প ছ ন্দে র ব ই
সৌম্য যেভাবে আকাশ দেখেছিল
মণিশংকর বিশ্বাস
গুরুচন্ডালি
মাঘের রোদ্দুর ফুলের ওপর ঝরে যায়। দূরে নীল আকাশে একটা চিল চক্কর কেটে নারকোল গাছের ওপর এসে বসে। আমার হাতে একটি একফর্মার কবিতার বই। সৌম্য যেভাবে আকাশ দেখেছিল। কবি মণিশংকর বিশ্বাস। বইয়ের পাতা উল্টোই। ভেতর নড়ছে শব্দশাখা―
‘মাঝে মাঝে ভাবি, আরও একা হতে হবে।’
তারপর
. . . ‘কোণা-ভাঙা মলাটের গায়ে হিজিবিজি লেখা
মলাটের উল্টোদিকে কিন্তু পরিষ্কার
পাশের বাড়ির টুকুদির উদ্ধত শঙ্খ
. . . দেখি শীতের সন্ধ্যায় গুলের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে
সাইকেল চালিয়ে টুকুদি ফিরছে’
(চর্যাপদ)
অথবা
‘মনে হয়, তুমি এক আশ্চর্য কাহিনি―
যার গল্প আমার একটুও মনে নেই
মনে আছে শুধু গল্পের মোচড়খানি
যেন কুমারী স্তনের অতিনাটকীয়তা―’
অতিনাটকীয়তা? কোথা থেকে এল এই শব্দ ওইভাবে। বিস্ময় আসে। দূরে করঞ্জ গাছের শাখা ঝরে যায়। আমি ভাবতে থাকি।
‘বাকি সবই তো প্রতীক
শুধু তোমার ওই পোষমানা ঈগলখানি সত্যি―’
(সৌম্য যেভাবে আকাশ দেখেছিল)
আকাশে চিল উড়ছে। তোমার ঈগল? তুমি কে? ঈশ্বর? মৃত্যু? নাকি সেই অচেনা যাকে কবি বলছেন,
‘আমি তাই অচেনাকে ডেকে বলি, ভাই, যত্ন নিও। . . .
যে পাখিটি ক্লান্ত, তাকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেবার আগে―
স্নায়ুগুলো যেন শিথিল ও শান্ত করে নিতে পারি―’
(ইউথ্যানেশিয়া)
এলাহী শব্দটি পড়েছি বহু। এলাহি আয়োজন, এলাহি ব্যাপার। তবে এটা পড়িনি―
‘কাছেপিঠে বহুগামিনীর মতো চাঁদ ওঠে
মেঘের আঁচল ফুঁড়ে তার এলাহী স্তন।’
কবি মণিশংকর বিশ্বাসের কবিতারা মাঘ মাসের দুপুরের ঘুঘুর ডাকের মতো। কেবলই নরম ঘোরের জন্ম দেয়।
সকল ধূসর চিহ্ন
সায়ন রায়
ভাষালিপি
মাঘনিশীথে কোকিল ডাকে নি। বাইরে বৃষ্টি। স্যাঁতস্যাঁতে শহরের পাঁজর। হাতের কাছে একটি ছিপছিপে এক ফর্মার বই। ‘সকল ধূসর চিহ্ন’। কবি সায়ন রায়। কী লিখছেন তিনি?
‘প্রত্যাখ্যান এক ফল। আমি সেই মধুফল
পান করি জন্মাবধি। চেটে চুষে নিই আত্মার নির্যাস
আমার চলায় দেখো অনন্ত খর্বতা
উপহাস করি। উপহাস হই। . . .’
