স্ম র ণ । পি না কী ঠা কু র
সময়ের এমনই পরিহাসপ্রিয়-ক্ষণে এ-লেখায় হাত দিয়েছি; যখন তিনি নেই। এরকম অভাবিত নির্মম পরিস্থিতির চিন্তা দুঃস্বপ্নেও মাথায় আসেনি কোনোদিন। পিনাকীদার সঙ্গে প্রথম সেই পরিচয়ের পরে কম নয়; পেরিয়ে গেছে প্রায় চব্বিশ বছর। মানুষটার স্বাভাবিক সরল আকর্ষণে আলাপন গড়িয়ে বন্ধুতা। তারপর নিজস্ব নিয়মে সেই সখ্য কখনো গাঢ়-গভীর, কখনোবা বুঝি নিয়মিত যোগাযোগের ছন্দপতনে, কিছুটা হালকাও…। কিন্তু কাঁচা প্রাণের- মাটিতে মুগ্ধতার যে অমোঘ ছাপ ফেলেছিলেন তিনি-তার থেকে বেরোতে পারিনি আর। ভালোলাগার ঘোর হয়ত কাটবেও না শেষদিনতক।…
পিনাকীদার লেখা নিয়ে যৎসামান্য কিছু বলার আগে এটুকু ভূমিকা না- করলেই নয়। ঠাকুরের পূজা কি আবাহন বিনা শুরু হয়!… এখন তাহলে ফেরা যাক রচনার মূল-সুরে।… যে-কবিতাবই সম্পর্কে পাঠ-অনুভূতির অভিজ্ঞতা লিখছি, সেই বইখানি, ‘মৌসম’, তাঁর লেখা বইগুলির ভেতর, আমার অন্যতম প্রিয়। পিনাকীদার প্রায় সমস্ত কবিতাই, সেই শুরুর দিক থেকে শুরু ক’রে জীবনের তুচ্ছ প্রয়াসপথে বাতি-হাতে নিঃসীম দাঁড়িয়ে…। তাই তো বেঁচে-থাকা শক্ত মুঠোয় ধরেছে কবিতাকে…।
যে’ যে’ লক্ষণ, চিহ্ন এবং স্বাতন্ত্যের টুকরোগুলি আনখশির বিধে রয়েছে পিনাকী ঠাকুরের তাবৎ কবিতার শরীর-আত্মায়-কথনের নিজস্ব জাদুভঙ্গিমা, স্বরের অনির্দিষ্ট ওঠা-পড়া-পাঠককে যা বিমোহিত, বিহ্বল, স্তব্ধবাক ক’রে বসিয়ে-রাখে মায়াবী, কিন্তু ভীষণ বাস্তবের মাঠে-আর অপেক্ষায় থেকে-থেকে কখন যে বেলা বয়ে যায়…খেয়ালও থাকে না আর–গনগনে আর জ্যান্ত তেমনই লেখার-পর-লেখায় সাজানো ‘মৌসম’। হাত ঠেকালে তীব্র ছ্যাঁকা–সেই দহন, উদ্ভৃত সকল ফোস্কাও, ভরা আবেশমাখানো নেশারসে।… আমরা জানি, এই মাদকতার সৌরভ পিনাকীর কবিতাভূবন জুড়েই।… এই বইতে পিনাকী পাঠককে সঙ্গে নিয়ে একের-পর-এক বিস্ময়ের পর্দা সরিয়ে এগিয়েছেন, এবং অন্তে এসে হাট-ক’রে খুলে দিলে দেখতে পাই-ঘনিয়ে আছে শেষ-না-হওয়া অপার বিস্ময়ই…।
বরং একঝলক দৃষ্টি ফেলা যাক কবির লেখালেখির আড়ালের ভিয়েনঘরে। মূলত শহরতলি বা মফস্সলের নাগরিক-যন্ত্রণাকে পাটে পাটে মেলে ধরতে চান পিনাকী-সম্পূর্ণ ন্যাকামিবর্জিত তাঁর এই উন্মোচন। সেখানে জীবন জড়িয়ে থাকে বাঁচতে-চাওয়ার, চুম্বনের, সমুদয় ক্ষত নিয়ে; ক্ষতমুখ হয়ে। স্রষ্টার-সৃষ্টি একাকার হয়ে যায়।… আঘাত, যন্ত্রণা, নিবেদন, অনুরাগ-তীব্রতম উচ্চারণ নিয়ে উড়ে-আসে ঝাঁক বেঁধে…। কখনো সে “টোন” উচ্চকিত-অসহায় আস্ফালন-ভরা; কখনোবা স্বগতোক্তি, বিলাপের মতন শোনায়। কিন্তু এক আশ্চর্য ক্ষমতাবলে চিৎকারের মধ্যেও মেদুরতা ভরে দিতে জানেন পিনাকী। অব্যর্থ শব্দপ্রয়োগে ‘ম্যাজিক’ হয়ে যায়। অভিঘাতের প্রকাশেও শোনা যায় সমুচিত আত্মমগ্নতা।
