ও অনুভবের মধ্যে প্রেমিক খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে। সমস্যা হল “সে আজ আর কারে ভালবাসে”। অভিমান আসলে অজান্তেই কখনো কখনো সূক্ষ্ম গণ্ডিটুকু পেরিয়ে পৌঁছে যায় অধিকারে, মালিকানায়, দাবি রাখে একনিষ্ঠ মনোযোগের। আমাকে আর ভালবাসে কিনা তার থেকে প্রধানতর হয়ে ওঠে “আর কারে ভালবাসে”র যন্ত্রণা! মন খাড়া করে ফেলে এক বাইনারি তত্ত্বের — “আর কারে ভালোবাসে” মানে আমায় আর বাসে না। ইগো নিজের ভালোবাসাটাকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করে self gratifying অঙ্গীকার — পরবর্তী পংক্তিতে :
“সে ভোলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে / আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।।”
এই অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থেরই আরেকটি কবিতা ‘মার্জনা’র দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব:
” ক্ষমা? ক্ষমা?কেন চাও ক্ষমা? / নিরুপমা / আমি তো তোমার ‘পরে করিনি নির্মাণ / অভ্রভেদী স্বর্গের সোপান; / স্থাপিনি অটল আস্থা বিদায়ের দিব্য অঙ্গীকারে; / ভাবিনি তোমারে নিষ্ঠার প্রস্তরমূর্তি, অমানুষ, স্থবির, নিষ্প্রাণ; / ভুলিনি তো তুমি মুগ্ধ নিমেষের দান।।”
প্রেমিকসত্তা স্থির জানে যে উল্লেখিত ‘ভুল’গুলোই সে করেছে। অথচ তার দয়িতা যখন ফিরে আসার লক্ষণ দেখায়, কতটা ক্ষিপ্রতায় সে তিরের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেয় অন্যদিকে! আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির সামনে নিজের উজ্জ্বলতম রূপটির উপস্থাপনের প্রয়োজন আছে বৈকি! একইসঙ্গে প্রয়োজন আছে নিজের অহং রক্ষার। তাই সে স্মরণ নেয় অ্যান্টিপ্রেমের। কল্যাণী প্রেম — আজ কটাই বা পড়ে আছে পৃথিবীতে?
অনুযোগ কখনও এতটাই পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠে যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলম থেকে বেরিয়ে আসে বিতৃষ্ণা সুলভ উচ্চারণ :
“ফুলকে দিয়ে / মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই / ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই। / তার চেয়ে আমার পছন্দ / আগুনের ফুলকি — / যা দিয়ে কোনোদিন কারও মুখোশ হয় না।”
(কবিতা: পাথরের ফুল, কাব্যগ্রন্থ: যত দূরেই যাই )
একই কবিতায় অনতিবিলম্বেই তিনি বলে ওঠেন:
“কাঁধ বদল করো / এবার / স্তূপাকার কাঠ আমাকে নিক। / আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি / আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা / ভুলিয়ে দিক।”
মিথ্যেবাদী ফুলসাজ আমাদের কাছে কখনও এতটাই অসহ্য হয়ে ওঠে যে অগ্নিদাহের যন্ত্রণাও তুলনায় শুশ্রূষা প্রদানকারী বলে গণ্য হয়। ‘ চিরকুট’ কাব্যগ্রন্থের ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ কবিতায় কবি প্রণয়পিপাসু দিগভ্রান্তের ক্ষতে প্রলেপ দেন:
“হে দিগভ্রান্ত, আমি তো বুঝি — / তোমার জটিল হারানো পথে / বাতি যে ধরব, সেটুকু পুঁজি / আলেয়ার নেই। আমার মতে, / এসো আজ এই জটিল পথে / ঠিকানা বদলে প্রণয় খুঁজি।”
আধুনিক বাংলা কবিতায় পরিবর্তনের প্রথম কাণ্ডারী বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় বিক্ষত মনকে নারীর দিক থেকে ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় রেখেছেন:
“এ জীর্ণ পাতার স্পর্শ নারীমাংস চেয়ে সুখকর, / মলাটে ধূলির গন্ধ — মুখমদ্য তার তুল্য নয়, / গ্রন্থের অক্ষয় গ্রন্থি — পরিপূর্ণ, প্রবল প্রণয়, / এই প্রেমে সমাসীন স্বপ্নলব্ধ পরম সুন্দর। / হেরিতেছে একসঙ্গে শত শিল্প, সংগীত, কবিতা, / কারুকার্য, চারুকলা, মাধুর্যের নাহি পরিসীমা।”
(কাব্যগ্রন্থ: বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা)
কবি বলে ফেলেন যে তাঁর কাব্যরচনায় পদার্পণ incidental, দ্রোহজাত:
“আমি যে রচিব কাব্য, এ উদ্দেশ্য ছিল না স্রষ্টার। / তবু কাব্য রচিলাম। এ গর্ব বিদ্রোহ আমার।”
একই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রেমিক’ কবিতায় সম্মুখীন হই অ্যান্টিপ্রেমের ভলকে বেরোনো ক্যাথার্সিসের:
“মোরে প্রেম দিতে চাও? প্রেমে মোর ভুলাইবে মন?/ তুমি নারী কঙ্কাবতী, প্রেম কোথা পাবে? / আমারে কোরো না দান, তোমার নিজের যাহা নয়। / ধার করা বিত্তে মোর লোভ নাই; সে ঋণের বোঝা / বাড়িয়া চলিবে প্রতিদিন — যতক্ষণ সেই ভার সর্বনাশ না করে তোমার।”
অ্যান্টিপ্রেমের উৎসার প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে কটুভাষণের গণ্ডি। এই তিক্ততাই পরিশীলিত অথচ রক্তক্ষরণে লা জবাব হয়ে ওঠে একই কবিতার পরবর্তী কয়েকটি পংক্তিতে:
“সুন্দর না হলে যদি জীবনের পাত্র হ’তে কোনো ক্ষতি, ক্ষয় নাহি হয়, / সুন্দর হবার গূঢ়, দুরূহ সাধনা– / ক্লেশকর তপশ্চর্যা / কে আর করিতে যায় তবে?
