গ ল্প
১
হলুদ চটা ছেড়ে যাওয়া দেওয়ালে একমাত্র সজীব নিশান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাল্লা দু’টি। টুকটুকে সবুজ রঙের। সে পাল্লায় জঙধরা কড়াগুলি বেমানান যেন। ঘন সবুজ জঙ্গলের বন্ধুত্বে এ পাল্লার অবস্থিতি হলে ছ্যাতলাপড়া গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মানানসই হত এ আবহটি। দরজা থেকে নজর একটু উপরের দিকে দিলে দেখা যাবে ঘোলাটে রঙের একটি সাইনবোর্ড। অনেক বছরের পুরনো তা সহজেই বোঝা যায়। আসল রঙটি ছিল দুধসাদা। দীর্ঘ দিনের অযত্ন, রোদ জল ঝড়ের সখ্য সে ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তার উপরে ঝকমকে লাল রঙে লেখা কয়েকটি শব্দ–
‘সৌভাগ্য’
জ্যোতিষ আচার্যা ইন্দ্রাণী
সমস্ত রকম দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে
বদলের ইঙ্গিত দেওয়া হয় এখানে।
পথচলতি দুর্ভাগা মানুষ এখানে পা না রাখতেই পারে। কারণ মনে মনে সে হয়তো ভাববে যার নিজের বিজ্ঞাপনটিই ম্যাড়মেড়ে ধুলোমলিন, সে আর আমার দুর্ভাগ্যের গতিপথ কোন বিদ্যাতেই বা বদলাবে! কিন্তু যারা হাতেনাতে ফল পেয়েছে, ঘটে গেছে কোনো মির্যাকল, তাদের সূত্র ধরে গুটি গুটি কিছু পা প্রায়শই এসে দাঁড়ায় সৌভাগ্যে’র দরজায়।
কার চাকরি হচ্ছে না, কার জমিজমা সংক্রান্ত আইনি গোলযোগ, মামলা-মোকদ্দমার হালহদিশ সব সমাধান রাশি -দিনক্ষণ- জন্মকুণ্ডলী মিলিয়ে করে দেন জ্যোতিষ আচার্যা। এবং সে সমাধান অব্যর্থ। সৌভাগ্যে’র দরজা দিয়ে ভিতরে পা গলালে কেমন যেন বিশ্বাস ভর করে আসে। মনে হয় ভাগ্যের বন্ধ দরজা খুলবেই।
ছোট্ট ঘরের চারকোণে চারটি উজ্জ্বল সাদা আলো। তবে আলোগুলি বৃত্তাকার ব্যাসার্ধে ছড়ায় না বেশি। ফলত আলো আবছায়ার চালচিত্র রচিত হয় সুনিপুণভাবে। অনেকটা সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের জলছবি যেন, পাশাপাশি আলো আর ছায়া। জ্যোতিষ আচার্যার আসনের উল্টোদিকে যে সবুজ টুকটুকে দরজার পাশে ভিতরের দিকের দেওয়াল সেখানে কালচক্রাকারে জল, পৃথিবী, বাতাস, আগুন ঘুরছে। যে পঞ্চভূতের সমন্বয়ে আমাদের দেহ গঠিত সে পঞ্চভূতের উপাদান মানুষের চরিত্র আর মনেও প্রভাব ফেলে। যেন এক একটি মানব চরিত্র এক একটি দিক। মূল চার দিক নির্দেশের চিহ্নগুলি পৃথিবী থেকে অন্তরীক্ষে ঘুরে ঘুরে ফেরে। একদিকে ক্ষিতি, আরেকদিকে অগ্নি, একপাশে অপ এবং অন্যদিকে মরুৎ। এসব চিহ্ন মিলিয়ে বারোটি রাশির জাতক জাতিকাদের মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটাই মিলে যায়।
যারা জ্যোতিষের এসব হিসেব নিকেশে মুখ বাঁকিয়ে হাসে বা বুজরুকি মনে করে উল্টে তাদের দিকেই তাকিয়ে হাসেন আচার্যা ইন্দ্রাণী। নাতনির হাতের রেখা দেখেই নিতাই মজুমদারকে ইন্দ্রাণী বলেছিলেন, মেয়ে বেশ একগুঁয়ে আর স্বাধীনচেতা। ধনু রাশির জাতিকা তো! খুব সামলে সুমলে রাখবেন! তখন তাঁর কথা নিয়ে সে কী হাসাহাসি! অথচ আজ! আজ চারিদিকে শুধু বুনবুনি আর নান্টুর বিয়ের চর্চা। ইন্দ্রাণী জানে আগুনে মেয়েগুলো একটু এরকম হয়!
