১০টি প্রেমের কবিতা
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখনায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমারে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আর্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
১
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রূকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলংকার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাই’র পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।
৩
ঘুরিয়ে গলায় বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম,
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দেবে এই শব্দবিদ কোবিদের নাম।
কক্কার শব্দের শর আরণ্যক আত্মার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী ,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ–
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্তি হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।
১
ওই হাতে হাত মুক্তি পেলে জেগে ওঠেন ব্যক্তিগত
তখন আমি সবার মুখের উৎস দেখি তোমার মতো।
শিরায় শিরায় মহীরুহ ছড়িয়ে দেয় আপন বূ্্যহ
প্রগলভতার উজ্জ্বলতা তখনই হয় লজ্জানত
আনন্দে চোখ কাঁপতে থাকে, বুকের নীচে পূর্ণ ক্ষত।
২
এখন লেগেছে গায়ে বড়ো বেশি ব্যক্তিগত হাওয়া
এখন উড়েছে সব ধুলো
আকাশের দিকে আর পথেরও ধমনী দেয় সাড়া
ভুলে যেয়ো সব কিছু ভুলো
এখন সমস্ত চোখে লুকোনো দেখেছি দূর ফেরি
হয়তো-বা এও খুব দেরি
এখন শহর থেকে শহরের স্মৃতিমুখে যাওয়া
এখন লেগেছে গায়ে বড়ো বেশি ব্যক্তিগত হাওয়া
কবি, এবার সত্যি করে বলুন তো, মধ্য গগন পেরিয়ে সূর্য এখন
চলে যাচ্ছে মধ্য বয়েসে, যেমন আপনার বয়েস,
প্রথম ফুল ফোটার মতন যৌবন উদগমে এবং বাতাসে বন্যার জলের মতন
আরও অনেক বছর
আপনি যে সব প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ঠিক যেন
নেশাগ্রস্তের মতন প্রেম,
এই প্রেমের দাপট কি আপনার এই বয়েসেও থাকে? প্রেম কি
সত্যিই কখনো পুরনো হয় না, হারিয়ে যায় না?
প্রশ্ন শুনে কবি স্মিতহাস্যে বললেন, তুমি সেই গল্পটা
জানো না বুঝি?
একজন রবীন্দ্রনাথকে প্ল্যানচেটে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, গুরুদেব,
মৃত্যুর পর সত্যিই কি স্বর্গটর্গ…
তরুণ প্রশ্নকারীটি ঈষৎ বিদ্রূপের সুরে বলল, আপনি আমার
উত্তর এড়িয়ে গিয়ে নিজেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করলেন?
বুড়ো বয়েসে বুঝি এরকম হয়?
আমি পরকাল কিংবা স্বর্গ-নরক নিয়ে…
কিন্তু প্রেম, সে কি ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, কিংবা
চোখ খোলা স্বপ্ন, কিংবা চার দেয়ালে বন্দির একটিমাত্র জানলা?
কবি হাসলেন, রবীন্দ্রনাথের কৌতুকটি তুমি বলতেই দিলে না
তা হলে প্রথম থেকেই এত উপমা দিচ্ছিলে কেন?
এসব প্রশ্ন করতে হয় সোজাসুজি!
তরুণটি বলল ঠিক আছে, স্পষ্টাস্পষ্টিই জিজ্ঞেস করছি, প্রেম
কতদিন টেকে বলুন তো? ক’ মাস? ক’ বছর?
একজনের সঙ্গে আজীবন প্রেম কি সম্ভব?
কবি মুচকি হেসে বললেন, আমার সোজাসুজি উত্তর, তোমায় বলব কেন?
তরুণটি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ব্যাস, ভয় পেয়ে গেলেন, ভাবলেন
বুঝি আপনার ওসব মাখো মাখো প্রেমের কবিতাগুলো
আর কেউ পড়বে না?