সব আমি জানি, তবু — তাই ভালবাসি, / জানি বলে আরও বেশি ভালবাসি। / জানি শুধু ততদিন তুমি রবে তুমি, / যতদিন রবে মোর প্রিয়া।”
ত্রুটিগুলো চোখে পড়ছে, প্রকট হয়ে উঠছে। যেমন ভাবা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি তো নয়। তবু পাত্র যে প্রায় উপুড় করে সবটুকু দেওয়া হয়ে গেছে, নিতান্ত ফিরিয়ে না দিলে আর তো ফেরার উপায় নেই! অতএব অ্যান্টিপ্রেমের এই উৎসারেই যেটুকু নিরাময়।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শালপ্রাংশু উচ্চারণে অনুরণিত হয় বিক্ষুব্ধ নির্দেশ:
“আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো ভানুমতী, সমস্ত সকাল / দুপুর বিকেল তুমি হাতে পেয়েছিলে। / যদি মনে হয়ে থাকে, আকাশের বৃষ্টিধোয়া নীলে দুঃখের শুশ্রূষা নেই, যদি / উন্মত্ত হাওয়ার মাঠে কিংশুকের লাল পাপড়িও / না পেরে থাকে রুগণ বুকে সাহস জাগাতে। / অথবা সান্ত্বনা দিতে বৈকালের নদী, — / আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো সন্ধ্যার সহিষ্ণু শান্ত হাতে।
আংটিটা ফিরিয়ে দিয়ো, এ আংটি যেহেতু তারই হাতে / মানায়, যে পায় খুঁজে পত্রালির ভিড়ে / ফুলের সুন্দর মুখ, ঘনকৃষ্ণ মেঘের শরীরে রৌদ্রের আলপনা।“
(কবিতা: আংটিটা, কাব্যগ্রন্থ: অন্ধকার বারান্দা )
সম্বোধিত সত্তার নাম নির্বাচনটি সচেতন পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। ভানুমতী তো তিনিই যিনি ‘খেল’ প্রদর্শনে পারদর্শী!
এই অ্যান্টিপ্রেমই এক অমোঘ ভাস্বরতা পায় নীরেন্দ্রনাথের ভিন্ন এক উচ্চারণে। প্রেম, অস্থিরতা, দ্রোহ পার হয়ে এক চিরন্তন সত্যের শিহরণ তোলে শরীর ছাড়িয়ে মননে:
“বরং দ্বিমত হও আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়। / বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। / বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। / অন্তত আর যা-ই করো, সমস্ত কথায় / অনায়াসে সম্মতি দিও না। / কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, / তারা আর কিছুই করে না, / তারা আত্মহননের পথ পরিষ্কার করে।………./ ওই দেখো কয়েকটি অবিবাদী স্থির / অভিন্নকল্পনাবুদ্ধি যুবক-যুবতী হেঁটে যায়। / পরস্পরের সব ইচ্ছায় সহজে ওরা দিয়েছে সম্মতি। / ওরা আর তাকাবে না ফিরে! / ওরা একমত হবে, ওরা একমত হবে, ওরা একমত হতে হতে কুতুবের সিঁড়ি বেয়ে / ঊর্ধ্বে উঠে যাবে, লাফ দেবে শূন্যের শরীরে।”
(কবিতা: মিলিত মৃত্যু, কাব্যগ্রন্থ: নিরক্ত করবী)
প্রেমের সিরাপে আশিরনখ ভিজে বিচার-বিবেচনাহীন হয়ে নিজস্বতা বিসর্জন দেওয়ার মেষপ্রবণতাকে কবি বিদ্ধ করেছেন তাঁর অ্যান্টিপ্রেমের প্রখর শরে। অথচ আজও সেরকম গভীরতায় সমৃদ্ধ মনের মানুষ বিরল যাঁর চোখে জ্বলে উঠবে লক্ষ ওয়াটের আলো যদি তাঁর গাঢ় চেনা মানুষটি তাঁকে বলেন ‘আমি তোমায় মধু নয়, প্রাত্যহিকতার লবণের মতই ভালবাসি’। রাজা লিয়ারের মতোই আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের তোয়াজপ্রিয়, প্রশ্নাতীত আনুগত্যে অভ্যস্ত মানুষটি এক হতদরিদ্র অসহায়তায় দিন কাটাতে বাধ্য হন, এগিয়ে যান কবি’র নির্দিষ্ট এক অনিবার্য আত্মহননের দিকে। অ্যান্টিপ্রেমের তীক্ষ্ণতা আরো প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে একই কাব্যগ্রন্থের ‘একটাই মোমবাতি’ কবিতায়:
“নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর / অনায়াসে কাটাতে পারতে, কিন্তু কাটালে না; / এখনই দপ ক’রে তুমি জ্বলে উঠলে ব্লাউজের হলুদে। / খুব অহংকারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়। / তুমি এত অহংকারী কেন? / একটাই মোমবাতি তবু অহংকারে তাকে তুমি দুদিকে জ্বেলেছ।”
যাঁর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা তিনি হয়তো প্রগলভতার উদযাপনে নিমগ্নতার হোমাগ্নিতে জল ঢেলে দিয়েছেন। এ দোষে আমরা অনেকেই দুষ্ট; এটুকুও অনেকসময় খেয়াল থাকে না যে দুদিক থেকে জ্বলতে জ্বলতে অনেকটাই ছোট হয়ে গেলে, নিভে যাওয়া ছাড়া আর প্রদর্শনযোগ্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে কোনো হার-জিতের প্রশ্ন ওঠে না, কোনো প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গ সেখানে অবান্তর। অথচ অ্যান্টিপ্রেম সমুদ্র থেকে ঢুকে পড়া গুমোট লোনা বাতাসের মতো কখন যেন বয়ে আনে সে বীজাণু। প্রেমেন্দ্র মিত্র লেখেন:
“সব কথা হেরে গেলে / তাই এক দীর্ঘশ্বাস বয়, / বুঝি ভুলে কেঁপে ওঠে / একবার নির্লিপ্ত সময়। / তারপর জীবনের ফাটলে ফাটলে / কুয়াশা জড়ায়, / কুয়াশার মতো কথা হৃদয়ের দিগন্তে ছড়ায়।”
(কবিতা: কথা, কাব্যগ্রন্থ: ফেরারী ফৌজ)
এ কুয়াশা কি কেটে যাওয়া সম্ভব?সে প্রসঙ্গে আর নয় একটু পরে আসি?