আর্থ, ফায়ার, এয়ার, ওয়াটার- এই চার চিহ্ন অনুযায়ী আচার্যার গণনায় মানুষের স্বভাব বৈশিষ্ট্য কিছুতেই অমিল হয়নি আজ অবধি। শুধু একবারই নীরব থেকেছিলেন তিনি। হালদার বাড়ির মেয়েটার যখন ডিভোর্স হয়ে গেল। মেয়ের বাবা এসে বলেছিল– ‘আপনার সব বুজরুকি! এত বিচার করে জন্মছক, কুণ্ডলী, রাশি, গণ, লগ্ন মিলিয়ে বিয়ে দিলাম! আপনি বললেন, না কি বৃশ্চিক আর মীনের রাজযোটক। দু’জনেই জল রাশির বৈশিষ্ট্যের। সরল তরল মন। কোনো জেদ ধরে বসে থাকে না। মানিয়ে গুছিয়ে নেয়…’
ইন্দ্রাণী শুধু বলতে গিয়ে ঠোঁট দুটো নেড়েছিলেন যে, দুজনেই জল রাশি হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়… কিন্তু তাঁর সে বাক্য জিভের মধ্যে শুকিয়ে পেটের পথে সেঁধিয়েছিল।
‘ছাড়ুন তো! আপনার রাশি আর তার ঠিকুজি কুষ্ঠী! জামাইয়ের কী খুনে রাগ! জলরাশি না ছাই! মেয়েটাকে সময় মতো ডিভোর্স না করালে এতোদিনে খুন করেই দিতো বোধহয়! আর কোনো মেয়ের এভাবে সর্বনাশ করবেন না! এসব ধান্দাবাজির ব্যবসা বন্ধ করে শাড়ি গয়নার দোকান দিন…’। বলতে বলতে গজগজিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগান মেয়ের বাপ।
আচার্যার সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, নিজের অক্ষমতায় নয়। মানুষের অবিশ্বাস দেখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রহ নক্ষত্রও স্থান পরিবর্তন করে, সে কথা মানুষ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বোঝেও না, বুঝতে চায়ও না। তখন আরো গভীর বিচার, গৃহশান্তি, গ্রহরত্ন ধারণ করার দরকার পড়ে। আজকাল আচার্যা ফলত বিয়ে বা প্রেমের ভবিষ্যদ্বাণী করেন না তেমন। কেউ জোরাজুরি করলে যদিও উপায় বাতলে দেন, তার সঙ্গে পরামর্শও থাকে সব কিছু বুঝে শুনে চলার।
