Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ ই ন্ডো  সি ট

পা র্থ জি ৎ   চ ন্দ

partha

আনন্দবাবুর মেয়েরা…

বিকেলের দিকে সাভানা-হাইপোথিসিসের ছায়া গাঢ় হতে শুরু করে। এই যে বিষণ্ণ আর আনন্দিত মানুষ… মফসসলের পেটের ভেতর ক্রমশ ঢুকে পড়া মানুষ… সব যেন ব্যক্তিগত সাভানার দিকে ঝুঁকে রয়েছে বহু দিন। মাথার ভেতর তড়িৎ-ইঁদুর ঢুকে কুটিকুটি করে কেটে দিয়ে গেছে একটা-দুটো ফ্রেম, ফলে নষ্ট হয়ে গেছে ক্যানভাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্মৃতির ভেতর নির্মিত হচ্ছে সে সব অংশ; রং ধুয়ে যাবার নিজস্ব যন্ত্রণা আছে। মাথা খসে পড়ছে সে যন্ত্রণায়। 

জীবনে কাছ থেকে উঁচু গথিক গির্জা দেখিনি, অথচ আমি দিব্যি নিজে হাতে তার ভারি দরজার পাল্লা খুলে ফেলতে পারি। বেলফ্রে-টাওয়ার পর্যন্ত উঠে গেছে অন্ধকার ও পায়রার ডানার শব্দ। আমার মফসসলের অদৃশ্য গির্জার মাথায় উঠে আমি দেখি দিনান্তে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। দিনান্তে বাড়ি ফিরে আসছে মানুষের দল; ভীষণ রোম্যান্টিক সে ফেরা। যেন কালেকটিভ আনকনশাসনেসের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে সবাই চলেছে ব্যক্তিগত-আফ্রিকার সন্ধানে। সভ্যতার সে প্রথম দোলনা… সাভানা।

কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা, আপনারা কোথায়? আড়াই দশকের ব্যবধানে আপনারা কোথায় হারিয়ে গেলেন আনন্দবাবুর মেয়েরা?

আপনাদের বাবা স্কুলে পড়াতেন, ধুতি পরতেন; বুক-পকেটের কাছে খুব সরু হয়ে ঝরে থাকতে এন সি নস্য। আপনারা পড়াশোনাতে খারাপ ছিলেন না; গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। দরকার হলে এম এ করতেন অথবা করতেন না। আপনারা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন এ মফসসলের জানালা; যে জানালা খুলে দিলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। 

আপনারা যে একটু আলাদা ছিলেন সে নিয়ে মফসসলের মাথাব্যথা কম ছিল না; অথচ আপনাদের ছিল হালকা রঙের মোটা পাড় শাড়ি। পায়ে হাওয়াই চপ্পল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। সময়টা ছিল সেই সময় যখন মফসসলের কলেজে দামি পোশাক পরে যাওয়াকে অশ্লীলতা বলেই গণ্য করতে মানুষজন। আপনারা ছিলেন তার থেকেও সাধারণ; সাধারণের থেকেও সাধারণ। খুব সাধারণ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন আপনারা মনেপ্রাণে।

আপনারা গ্রীষ্মের দুপুরে ছাতা-ছাড়া টংটং করে সাইকেল চালিয়ে স্টেশনরোড ধরে বাড়ির দিকে ফিরতেন। সাইকেল থামিয়ে এক টাকার আইসক্রিম খেতেন চুষে চুষে। আইসক্রিমওয়ালা বরফের মাথায় এক চিমটে বিট-লবন দিয়ে দিত। বরফ গলত দ্রুত; আপনাদের রোদে পোড়া গালে হাতে এসে পড়ত নীলঅঞ্জনঘনপুঞ্জছায়ার একটি দু’টি ক্ষণ। 

খুব সাধারণ, খুব সাধারণ হতে চেয়েছিলেন আপনারা; শুধু একটি বিষয়ে আপনারা ছিলেন অসাধারণ। 