অনুভূতির সর্ব স্তরে, সব মেজাজে এতটাই নিপুণ ও নিখুঁত পিনাকীর কবিকৃতি। তিনি যে শরীরে-মনে ‘টপ টু বটম’ এই-সময়ের-কবি। এই একুশ শতকের। তাই শব্দপ্রয়োগেও যথারীতি ছুমার্গ নেই কোনও। রকের ভাষা-মুখের ভাষাকে অবলীলায় এক ক’রে কবিতায় গেঁথে দেন। চলতি ইংরেজি-হিন্দি শব্দের যথাযথ, ঝকঝকে ব্যবহার। শব্দের খেলায় যে তিনি একজন সার্থক ‘জাগলার’ এব্যাপারে সন্দেহ নেই। দক্ষ-হাতের শব্দচয়ন এবং পংক্তিতে তার অনায়াস চলাচলে যে কত কত স্মরণযোগ্য কবিতা জন্ম নিয়েছে পাঠকমাত্রেই তা মনে করতে পারবেন। নব্বইইয়ের গোড়ায় আলোড়ন ফেলে অনেকেই এক অন্য-ভূখন্ডের সন্ধানকামী হয়েছিলেন; একথা বলতে দ্বিধা নেই, পিনাকীই সর্বপ্রথম খোলস ছিড়ে জলজ্যান্ত ‘স্মার্টনেস’ আনেন নিজের লেখায়। যে বকঝকে খজুতা সারাজীবন শিরদাঁড়ায় হয়ে থেকেছে তাঁর কবিতার। তাই তো বুকের একেবারে গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টসমূহকেও রঙচঙে সাবলীলতায় মুড়ে; অথচ দরদ দিয়ে, নিবিড় ক’রে বলার কৌশল অনায়াস রপ্ত তাঁর ।
‘মৌসম’ গ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ মোটামুটি তিনটি পর্বে বিভাজিত। এর মধ্যে শেষ পর্বের (বাংলার ব-দ্বীপ) কবিতাগুলি আঙ্গিকে-আবেদনে বাকিদের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন-ধর্মীয়; এই স্তরের লেখার ‘ফ্লেভার’ যে সম্পূর্ণ আলাদা-তাতে সংশয় নেই। সে-কথায় পরে আসবো। এখন বইয়ের বাকি-অংশের কবিতায় চোখ ফেলা যাক। ‘মৌসম’-এর প্রথম দুটি পর্বের প্রায় সমস্ত লেখাতেই মূর্ত, বাঙময় হয়ে-রয়েছে ‘প্রেম’। সেই প্রেম-যা একেবারেই পিনাকীর নিজস্ব ঘরানার; স্বকীয় এক-অনবদ্য স্টাইলের শিল্পিত লিপিরূপ। এসব কবিতা-লাইন কেউ না বলে দিলেও, শুধুমাত্র কানে শুনেই চিনে নেওয়া যায়-পিনাকী ঠাকুরের লেখা। বলা-য় এই ঐকান্তিক জোর; চলা-য় এই বিশিষ্ট ধরন-কারোরই হতে পারে না এইসব কুহক-পঙক্তি…। পিনাকীর ‘সিগনেচার স্টাইলাইজেশন’ এমনই। অদ্বিতীয় এবং অনন্য। একটি লেখার ছিন্ন অংশ তুলে দিচ্ছি-
“শিউরে ওঠে লোহার মতন সর্পফণা
জাগছে, ওহো, জেগে ওঠার কী যন্ত্রণা
এবার কিন্তু উগরে দেবে বিষের ঝলক…
আঃ পারছিনা, দু ঠোঁট দিয়ে বিষ তুলে নাও,
আদর করো!”
