স্ম র ণ । পি না কী ঠা কু র
জানুয়ারি তিন মানেই মনখারাপের দিন। কিচ্ছুটি ভালো না লাগার দিন। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন লগবগে সাইকেল নিয়ে ডানলপ গেট পেরিয়ে বাঁশবেড়িয়ে এসে কিছুটা গিয়েই বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে এ মোড় সে মোড় পেরিয়ে দু তলা বাড়ির নিচের থেকে হাঁক মেরে ওপরে তাকাতেই, যে মানুষটি এসে দাঁড়ালেন তিনিই হলেন আমাদের কবি পিনাকী ঠাকুর। বিস্ময় শেষ হতে না হতেই ডাক ,আরে এসো, ওপরে চলে এসো। কবির ঘরের দিকে গুটি গুটি এগিয়ে যাওয়া। চেনা নেই,জানা নেই, দেখা নেই। শুধুই শোনা।
সেই সেদিন যে গল্পের শুরু হয়েছিল তাঁর চলে যাওয়ার দিন পাঁচেক আগে পর্যন্ত সে গল্প চলে ছিল। সম্পর্কের কত বাঁক কত অভিমান! সম্পর্ক বোধহয় এমনিই হয় । চড়াই উৎরাই সম্পর্কের ভিত শক্ত করে কিনা জানি না কিন্তু একটা অনুভবি অবস্থান তৈরি করে দেয়। এই সম্পর্কের সমীকরণ বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা বেশ মুশকিল। ‘একদিন অশরীরী’ র প্রকাশের দিনগুলির কথা আজ বেশি মনে পড়ছে। কবির চেয়ে কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে আমরাই যেন বেশিই উত্তেজিত। কারণ কবিযে আমাদের, একান্ত আমাদেরই। তাঁর সাফল্য ব্যর্থতা তো আমাদেরই। অথবা ‘অংকে যত শূন্য পেলে’ এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়েও কী আমরা কম উত্তেজিত ছিলাম! রোজ বই আনছি কলকাতা থেকে আর সে বই নিমেষে উবে যাচ্ছে। সে এক রূপকথা সময়। অথবা আমাদের কবি কণ্ঠে ক্যাসেট তৈরি করার পরিকল্পনার দিনগুলি। অথবা কৃত্তিবাস পুরস্কার পাওয়ার সন্ধ্যেটি। ওই রকম আলো করা সন্ধ্যে আমাদের মফস্বলি জীবনে কম এসেছে বলেই মনে হয়। কবি আমাদের । এ কবি কে ছেড়ে দিতে বড়ো ভয়। বড়ো উৎকণ্ঠা। বড়ো শঙ্কা। পিনাকীদা তো নিজের মতো করে কবিতাই তো লিখতে চেয়েছেন। সব হাতছানি কে দূরে সরিয়ে কবিতাতে মনোনিবেশ করেছেন। গদ্য যে খুব একটা লিখতে চেয়েছেন এমন নয়। কিছুটা চাপে বা কিছুটা অনুরোধে গল্প দু একটি উপন্যাস আর কিছু গদ্য। গল্পগুলি নিয়ে আমাদের প্রকাশনার শুরুতে আমরা একটা বই করেছিলাম ‘রোম্যান্টিক’।
হঠাৎ ই শুনলাম আমাদের বন্ধু ভাস্করের বাড়ি দু চার দিন পিনাকী দা থাকবেন। কেন কি এসব আমরা প্রশ্ন করি নি এই কারণে, ভাস্কর এর সাথে পিনাকী দা কবিতা নিয়ে নানান আলোচনা করতেন। ভাস্কর ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। যে কোনো কবিতা ভাস্কর খুব ভালো বুঝত। এবং চমৎকার বিশ্লেষণ করতে পারত। আমার তো মনে হয় ভাস্কর পিনাকীদার কবিতা যে ভাবে বুঝতে পারতো সে ভাবে খুব কম জন আছেন বুঝতে পারতো।
কিছুদিন পরে জানা গেল পিনাকীদা ভাস্করের বাড়িতে একটি উপন্যাস লেখার জন্য ছিলেন। তারপর তো ইতিহাস। আনন্দলোক এ প্রকাশিত হয়েছিল উপন্যাস টি ‘কলঙ্করচনা’।
