উ প ন্যা স । পর্ব ৩
(গত সংখ্যার পর)
পূর্বপুরুষ না থাকলেও উত্তরাধিকার বর্তায়, পাখিরা ওড়ে তবু কিন্তু হাওয়ায় দাগ পড়ে না।
মাঘ মাস আসতে না আসতেই পাতারা সবুজ রঙ খরচ করে ফ্যালে। ধুলো, ধুলো, ধুলো।
মুখমেহনের স্বাদ, উল্লাসধ্বনি, স্ফীতির কনকনে চড়াই-উৎরাই, কেবল ঘণ্টাখানেকের উগ্রতা।
তোর মতো তোর মতো তোর মতো অনুচক্রিকা, ভাবতে পারিনি আমিই ঘুটি, আমিই জুয়া।
জগদীশ আর ওর বউ একবার দুজনে এসেছিল লাক্ষাদ্বীপে, কাভারাত্তিতে, আমার কাছে, তোরা দুজনে নৈনিতালে আর আরিয়ান আজমেরের হোস্টেলে। বৈদেহী ক্লাস টুয়েলভে, পরীক্ষায় টেন্সড আপ।
অমরিন্দর কয়েক পেগ টানার পর রোজই সন্ধ্যায় বলত, প্রধান ইউ হ্যাভ স্পয়েল্ড ইওর লাইফ, জীবন নষ্ট করে ফেললে, এখনও চান্স আছে, লাইফ পার্টনার যোগাড় করে নাও, নয়তো চুল পেকে গেলে ভিষণ লোনলি ফিল করবে।
বিয়ে করার জন্য আমাকে চাপ দেবার পেছনে যে অন্য উদ্দেশ্য আছে, তা তখন বুঝতে পারিনি।
লোনলি ? একা ? নিঃসঙ্গ ? নাঃ, মনে হয়নি কখনও যে আমি একা। এইজন্য নয় যে তুই আছিস আমার জীবনে, আমি তোর পালক পিতা, তোর কথায় ফাউনডিং ফাদার, আসলে আমার চরিত্রে একাকীত্বের বিষ নেই রে, একেবারেই নেই। ফাইল খুললেই মানুষের ভিড় দেখতে পাই, তারা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকে।
পালক পিতা বলতে পারব কি নিজেকে, ধাত্রীবাবা?
একরাতের ঘটনা বলি তোকে ; তখন আমি পুডুচেরিতে। তোর বারো ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ডের ফোটো দেখে অব্দি পরাভূত টান অনুভব করেছি। কার্ডটা পাবার পর কতবার যে দেখেছি ফোটোটা। আর তার ফলে কী হল জানিস ? স্বপ্ন দেখলুম তোকে, স্বপ্নে পেলুম তোকে, ভরাট শরীর, আর আমার, বহুদিন পর, এই বয়সে, ভেবে দ্যাখ, এই বয়সে আমার নাইটফল হল।
উড়তে লাগলাম, ঝড়ের চক্রব্যুহে থেকে অতিঝড়ের চক্রব্যুহে, বাজপাখি হয়ে, ঈগল হয়ে, নখের রক্ত চাটছি, নিচে চোখ মেলে দেখছি উপত্যকায় তুই দৌড়োচ্ছিস দু-হাত দুই দিকে মেলে, পোশাক পরিসনি, নামছি, নামছি, নামছি, ব্যাস, ছোঁ মেরে তুলে নিলাম তোকে ; কিন্তু তুই-ই আমাকে খেতে লাগলি, বললি, বদলা, বদলা, প্রতিশোধ, কারাগারে আটক রাখার প্রতিশোধ।
তোর কনকনে দেহ, বললি, আগুনের ফোয়ারা দিন, বরফকে গলিয়ে ফেলুন, গলিয়ে ফেলুন, দ্রুত নয়, দ্রুত নয়, এক ঘণ্টা মানে ষাট মিনিট, প্রচুর সময় রয়েছে, অন্ধকারকে রোমশ হতে দিন, হাতের আঙুলের ডগায় দৃষ্টি নিয়ে যান, প্রচুর সময় আছে, সময়ই সময়।
ঘরের ভেতরে ঢুকে ঝোড়ো ঝড় যদি নিজের হাতে চুপিচুপি দরোজা বন্ধ করে দ্যায়, অন্ধকার পোড়োবাড়িতে আটক প্রতিধ্বনির ঢঙে, যেন গর্তের হৃদয়ে ইঁদুরের ধান জমা করার রাত।
বলা যাবে কি জীবন নষ্ট ?
