উ দা সী ন তাঁ ত ঘ র | পর্ব ৭
এই তো এক দশকেরও বেশ কিছু আগে একটি ছোটো পত্রিকার ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল ‘ অন্য ধারার বাংলা উপন্যাস।’ সেখানে প্রধানত উল্লেখ্য ছিলেন সত্তরের এক ঝাঁক লেখক। তাঁরা ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত। এমনকী পাঠকপ্রিয়। স্থানীয় গ্রন্থাগারেও তাঁদের বই পাওয়া যায়। অর্থাৎ শহর- মফস্সলে পাঠকের চাহিদা আছে। তবুও সম্পাদক তাদের ‘অন্যধারা’ বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন। কেন? তাহলে কি মূলধারার বাইরে এই অক্ষরযাপন? মেইনস্ট্রিম বলে কথা সাহিত্যের স্বতন্ত্র এক মান্যধারা আছে তা কি প্রতিষ্ঠান আর মিডিয়া গেঁথে দিয়েছে আমাদের মগজে? আমরা কি সহজেই মেনে নিয়েছি শীর্ষেন্দু- সুনীল- সমরেশ মেইনস্ট্রিম আর কিন্নর- অমর-সৈকত-রামকুমার বিকল্প বা অন্যধারা? সত্যজিৎ- ঋত্বিক প্যারালাল আর অঞ্জন চৌধুরী- স্বপন সাহা মেইনস্ট্রিম? এতদিন পর এসব প্রশ্নে মিথ্যে এক গোলোকধাঁধা সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। পাঠকের অধিকার সংকুচিত করে এই বিভাজনের রাজনীতি কয়েক দশক ধরে চলছে। রুচির প্রশ্নটি অতিনিরূপিত। রুচির সমগ্রতা কেবলই সন্দেহপ্রবণ এক নিরপেক্ষতা।
পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে এই সংকট ছিল পাঠকের দিক থেকে কিন্তু বিভাজনের জল অচল স্পষ্ট করে দেননি কোনো সম্পাদক বা প্রকাশক। তাই জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা রতন ভট্টাচার্যের মতো সৎ লেখকের লেখায় পুষ্ট হত বিগ হাউস। বনফুল বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস , বুদ্ধদেব গুহ বা মতি নন্দীর ছোটগল্প পাশাপাশিই ছিল। এর পাশাপাশি বিপুল পাঠক ছিল শক্তিপদ রাজগুরু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, প্রফুল্ল রায়ের। বরেন গঙ্গোপাধ্যায়,দেবেশ রায়ের পাঠক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ পড়েছেন স্বচ্ছন্দে। অমিয়ভূষণ বা কমলকুমার দুই মজুমদারের পাঠক তাঁদের ভালোবেসেছেন ভিন্নপথকে গুরুত্ব না দিয়েই। বাংলাদেশ সীমান্তের এক গ্রাম্য পাঠাগারে এই তো সেদিন একজন গবেষক খুঁজে পেলেন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস । তখনও তাঁর উপন্যাসসমগ্র ছিল দুরাশা মাত্র। আবার মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামীণ লাইব্রেরীতে দশ বছর আগে কবিতা সিংহর অনেক দুর্লভ উপন্যাসের দেখা মিলল যার হদিশ দিতে পারেনি অনেক জেলা গ্রন্থাগার। সর্বত্র পাঠকই শেষ কথা।
সত্তরের সূচনায় দৃশ্যটি আমূল বদলে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যর চেহারা নগ্ন হয়ে গেল অনেকখানি। সমরেশ বসু কে কিনে নিলেন আনন্দ বাজার। তাদের হাউসের বাইরে অন্যত্র লেখা নিষিদ্ধ হল। সুনীল- শীর্ষেন্দু-সমরেশ আরও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত মেনে নিলেন। যেকোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চিহ্নিত হল ‘ অন্য ধারা’ বলে। বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সুবিমল মিশ্রর সৎ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক চেহারায় সেইদিন পাঠক ছিলেন অপ্রস্তুত। রমানাথ রায়- বলরাম বসাক- শেখর বসুর ছোটগল্পের আরেকরকম চেহারা দেখলেন পাঠক। সেদিনের সব পুরস্কার জিতে নিচ্ছেন মিডিয়াধন্য লেখকেরা। তাঁরাই কমিটি, তাঁরাই পুরস্কার। তাঁরাই শেষকথা। তাঁরাই চুল্লির কিছুটা আগে অভিশপ্ত শেষ কিংবদন্তি। শুধু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়,বিমল মিত্র, নারায়ণ সান্যালের জনপ্রিয়তায় তাঁরা শোচনীয় পরাজিত। পাঠকের ‘ দুপুরের ঘুম’ কে অভিশাপ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
কথা সাহিত্যের যখন এই অবস্থা তখন কবিতা র ক্ষেত্রটি কেমন? জীবনানন্দকে মেইনস্ট্রিম না বলে আমাদের উপায় ছিল না। বিষ্ণু দে থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে আমরা প্রধান কবির মর্যাদা দিয়েছি। পঞ্চাশের কবিরা মিডিয়ার দৌলতে ধুম মাচিয়েছে কয়েক দশক। বলতে চেয়েছে জীবনানন্দ পরবর্তী আমরাই প্রধান কবি। শক্তি- সুনীল – শঙ্খ ছিলেন প্রধান উপাস্য। তরুণ কবিদের কাছ থেকে আদায় করেছেন বিগ্রহের যাবতীয় উপাচার। এই আবহাওয়ায় বানিজ্য বিস্তার সুবোধ সরকার বা জয় গোস্বামীর। কিংবদন্তির ছায়া গিলে নিচ্ছে শহর- মফস্সল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর মুখ থুবড়ে পড়ল যাবতীয় কিংবদন্তি। গত কুড়ি বছরে পাঠকের তালিকায় প্রধান কবি হিসেবে উঠে এসেছেন উৎপলকুমার বসু, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়,প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মনীন্দ্র গুপ্ত,দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কবি। অনেক কিংবদন্তি কবির যজমানি বন্ধ। বাংলা কবিতার পাঠককে ধন্যবাদ শত প্রলোভন সত্ত্বেও তারা কবিতায় মেইনস্ট্রিম বা অন্যধারার কবিতার বিভাজনে আস্থা রাখেন নি। আবহমানকালের বাংলা কবিতায় আস্থা রেখেছেন।
বাংলা কথাসাহিত্যের সমস্যা অবশ্য অন্য এবং অন্যত্র। কথাসাহিত্য কে আজও লড়তে হয় গল্পপিপাসু পাঠকের বিরুদ্ধে। আজও ‘ একটু পাহাড়,একটু প্রেম, একটু ভ্রমণ আছে’ এমন দাবি মেনে উপন্যাসের নাম সাজেস্ট করতে হয় বিভিন্ন গ্রুপে। আশুতোষের পাঠকের জ্যোতিরিন্দ্র পড়ার হৃদয় ছিল একদিন। আজকের পাঠকের সেটুকুও অবশিষ্ট নেই। তবুও ভাঙছে প্রবণতা। কিন্নর থেকে রবিশঙ্কর বল বা মানিক চক্রবর্তী থেকে কনিষ্ক ভট্টাচার্য-শাক্যজিৎ- অনির্বাণ বসু কে আজ আর অন্যধারা বলে ভাবতে রাজি নই আমরা। আবহমানকলের সাহিত্যে কোনো প্রধান ধারা নেই ।পাঠক প্রস্তুত। অপ্রস্তুত মিডিয়ার জন্য আমাদের সান্ত্বনা পুরস্কারও নেই।
* ক্রমশ