কবি বিষ্ণু দে-র অ্যান্টিপ্রেমের স্বর ব্যর্থ হয় প্রকৃতিজোড়া উৎসব উদযাপনের আয়োজনে নিজেকে শামিল করতে। দীর্ণ হয় বিধুর স্মৃতির রোমন্থনে:
“শরতের সাদা খামকাখুশির মেঘ — / পৃথিবী পাঠায় কাশের নিমন্ত্রণ — / নির্বোধ, নির্বোধ। /পদ্ম দীঘির পাড়ে / আশ্বিনে গাঁথা গান যে আমার কুচিকুচি করে ছিঁড়ে / ভাসালে নিথর জলে। / আমারই হৃদয় নিথর গভীর নীল সে পদ্মদীঘি।”
( কবিতা: ওফেলিয়া, কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি )
মনের ক্যানোপিতে এতটাই বুনো মেঘের আনাগোনা, শরতের স্বাভাবিক সাদা মেঘের খুশির অনুষঙ্গতেও ‘খামকা’ বিশেষণ জুড়ে যায়! জলের নিথরতা যেন সাড়া না দেওয়া হৃদয়ের নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরতার ইঙ্গিতবাহী। আহত অ্যান্টিপ্রেম কখনও বা নিষ্কৃতি খোঁজে লঘু মস্করায়, the lips curl up in a wry grin:
“সভ্য তো বটে, শরীরধর্ম লোপাট আজ / আদিম স্নায়ুর প্রতিক্রিয়ায় মুক্তি নেই। / তবুও তোমাকে খুঁজে ফিরি দেখো কলকাতায়! / রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কেন যে তোমার চুক্তি নেই!”
(কবিতা: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি)
তাঁর অমর কবিতা “ক্রেসিডা”-য় অ্যান্টিপ্রেমটুকু সম্বল করে গুঁড়ো করে দেন প্রেমজনিত সন্ত্রাস:
“তুমি ভেবেছিলে উন্মাদ করে দেবে? / উদ্বায়ু আজও হয়নি আমার মন, / লোকায়ত মোর স্বেচ্ছা বর্মে লেগে / বর্শা তোমার হয়ে গেল খান-খান। ”
(কাব্যগ্রন্থ: চোরাবালি)
অ্যান্টিপ্রেমের আহত মুখটি মার্জিত করে আলোক সরকার ঘুরিয়ে দেন শুশ্রুষাকারী প্রকৃতির দিকে:
“ফুলকে তো বলতে হয় না তুমি বেলফুল, জুঁইফুল, অর্পিত সম্মান / দুই চোখে অনায়াস দিঘি। / তোমার বাড়িতে আর যাবো না কখনো। সারাদিন নিবিড় বাগান। / তোমার নামের ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি না। একদিন নিশ্চিত প্রেমিক / তোমাকে ডেকেছি আর রুগ্ন সাদা হেমন্ত পৃথিবী।
জিহ্বার জড়তা এক অভিশাপ৷ ক্লান্ত অসুস্থতা শারীরিক / মানসিক দুর্বলতা আনে। / ভাষা ব্যবহারে ভুল হয়?সেই দিন ভালবাসি / বলতে চেয়েছিলুম। তুমি তার কোন মানে / করেছিলে? নিখিল রাত্রির শুভ্র বাগানে সার্থক ফিরে আসি।”
(কবিতা: ঘাসের আড়ালে, কাব্যগ্রন্থ: বিশুদ্ধ অরণ্য )
তবু মানুষের মন তো, শত লাঞ্ছনা, যন্ত্রণালাভের পরেও একটু খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে স্মৃতি কণামাত্রও ধরে রেখেছে কিনা নিহিত যৌথযাপনছায়াটুকু। অ্যান্টিপ্রেমের উচ্চারণেই লগ্ন হয়ে থাকে সেই উদ্ভাস:
“পোকাটাকে দুই পায়ে পিষে ছুঁড়ে দিল বাইরে অন্ধকারে / আমার প্রেমিকা। আমি অবজ্ঞাত লাঞ্ছিত প্রেমিক / পরিত্যক্ত ঘরের বাইরে এসে দেখলাম শুভ্র ব্যবহারে / সমগ্র নিশীথ সান্দ্র অভিসার।…… / তোমার সিঁড়ির শূন্যতায় / একাগ্র মাকড়সা নিঃস্ব স্বাভাবিক জাল বোনে। স্বাভাবিক / ধুলো, বাদামের খোসা, মৃত্যুর নিশ্চিত সত্যে স্থির। / ভালবাসা, আমাদের দুজনের নির্মিত বিকেল মনে পড়ে?”