আপনাদের অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া তিনটি ঘরের একটিতে ছিল হাপরটানা হারমোনিয়াম; পাশের পাড়ার একটি ছেলের বাড়িতে ছিল তবলা। আপনাদের হারমোনিয়াম আর ওই তবলার দেখা হয়েছিল; সেদিন বুঝিনি, আজ বুঝি ওই দেখা হওয়াটি ছিল একটি পবিত্র ঘটনা। 

বিকেলের দিকে গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া ছুটে এসে ঢুকে পড়তে কলোনির দিকে; হলুদ-ল্যাম্পের আলোয় আপনাদের রিহার্সাল শুরু হত। আপনাদের বাবা ছিলেন অবধারিতভাবে ওপার বাংলার মানুষ। কলোনির মানুষের মুখে মুখে আপনাদের গানের নাম রটে গিয়েছিল, ‘কমরেড-গান’। 

প্রায়-অন্ধকার ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াত তীব্র প্রাণখোলা সুর, ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না…।’

বেঞ্জামিন, প্রিয় বেঞ্জামিন মোলায়েজ… তখনও জানি না তোমাকে কেন ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল… শুধু জানতাম, তুমি শাসকের ফাঁসিতে চড়েছো মানে তুমি ভাল-মানুষ। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম মোলায়েজ; বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম আমাদের গান আমাদেরই গাইতে হবে। সে গান বন্ধ করবার জন্য হায়না ঝাঁপিয়ে পড়বে… কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা… আপনারা আমাকে শিখিয়ে ছিলেন গান বন্ধ করলে চলবে না… গেয়ে যেতে হবে, গেয়ে যেতে হবে। ঠিক যেভাবে হাস্কি-গলা নিয়ে, নিচের দিকে সুর ঠিক লাগে না; তবুও আমরা গেয়ে চলেছি শীতগ্রীষ্মবর্ষা। 

‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন’ গানটির সঙ্গে অ্যাডেসিভের মতো সেঁটে রয়েছে কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। দিনের পর দিন শুনেছি ওই গান; তবু একদিন গানটির ভেতর ঢুকে পড়েছিল কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ। আজও গানটির থেকে সে গন্ধকে আমি পৃথক করতে পারিনি। 

আপনাদের গণনাট্য-শাখার নাম কী ছিল? ‘সংগ্রামী উদ্বাস্তু কলোনি’ শাখা? স্মৃতি প্রতারক, আপনাদের কথা মনে আছে অথচ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে বসেছি সে শাখার নাম। দলের যে ছেলেটা ম্যারাকাস বাজাতো তাকেও স্পষ্ট মনে আছে। ফিকে হয়ে যাওয়া নীলচে জামার ভেতর ধুকপুক করছে ছোট্ট একটা শরীর; কিছু না-করাই তার মন্ত্র। সে যে কিছু হবে না এবং ম্যারাকাস বাজিয়ে বাজিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে, এরকম এক অসম্ভব স্বপ্ন দেখা তখন রীতিমতো বাস্তব ছিল। 

আনন্দবাবুর মেয়েরা, আমি কতদিন চেয়েছি আপনাদের গানের পাশে বেড়ালের মতো চুপটি করে বসে ওই ম্যারাকাস বাজানোর থেকেও সহজ কোনও একটা কাজ খুঁজে নিতে। 

স্ট্রিট-কর্নার শুরুই হত আনন্দবাবুর মেয়েদের গান দিয়ে, ‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি/ এখানে থেমো না…।’ বালুচরে আশার তরণী কেউ বাঁধে না, কিন্তু সংশয়ী মানুষ ছিলেন এক; সেরিব্রাল কিছুটা। ঠোঁটের কোণে বিড়ি ঝুলে থাকত; এক কোণে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ‘আমি শ্রান্ত যে, তবু হাল ধর/ আমি রিক্ত যে, সেই সান্তনা’ সলিলবাবু বলছেন বটে, তবে কমরেড, আমি কিছুতেই ওই শ্রান্ত আর রিক্ত শব্দদুটিকে গ্রহণ করতে পারি না… একজন কমরেড কেন শ্রান্ত আর রিক্ত হবেন! দিনের পর দিন এ ধাঁধার মধ্যে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের; অনেক পরে যুৎসই উত্তর পেয়েছি, কারণ সলিলবাবু তো লিখেছিলেন, ‘এ যে কুয়াশা, এ যে ছলনা/ এই বঞ্চনাকে পার হলেই পাবে / জন সমুদ্রের ঠিকানা…।’ 