তবে ইদানীং তিনি আরো গভীর খোঁজে মত্ত। মেয়েটি প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি, যেখানেই গিয়ে দাঁড়ায় মাতিয়ে দেয় সবাইকে। ভাব-ভঙ্গি, ইশারা-ইঙ্গিতে জমিয়ে দেয় সবাইকে। ঠিকুজি-কুষ্ঠী, জন্মলগ্ন সবই ভালো, শুধু আগুনে ফাঁড়া আছে। ওইটাই ভাবিয়ে রেখেছে আচার্যাকে। আজকাল কেস তেমন আসে না। এলেও বাইরের ঘরে অ্যাসিস্ট্যান্টের হাতে ছেড়ে দেন। চার মহাকালচক্রের পাশেই দরজা ফুঁড়ে একটি ছোট্ট বিশ্রামঘর বানিয়েছেন তিনি। সেই সকালে চাট্টি নাকে মুখে গুঁজে চলে এসে সন্ধে অবধি থাকা। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট জানে দুপুরের দিকে ঘন্টা দুয়েক আচার্যা গড়িয়ে নেন।
আসলে ওই সময়টাই প্রশস্ত খোঁজার জন্য। মেয়েটি যে বড় ভালো। রাশি, লগ্ন, গণ, দোষ, নিপুণভাবে মেলালে কি আর ভালো স্বভাব চরিত্রের ছেলে মিলবে না! এক দুটো ক্ষেত্রে না হয় ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে সফল হতেই হবে। ভাবতে ভাবতে চোখ মুখ দৃঢ় হয়ে ওঠে নিজের অজান্তেই। সামনে কোনো যুবক চাকরি বা পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এসে দাঁড়ালে কুষ্ঠী বিচার করে যদি দেখেন, যে জলরাশির মানুষ। চোখের পাতা নরম হয়ে আসে ইন্দ্রাণীর। মনে হয় এরকম নরম, ধৈর্যশীল, শান্ত মানুষ ঠিক বুঝবে প্রাণচঞ্চলতাকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই খটকা আসে। যদি না বোঝে! কখনও ভুল করে আর ভুল স্বীকার না করে! জলরাশির মানুষদের যে এটাই সবচেয়ে বড় দোষ।
আজকাল রাস্তা ঘাটে, বাসে ট্রেনে মানুষের মুখ চোখ দেখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোথায় কোন স্বভাব বা চরিত্র বৈশিষ্ট্য থেকে হাসিখুশি মেয়েটার জোড় খুঁজে পাওয়া যায় কে বলতে পারে! ধীর, স্থির, ধৈর্যশীল, ছটপটে, বিরক্ত, হাস্যমুখ, অশান্ত কতো রকম মানুষ আশেপাশে। হাস্যমুখ, ধৈর্যশীল, শান্ত মেজাজের মানুষ আচার্যার তালিকায় প্রাধান্য পায়। কিন্তু ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে ট্রেন ক্যানসেল শুনে হতাশ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়েন আচার্যা! মাথা নাড়েন, নাঃ! হবে না! এরকম মানুষ বাতাসের মতো ফুরফুরে মেয়েটাকে কী করে সামলে রাখবে! ছটফটে বিরক্তি ভরা মানুষেরা আগুনে রাশির না হয়ে যায় না। মেয়েটার যে আবার আগুনে ফাঁড়া আছে!