(কবিতা: পারিজাত, কাব্যগ্রন্থ: বিশুদ্ধ অরণ্য)
ধীরে খুব ধীরে শান্ত হয়ে আসে সেই আকুতিও। মার্জিত রুচির মানুষটি নিষ্কৃতি খুঁজে নেন তাঁর পারিপার্শ্বিকে, প্রকৃতিতে। দোষারোপের কণামাত্র ধুলোও আর বহন করে না তাঁর অন্তঃকরণ। মেনে নেন, যা আদতেই তাঁর হওয়ার নয়, তাঁর আহরণক্ষমতার বাইরে, তা স্বাভাবিকভাবেই তাঁর হয়নি, এ নিয়ে তো বিলাপের বা কালক্ষেপের কারণ নেই। অ্যান্টিপ্রেম এক অন্য উচ্চতা পায়:
“বৈশাখের নির্জন নীলিমা / উচ্ছ্বসিত নীল রিনিঝিনি সুরে সুরে গেয়ে ওঠে, লাল কৃষ্ণচূড়া / দিগন্তের শান্ততায় উদ্ধত অভীপ্সা তার কেনই বা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়! / আমার তো জানা নেই সহসা এ রঙের প্রণয় / কেন এত কথা কয়! / আমাকে তা দেওয়া কেন আমার যা নয়?
(কবিতা: স্বজ্ঞা, কাব্যগ্রন্থ: উতল নির্জন )
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’র অ্যান্টিপ্রেম ‘অধ্যাপিকা’কে তর্জনী তুলে বলে আসে:
” ম্যূর অ্যাভিনিউর শেষ বাঁকে / স্পষ্ট বলে এলাম ‘তোমাকে / অন্তত — গোটা জীবনে একবার — বিধাতার কাছে / নগ্ন হতে বলি, / এবং নগ্নতা মানে সভ্যতার প্রচ্ছাদন নয় / কিংবা এক ফাঁকে / কন্দর্পনির্দেশে খুব ঢেকে ঢেকে রাখা কুন্দকলি; / এবং নগ্নতা নয় অভিনীত সুদীর্ঘ প্রণয়।। “
(কবিতা: অধ্যাপিকা, কাব্যগ্রন্থ: লঘু সংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে)
যে সমর্পণ তিনি পাননি, তা তাঁর চেনা মানুষটি, একবার, শুধু একবার বিধাতার কাছে তো করুন, এই সততাটুকুই তাঁর একান্ত দাবি। একই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রেমিকা’ কবিতায়:
“চেয়েছিলাম সহাবস্থান / দেখিয়ে দিলে মহাপ্রস্থান আঙুল তুলে; / যেই না করতে গেছি ভক্তি / দেখি অথৈ রক্তারক্তি দশ আঙুলে৷ / রক্ত মুছতে জামার কাপড় / ছিঁড়তে গেছি অমনি ‘পামর’ বাজল কানে — বাজল ব্যথা তার চেয়েও / বললে যখন: ‘খেয়ে যেয়ো আজ এখানে।’”
ভক্তি করতে গেলেই রক্তক্ষরণ! কেন? ভক্তিযোগ্য পরিচিত লক্ষণগুলো কি ঠিক মিলছে না? কানে বাজছে কারণে-অকারণে রূঢ় ভাষণের মুহূর্তগুলো? আঘাতের icing on the cake ঘটে যখন পোশাকি ভদ্রতার আবরণে এসে হাজির হয় সৌজন্যের ক্রূরতা — যে অমোঘ অস্ত্রটি শীলিত সমাজে ব্যবহৃত হয় চরম মূহূর্তটির জন্য, নিশ্চিত এবং নিদারুণভাবে এটুকু স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য যে– তুমি আমার কাছে অন্যদের মতোই, আলাদা কিছু নও। তাই আমার বাড়ির সৌজন্যের প্রথা অনুযায়ী অতিথি সৎকারের বরাদ্দটুকু তোমার জন্যও অক্ষুণ্ন আছে।
এরকম নির্দয় সরলীকরণ এক ধরনের delirium-এর জন্ম দিতে পারে। অ্যান্টিপ্রেম যন্ত্রণার হাহাকারে চিৎকার করে ওঠে কৃত্তিবাস আন্দোলনের পুরোধা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছাকৃত পুনরাবৃত্তির স্বরে:
“সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে, নীরা, কেন হেসে উঠলে, কেন
সহসা ঘুমের মধ্যে যেন বজ্রপাত, যেন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নীরা, হেসে উঠলে, সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে কেন সাক্ষী কেন বন্ধু কেন তিনজন কেন?
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেন হেসে উঠলে সাক্ষী রইল বন্ধু তিনজন!”