(বেদেনি)
প্যাশনের এই উদ্দাম তীব্রতাই পিনাকীর প্রেম-আকুল-করা, লন্ডভন্ড, ছিড়ে-খুঁড়ে দেওয়ার পাগলামি; উ্থালপাথাল আবেগনির্ভর- ভয় পায় না ধ্বংসকেও। জ্বলে এবং জ্বালায়। পুড়তে পুড়তে নির্মাণ করে প্রতিটি অক্ষর।…পিনাকী ঠাকুরের প্যাশন আদ্যোপান্ত রক্তমাংসময়।
প্রতি মুহূর্তে ছটফটাতে-থাকা ক্ষরণ-প্রক্রিয়ার ভাষ্যরূপ। একচুল দূরে থাকতে না-পারা, না-চাওয়া, একবুক তেষ্টা নিয়ে মিলন-সম্ভবে ঝাঁপ দিয়ে তলিয়ে-যাওয়া এবং নিষ্ফল এই শূন্য মুহূর্তের ধারা-বিবরণ…। শিল্পসম্মত কিন্তু গতিময়। যাকে ধরা যায় না, ধারণ করা যায় না-পিনাকীর প্রেম-সবকিছুর উর্ধে সেই ঘুরতে-থাকা অগ্নিগোলক যা’ সারাজীবন কবিকে তাড়িয়ে ফিরেছে-লিখিয়ে নিয়েছে অসহ যন্ত্রণাদগ্ধ নান্দনিক পংক্তিমালা। যেকোনো কবির ভান্ডারে তা’ সম্পদবিশেষ। এখানে বলা বাহুল্য, বিরহের কবিতাতেও তিনি একইরকম অস্থির, ছটফটে, বেগবান। সে-সমস্ত কবিতার ক্ষুরধার শব্দে হাত ঠেকালে হাত কেটে যায়। রক্ত পড়তে থাকে। বুকের অতল থেকে, স্নায়ুর কুয়াশা থেকে উৎসারিত অক্ষরেরা ক্রমাগত বিদ্ধ করে।… আর অজ্ঞাতেই কখন যেন অংশভাক হয়ে-ওঠি কবিতাটির। পিনাকী ঠিক সচেতনভাবে করেন না, নিজেকে নিয়ে খেলতে খেলতে, খুঁড়তে খুঁড়তে, ব্যথার সূচিমুখগুলি খুলে দিয়ে অজান্তেই পাঠককে টেনে নেন কবিতা-শরীরে।
“বলতে পারিনি তাই অত চাপ জমতে জমতে
একদিন বিস্ফারিত হয়ে গেছি নিজে!
হাত-পা কোথায়? বডি ছিন্নভিন্ন, লাল…
মানববোমার ছবি টিভিতে দেখেছ?
শুধু দুটো চোখ আর চারটে চোখের পাতা
এতদিন পরে এসে চেয়ারে বসেছে।
তুমি ভাবছ পুরো লোকটা তোমার সামনেই
আসলে চোখদুটো জ্যান্ত, শরীরটা নকল” ।
(বিস্ফোরণ)
জমে-থাকা আবেগের বিস্ফোরণ এবং যেন বা মন্ত্রপাঠের আচ্ছন্নতায় পাঠককে ডেকে নেওয়া-র মত অযুত কবিতা-পুঙক্তি ‘মৌসম’-এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে। হয়ত পিনাকীর জীবনেই মজুত ছিল এতসব বিস্ফোটক-যেগুলি কবিতায় ফেটে-পড়ে অদ্ভুত নরম আলো দেয়…। এখানে লক্ষ্যনীয়, ধ্বংসের রিঅ্যাকশনেও কলম কত শান্ত ও পেলব।
একথা সবাই জানি, একজন কবি গোটা জীবৎকাল জুড়ে আত্মকথনেরই পুননির্মাণ করেন। কবিতা, কবির জীবনেরই খন্ড, অংশবিশেষ। পিনাকী ঠাকুরও বোধহয় সমগ্র-রচনার ক্যানভাসে আত্মজীবনীরই বিন্যাস এঁকেছেন। কখনও লাইনগুলি ভাঙা-চোরা, অস্পষ্ট, প্রায় বিমূর্ত; কখনো আবার ফুটে নির্দিষ্ট আদল, আকারের চেহারায়। সেখান থেকে কবিজীবনের একান্ত টুকরো রেখা জুড়ে-জুড়ে খুঁজতে অসুবিধে হয় না পাঠকের।… পিনাকীর কবিতায় সে-জীবন কীরকম?