২
বৃত্তাকার জটলাকে ঘিরে আরো বৃত্তাকারে হাসিগুলি ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশে বাতাসে। মিশে যাচ্ছিল রেণু রেণু হয়ে ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, উপধ্বনি। জটলাটি পাড়ার মহিলা মহলের। মফস্বল এলাকা বা গাঁ-গঞ্জে এখনও দেখা যায় এরকম বৈকালিক আড্ডা। এসব আড্ডায় কারো বাড়ির হাঁড়ির খবর থেকে পঞ্চব্যঞ্জনের স্বাদ যেমন থাকে, তেমনই এসব আড্ডায় ঘরোয়া সুখ দুঃখের পাঁচালিও পড়া যায়। শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে শোনে। আহা উহুও করে, আবার নিজের নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে মনে মনে বলে – “মিত্তির গিন্নীর টাকার খুব গরম; সুখের মুখ দেখছে এখন।” তেমনি মিত্তির গিন্নি চায়ের কাপ হাতে কত্তাকে বলে, “ঘোষেদের নতুন বউটা বড় ছিঁচকাদুনে। কথায় কথায় আমার কিছু নেই, আমার কিছু নেই বলে নাকি কান্না।”
তবে এসব জটলা প্রায়শই গড়িয়ে পড়ে বিয়ের বা প্রেমের আলোচনায়। কোন পাড়ার ছেলে এ পাড়ার কোন উঠতি মেয়ের সঙ্গে চুলবুলানি করছে, নয়তো কার মেয়ের বিয়ের ঠিক হল কী না! কে না জানে প্রেম আর বিয়ের রসের গাঢ়ত্বই আলাদা। সে গাঢ় রসে যদি মিঠিয়া উড়ে এসে বসে তো আরোই রস উপচে পড়ে। এই যেমন সেদিন ক্ষ্যাপা উদয়চাঁদের পুচকে মেয়ে বুনবুনি যে গোপনে ভচ্চাজদের নান্টুর সঙ্গে বিয়ে সেরে ফেলেছে, সে খবর মিঠিয়া না দিলে এদের জানাই হতো না। জটলার হল্লাগুল্লার পাশ দিয়ে মিঠিয়া দ্রুত বেগে চলেই যাচ্ছিল। ওদিকে জটলা তো হেসে হেসে ফুলে ফেঁপে উঠেছে বর্ষাকালীন বাঁধভাঙা নদীর মতো। স্বাভাবিকভাবেই নদীর স্রোত মিঠিয়াকে ঘিরে ধরল, “কি রে মিঠিয়া, এত তাড়াতাড়ি চললি কোথায়…”
“ইককুল পাড়া… ইককুল পাড়ায়…”। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রৌঢ় মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে, “এতো বয়েস হলো! ধিঙ্গিপনা আর কবে যাবে তোর!”
“ইঁইই… বুনি বুনি… উলুলুঁ… উলুলুঁ…… ও পাড়ার নান্টুর বউ বুনি… যাবঁ যাবঁ…”
মিঠিয়া বলে কী! ঐটুকু পুঁচকে মেয়ে বুনবুনির পেটে পেটে এতো বিয়ে করার শখ ছিল! আর মিঠিয়াও তেমনি! সারা দুনিয়ার সবার বিয়ের খবর না রাখলে যেন তার চলে না। জটলায় রঙ্গ রস চলতে থাকে। সঙ্গে চলে চটুল আলোচনা। হঠাৎ মুখুজ্যে গিন্নির বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিঠিয়া বলে ওঠে, “রিনা … রিনা… বড় হবে। ইককুল পড়বে…… তারপর রিনার উলুলুঁ হবে…”
এতক্ষণ মুখুজ্যে গিন্নি বেশ রসিয়ে রসিয়ে শুনছিলেন। হাসছিলেন একগাল ভরে। কিন্তু এইবার হাসিটি গেল বন্ধ হয়ে। বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “আমার এত ছোট মেয়ে। ওর এখন থেকে বিয়ে বিয়ে আবার কী রে মিঠিয়া…”
মিঠিয়া হি হি করে হাসতে হাসতে সরে যায় জটলা থেকে। মিত্তির গিন্নি মুখুজ্যে গিন্নির মুখ পড়ে নেন মুহুর্তে। কলকলিয়ে বলে ওঠেন, “খোনা গলায় পাগলামি করলে কি হবে! মিঠিয়ার পেটে পেটে অনেক বদবুদ্ধি আছে!”
