উ ই ন্ডো সি ট
ভোরের দিকে আজান বেজে ওঠে। নরম আলোর পাখি ডাকে। হাওয়ায় কার্পাস ভাসে। ভোর থেকে গড়িয়ে নামে তিলক কামোদের সুর। নরম। নরম। এত নরম যে ঘাসের ওপর পা রাখলে আয়ু ঠান্ডা হয়ে আসে। আয়ুর কী দোষ সে যদি সহজেই ফুরিয়ে যায়। তবু স্মৃতির কাছে দলা পাকিয়ে আটকে থাকে একান্নবর্তী দিন। জমতে জমতে স্মৃতিও পাথর হয়ে যায়। ভোরের নরম আলো সেই পাথরের গায়ে এসে পড়লে প্রজাপতি রঙ গুঁড়ো-গুঁড়ো হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। পাথর থেকে বেরিয়ে আসে কালসাপ ও বিষাদ। ভোরের পাশে গিয়ে বসে। ভোরের গান শোনে। ভোর বৈরাগ থেকে অন্য কোনও সুরের দিকে সরে সরে যায়। ওই যেমন তিলক কামোদ। ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? স্বপ্ন থেকে খসে পড়ে শেফালি ঘ্রাণ। স্বপ্নের ব্রাহ্ম মুহূর্ত থেকে আত্মলিপি ও অক্ষরসমগ্র উঠে বসে। সামনেই ভোরের জানলা। ভোরের পাখি এসে বসে সেই মায়াবী ঝিলপাড়ে। সত্যি হোক না হোক স্বপ্নের পরে জেগে উঠলে রাতের অন্ধকার নয় বরং ভোরের আলোই নিরাপদ বোধ করায়। ঠিক যেমন ভোরের নদী নিরাপদে ঘুমিয়ে থাকে বালিকার কোলে মাথা রেখে। কামিনীফুলের আয়ু ফুরিয়ে যায় এমন সময়। বালিকার কলসি ফাঁকাই পড়ে থাকে পাথুরে ঘাটে। কলসি ফেলে রেখে ভোরের বালকের মাথায় ফুলের মতো ফুটফুটে আঙুল রেখে সে তাকিয়ে থাকে সিঁদুর রঙের সূর্যের দিকে। হৃদয়চঞ্চল শ্যামভাব জেগে ওঠে আমার নরমভাষ্যে। বাঁশির ভেতর জমে থাকা বাতাসের গ্রামে ভোরবৈরাগী বাউল একলা হেঁটে যায়। বোষ্টমি স্নান সেরে উঠে আসে ঘাটে। কোমরে দড়ি জড়িয়ে খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধে মনসুর মিয়াঁ। জীবনের রসও এভাবেই হয়তো গড়িয়ে পড়ে যাপনে বেঁধে রাখা হাঁড়ির ভেতর। ভোরের আজানের মতো এমন পবিত্র ও শুদ্ধ সুর আমি শুনিনি কখনো। আজান শব্দের মধ্যেও তাই এক আত্মসমর্পণের স্নিগ্ধ ভোরের আলো লেগে থাকে। সে আমি ধর্মের ঘরে জুতো খুলে ঢুকি আর নাই ঢুকি, ভোগের প্রসাদ প্রণাম করে খাই বা না খাই, ওই শুদ্ধ ভাব আমার শ্রুতির ভেতর এক অনন্ত ধ্যানের আসন সাজিয়ে দেয়। নিজেকে নিজের ভেতর থেকে দেখার এই আকুতি ভোরের নীরবতার মাঝে গিয়ে বিলীন না হলে উপলব্ধি করা যায় না। বুকের ভেতর তখন নতুন সূর্য ওঠে। শুধু তাকে চিনে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয়। ধারণ করে নিতে হয় অন্তরে। মনের জানলা আরেকটু খুলে দিলেই সেই আলো এসে পড়ে নির্জনের উপাসনা গৃহে। রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে গোপন দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সাধনার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকলে জীবনের আঁধার কাটে। ভোর হয়। ভোরের সংবাদ ফেরি করে কিশোর কবি। পরনে তারও স্বপ্ন রঙের ডানাকাটা জামা। কত উড়ানের স্বপ্ন এসে জড়ো হয় ভোরের নৌকাঘাটে। যাত্রী নিয়ে একবার জলজ জীবনের সীমানা পেরিয়ে যেতে পারলে সবুজ দ্বীপ। আদরের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। এমন অলীক দৃশ্যেই আমি ভোরের উঠোনে গোবর জলের প্রলেপ দিয়ে রাখি। বালিকারা যে পথ দিয়ে জল নিয়ে ফেরে।
আমারও শৈশবের এক অন্যরকম ভোর ছিল। সে ভোরের আগে একটা ইচ্ছেনদীর ঘাট ছিল। গোপন ভালোবাসার জলে পা ডুবিয়ে রাখা কিশোরসম্রাট মনে হত নিজেকে। আমি আর নদী, একটা ছায়াঘন গাছের আড়ালে ভোরের আজান শুনতাম। জল কতটা শান্ত হতে পারে সেই কিশোর বুকে তোলপাড় হওয়া বাতাসের মোচড় না উঠলে বুঝতেই পারতাম না। দ্রুত পালিয়ে বেড়ানো সেসব খেলাদিনের আড়ালে আমার নতুন ডানার একটা একটা পালকের নাম লেখা আছে। একার সঙ্গে একার বন্ধুতা আমার সেই থেকে শুরু। সেই ভোরের বাউলের মতো। সেই থেকে জল আর গাছ আর মাটি আর হাওয়া আমার দলবল। শিশুমনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ফুলচোরের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় ভোরের পাড়াতেই। শিউলি ফুলের রঙ আর ভোরের রঙের মধ্যে আজও আমি তফাৎ করতে পারিনা। আস্তে আস্তে সেই ভোরের বয়স বাড়ল। নতুন নতুন গাছের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল। যৌবনের জোয়ার এসে লাগে যখন ভোরের গায়ে, সে এক অন্য রকম বাউল বাতাস। শুধু গানের মতো কী যেন গুনগুন একটা মেয়েলি কণ্ঠ জড়িয়ে ছাড়িয়ে চলে যায়। না সে গ্রহণ করে কাছে টানে, না দূরে গিয়ে ফিরে চায়। তবু মনের ভেতর আবারও গান বেজে ওঠে, “খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন”। ভোরের গা থেকে একই সঙ্গে ঠান্ডা চাঁদ ও নক্ষত্রপক্ষের ধ্রুবতারা সরে সরে যায়। আমি ও আমার শৈশবের দিনগুলিও সরে যায় পরস্পরের কাছ থেকে। কাকে আর ধরে রাখা যায় এ জীবনে। থাকার মতো বাতাস, বুকের পাঁজর আঁকড়ে ঠিক পড়ে থাকে। ভোরের আকাশেই একমাত্র সেই অমূল্য বাতাস মিশে থাকে। কিন্তু প্রেমের মতোই মুঠোতে আলোও বেঁধে রাখা যায় না জোর করে। সে ইচ্ছেমতো ধরা দেয়। ইচ্ছেমতো জড়িয়ে রাখে। ভোরের ভেলা বয়ে যায় বেলার দিকে রোদমুখ করে। বিষণ্ণ লাগে। শাওনের মেঘের মতো।