… মফস্সলে বেড়ে-ওঠা এক যুবকের হতাশা, মাথার ওপর থেকে ছাত সরে-যাওয়ার অসহায়তা, ব্যর্থ কৈশোর, যৌবনের অপচয়, পরিবারকে কেবলমাত্র টিকিয়ে-রাখার নাছোড় লড়াই, নির্মম সময়াঘাতে কোণঠাসা হয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, ভাঙা প্রেম, অমোঘ বিরহ, ভালোবাসায় আকুল শুন্য করতল পেতে-রাখা, যৌন-তাড়না, নস্টালজিয়া, নিয়ত অস্তিত্ব-সংকট-এবং, এতদ্সত্তেও, জীবনের খাঁজখোঁজ থেকে উড়ে-আসা অতি তুচ্ছ বিস্ময়-প্রাপ্তিকেও আগলে রাখার মমতা। হ্যাঁ, পিনাকীর কবিতা শেষপর্যন্ত জীবনে থিতু হতেই শেখায়। এ তাঁর অপার দক্ষতা। লেখার পরতে পরতে তাঁর দিনযাপন কীভাবে ছায়া ফেলেছে-_তা অধিকাংশ কবিতায় চোখ বোলালেই বোঝা যাবে।
“তোমার পেছনে ছুটছে খাকি পুলিশ আর সাদা পুলিশ। সামনে
টাকার চিন্তা। মা বোন বান্ধবী
সবার অভিযোগের পর অভিযোগ।
কতদিন কবিতা লেখনি তুমি, নিজের রোগা বইগুলো
এখন তোমারই কবর, সেখানে আগাছা জন্মাচ্ছে!
সব ট্রেন চলে গেল, বাস নেই একটাও, এই পৃথিবীর
প্রায় কিছুই না দেখে তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে
সবার চোখের আড়ালে
কেউ জিগ্যেশ করল না আজ তোমার খাওয়া
হয়েছে কি না”…
(সন্ত্রাসবাদী, রোমিও)
“এখন আর একটুও সময় নেই আমার জন্য তোর
দুজনের আকাশে একই মেঘ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে আজও
কোন্ পাতাল আমাকে গিলে খাচ্ছে মৃত সেই গহবর
আবছা অন্ধকারে আমি মরে গেছি একেবারে নিঃশব্দে”
(গহ্বর অথবা পুরনো শার্টের বোতাম)
‘মৌসম’-এর পরপর দুটি পাতায়-থাকা দুটি কবিতার কিয়দংশ পরস্পর তুলে দিলাম। পাঠক খেয়াল করুন, প্রথম লেখাটিতে কষ্ট-অভিমান-বিপন্নতার ভাষা কতটা নীচু, অনুচ্চ। বুকফাটা হাহাকারকেও আশ্চর্য সংযমে “লো পিচড টোনে” ব্যক্ত করছেন। মনে হতে পারে, এ শুধু সময় বা ব্যক্তিবিশেষের উদ্দেশে বলা নয়, হয়তবা নিজের সঙ্গেই কথা-বলে-চলা। নিজেকেই জানানো অবহেলা আর অনাদরের ব্যপ্ত সমস্ত শূণ্যতা…। এই ভয়ংকর উপেক্ষার বিবৃতি শুনতে শুনতে বারংবার বুক কাঁপে। গায়ে কাঁটা দেয়। অথচ কবি উদাসীনভাবে যেন বা নিয়তিরই স্বরে একটানা বলে চলেন..। এ বড় অবাক-করা সিদ্ধি।
পরবর্তী লেখাটিতেও স্বল্প কথায় মুখর হয়ে আছে বিচ্ছেদ। বিরহের কবিতা অথচ অদ্ভুত রকম শান্ত, নির্লিপ্ত। কোনও বিচলন নেই। চাতুরি নেই। কবি যেন গভীর সংহত-বোধে লীন। অথচ বিরহের রঙে পাঠকের মর্মমূল রঙিন হয় ছলনাহীন সরলতায়। আসলে এই সহজতা পিনাকীর সহজাত। কোনও ভাণ-ভণিতা বা ‘গিমিক’ জানে না এরা…। পাঠক ইতিমধ্যেই, লেখা দুটিতে গহন-হ’তে উঠে-আসা মৃত্যুবোধকে শনাক্ত করেছেন। পিনাকীর কলমে এখানে মৃত্যবোধও ভিন্ন মাত্রা খুঁজে পেয়েছে। আমরা নীল হয়ে যাই কবির বিষাদে।
আরও একটি প্রেমের কবিতার টুকরো মেলে ধরব আবার-
“জীবন, বাঁচার নেশা, তুলে ধরছি-বন্ধনে জড়াও!