কবি বললেন, তুমি এবার চাঁছাছোলা ভাষায় কথা বলছ
তবে আমি উপমা শুরু করি?
প্রেম একটা নদী। আসলে নদী বলে কিছু নেই অথচ
পৃথিবী ভর্তি নদীর কত নাম। কত কাব্য।
আজ তুমি একটা নদীতে স্নান করতে গেলে, কী সম্ভোগের দাপাদাপি
এক বছর পরে যাও, সেই নদীর অন্য জল, তুমিও অন্য মানুষ
ফুল আর ভ্রমরকে কতবার মেলানো হয়েছে, ফুল দু’একদিনে ঝরে যায়
ভ্রমরেরই বা কতটুকু আয়ু?
তবু ফুল ফুটতেই থাকে, ভ্রমরও আসে গুন গুনিয়ে
যেন একই ফুল, একই ভ্রমর
তরুণটি বলল, আপনি কিন্তু এখনো উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছেন
কবি বললেন, উপমা মাত্রই তো এড়িয়ে যাওয়া, তুমি
মধ্য গগনের কথা বলছিলে
কেন জানতে চাওনি, এই বয়সেও আমার সেই অঙ্গটি চাঙ্গা থাকে কিনা?
তরুণটি খানিকটা থতোমতো খেয়ে বলল, তার মানে, তার মানে
প্রেম শুধু শরীর, মানে এতকাল যে…
কবি তাকে বাধা দিয়ে বললেন, শরীরও এক শরীর নয়,
নদীর মতন, হৃদয়ও এক হৃদয় নয়, নদীর
মতন। অথচ সবই আছে।
যাও, সন্ধেবেলা একটা নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকো
তোমার সঙ্গিনীর কানে কানে সুমধুর শাশ্বত মিথ্যেগুলো বলো
তাকে দুঃখ দিও না,
সে-ও তোমাকে যা-দেবে, তুমি তার মানেই বুঝবে না।
কৃষ্ণচূড়ায় এখনো ফোটেনি ফুল
হৃদয় ছিলো কি অকাট্য নির্ভুল
পায়ে পায়ে ভাঙে যেখানে পাতার রাশি
শব্দ সেখানে ওঠেনি কি ‘ভালোবাসি’?
কে তার খবর রেখেছে শহরে-গ্রামে
ডিসেম্বরের বৃষ্টিও যদি নামে
অকালে সকাল হয় যদি কোনোদিন
ভাঁড়ারে মানুষ খুঁজে মরে দূরবীন!
সহসার বাঁশি এখানে পশে না কানে
গর্জন, জানি সমুদ্রে-শাম্পানে
স্বাভাবিক— তবু অপরাজিতার কাছে
বিদেশি মানুষ বারবার ফিরে আসে!
সোনার খাঁচার পাখি কি সোনায় খুশি?
দ্বার খোলো, কিবা মারো তাকে আলকুশি
মুক্তির দূত, বুকে রেখো স্মৃতি তারই
জলের কলস কোন জলে হলো ভারী?
কৃষ্ণচূড়ায় এখনো ফোটেনি ফুল
সময় হয়নি, তাই এত নির্ভুল
এ-দেশের গাড়ি— দুঃখ পেয়েছি কত
স্টেশন ছেড়েছি স্বদেশ ছাড়ার মতো।।
কলকাতা থেকে লিখি— পুরোনো হাতের লেখা— চিনবে নিশ্চয়।
তোমাদের শহরে এখন বাতাস কি?— বৃষ্টি কি?