প্রৌঢ় মহিলাটি মুখ বেঁকিয়ে বলেন, “হবে না! কোন মা বাপের মেয়ে দেখতে হবে…! সারাদিন ঘরে মা-বাপের টিকি থাকে!” যে যার বিরক্ত মুখে ঘরে ফিরে যায়। অন্যের ছেলে মেয়ের বিয়ে, প্রেম, স্বভাব চরিত্র নিয়ে আলোচনায় যতো রসের মাছি ভনভন করুক না কেন, নিজের নিজের ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে সে রস গেঁজে ওঠে প্রায়শ। সুতরাং বিরস বদনে যে যার বাড়ির পথ ধরে অগত্যা। আসর ভেঙে যায় সেদিনের মতো।
৩
মেয়েটার নাম মিঠিয়া। তবে গলার আওয়াজটি নামের সঙ্গে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য সম্পর্ক বেঁধে রেখেছে। বহু দূর থেকেও এলাকার যে কোনো মানুষ নিশ্চিত হয়ে বলে দেবে এ আওয়াজ মিঠিয়ার। এমন খোনা খোনা ফাটা কাঁসরসম গলার আওয়াজ এ অঞ্চলে একমাত্র মিঠিয়ারই। কেন তার গলার আওয়াজ এমন খোনা বা কাঁসরফাটা হলো সে নিয়ে এলাকায় গুঞ্জন ওড়ে বিস্তর। কেউ কেউ বলে জন্মদোষ কেউ বা বলে অন্য কিছু হবে! আসলে কোনো না কোনো সূত্রে মিঠিয়াও ঐ বৃত্তাকার জটলার অংশভাগিনী। আত্মীয়গুষ্টির মধ্যে কবেই বা তেমন নিন্দেহীন ভালোবাসা জায়গা পায়!
গলার আওয়াজ যতোই উত্তাল হয়ে কানে গিয়ে ধাক্কা দিক না কেন, কেউ যদি মিঠিয়ার চলে যাওয়ার পথরেখায় দৃষ্টি পাতে তো দেখবে, এক সহজ সরল ছন্দের দোলাচল। ঋজু তার ভঙ্গী। কোঁকড়ানো কালো একরাশ চুলের ঢেউ সহজ সরল ছন্দের তালে আনমনে খেলে ফিরছে। পরিছন্ন পরিপাটি পোশাক পরিচ্ছদ। কিন্তু মিঠিয়ার চলে যাওয়াটি ঘুর পথে এঁকেবেঁকে আপনার কাছে যখনই ফিরে আসবে, ঠিক তখনই আপনার আন্দোলিত মন চেতনার কাছে সজোরে এক থাপ্পড় খাবে। আপনি অবাক বিস্ময়ে দেখবেন, যার গমন পথের দৃশ্য দেখে মন বলে ওঠে আহা! সেরকম কিছু ইত্যাকার ভাবনার মিথ্যে হয়ে যাওয়া। দেবীস্বরূপ সে সামনে এসে দাঁড়ালে আপনি চমকে উঠবেন। এত জীর্ণ চামড়ার আবরণে কোনো যুবতী কি মুখ ঢেকে থাকে! কোনো এক অতি প্রাচীন পোড়া মাটির মন্দির বহু কালের ক্ষয়ে যে এবড়োখেবড়ো শ্রীহীন রূপ ধারণ করে তেমনই অনুজ্জ্বল ম্যাড়মেড়ে চামড়ায় সজীব ও উজ্জ্বল একজোড়া কৌতুকী চোখ আপনার দিকে চেয়ে থাকবে।
মিঠিয়ার চোখ দুটো দেখলেই বোঝা যায় জীবনের প্রতি অনিঃশেষ কৌতুক তার। জেদ করেই একসময় স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। পড়াশোনা, জ্ঞান এসব কিছু তাকে আকুল করে না তুললেও ‘পাশ-ফেল’ শব্দবন্ধটি মাথায় ভালোভাবেই গেঁথে গিয়েছিল তার প্রাইমারি বেলায়। প্রতিটি ক্লাসে দ্বিবার্ষিক পঠনপাঠনের পর ‘পাশ’ এই সুযোগটি আসতো মিঠিয়ার জীবনে। পোড়া মুখে দু’চোখের মণি উঠত ঝিকিয়ে। সারা দিনমান তার মনে তখন একই ধুন—‘আমি পাশ… আমি পাশ… জানিস জানিস মাস্টার আমি পাশ…।’ সম্বোধনে অস্বস্তি মিঠিয়ার জন্মগত নয়।