টবে ফোটা জুঁইফুলে বিবাহরাতের হাহাকার…
তুমিও নেশার ঘোরে অন্ধকার ছাদে ঝুঁকে হঠাৎ তাকিয়ে
দেখলে সাইকেল-চড়া রোগা কালো মাথানিচু তাকে
যার প্রেম পরিত্যক্ত, যে জীবন বিষের জ্বালায়
জ্বলে পুড়ে অসহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর
পাহাড়ি খাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে-তাকে তুমি
ঝড়ের বাতাস আর পাতার মর্মর থেকে পাখির গলায়
আর একবার ডাক দাও : “ও পাগল, একটা কথা শোন্!”
(মৌসম)
কিচ্ছুটি বলার নেই। একেবারে “স্পেল বাইন্ডিং, তাই না? সমস্ত জীবন-ক্লেশের অতীত যে মধূ-সন্ধান করে ফিরেছে এই কবিতা; একেবারে শেষের আর্তি-ডাকে পেয়েও গিয়েছে তা’! শেষ পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে কবি বড় মিষ্টি ক’রে ডাক দিয়েছেন প্রেমিকাকে। হয়ত অনুযোগ, কিন্তু মধুর। সত্যি, কী মিষ্টি, কী জাতপ্রেমিক, কত নির্ভার, এই কবিতাখানি! জীবনের শতেক দহন-জ্বালায় ঠান্ডা হাতের প্রলেপ ছড়ায়। শাশ্বত উপশম বয়ে আনে এই প্রেম। অস্তির পথে আরও দুপা এগিয়ে দেন কবি। এই নামকবিতার আপাদমস্তক-জুড়ে প্রতিটি অক্ষরের পিছনে শিশিরের মত ক্লিপ্ধ হয়ে আছে- আনন্দ । সকল যুক্তি-ব্যাখ্যার বাইরে সে আনন্দ প্রগাঢ়, বন্ধনহীন।… কবিতাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেগে-আছে প্রথমপ্রেমের ব্যথাসুখ, কৈশোরের দুরপনেয় মায়া…। এ-লেখা নিজেই নিজেকে ধারণ করেছে অসম্ভব অবিশ্বাস্যতায়। এই হিপনোটিক-স্টাইল এক ও একমাত্র পিনাকী ঠাকুরের কলম-সঞ্জাত।
যতি টানার আগে আরও দু-একটা বিষয় না-বললেই নয়। রম্যচেতনা, হিউমার ও শ্লেষ পিনাকীর কবিতাসমগ্রের জায়গায় জায়গায় মণি-মুক্তোর মত ঝিকিয়ে ওঠে। অনাবিল হাস্য ও তির্যক ব্যঙ্গ–দুটি প্রকারভেদই তাঁর করতলধৃত। আর অবশ্যই উল্লেখনীয়, পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা। জীবনকে, তার চারপাশকে ও বিভিন্ন মানুষজনকে, ছেঁকে কবিতায় তুলে আনতে জুড়ি নেই তাঁর। দেখার চোখেই শিল্পে অনুদিত হয়ে যায় তারা…। একটিমাত্র লেখায় চোখ রাখলেই বোঝা
যাবে।
“ইন্দ্রজিতের ব্যাচিলর মামু মেয়ে পটানোর রাইমস লিখত !
তখনও দাঙ্গা, তখনও জখম, খুন, রেপ, কেস, স্ট্রাইক, ঘেরাও-
………………………………………………………………………………
………………………………………………………………………………
অফিস-ফাইলে, ক্লাব ম্যাগাজিনে ইন্দ্রজিতের সেই কবি-মামা
প্রেমের পদ্য লিখছে কেবল, তাছাড়া শুনেছি আস্ত নভেলও!