স্বপ্নে তুই যবে থেকে আসা আরম্ভ করেছিস, তোর আইডেনটিটি কার্ডের ফোটোগুলো আর দেখি না। তোকে স্বপ্ন থেকে চলে যেতেও বলেছি একদিন স্বপ্নের ভেতরেই, তুই-ই আষ্টেপৃষ্টে শরীরের ফেরোমোন দিয়ে জড়িয়ে ধরলি, আমি ছাড়াতে পারলাম না, সারা স্বপ্ন ছেয়ে গিয়েছিল তোর উড়ালক্লান্ত সুগন্ধে।
আসলে নষ্টামির স্বপ্ন দেখি ; ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে রে, স্বপ্ন, উঞ্ছমজুরিতে-পাওয়া সম্রাজ্ঞীর প্রেরণার অপ্রত্যাশিত আক্রমণে কাহিল। এছাড়া অন্য উপায় আমার জানা নাই, আয়ত্বে নেই।
আহ, কি আরাম, কি আরাম, কি আরাম।
জীবন নষ্ট কাকে বলে ? জগদীশের ছোটোবোন চিন্ময়ীর বর অর্নব চ্যাটার্জি প্যাংক্রিয়াটিক ক্যানসারে মারা গেল, যেদিন চিন্ময়ীর শাশুড়ির শ্রাদ্ধের ভোজ, সেই দিনকেই। রান্নাবান্নাও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল শাশুড়ির শ্রাদ্ধের ভোজের জন্য। অতিথিরাও বাইরে থেকে এসে পড়েছিল অনেকে। আমিও গিয়েছিলাম জগদীশের সঙ্গে। শ্মশান থেকে যখন আমরা ফিরে এলাম, চিন্ময়ী কান্না থামিয়ে বলেছিল, কী পেলুম সারা জীবন ? আইবুড়ো নাম ঘোচাবার জন্যে একটা বর, আর বাঁজা নাম ঘোচাবার জন্যে দুটো বাচ্চা, সারাজীবন তো ও নিচের তলায় মায়ের সেবা করায় ম্যা ম্যা ম্যা ম্যা করে কাটিয়ে পাড়ি মারল ; এত বড় বাড়িটার কী হবে এখন, বাগানের, গাছগুলোর, গাছের ফলের, ফুলের ? ছেলে আর মেয়ে বিদেশেই থাকবে। আমি দোতলায় শুচ্ছি দ্বিতীয় বাচ্চাটা হবার পর থেকে। আমি যে পৃথিবীতে আছি তা ওর খেয়াল ছিল না কখনও। বিধবা শাশুড়ির জন্যে চারবেলা টাটকা নিরামিষ রেঁধে কেটে গেল; তিনি চলে গেলেন, ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন, সগগে গিয়ে স্যাবা নেবার জন্য।
কী বলবি তুই?