মিঠিয়া ছাত্রী হিসেবে একই ক্লাসে দু’বার করে থাকলেও বয়েস কোনো খুঁটিতে বাঁধা থাকে না। সুতরাং সপ্তম অষ্টম শ্রেণির গণ্ডিতে সে মনে ও শরীরে পূর্ণবয়স্ক যুবতী। স্বভাবতই প্রেম, বিয়ে এসবে তার নজর গেছে বেশি। এলাকায় কবে কার বিয়ে, কোন কোন নতুন প্রাণে প্রেমের জোয়ার লেগেছে তা মিঠিয়ার নখদর্পণে। বিয়েবাড়ি, বউ, আলো, সানাই, ফুলচন্দনের গন্ধ সে খুব উপভোগ করে। যে কোনো বাচ্চা মেয়েকে দেখলে তার মনে হয়, এরা একদিন বড় হবে। শরীর জুড়ে পাহাড়ি ঝরনার মতো নেমে আসবে নদী। সে নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকবে তার প্রাণের পুরুষ! মনের মতো জুটি হয় যেন তারা, এই তার সবসময়ের প্রার্থনা।
৪
রবিবার সকাল মানেই আয়েশ। সপ্তাহে এই দিনটাতে ঘর সংসার, রান্না খাওয়ার দিকেই নজর থাকে মজুমদার গিন্নির। তার সঙ্গে থাকে কতো বাড়তি কাজ। কাজ আর আয়েশ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সঙ্গী হয় ভালো মন্দ খাওয়ার শখ সাধ। আজকেই যেমন মিঠিয়া সকাল থেকে চ্যাঁচাচ্ছে, “মা চাউমিন করো, চাউমিন করো!” মেয়ের সেই আব্দার মেটাতে কোমর বেঁধে লেগেছেন মজুমদার গিন্নি। চাউমিন সেদ্ধ হয়ে গেছে। সবজি ভেজে তাতে চাউমিন দিয়েছেন সবে। বাতাসে বাস ছড়িয়েছে। এমন সময় টুনা আর মিলির মা বারান্দায় এসে বসলো। এরা সবই মজুমদার গুষ্টির। এদের রবি, সোম, বুধ সব দিনই সমান। “এই এখন বকবক শুরু হবে…” মনে মনে বলল মিঠিয়ার মা। তবু পাড়াঘরের রেওয়াজ, অতিথি এলে সম্ভাষণ করতেই হয়।
“বলো বৌদি কেমন আছ?”
“আর কি বলবো বলো! তোমরা সারাদিন নিজেরা সব ব্যস্ত, তাছাড়া সারা সপ্তাহে রবিবার ছাড়া তোমাদের দেখা পাওয়া ভার।” মিলির মা ঢোঁক গিলে বলেন। মিঠিয়ার মায়ের মেজাজ বোঝা ভার। মিঠিয়ার মা টুনার মায়ের দিকে তাকান। এই মহিলা অনেক ভদ্র সভ্য। মৃদু হেসে টুনার মা বলে, “ঐ যে বুনবুনি আর নান্টু বিয়ে করে নিয়েছে… কী সাহস ঐটুকু মেয়ের!” মৃদু হাসেন মজুমদার গিন্নি। বলেন, “কী বলবে বলো দিদি! খুব অস্থির আর অশান্ত মেয়ে তো… ও মেয়েকে ধরে বেঁধে রাখা কষ্টের।”
“তা বলে এভাবে লোক হাসাবে, ছিঃ! খবর তো তোমার মিঠিয়াই দিলো”— মুখ বাঁকান মিলির মা।
