প ছ ন্দে র ব ই
ভাস্কর চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা
ভাস্কর চক্রবর্তী
“তথাকথিত ছন্দ ছাড়া আমার কবিতাকে আমি হাঁটতে শিখিয়েছিলাম |” ভূমিকার এই লাইনটুকুর ঘোর আমি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি | ছন্দ বিছিন্দতায় সদা ভাস্বর ভাস্কর চক্রবর্তী | তিনি ছন্দ ছাড়া হলেও ছন্ন ছাড়া নন | ‘ভাস্কর চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ – তার জীবন্ত উদাহরণ | তাঁর ‘উৎকন্ঠা’ আজকেও সমান সত্য ও সমান প্রাসঙ্গিক | তিনি লিখলেন –
“আমাদের ঘষটাতে ঘষটাতে মরতে হবে |
ঘরের অভাবে আর ভাতের অভাবে মরতে হবে |
আমাদের পরমাণু খেয়ে মরতে হবে |
সাত স্বর্গ ঘুরে ঘুরে বন্ধুর অভাবে
সাতটা নরক ঘুরে প্রেমের অভাবে
একা একা কথা বলবার অপরাধে
একা শুয়ে থাকবার অপরাধে
রাস্তাজুড়ে বিড়ালের মতো
আমাদের একদিন চেপ্টা হয়ে পড়ে থাকতে হবে |
কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাতেই শুনলাম নতুন স্বর- “সকলেই কবি আজ- শুধু কেউ কেউ নয় কবি |” মানুষকে সম্মান করার নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম | সত্য কথা বলতে কী আত্মশ্রদ্ধা জাগাল এই লাইন |
কী ছোটো কথায় ভালোবাসার অদ্ভূত সংজ্ঞা দিলেন তিনি | “ভালোবাসা শুধুই বোতাম খোলার শব্দ নয় |”
কবি ভাস্কর চক্রবর্তী শখের কবি নন | “আমার নিজের কাছে আমার একটাই দায় ছিল, জ্যান্ত আর নতুন কবিতা লেখার দায় |” কবি মানুষের প্রতিনিধি | কবি ভাস্কর চক্রবর্তী সেই দায়িত্বকে অস্বীকার করেননি | মানুষের জন্য, মানুষের হয়ে সমস্ত জীবন ধরে তাঁর কীসের যেনো অন্বেষণ – “একটা সরলরেখার খোঁজে আমি বেরিয়েছিলাম সকালবেলায় |” অথচ লালায়িত প্রেমিক মানুষ, যে লিখে রাখে : শম্পা আমার প্রেম, তাঁরই ( মানুষের) জন্য উপসংহারে লেখা হয় –
“আজ হেসে চলেছি আমি শব্দহীন এক হাসি
আজ নুয়ে পড়েছি আমি অশ্রুহীন এক কান্নায়”
কবিরা স্বার্থপর নন | “সর্বে ভবন্তু সুখিন” – এই মন্ত্রেই বিশ্বাসী কবি ভাস্কর চক্রবর্তী | তা না হলে তিনি কখনোই লিখতে পারতেন না –
“এবং যে খেতে পায় না সারাদিন, তুমি প্লেট-ভর্তি খাবার পাঠিয়ে দিয়ো তাকে |
এবং রাত্রিবেলা যার ঘুম হয় না
তুমি লিখে জানিয়ো তাকে ঘুমিয়ে পড়ার সহজ উপায়গুলো |
যার কোনো প্রেমিকা নেই, তুমি
অঢেল বন্ধু দিয়ো তাকে-
এবং যে অসুখী আমার মতো, তুমি তাকে চিরকালীন শান্তি দিয়ো ”
কবিরাই পারে মানুষের মেকি, ফাঁকির মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলতে –
“আমরা ভান করি যে আমরা অপরের জন্য জন্মেছি
আর অনুভূতিহীন এমন একটা স্রোতে গা ভাসাই
আর এমন সব কথা আমরা ছুঁড়ে দিই চারপাশে
চারপাশ কাঁটাতারে ভরে ওঠে
চারপাশ রক্তে ভেসে যায় …..”
তবুও কবিরা আশাবাদী | তাই কবি জীবনের কথা ভেবে লিখলেন –
“উদ্বন্ধন ভালো নয়
ভালো নয় , রেলে মাথা
অথবা ছ’তলা থেকে
লাফ –
এসো, ধরো টেলিফোন
এসো , ধরো টেলিফোন
হেসে বলো- দেখা হবে
রাস্তায় আবার |”
আশাবাদের জয় হোক, কবির জয় হোক, কবিতার জয় হোক, মানুষের জয় হোক | মানুষের জয়যাত্রার পথে কবির বাণী পাথেয় হোক – “আরো একটু চেষ্টা করি সুমঙ্গল, এসো বাঁচি, বেঁচে থাকা যাক |”