এমন মায়াবী উপন্যাস খুব একটা পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তারপর ও আরো দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন। একটা সরাসরি বই হয়েছিল অন্যটি শারদীয়া পত্রিকা তে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কলঙ্ক রচনা’ ও ‘ক্যাকটাস’ আমরা পরম্পরা প্রকাশ করে ছিলাম। ‘অকাল বসন্ত’, ‘কম দামের যৌবন’ আনন্দ। ‘ কম দামের যৌবন ‘ অপ্রকাশিত উপন্যাস ছিল।এই সেদিন শুনলাম ‘ তখনও দেওয়ালে চেয়ারম্যান’ নামে একটি উপন্যাস নাকি লিখে গিয়েছিলেন। সেটা এবার বইমেলাতে প্রকাশিত হবে।তার মানে এবারও বইমেলাতে নতুন বই নিয়ে পিনাকী দা আছেন। গদ্যের বই বলতে এই কটিই। কিন্তু এই কটি গদ্যেই পিনাকীদা জাত চিনিয়ে ছিলেন। ওই যে আগেই বলেছিলাম গদ্য খুব একটা লিখতে চাইতেন না। পিনাকীদার বিশ্বাস ছিল গদ্য বেশি লিখলে কবিতা হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। দিনের পর দিন কবিতা হয়তো আসে নি , কিন্তু গদ্যও লেখেন নি। অপেক্ষা করছেন। ধৈয্য ধরেছেন। আবার যখন কবিতা এসেছে তখন সময় নষ্ট করেননি লিখে গেছেন। বার বার বলতেন আমার হাতে অনেক সময় নেই।
গল্প উপন্যাসের বাইরে দু একটি ফিচার বা বইয়ের আলোচনা করেছেন। দু একটা অন্যরকম গদ্য নিয়ে আমরা একটা বই করেছিলাম ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। কী ছিলো তাঁর গদ্যে যা নিজেই গদ্যের উপমা হয়ে গেল অনায়াসে? কী সেই অমোঘ আকর্ষণ যা আমাদেরকে তাঁর গদ্যের সামনে বার বার দাঁড় করিয়ে দেয়?
আসলে গল্পগুলি ও উপন্যাস পাঠ করলেই বোঝা যায় সহজ সরল এক আশ্চর্য সাবলীলতা জড়িয়ে আছে গল্পের কথায়, কাহিনীর পরতে পরতে যা সহজেই পাঠক কে লেখাটি সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলছে। কোথাও কোনো জটিলতা নেই। অকারণে বাক্যের জটিলতা নেই। দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগে ঘোরতর আপত্তি ছিলো তাঁর। একটি ম্যাজিক্যাল গদ্য যেন ! পিনাকীদার গদ্য পড়তে পড়তে ক্রমশঃ সেই গদ্যের প্রেমে পড়ে যাওয়া।
মূলত গল্প উপন্যাসে ভালোবাসার কথাই বলতে চেয়েছেন। ছবি এঁকেছেন মানবিক সম্পর্কের। মাঝে মাঝে নিজের কারখানা জীবন, আশাহত জীবনের কথা শুনিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ব্যক্তিগত ঘটনা কে বিশেষ প্রশ্রয় দিতে চান নি। নারী পুরুষের চিরকালীন প্রেম ভালোবাসার নানা টানাপোড়েন তার অবাক বাঁক উপজীব্য হয়েছে । প্রয়োজনে যৌনতা আর তার অনন্য প্রয়োগ গল্প ও উপন্যাস কে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আমরা যারা তাঁর নিবিষ্ট পাঠক তাঁরা গদ্যে এখনো বুঁদ হয়ে থাকি। যে টুকু গদ্য লিখেছেন সে টুকুতেই ভরিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের প্রতিদিনের চলার পথে শূন্য পাওয়ার তো কমতি নেই। কাজে,অকাজে প্রেমে,বিশ্বাসে শূন্য এসে বসে পড়ে,মন ভার হয়ে যায়। তখন অমোঘ ঔষধি তো আছেন আমাদের কাছের কবি, আত্মার আত্মীয় কবি পিনাকী ঠাকুরে অনন্য সাধারণ কবিতা।