আমি তো উচ্চিংড়ের স্বরলিপিতে গাওয়া ফুসফাসুরে গান ; বেড়াজালের হাজার যোনি মেলে ধরে রেখেছি ইলশে ঝাঁকের বর্ণালী। তাকিয়ে-তাকিয়ে যে যুবতীর কৌমার্য নষ্ট করেছি, তারই অদৃশ্য হাতের মাংসল আলিঙ্গনে চোখে পড়েছে কাঁকড়ার আলোতরল বুকে আমার ছককাটা ঠিকুজি, শনি বক্রি, কালসর্পযোগ, কপালের বলিরেখায় গৃহত্যাগী বিষপিঁপড়ের সার। সে যুবতী স্বপ্ন ছেড়ে যেতে চায় না।
জগদীশ ব্যানার্জিকে বলেছিলাম তোর নামটা স্কুলেই সংশোধন করে এফিডেভিট আর গেজেট নোটিফিকাশান দিয়ে নেতি থেকে ইতি করিয়ে নিতে। জগদীশের স্ত্রী অমি, রাজি হয়নি, বেশ হ্যাঙ্গাম বলে নয়, স্পনসর যে করেছে তাকেই করতে হতো, আর আমি চাইছিলাম না যে তুই কখনও আমার উপস্হিতি তোর জীবনে টের পাস। আমার সাহায্যের ভারে ঝুঁকে পড়িস।
জগদীশের মেয়ে আর ছেলেও মত দিয়েছিল, নেতি নতুন ধরণের নাম, বদলাবার কোনোই প্রয়োজন নেই। তেইশ বছর বয়সে নিজেকে পালক পিতা, ফসটার ফাদার, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, জাস্ট ইডিয়টিক, ভাবতেই পারিনি আমি একজন মুকুটপরা বাবা, তোর কুড়িয়ে পাওয়া বাবা। ফসটার মাদারদের বলে ধাই-মা; আমি তার মানে তোর ধাই-বাবা।
আমার মা যখন হাসপাতালের বিছানায়, তখন তাঁকে বলেছিলাম যে আমি বিয়ে এইজন্যই করিনি, কেননা আমি একটি শিশুর পালক পিতা। সংবাদপত্রের কাটিংটা দেখিয়েছিলাম মাকে, একজন নার্সের কোলে তুই, সদ্য আঁস্তাকুড় থেকে থানা হয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছিস।
নিয়ে আয় না, যাবার আগে চাক্ষুষ করে যাই, মার নাক থেকে কেরালিয় নার্স ভেন্টিলেটার সরিয়ে দিতে, বলেছিলেন।
আমি ওকে জানতে দিতে চাই না মা, যে আমি ওর জীবনে ঈগলপাখির মতন ডানা মেলে আছি; জগদীশ আর ওর বউ অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছে।
সত্তা, মুহূর্ত, ভাষা, বীর্য, স্পন্দন, উৎসমুখ, কচুর জঙ্গলে ফড়িং, কলার মান্দাস, কাপড়ের খুঁট।
বরফঝুরির গ্রন্হি শুভ্রবিষ অনন্ত শিকড়ে। কাদায় কলকা এঁকে রেখে গেছে কীট।
কাঠঠোকরার বাসার ফুটোয় সাইক্লোনের মতন ফুঁ দিয়ে বাজানো বাঁশির সুর। বাজাও হে বাজাও
বুদবুদেরা জাতিস্মর হয়, তা এক মাদারির ইন্দ্রজাল।
এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।
যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।
ব্যানার্জি পরিবারকে তোর স্হানীয় অভিভাবক করতেও চাপ দিতে হয়েছিল। ওরা প্রথমে রাজি হয়নি। অযথা ঢুকতে চাইছিল না আমার আর তোর জীবনের আগাম জটিলতায়। ব্যানার্জি যখন হরিয়ানায় হিসারের এসডিও ছিল তখন আমিই ওকে বাঁচিয়েছিলা জাঠদের গোঁসা থেকে।