আমার খেলাধুলায় মন নেই আর।
কেন লিখে জানাও না কার সঙ্গে ফেঁসেছ বিকেলবেলা
কাকে তুমি হরদম মিথ্যে বলছ—
মস্করার মধ্যে আর রেখো না গীতবিতান
ছাড়ো ওই খেলা, শুধু ছেড়ো না আমাকে মরে যাব।
আগেকার মতো অতো দৌড়ে হেঁটো না। এখন তো আর
জামা-পরা বালিকা নও। এখন শাড়িতে
পা আটকে যেতে পারে। তোমাকে দেখবার
জন্যে যে দীঘল স্রোত পাড়ে আছড়ে পড়ে তাকে দেখতে দাও। দেখো
চারিদিকে বড়ো-বড়ো চোখ সব তোমাকে দেখতে চায়
তুমি অতো দ্রুত গেলে হবে না তো।
আমিও সমস্ত ধেনু প্রথম দিনের মার কাছে
ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি সোনার মুকুট পরে এবার এসেছি।
এসো আমরা দুইজনে পাশাপাশি মগ্ন অবকাশে
আবছা নদীর তীরে কথা বলি।
সেদিন তো নদীর ভাষা বুঝতে পারোনি। কিংবা সেদিন
একবারও নদীর দিকে ফিরেও চাওনি।
অবশ্য নদীর ভাষা সেইদিন এমন প্রেমিক
ছিল না। চারিদিকে কী রকম আলো দেখো
আম কুড়োবার গন্ধ একেবারে নয়। বৈশাখী ঝড়ের
মধ্যে যেন ফুলে-ওঠা সংহতির অশথ কি আম জাম গাছ।
এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কিনা।
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
চলো খেয়ে আসি।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে…
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
–দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি!
সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীণ শরীরে
আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি–
জলস্রোত ক্রমশ তীব্র… কনকনে…
অবোধপূর্ব স্মৃতি- স্মৃতি আছে, কিন্তু কীসের স্মৃতি, জানি না— কালিদাস
আরও বহু জন্ম ছিল আরও বহু মৃত্যু পেছনেই
তুমি সব ভুলে গেছ মনে আছে সমস্ত আমার
নষ্ট মাধ্যমের মত ফেলে এলে সরল বাঁশরি
স্বরমালা ভুলে যাও শিল্প কর-মাধ্যমে বেজেছে।
আমার জন্যেই সব ফেলে এলে পুরোনো নগরী
চিহ্ন-ছাড়া ভবিতব্য নিয়ে যাবে কোথায় এবার
আহীর পল্লীর মেয়ে আমাকে কি শেখাবে দোহন
তপ্ত দুঃখ অঙ্গুলীতে বেদনায় আপাত্র ভরেছে।
এত বৃষ্টি হয়ে যাবে একজন্মে কে দেখেছে আগে
কেমন হৃদয় করে পথ চেয়ে আছি সারাক্ষণ
পরাজিত এই বোধ প্রতীক্ষার দুঃখে অভিমানী
বহু বৃষ্টি পার হয়ে তুমি আসছ দেখতে তো আমাকে?
এ যেন অনেকবার ঘটে যাবে আরও জন্ম নিলে
বাদল সন্ধ্যাকে ঘিরে অসীম নির্জন দুটি প্রাণী।
সেদিন বৃষ্টির শেষে কেনো যে কেঁদেছি মনে নেই
বহু জন্ম আগে তুমি এমন দিনে কী করছিলে!
ভালোবাসব আদর দেব
যৌনকাতরতা
তোমার দিকে গড়িয়ে দেব
আদিম রূপকথা
মুগ্ধ হয়ে বলবে তুমি
বকবকম বক
পুরুষ চায় চিরনতুন
মুগ্ধতার ছক
আমিও কত হাজার যুগ
মুগ্ধতার শেষে
নতুন প্রতিরোধের দেশে
পৌঁছলাম এসে
এ দেশে সব পাখি ও ফুল
তেজ ও বিদ্যুৎ
ওদের দেখে বুঝেছি
সেই প্রণয়ে ছিল খুঁত
প্রভু সাজার ইচ্ছে হলে
প্রেমিক তুমি নও
ভালোবাসব আদর দেব
বন্ধু যদি হও