স্ম র ণ । পি না কী ঠা কু র
শিশুমন সহজ সরল নির্মল মসৃণ। কোথাও কোনো চড়াই-উতরাই নেই। যেভাবেই ছোঁয়া যায় সেভাবেই তারা সাড়া দেয়। এমন নমনীয় মনের ভিতর প্রবেশ করা খুব কি সহজ? যা নমনীয় যা তরল যা নির্মল তাকে স্পর্শ করা অতটাও সহজ নয়। কিন্তু শিশুমন একপ্রকার সারল্যের আধার, যেখানে আছে স্বাদ ও সাধের মিশ্রণ, ছেলেবেলার উদাসীনতা, প্রাঞ্জল দৌড়, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার ঔৎসুক্য। আর শিশু সাহিত্য সে এক অন্য পৃথিবী, সেখানে আলো আছে, জল আছে, রোদের মত উজ্জ্বল হাসি আছে, সর্বোপরি একটা গোটা ছেলেবেলার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লুকিয়ে আছে। তবে এইখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, শিশুমন ও শিশুসাহিত্য দুটোই একটি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। ছড়ানোছিটানো এমন একটি সরল মনের বিকাশ যে সাহিত্যের অপরিমেয় ভাষা তা বলাই বাহুল্য।
কবি পিনাকী ঠাকুর সেই শিশুমনকে ছোঁয়ার দূরহ কাজটি অতি অনায়াসে করেছেন তাঁর একটিই মাত্র ছড়ার বই ‘অঙ্কে যত ১০০ পেলে’-তে। তিনি তাঁর প্রতিটি রচনাতেই বলতে চেয়েছেন ছন্দে ছন্দে বালক-বালিকা বেলার স্রোতকে, নমনীয় উচ্চারণের মধ্যে গিয়ে খুঁজতে চেয়েছেন তাদের যাবতীয় সব প্রশ্ন ও সমাধান? হ্যাঁ, এটা একদিক থেকে ঠিক, তবে পুরোটা না, পুরোটা অর্থে, শুধু এটুকু না। তাঁর ছুঁতে চাওয়া অনেক বড়, তিনি এক ধাপে উপর থেকে নেমে এসেছেন নীচে। নামতে নামতে এসে পৌঁছেছেন শিশু মনের তলানিতে। তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন শিশু ও শিশুমনের সব দিকগুলো, অর্থাৎ আলো অন্ধকার জিজ্ঞাসা অনুসন্ধিৎসা ও অভিব্যক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ সব আকার ও চেতনা। কিন্তু শুধু খুঁজছেন ও খুঁজেছেন বললেই তো আমাদের দায় মুক্ত হয়ে যায় না, আমাদের দায় মুক্তি সেখানে যেখানে গিয়ে আমরা বুঝে উঠতে পারি কবি তাঁরও প্রাপ্তবয়স্ক মনটাকে শিশুক্রোড়ে কতটা লালন করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি কতটা জন্ম দিতে পেরেছেন বটের মতো একটি চারার, যার পরিধি মনের অনেক গভীরে গ্রথিত হয়েছে ‘শিশুসুলভ’ আকারে।
তবুও প্রশ্ন এখনও থাকে, ‘শিশুসুলভ-চারা’! সেটা আবার কী? ঠিক, একদমই ঠিক, শিশুসুলভ চারা আমার মতে তাঁর ভাবনাকে ছোঁয়ার জন্য অন্যতম একটা বড় উপমা বা হাতিয়ার যাই বলা হোক না কেন। এটা মাথায় রাখতে হবে শিশুমনকে একটা গাছের মতো জন্ম দিতে গিয়ে তিনি সার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংমিশ্রণকে আর জমি হিসাবে সাহিত্য। আর, সেই জমির পর জমি হেঁটে যাওয়ার জন্য যে আল প্রয়োজন ছিল, তাকে তিনি ‘ছড়া’ হিসাবে রূপ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, শিশুমন সহজ সরল ভঙ্গিতে সাহিত্য জুড়ে অবাধ গতিতে চরে বেড়াতে চাইলে তাকে তো আল হিসাবে একমাত্র ছড়াকে অবলম্বন করতে হবে বৈকি! ছড়ার মতো স্নিগ্ধ মধুর মসৃণ তরল আর কিছুই হয় না যে। তাই তো তিনি বারবার একবার ছুটে গেছেন রেলপথে, একবার শান্তিনিকেতনে, খাবারের রসে, আবার কখনও চাঁদের বাইরে অন্য কোনো গ্রহে কিংবা উপগ্রহে। তাই তাঁর ছড়া পড়লেই বোঝা যায় তাঁর লেখার প্রতি ধাপে ধাপে কীভাবে ফুটে উঠেছে ছেলেবেলার আবদার, রবিবারের ছুটি, স্কুলের শেষে বাঁধন মুক্তির ছুটির হুইসেল, কেক কাটার আনন্দ, আরও কত কী!