(কবিতা: অপমান এবং নীরাকে উত্তর, কাব্যগ্রন্থ: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি )
নীরার কাছ থেকে ফিরে এসে প্রেমিক সত্তাটি অ্যান্টিপ্রেমের ঘোরে যেন নিজেকে দেখতে থাকে একটি নিকৃষ্ট সত্তা রূপে — যেন Beauty-র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া একটা Bestial (মনুষ্যেতর/জান্তব) presence(উপস্থিতি)। এ এক ধরনের self flagellation, এক মৃদু মর্ষকামপ্রবণতা ( masochistic tendency ) যা একই কাব্যগ্রন্থের ‘নীরার জন্য কবিতার ভূমিকা’ শীর্ষক কবিতায় ঘনিয়ে তোলে এহেন উচ্চারণ:
“এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাস রেফ / ও রয়ের ফুটকি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার / আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও / বিছানায় আমার নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলি / এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু / তোমার জন্য এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে / তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও,… / আমার ভয়ঙ্কর হাত তোমাকে ছোঁবে না,… / শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম, শব্দ ও অক্ষরের কবিতায় / তোমার শিয়রের কাছে যাবে– এরা তোমাকে চুম্বন করলে তুমি টের পাবে না। / এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে এক বিছানায়– / তুমি জেগে উঠবে না / সকালবেলা তোমার পায়ের কাছে মৃত প্রজাপতির মত এরা লুটোবে।”
মাফ করবেন। কেন জানিনা কিশোরবেলায় হলিউডের উপস্থাপনায় দেখা রুপোলি পর্দার ভীষণদর্শন অথচ পেলব চোখের দৈত্যাকৃতি গরিলা আর তার আগলে রাখা রূপসী মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। চোখে অজান্তেই একটা ঝাপসা পর্দা নামল। সিরিয়াস সাহিত্য আলোচনার মাঝখানে এই প্রগলভতা মাফ করে দেবেন।
কবির প্রবাদপ্রতিম ‘দেখা হবে’ কবিতা থেকে অ্যান্টিপ্রেমের, তুলনায় সমাহিত একটি উদাহরণ তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না:
“ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে… এতকাল ডাকোনি আমায় / কাঙালের মতো আমি এত একা, তোমার কি মায়া হয়নি, / শোনোনি আমার দীর্ঘশ্বাস? / হৃদয় উন্মুক্ত ছিল, তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!… / আমার দুঃখের দিনে বৃষ্টি এল, তাই আমি আগুন জ্বেলেছি, সে কি ভুল?/ শুনিনি তোমার ডাক, তাই মেঘমন্দ্র স্বরে গর্জন করেছি, সে কি ভুল?/ আমার অনেক ভুল, অরণ্যের একাকিত্ব, অস্থিরতা, ভ্রাম্যমান ভুল!”
(কাব্যগ্রন্থ: আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি)
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরস্ত্রী’ কবিতায় সাক্ষী হই অ্যান্টিপ্রেমের তীব্র অভিমানের, প্রায় কৈশোরসুলভ আকুলতার:
“যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো / যাবো না আর ঘরে / সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না / ধরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না /বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো / কখন যেন পরে।”
( কাব্যগ্রন্থ: হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য )
অ্যান্টিপ্রেম এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ও নৈরাশ্যবোধ বহন করে আনে নান্দনিক উৎকর্ষতায় অনন্য ‘হৃদয়পুর’ কবিতাটিতে:
“তখনো ছিল অন্ধকার তখনো ছিল বেলা / হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা /………. / কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রূকুটিতে / সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা চারিভিতে / কী কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনো, এই বেলা / হৃদয়পুরে জটিলতার ফুরালে ছেলেখেলা ”
(কাব্যগ্রন্থ: ধর্মে আছো জিরাফেও আছো )
ওপার বাংলার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের কলমে অ্যান্টিপ্রেমের উচ্চারণে লাগে এক বিচ্ছেদমেদুর অথচ কমনীয় আন্তরিকতার ছোঁয়া:
“তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার / কুরুলিয়ার পুরোনো কই ভাজা; / কাউয়ার মতো মুন্সি বাড়ির দাওয়ায় / দেখব বসে তোমার ঘষা মাজা / বলবে নাকি, এসেছে কোন গাঁওয়ার?
ভাঙলে পিঠে কালো চুলের ঢেউ / আমার মতো বোঝেনি আর কেউ, / তবু যে হাত নাড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায় / শহরে পথ দেখিয়ে দিলে যাওয়ার।”
কাব্যগ্রন্থ: সোনালি কাবিন)
‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত সনেটসিরিজের প্রবেশক সনেটের শেষ দুই পংক্তিতে যেন সময়ের ফলকে খোদাই হয়ে থাকে আপামর কবির অ্যান্টিপ্রেমের স্পর্ধা:
“পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুন আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।”
‘আপামর কবি’ বলেছি বলে ভ্রূ পল্লবে কিঞ্চিৎ কুঞ্চন লক্ষ্য করলাম কি? উদ্ধৃত পংক্তিদ্বয়ে ব্যবহৃত একটি শব্দের জন্য দোষ নেবেন না মহাশয়া। আপনি ‘নারী’ শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রিয়’ শব্দটি বসিয়ে নিন না! ভ্রূ পল্লবের কুঞ্চন স্তিমিত হয়ে আসবে আর বক্তব্যের নির্যাসটুকুও আমরা কোনো বিভেদের শিকার না হয়েই উপভোগ করতে পারব।
আমাদের অর্ধেক পৃথিবী অর্ধেক সত্তা অর্ধেক জীবনের কাছে প্রেম কখন আসে?কিভাবে আসে?কিভাবে এসেছে বলে মনে হয়?কিভাবে প্রেমকে আনতে হবে বলে শতাব্দীর পর শতাব্দীর লোকাচার সেই সত্তাটিকে প্রস্তুত করে রেখেছে? Conditioned করে রেখেছে? শুনব না আমরা? ভলকে উঠে ছিটকে বেরোনো অ্যান্টিপ্রেমই সংজ্ঞায়িত করে তাকে, কবিতা সিংহের কলমের তির্যক প্রয়োগে:
“যখন পায়ের তলায় পেতে দিতে হয় বুক / বুকের ভিতর তুলে নিতে হয় পা / যখন অহংকার সকল অহংকার হে আমার / ঝরিয়ে দিতে হয় মানুষের চরণধূলায় / ভিতর-সেতার থেকে ছিঁড়ে ফেলতে হয় একটি ছাড়া / অযথা সব তার / একটি একতারা হয়ে / শেষ বিকেলের সূর্যকে বলতে হয় ‘থামো’ / — থামো দিনমণি থামো / ‘তাঁর মৃত্যু হয়েছে’ লিখতে গিয়ে কেউ / মৃত্যু শব্দটাকে উপড়ে ফেলে দেয় / ডুবন্ত সূর্যের আর্কল্যাম্পের দিকে / দুই হাত তুলে চিৎকার করে ওঠে — ‘থামো’ / দিনমণি থামো তার প্রেম হয়েছে প্রেম হয়েছে প্রেম’
(কবিতা: প্রেম, কাব্যগ্রন্থ: বিমল হাওয়ার হাত ধরে )
নারীকে ব্যবহার করে, তার সঙ্গে ঘটা আদান-প্রদানের ওপর রং চড়িয়ে, কখনো কখনো তার নাম বা পরিচয়টুকু আড়ালে রাখার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও না করে সাহিত্য রচনার একটা প্রবণতা আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। একে অ্যান্টিপ্রেম বলে কি? এ এক বিকৃত পুরুষতন্ত্র যা খেয়াল রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না এতে একটা মানুষ কতটা বিব্রত হচ্ছেন, তাঁর জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। নাকি এটাই অভীষ্ট চাঁদমারি?প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার এক স্বাদু শিল্পসম্মত প্রকরণ? কবিতা সিংহের অ্যান্টিপ্রেমের স্ক্যানার থেকে বাদ যায় না এ প্রবণতা:
“না আমি হব না মোম / আমাকে জ্বালিয়ে ঘরে তুমি লিখবে না / হব না শিমূল শস্য সোনালী নরম / বালিশের কবোষ্ণ গরম।
কবিতা লেখার পরে বুকে শুয়ে ঘুমোতে দেব না। / আমার কবন্ধ দেহ ভোগ করে তুমি তৃপ্ত মুখ, / জানলে না কাটামুণ্ডে ঘোরে এক বাসন্তী-অসুখ / লোনা জল ঝাপসা করে চুপিসাড়ে চোখের ঝিনুক। /………. / যন্ত্রণা আমাকে কাটে, যেমন পুঁথিকে কাটে উই।”
(কবিতা: না, কাব্যগ্রন্থ: সহজ সুন্দরী)
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল তারাপদ রায়ের ‘যমুনাদি’ কবিতাটি:
“তুমি ঠিক প্রেমিকার পর্যায়ে পড়োনা, যমুনাদি, / তোমার বুকের দিকে তাকালে কৈশোর মনে পড়ে! / তুমি কি এখনো ভাবো আমি সেই ষোলো বছরের / সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছি, মাসে একদিন / চুল-দাড়ি একসঙ্গে কামাই, ক্ষীণ গোঁফ, দ্বিতীয়ার / বাঁকা চাঁদ, তোমারই ঠোঁটের কূলে কবে অস্ত গেছে।”
(কাব্যগ্রন্থ: কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু )
আমরা এটুকু আশা করতেই পারি যে ‘যমুনা’ নামটি কাল্পনিক; নিদেনপক্ষে কবিতায় বর্ণিত চরিত্রটির লেখকের পরিচিত জীবনে অস্তিত্ব থাকলেও, তার বাস্তবজীবনে ব্যবহৃত নামটি কোনো নদীর নামের সঙ্গে সাদৃশ্য বহন করে না বা যমুনা শব্দটির সঙ্গে ছন্দে মেলে না, অর্থাৎ কাউকে ‘চিনিয়ে’ দেওয়ার সুচারু সন্ত্রাস কবিতায় অনুপস্থিত। আমরা অবশ্য শুধু আশাটুকুই করতে পারি। অ্যান্টিপ্রেমে দগ্ধ যৌবন আসলে পরাজয় শব্দটাকে বড় ভয় পায়, জয় বা পরাজয়ের উর্ধ্বে ওঠার মনস্তত্বটুকু তখনও আয়ত্তে আসে না:
“সম্রাজ্ঞীর মতো যাচ্ছ, যাও / দেখা হবে, যেখানেই যাও / দেখে নেবো, ঠিক একদিন, / আজ হোক কাল হোক কবে, / ঠিক একদিন দেখা হবে। / হংসীর মতন যাচ্ছ, যাও, / দেখা হবে, ডোবায় না হোক, / খালে বিলে, ঘাটা আঘাটায়, / সাগরে? না হয় তাই যাবো, / একদিন তোমাকে দেখাবো। “
(তারাপদ রায় — কবিতা: সম্রাজ্ঞীর মতো — কাব্যগ্রন্থ: ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন )
লক্ষ্যণীয় — ‘সম্রাজ্ঞী’ কিভাবে তপ্ত হৃদয়ের আঁচে কয়েকটি মাত্র পংক্তির ব্যবধানে ডোবার ‘হংসী’তে পরিণত হচ্ছে!