যেই একটুস কবি-কবি নাম, ‘প্রেম’, ‘নিসর্গ’, ‘সামাজিক ন্যায়’…
তার পরে ভাই, যা হয় আর কি, পেছনে ঢুকলো গোটা হনুমান!
এ বলে আহা রে’, ও বলে ‘এবার?’
তারপরও মামু, কী বলব তোকে, মেয়ে পটানোর…হো হো হি হি ও!”
(২০৫৯)
রঙ্গ-ব্যঙ্গের চূড়ান্ত পারফেকশান !… এবং একেবারে শেষে এসে কী এক চরম গতির ভরে নিজেকেই ছাপিয়ে বেরিয়ে গেল কবিতাটি।…বহু লেখার শেষে পৌঁছতে পৌঁছতে পিনাকী এরকম আকম্মিক ‘স্পীড’ জুড়ে দেন; লেখাটি নিমেষে সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম-করে যেন বা পাখায় ভর-দিয়ে উড়ে বেরিয়ে-যায় নাগালের বাইরে। মাথার ভিতরে শুধু রিনরিন করতে-থাকে তার ঝাপটার মুগ্ধতা।…
‘মৌসম’ বইটির অন্তিম পর্ব হল ‘বাংলার ব-দ্বীপ’। এই পর্বে আবহমান বাংলার সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের ‘রি-ক্রিয়েট’ করতে (তাঁর মুখেই শুনেছিলাম শব্দটি) বেশ কিছু লেখায় সাধৃভাষা বা তৎসম শব্দের ছদ্মবেশ পরেছেন কবি। ইতিপূর্বে এই ফরম্যাটে-লেখা তাঁর বেশ কিছু কবিতা অতীব জনপ্রিয়। অন্যন্য বইতে সেগুলি আছে। এবং মুখেমুখেও ফিরেছে একসময়ে। যাই হোক, এই পর্যায়ে তরতরে চলিত-গদ্যভাষার একখানি সম্পূর্ণ কবিতা উদ্ধৃত করে আমার লেখা শেষ করব।
“আমি তোমাদের সেই নবকুমার। কী, মনে পড়ছে?
রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, বাঘের ডাক শুনতে শুনতে
তোমাদের জন্যই আমি কাঠ কেটে চলেছি।
কত রাত, সপ্তাহ, মাস, কত বছর আমার
মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। পুরো একটা দশক।
একটা শতক আর সহস্রাব্দ কেটে গেল কোথায়!
বাঘের ডাক। মশার কামড়। আমার কাঠ কাটার শব্দ
তোমরা শুনতে পাচ্ছ না? নিশ্চিন্তে মেলা দেখে
পাড়ায় রটিয়ে দিচ্ছ আমাকে খেয়ে ফেলেছেন বড় মিঞা?
অথচ তোমাদের রান্নার কাঠ আমি একাই
কেটে চলেছি। এডিশনের পর এডিশন হচ্ছে কপালকুন্ডলার।
হ্যাঁ, বইয়ে যখন লেখা, নায়িকার সঙ্গে একদিন
তরঙ্গে ঝাঁপ দেবো ঠিকই। কাপালিকটা রেগে যাবে।
কিন্তু তোমাদের এত হিংসে কেন ভাই?
আমি তো একেবারে মরেই গেছি, তাই না !
(সাগরসঙ্গমে নবকুমার)
…কোনও কথা হবে না। উৎসুক পাঠকমাত্রেই টের পাচ্ছেন তো, মৌসমের বাঁঝ? স্নায়ুর চারপাশে কিলবিল করছে না অক্ষরগুলো ?… হ্যাঁ, এই ‘মৌসম’ রক্তমাংসের। ব্যর্থতার। প্রেম ও ঘেন্নার। জীবনের।…এবং ‘মৌসম’ মানেই তো অনিশ্চিত…। ‘আনপ্রেডিক্টেবল’…। তাকে ‘ট্র্যাক’ করে সাধ্য কার!
*লেখাটি ‘দাঁড়াবার জায়গা’ পত্রিকার পিনাকী ঠাকুর সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হল।