আমাদের আধুনিক সমাজে শিশু মন যেভাবে ডুবে থাকে ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ও পাশ্চাত্যের অনুকরণে, সেখান থেকে দাঁড়িয়ে তিনি শিশুমনের এই সংকীর্ণ-মনতার বিকাশের পথ এঁকে দিয়েছেন ছড়ায় ছড়ায়। তাই কি তিনি মিষ্টি করে বলেছিলেন- “তোদের যত চড়ুইভাতি, বাজনাবাদ্যি, নাচ/ আমি যেন একলা একটি কুর্চি ফুলের গাছ”? আবার কোথাও বলেছেন “মোবাইলে রিং শুনেছিস মোৎজার্ট, শ্যোঁপা, রবীন্দ্র/ ভোরবেলার দোয়েল যত কী যেন গায়? ও, ‘বৃন্দ’!” আবার “কোথাও সমুদ্র? না পাহাড় ভাল? কিংবা নলবন?/ উঁহু, সমন্বিতা যাবে শান্তিনিকেতন।” আসলে তিনি যেমন প্রশ্ন করেছেন খুঁজেছেন, আবার উত্তরও সমান তালে লিখে দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন একটা শিশুমনে প্রশান্তি ও বিকাশ গড়ে ওঠে প্রাকৃতিক নির্মলতার মধ্যে দিয়ে। তিনি তাই বারবার বুঝিয়েছেন শিশুমনের প্রসার সম্ভব রবিঠাকুর, আবোল তাবোল, জুল ভের্ন, একটা গোটা লাইব্রেরি ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে দিয়ে।
একজন শিশুর ভাষা চড়াই, শালিক, গাছের পাতা এরাই যে ভালো বোঝে তা বোঝা যায় কবির লেখা পড়লেই। আসলে, শিশু একটা রূপ, সেই রূপের অন্তরালে যেমন আছে প্রশ্ন, কৌতূহল, দিকশূন্য দৌড়, ঠিক তেমনি আছে কিছু একটা জিনিসের কোলে শুয়ে সমগ্র জগৎকে চোখের সামনে দেখা পাওয়ার তীব্র ইচ্ছে। তাদের মনে যেমন থাকবে ছুটি, যেমন থাকবে ভবিষ্যৎ, ঠিক তেমন থাকবে উন্মাদনা ও তেমনই থাকবে সমগ্র জগৎকে নিমেষে মুষ্টিবদ্ধ করার প্রয়াস। তাই তো কবি ছুটি এঁকেছেন সমুদ্রে নয় শান্তিনিকেতনে, ইস্কুল এঁকেছেন মেঘে নয় আগস্ট মাসে, জন্মদিনের উপহার এঁকেছেন বস্তুতে নয় চাঁদের পাহাড়ে, বই এঁকেছেন ম্যাপে নয় ব্যোমকেশে… আরও কত কী! কবি পিনাকী ঠাকুরকেই দেখলাম চিনলাম জানলাম, যিনি অবাধ গতিতে কি সুন্দরভাবে শিশুমনের ভিতরে একটা গর্ত খুঁজতে পেরেছেন, আঁকতে পেরেছেন একটা পৃথিবী।
ফ্রয়েডের মতে, মানুষ একটা soul হলেও তাদের একটা বিভাজন আছে, soul আর মানুষ আইডেন্টিফিকেশন করলে অভেদ এবং অ্যানালিসিস করলে সভেদ, ঠিক সেরকমই কবি পিনাকী ঠাকুর শিশুমন ও শিশুসাহিত্যকে ছড়ার মধ্যে দিয়ে সভেদ ও অভেদতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন সুন্দরভাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাঁর ‘বইপাগলি’, ‘ড্রাগন সিরিজ, চাঁদের পাহাড়’, ‘সিটি লাইটস’, ‘বন্ধু’, ‘ভিবজিওর’, ও ‘অঙ্কে যত ১০০ পেলে’ ইত্যাদি ছড়াগুলো যেন এক একটি শিশুমনের অবয়ব শুধু নয়, যেন শিশু-সাহিত্যের একটি অনির্বাণ নির্মাণ।
তাই, এই প্রবন্ধের একেবারে শেষে এটুকু স্বীকার করতেই হবে তাঁর (পিনাকী ঠাকুরের) ছড়ার বই ‘অঙ্কে যত ১০০ পেলে’ বইটি বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম একটা নিদর্শন বা পথ। যে পথ ধরে শুধু শিশুরা নয়; উঠে আসে শিশুমন তথা বিকাশের একটা সম্পূর্ণ দর্শন ও নিদর্শনের ইতিবৃত্ত।