ব্যানার্জি কীই বা করত! মারোয়াড়ি আর গুজরাতিদের ছেড়ে দেয়া ধর্মের ষাঁড়গুলো হেলতে দুলতে হরিয়ানায় পৌঁছে মাদি মোষদের সঙ্গে সঙ্গম করছিল আর মোষগুলোর কিছুদিনেই গর্ভপাত হচ্ছিল, শরীর খারাপ হচ্ছিল, দুধের ঋতু হাতছাড়া হচ্ছিল। ষেঁড়োমোষগুলোকে ওরা বেঁধে রাখে, প্রজননের ঋতুতে মাদিমোষদের চাষিরা নিয়ে যায় ষেঁড়োমোষদের মালিকের গোয়ালে; মালিকদেরও রোজগার হয়।
জাঠ পঞ্চায়েতের কর্তা জগদীশকে টিটকিরি মেরে বলেছিল, বাঙালি ষাঁড় চাপছে হরিয়ানার মাদিমোষের ওপর, সে আর কি করে বুঝবে যে গোরু আর মোষ একই প্রজাতির প্রাণী নয়।
ষাঁড়গুলো গরু খুঁজে পায় না হরিয়ানার পথে আর খেতে। তারা তাড়নায় এলে সামনে মাদিমোষ পেয়ে তাদের ওপরই চাপে।
আমি হিসারের জাঠসভার কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের বাজেট থেকে লোকসানের টাকার সরকারি ব্যবস্হা করে মন্ত্রীর রোষ থেকে বাঁচিয়েছিলুম ব্যানার্জিকে। তখন আমি ওই বিভাগে।
পৌরুষের গরিমা, মৌমাছিদের প্রত্যাখ্যাত ফুলের মধু।
অন্ধকারে স্পর্শের মর্মার্থের সাথে আলোয় স্পর্শের মর্মার্থের প্রভেদ,
সব দেশের সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজে না।
পশ্চিমবঙ্গের ক্যাডারের জগদীশ হারিয়ানাতে পোস্টিং নিয়েছিল। না, অমরিন্দরকে হাসিখুশি রাখার জন্য নয়; নয়তো সরকারি আধিকারিকদের তো শাসকদলের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মেলানো ছাড়া কোনো কাজ নেই, পুঁজিবাদ হোক, সাম্যবাদ হোক, গান্ধিবাদ হোক, খিচুড়িবাদ হোক, হিন্দুবাদ হোক, মুসলমানবাদ হোক, গণতন্ত্র হোক, আমিরতন্ত্র হোক, একনায়কতন্ত্র হোক, দেশে-দেশে তা-ই তো ঘটে চলেছে।
না, না, বউয়ের জন্য নয়, হরিয়াণায় উপরি রোজগার করাকে সমাজ স্বাভাবিক মনে করে, তাই। পশ্চিমবাংলায় ঘুষও খায় আবার সৎসন্ন্যাসী সেজে থাকে, প্যাঁচ-পয়জার মারতে হয়, বুঝিয়েছিল জগদীশ, অমরিন্দরের সামনেই, ওদের অ্যানিভার্সারির ককটেল পার্টিতে, হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে, চণ্ডীগড়ে। পশ্চিমবাংলায় ঘুষের গুড় খেয়ে ফ্যালে নেতারা। ব্যুরোক্র্যাটদের তোল্লাই দেয় না। হরিয়াণায় খাও আওর খিলাও, পেয়ারে, মজাদার চানা জোরগরম।
পশ্চিমবাংলাকে জগদীশ বলে ওয়েএএএএস্ট বেঙ্গল, বামপন্হীরা সুযোগ ওয়েএএএস্ট করেছে, তারপর যারা এলো তারা ওয়েএএএস্টকে সুযোগ দিয়েছে, যারা জঙ্গলে লুকিয়ে বিপ্লব করছে তারা নিজেদের জীবন ওয়েএএএস্ট করছে। কোথায় খাবে, খাওয়াবে, তা নয়, কেবল বাকতাল্লা। জগদীশের ওয়েস্টলাইন পাছার দ্বিগুণ হতে চলল।
প্রেগনেন্ট বলে অমরিন্দর তিন পেগ মাত্র সিঙ্গল মল্ট খেয়েছিল, ঘুষের। জাঠনি, মাতাল হয় না, মাতন লাগে।
আমি বাড়ির বাইরে ড্রিংক করতে পারি না, যুৎসই মনে হয় না, নিজেকে অগোছালো না করে, লুঙ্গি পরে, ঠ্যাঙ ছড়িয়ে, একা-একা, চুপচাপ, বসে ড্রিংক করি।
ক্রমশ