অ্যান্টিপ্রেমছন্দে বর্ণে চিত্রকল্পে দ্যুতিময় হয়ে ওঠে শিল্পী কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কলমে:
“আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে। / এর আকাশে ওর আকাশে / ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে / পায়রাকে ধান খুঁটতে দিলে খোয়াই জুড়ে / বুকের দুটো পর্দা ঢাকা জানলা খুলে / কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে। /……
আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে। / একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি / আলমারিটার ঝুলন চাবি।”
(কবিতা: অনেককেই তো অনেক দিলে, কাব্যগ্রন্থ: শব্দের বিছানা)
ওই ‘ঝুলন চাবি’ই অ্যান্টিপ্রেমে রেখে দিয়েছে, টেনে রেখেছে একফালি আলোয়, আড়াল করে রেখেছে বিরহের রাস্তা। ওই প্রাণভোমরার আশায় পথের পাশে অপেক্ষা, আবার ফেরার কথা ভাবা:
“সে ভোমরাটি সকল জানে / কোন হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো / সে ভোমরাটি সকল জানে / কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত………. / তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন চাবি / আমায় দেবে?”
এই অপেক্ষা কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দমচাপা অবসাদের এবং আরও ঘনীভূত অ্যান্টিপ্রেমের ঘূর্ণির — এমন উদাহরণও বিরল নয়। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায়:
“এখন শীতের রাতে ওই ট্রেন / কত দূরে যাবে / আমি যাব। / জানলার দেশ থেকে / তোমাকে লিখেছিলাম কত চিঠি — / কত কথা তোমাকে বলেছিলাম / পথে-পথে, নির্জন টেবিলে। / অনেক বছর হলো / সেই সব — / মনে পড়ে, আজও মনে পড়ে / সমস্ত তাচ্ছিল্য আজ মনে পড়ে। / নির্জন চোখের জল মনে পড়ে। / মাথা, ভারী হয়ে আসে — / মৃত্যু / দুই-তিন পয়সার খেলা।
(কবিতা: মৃত্যু সম্পর্কে আরো, কাব্যগ্রন্থ: এসো, সুসংবাদ এসো )
অযথা অপেক্ষায় অস্থির হতে হতে অ্যান্টিপ্রেমে বিধ্বস্ত মানুষটি ঠিক করে অপর মানুষটিকেও শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই :
“এমনকি আমার চুরুট, বন্দুকের মতো, ছুটে যাবে তোমার ঘরে — / সকালবেলা আমি / বসে থাকব আমার বিছানায় — একটা বিড়াল, রোজ, রুটিন মাফিক / চেটে দেবে আমার পা — কোথাও যাব না আমি — / আমার ঘাম, বিশাল জলের মতো / আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে তোমার ঘর — তুমিও কোনোদিন / যেতে পারবে না কোথাও — দু হাজার মাইল দূরের / ছোট্ট এক ঘর থেকে প্রতিদিন, আমি কথা বলবো তোমার সঙ্গে / তুমি খেতে পারবে না ঘুমোতে পারবে না / তুমি গান গাইতে পারবে না হাসতে পারবে না / তুমি থেকে থেকে — সারাজীবন — কেবলই আঁতকে উঠবে ভয়ে — ”
(কবিতা: প্রতিহিংসা ১, কাব্যগ্রন্থ: শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা)
উৎফুল্ল আশা নিয়ে শুরু হওয়া প্রেমে এভাবেই অনিচ্ছাকৃত ঘনিয়ে ওঠে অ্যান্টিপ্রেমজনিত সন্ত্রাস। বিনয় মজুমদারের ভাষায়:
“কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে। / কৌটোর মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা / উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল। / সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা / বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু। / দৃষ্টিবিভ্রমের মত কাল্পনিক বলে মনে হয় / তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত। / অথবা করেছ ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো, পথে। ”
( কবিতা: কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে)
শেষ পংক্তিগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছে কাষায়, প্রায় কটু এক উচ্চারণে। এরকম সম্ভাষণে সম্বোধিত কারও পক্ষে আবারও প্রেমের স্বাভাবিক সরণিতে সাবলীল পদচারণা একটু দুষ্কর বৈকি! তাই কি বিনয় ‘মাংসল চিত্রের কাছে’ কবিতায় তাকে একটু সংহত করতে সচেষ্ট হন?