শীর্ণ গঙ্গা হয়ে উঠত সমুদ্র, সূর্য পিঠে নিয়ে শুশুক ঘাই মারত। ক্ষয়াটে বুকের ভেতর থেকে কে যেন ডাক দিয়ে যেত, ‘নো পাসারান… নো পাসারান…।’ গানটির শেষ দিকে এসে দ্রুত লয় বদলে যেত, আনন্দবাবুর মেয়েরা বুক ভরে শ্বাস নিতেন। তাদের ঘামে ভেজা ব্লাউজ ফুলে উঠত, ‘আহ্বান, শোন আহ্বান…।’ 

ঘোড়ার দল ছুটে যাচ্ছে… দলে দলে ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। দিগন্ত পেরিয়ে। সে প্রথম মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রবেশ করেছিল একটা বোধ, সমস্ত জয়ের প্রথমে ও শেষে ফুটে থাকে গান। 

কিন্তু আনন্দবাবুর মেয়েরা সব কি প্রবল ‘রাজনৈতিক’ ছিলেন? ছিলেন না হয়তো, মিটিং শুরু হলে তারা সরে যেতেন এক কোণে। গ্যাট-চুক্তির বিরোধীতা আর কেন্দ্ররাজ্য বঞ্চনার মধ্যে তারা ছিলেন দারুচিনি দ্বীপের মতো। 

ক্ষমতা দখল করতে চায়নি তারা, তারা শুধু খুব সাধারণ হতে চেয়েছিল, এক অস্পষ্ট মুক্তির স্বপ্ন দেখে যেত তারা। তাত্ত্বিক দিক থেকে এ অস্পষ্ট স্বপ্নের তেমন কোনও গুরুত্ব নেই হয়তো; কিন্তু স্বপ্ন তো তত্ত্বকে অতিক্রম করে উড়ে যেতে পারে মাইলের পর মাইল। 

আনন্দবাবুর মেয়েরা অ্যাপলিটিক্যাল হবার মতো নিরাপদ দূরত্ব বাস করতেন না, আবার প্রবলভাবে পলিটিক্যাল হয়ে ওঠাও সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। 

নিশ্চয় বহু ‘আনন্দবাবু’র মেয়েরা এ দু’টির কোনও একটি হয়ে উঠেছিলেন; কিন্তু আমার দেখা আনন্দবাবুর মেয়েরা এমনই। 

তাদের নিয়ে মফসসলে মৃদু রটনা ছিল; তবলা-বাজানো ছেলেটার সাইকেল-ক্যারিয়ারে বসে তাদের ফ্যাটফেটে জ্যোৎস্নারাত্রে দেখা যেত মাঝে মাঝে। ‘অসুন্দর’ কিন্নরী… অসুন্দর বলেই এতদিন পর তারা মাঠঘাট পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে আসছে। 

বহুদিন পর জোয়ান বায়েজের কণ্ঠে ‘উই শ্যাল ওভারকাম…’ শুনেছিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, পঁচিশ বছর আগের সেই আনন্দবাবুর মেয়েরা, আমার মফসসলের সে সব ‘আপাত রুক্ষ’ জোয়ান বায়েজ কোথায় হারিয়ে গেলে্ন আপনারা? কোথায়… কোথায়?

হাই-মাস্টের নীচে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘রাজনৈতিক’ দলগুলি কি আপনাদের খুঁজছে? না কি খুঁজে খুঁজেও পাচ্ছে না আপনাদের? 

আপনারা যেখানেই থাকুন দ্রুত ফিরে আসুন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী। ঈষৎ হাস্কি… খাদের দিকে সুর ঠিকঠাক লাগে না… ওই কোরাস ছাড়া কে মানুষকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে মাইলের পর মাইল? কে তাদের শেখাবে সেই মন্ত্র- ‘নো পাসারান… নো পাসারান…।’

আরও পড়ুন...