“তোমাদেরও বলিহারি যাই! অতো বড় মেয়েকে বাইরে ওভাবে চরে বেড়াতে দাও কেন! কোন দিন কী বিপদ না হয়ে বসে!” টুনার মায়ের গলায় স্নেহ ঝরে। আড্ডাপ্রিয় মিঠিয়াকে এসব কলরব ঠেলে নিয়ে আসে আড্ডাস্থলে। যদিও মিঠিয়ার মা চান না মিঠিয়া এ আড্ডায় যোগ দিক। তবুও মিঠিয়া আসে। এসেই জুড়ে দেয় কলকল, “বুনি বুনি… উলুলুলুঁ… হি হি… হি হি…।” মিলির মা বাঁকা হেসে বলেন, “এবার তোরও উলুলুলু…।” এ কথা শুনে মিঠিয়া চরম খুশি হয়। একপাক নেচে নেয় বারান্দায় আনন্দের আতিশয্যে। যায় ছুটে মায়ের কাছে । মায়ের আঁচল ধরে পাক খেতে খেতে বাতাসিয়া হয়ে ওঠে আরো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, “মা, মা আমার উলুলুলুঁ…” একমুখ হাসি নিয়ে নিজের সিঁথির দিকে ইশারা করে। মজুমদার গিন্নির ঘরোয়া আবহাওয়া তখন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পড়শিরা ধীরে ধীরে সরে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে মিঠিয়ার উত্তেজনা তুঙ্গে। সে হাসছে… সে হাসিতে বারান্দা জুড়ে নামছে গোধুলি আলো। একটি পোড়া মুখ সে গোধুলি আলোয় হয়ে উঠছে মোহময়, রাঙা নেশাজড়ানো অস্তছবি। মজুমদার গিন্নি দাঁতে দাঁত কষে মেয়েকে শাসন করতে গিয়েও পারেন না। কতো কী মনে এসে জড়ো হয়।
এই তো সেদিন মিঠিয়া জন্মাল দুর্গাপুজোর আগে আগে। মা দুগগার মত রূপ নিয়ে জন্মেছিল বলে শাশুড়ি গৌরি ডাকতেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই বোঝা গেলো, মেয়ের গলার আওয়াজ খোনা। তখন থেকেই মজুমদার গিন্নি ঠাকুরের থানে হত্যে দিতেন। যদি কোনো পুজোআচ্চায় মিঠাস এসে বসে মিঠিয়ার গলা জড়িয়ে। এর আরো পরে মেয়েটার অত রূপ আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পোড়া মাটি করে দিলো। মিঠিয়ার মা আর দেরি করেননি। ঠিকুজি কুষ্ঠী ঘেঁটে, জন্ম ছক বিচার করে বুঝেছিলেন এ মেয়ের আগুনে ফাঁড়া। বুঝেছিলেন মিঠিয়ার শরীরে বায়ুর বৈশিষ্ট্য, তাই সে এতো অস্থির, চঞ্চল। নাহ, কোনো জ্যোতিষীর কথায় তাঁর ভরসা হয়নি। নিজেই গ্রহনক্ষত্রের অবস্থানের সঙ্গে নড়ে চড়ে বসেছিলেন। শুরু হয়েছিল খোঁজ। এ সংসারে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী চোখ বুজলে মিঠিয়ার কী হবে!
তখনই বুঝেছিলেন আচার্যা ইন্দ্রাণী, মিঠিয়ার পাশে জলের মতো শান্ত, নরম অথচ মাটির মত ধৈর্যশীল মানুষ চাই। শুরু করেছিলেন রাশি মিলিয়ে মিঠিয়ার সৌভাগ্যের খোঁজ… আজও খুঁজে চলেন আচার্যা… আর মনে মনে স্বপ্ন দেখেন মিঠিয়ার মা… একমাথা সিঁদুর নিয়ে মিঠিয়া এ জন্মের মতো সুখে সংসার করছে। আকাশ বাতাস ভেসে যাছে একটিই ধ্বনিতে… উলুলুলুঁ… উলুলুলুঁ…