“কোনো যুগে কোনো আততায়ী / শত্রু ছিল বলে আজও কাঁটায় পরিবেষ্টিত হয়ে / গোলাপ যেমন থাকে তেমনি রয়েছো তুমি, আমি / পত্রের মতন ভুলে অন্য এক দুয়ারের কাছে”
এহেন অ্যান্টিপ্রেমের উৎসারেই, না কি অ্যান্টিপ্রেমে তিতিবিরক্ত হয়ে মল্লিকা সেনগুপ্তের কলম থেকে উদগীরণ ঘটে তীব্র প্রদাহী শ্লেষের:
“প্রেমের কথা লিখতে গেলেই / সামনে দাঁড়ান প্রেম চোপড়া
আমার দিদি দুঃখী মানুষ / বলেন, প্রেমের ভেতর ফোঁপরা
বলেন প্রেমের নামেই ওরা / কত মিথ্যে চালিয়ে গেলেন
সব ছেড়ে যেই আসেন রাধা / কৃষ্ণ রাজার মুকুট খোঁজেন”
(কবিতা: দিদির প্রেমিক, কাব্যগ্রন্থ: মেয়েদের অ আ ক খ)
প্রেম-অ্যান্টিপ্রেম ছাড়িয়ে কবি আমাদের পৌঁছে দেন এক তোলপাড় করে দেওয়া প্রশ্নের অলিন্দে — নারীকে যথেচ্ছভাবে পাওয়া হয়ে গেলে পুরুষের কি প্রয়োজন হয় নতুন এক অ্যাড্রেনালিন-বর্ধকের? কি সেই পেপ-পিল (pep pill )? ক্ষমতা? যা পুরুষকে যোগায় আনুষঙ্গিক সব উপকরণ — Big boys’ toys! এ আলোচনার পরিসর অবশ্য অন্য৷ ফিরে আসা যাক কাব্যে, প্রেমে এবং অ্যান্টিপ্রেমে। ফিরে যাওয়া যাক সেই প্রশ্নে — অ্যান্টিপ্রেমের কুয়াশার পর্দাটার কি সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে? সরলে কি সত্যিই মেলে সেই প্রথম দিনের স্বচ্ছতা?এই প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আমাদের খুঁজতে হবে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর?অ্যান্টিপ্রেমের এই দ্রোহের বয়স কত, কবিতায়?তার বেশিরভাগ প্রকাশটাই কি গত একশ বছরে?না হলে প্রেম আর বিরহের মাঝখানে কোন ছায়াচ্ছন্ন কুলুঙ্গিতে তার বাস? বৈষ্ণব পদাবলীর দিকে মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পাব পূর্বরাগ এবং অভিসার পর্বের মাঝখানে আছে অনুরাগ পর্ব। এই অনুরাগ পর্বটি তিন ভাগে বিভক্ত – রূপানুরাগ, আক্ষেপানুরাগ এবং অভিসারানুরাগ। একটি বহুল প্রচলিত আক্ষেপানুরাগের পদ দেখে নেওয়া যাক:
সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিলুঁ
আনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।।
(সখি হে) কি মোর করমে লেখি।
শীতল বলিয়া ও চান্দ সেবিলুঁ
ভানুর কিরণ দেখি।।
নিচল ছাড়িয়া উচলে উঠিতে
পড়িলুঁ অগাধ জলে।
লছিমী চাহিতে দারিদ্র বাঢ়ল
মাণিক হারালুঁ হেলে।।
পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিলুঁ
বজর পড়িয়া গেল।
জ্ঞানদাস* কহে কানুর পিরিতি
মরণ অধিক শেল।।
(*মতভেদে চণ্ডীদাস )
এই উচ্চারণে হতাশা আছে, দীর্ঘশ্বাস আছে, অভিযোগ আছে, আছে দ্রোহও। অপেক্ষার অস্থিরতা, অবসাদ এবং মৃত্যুর চকিত অনুষঙ্গও উপস্থিত। অর্থাৎ আক্ষেপানুরাগই যে অ্যান্টিপ্রেমের পূর্বসূরী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু তর্জনী উত্তোলন আর দোষারোপের তীব্রতা ও প্রকারভেদটুকুই বৃদ্ধি পেয়েছে সময়ের সঙ্গে, যাপনজনিত জটিলতার হাত ধরে। ডিভোর্স, সেপারেশন, সিঙ্গল পেরেন্টিং, ডেটিং অ্যাপস, লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড, লিভ-ইন, ক্রস জেনারেশনাল কাপলিং-এর মতো লাইফস্টাইল চেঞ্জসমূহ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অ্যাটিটিউড এই আক্ষেপানুরাগের হীরকখণ্ডে নতুন নতুন পৃষ্ঠদেশ যোগ করে তাকে দ্যুতি বিকিরণে প্রকৃতই মহার্ঘ করে তুলেছে। তাই এখন আর তাকে অ্যান্টিপ্রেম বলে না ডাকলে চলে না। এবার আসা যাক পরের প্রশ্নে — কুয়াশার পর্দাটা সরলে কি পাওয়া যাবে প্রথম দিনের স্বচ্ছতা? প্রতিপ্রশ্নে আসি – প্রথম দিনটি কি আদৌ স্বচ্ছ ছিল ? মায়াঞ্জনপরিহিত দৃষ্টি কি আদৌ স্বচ্ছ থাকে? সে তো সত্যকে বর্জন করে কাঙ্খিতটুকুই দেখতে চায়, দেখাতে চায়! অভিযোগের মাধ্যমে, অভিমানের মাধ্যমে, দোষারোপের মাধ্যমে, দ্রোহের মাধ্যমে একে অপরকে যে চিনে নেওয়া সেটাই তো সত্তার কাছে সত্তার উন্মীলন। একে অপরের দেবত্বকে নয়, মনুষ্যত্বকে গ্রহণ করে তাতে মুগ্ধ হওয়ার নামই কি প্রেম নয়? কুয়াশা কেটে গেলে সেটাই তো কাঙ্খিত স্বচ্ছতা যা অ্যান্টিপ্রেমের অনুপস্থিতিতে কোনোদিনই পাওয়া সম্ভব হতো না।
অন্তরাত্মার ঋদ্ধ উচ্চারণে তবে অনুরণিত হোক:
“এবার তবে খুলে দেওয়া, সব বাঁধনই আলগা ক’রে নেওয়া
যখন বলি, কেমন আছো?ভালো?
‘ভালো’ বলেই মুখ ফিরিয়ে নেবার মতন মরুভূমি
এবার তবে ছিন্ন করে যাওয়া।
বন্ধ ছিল সদর, তোমার চোখ ছিল যে পাথর
সেসব কথা আজ ভাবি না আর
যাওয়ার পরে যাওয়া কেবল যাওয়া এবং যাওয়ায়
আকাশ গন্ধরাজ।
শিরায় শিরায় অভিমানের ঝর্না ভেঙে নামে
দুই চোখই চায় গঙ্গাযমুনা
মন কি আজও লালন চায়? মনকে বলো ‘না’
মনকে বলো ‘না’, বলো ‘না’। “
( শঙ্খ ঘোষ — কবিতা: মনকে বলো না — কাব্যগ্রন্থ: বাবরের প্রার্থনা )
এরপর
আর তো অভিসারে কোনো বাধা থাকে না…