ভোরের নীল এক নতুন জীবনের ইশারা যেন। সম্পর্কের এত মোলায়েম নীল রঙ আমি আমার আঁকার খাতায় কখনো ধরতে পারিনি। নতুন একটা দিন। নতুন একটা শুরু। অতীতের কালো রাত পেরিয়ে এসে আরও একবার জীবনের কথা বলার দিন। তবু সমস্ত বিষণ্ণতার পিছুটান পুড়িয়ে শ্মশানের ঘাটে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত বসে থাকা একজন স্বজন হারানো শোকের কাছে পাথরও কেমন একা হয়ে যায়। নদীর জলও সেই পাথরের কষ্ট ধুয়ে দিতে পারে না। সদ্য আলো ফোটা সকালের সেই স্নান-মুহূর্ত, যার জল থেকে উঠে এসে পিছু চাওয়া মানা। যার সারা রাত আগুনের কাছে মাথা নিচু করে পড়ে থাকা খিদেহীন ভিজে চোখ মুছে দেওয়ার মতো রুমাল একমাত্র ভোরই হতে পারে। কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তের দেহ এই এমনই ভোরের বাতাসে মিশে গিয়েছিল। চিরনিদ্রায় মগ্ন কবিকে জলপাইগুড়ি থেকে ধুপগুড়ি নিয়ে যেতে যেতে প্রায় রাতের আকাশ পাতলা হয়ে এসেছিল। শ্মশানের দুয়ারে তখন শোকের সারিন্দা বাজছে। শরীর জল আর ছাইয়ের ভেতর মিশে যেতে যেতে ভোরের কবিতা হয়ে উঠছিল সেদিন। উত্তরের আকাশে শীত সবে দস্তক দিতে শুরু করেছে তখন, বুকে টান লাগে খুব।
প্রতিটি ধর্মে ও মিথে ভোরের একজন দেবতা রয়েছেনই। কিন্তু বাঙালির ধর্মে ভোরের দেবতা একজনই। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। এই দেবতার আগমন না ঘটলে দেবী পক্ষেরই যেন সূচনা হয় না বঙ্গদেশে। ছোট থেকেই ভোরের মহালয়ার সঙ্গে মায়ের আঁচলের মতো একটা সম্পর্ক আমাদের। পাড়ায় মাত্র একটা কি দুটো বাড়িতে টিভি তখন। তবু মহালয়ার ভোরে অ্যালুমিনিয়ামের বিরাট অ্যান্টেনা দেওয়া সেই টিভির সামনে বসতে আমাদের মানা ছিল না। সেটা ছিল ছোটদের ভোরবেলা। আনন্দবেলার সেই ভোরে আশ্চর্য বাক্স দেখার জন্য বলতে হত না খুল যা সিমসিম। শৈশবের অবাধ প্রবেশ ছিল প্রতিবেশীর ব্যক্তিগত টিভির ঘরে। সেই ছোটবেলার চাদর সরিয়ে একঝলক আলোয় চুমুক দিয়ে আবার আলোর বেণুতে মন ফেরাই। নদীর ঘাটে ভাটিয়ালি গান গাওয়া বন্ধু আমার আজও বসে থাকে আমার অপেক্ষায়। কুমোরটুলিতে রাত জাগা চোখ ডলতে ডলতে উঠে আসে খুদে মৃতশিল্পী। জানি না ভবিষ্যতে তার হাতে মাটি উঠবে কিনা। তবু ভোরের এই কাঁচা আলোর পর্দা সরিয়ে মাতৃমূর্তির চক্ষুদানের রীতিও ঠিক থেকে যাবে উত্তুরে হাওয়ার মতো। আত্মার আত্মীয়স্বজন ঘাটের দিকে পূর্বজদের নামে স্মৃতিতর্পণ করে। এও এক মিলন মুহূর্ত। জলের জীবন জলের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া পুনরায়। মন্ত্রে ও ভালোবাসায়। আমারও ভেতরে ভেতরে ভোরের চা-বাগান জুড়ে খেলা আর খেলা। চার্চের প্রেয়ার শান্ত করে শীতের বাতাস। মাহুতভাই কুনকি হাতির পিঠে চড়ে রাজার মতো পাতলা নদীর জল পার করে কোথায় যে হারিয়ে যায় ভোরের কুয়াশা ভেদ করে, দূর থেকে তার গান ভেসে আস— তোমরা গেলে কি আসিবে মোর মাহুত বন্ধুরে…