চমক লাগে। ‘প্রত্যাখান’ শব্দের সঙ্গে জুড়ে থাকে আমাদের জীবন। সকলেই এই মধুফল খেয়েছি। অথচ কবি বললেন ‘পান করি’। এই ক্রিয়াপদটি ভাবাচ্ছে।
কবি হেঁটেছেন দীর্ঘ। ‘অজানা ভয়ের দেশে কেটে গেছে কত কত কাল’ অথচ ‘কী এক আলস্য ঘিরে ধরেছে এখন আমাকে’। তিনি অভিজ্ঞতাপ্রসূত কন্ঠে বলছেন―’একদা জেনেছি গন্তব্য নয়, পথ শুধুই পথ আমাদের’ আর তারপর
‘এগিয়ে চলার যে শিল্প সৌভাগ্যসূচক, সকলের নয়
জানি অনেকেই পাথরের বলের মতো
গড়িয়ে দিচ্ছে বুকচাপা কান্না’
বাইরে কি বৃষ্টি বাড়ল? পথের কুকুরগুলো ভিজছে। আশ্রয় নিচ্ছে বারান্দার ছায়ায়। কবিতা থেকে উঠে আসছে গাঢ় হিম নির্দেশ―
‘খ্যাতির খানিকটা আগেই
দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু
তুমি মৃত্যুর নদীকে চেনো’
বৈতরণী কথা ভেসে এলো নাকি? কবি পৃথিবী ঘেঁটে দেখেছেন―’ঢের শিক্ষে হল। অভিনিবেশের চেয়ে দামী/অনুভব।’
আমরা মহামারির ভেতর দিয়ে চলেছি। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। চোখ পড়ে একটি কবিতায়, শিহরণ আসে―
‘যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল
তার সকল জ্ঞান, শাখা উপশাখা, ধারা ক্রমধারা অসীম
সব নিমেষেই ঝুপ। উফ্! কত কত মানুষের শ্রম
মৃত্যুর ঠিক আগে কথাক’টি ভেবেছিল
তারপর হঠাৎই আলো নিভে গেল’
কবি সায়ন রায়ের কবিতায় গাঢ় রাত জেগে থাকে নিরলস, তার ঘুম নেই। সে ঘুমোতে দেবে না।
সন্তাপ ও সিজার টেবিল
পার্থজিৎ চন্দ
প্ল্যাটফর্ম
সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় ভারী হয়ে আছে উপকূলীয় বাতাস। পাতা উল্টে চোখে পড়ল দুটি পংক্তি―
দেখেছি আমার ঠোঁটে ও নখের কোণে লাল এক অচেনা ফলের দাগ
মাংসফলের বনে ঘন হয়ে উঠেছিল ছায়া
(ছায়া)
চুপ করে থাকি। পাতা ওল্টাই। দু’ফর্মার কবিতার বই। সন্তাপ ও সিজার টেবিল। কবি পার্থজিৎ চন্দ। তাঁর কবিতা ঘন, মেঘময়। তাঁর কবিতায় মিশেল চলছে। ইংরেজি, হিন্দি শব্দ মিশ্রণ করছেন আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে। যেমন―
‘ফলসার বনে কোবাল্ট-প্রহর ঘনিয়ে উঠেছে
এক রাক্ষস-শিশুর দাঁতে ছিঁড়ে নেওয়া স্তনবৃন্ত কোবাল্ট-রঙের’
(বিষ)
অথবা
‘একদিন অচানক হেমন্তের বিকেলবেলায় পড়ন্ত সূর্যের আলো
ঢলে পড়ে আমলকি-বনে।’
(শ্ব-দাঁত)
শহর ভিজছে। গাড়ির সংখ্যা কমে আসছে। পৃথিবী ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ। এমন সময় পড়ছি ‘সন্তাপ’ ও ‘ছিন্নমস্তা ২’ কবিতাটি। একটা গাঢ় ভাবনা গ্ৰাস করছে। গঠনশৈলীর কারণে উদ্ধৃত করা যাবে না কবিতা দুটি। পড়ে নিতে হবে।
রাজনৈতিক হিংসার কথা মনে আসে। খবর বলছে, রাজ্যে দেশে পৃথিবীতে শুধু হিংসা। আমি পড়ছি―
‘দূরে গুলির শব্দে ধড়ফড় করে উঠে, হ্যাট ঠিক করে
খুলি-ওড়া পশু কাঁধে ঘরে ফিরছে নিহত শিকারি’
(শিকার)
ইমেজটা মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। উত্তরের দরজাটা খুলি। বাতাস জোলো, ঠাণ্ডা। কোনও নদীর কথা মনে আসে―
‘ভাষা-নদীটির জন্য তুমি কুড়িয়ে এনেছ গ্ৰহান্তরের জাদুঝাঁপি’
(লেখা)
তারপর পড়ি
‘হরিণ-চোখের মতো এ-বিকেল সুন্দর
যার হাতে রক্ত লেগে আছে সে আমায় হত্যা করেনি
যে আমায় হত্যা করেছিল
তাকে আমি চিনি। . . . ‘
(দোতারা)
সন্ধ্যে রাতের দিকে ঢলে আসে। বিপুল এক জলীয় ছায়ায় ঢেকে যায় শহর, মসস্বল ও গ্ৰামের চোখ। আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্বের কথা ভাবি। দিশেহারা করে দেয় দুটি লাইন―
‘আমিই সে অকৃত্রিম যোনি
নিজেকে প্রসব করে সারারাত একা একা রক্ত মুছেছি’
(যতটা শূন্য ধরে)
কবি পার্থজিৎ চন্দর কবিতা বিপন্ন করে আমাদের। আক্রমণ করে। সন্তাপ শিল্প হয়ে ওঠে।
রাতের অস্পষ্টতায় ঢেকে যায় শব্দের চারপাশ।