গ ল্প
১
ছোটোবেলায় কোনো পরীক্ষায় নম্বর কম পেলেই বাংলা খাতার পিছনের পাতায় আত্মজীবনী লিখতে বসে যেতাম। তখনই জমা হয়ে গেছে বেশ কিছু স্মৃতি। না, ঠিক নিজের স্মৃতি নয়। বাবার মুখ থেকে শোনা কিছু ঘটনা। তার সত্যি-মিথ্যের হদিশ নেই। হয়তো সত্যি-মিথ্যে নেইও। সব কিছুর তো শুধুই সত্যি-মিথ্যে হয় না। কিছু কিছু ঘটনায় সত্যি-মিথ্যে এমন জড়িয়ে থাকে যে একজনকে অপরের থেকে আলাদা করা যায় না। আবার কিছু ঘটনা কারো কল্পনায় সত্যি, কারো কাছে একগলা গঙ্গা জলেও মিথ্যে। কারো কাছে শুধুই ঘটনা; সত্যি-মিথ্যে কিচ্ছু না। কারো কাছে সত্যি-মিথ্যের অনেক ওপরে জীবনের সবচেয়ে বড়ো সঞ্চয়। সেই সঞ্চয় অবশ্য তখনও হতে বহু বাকি। তখন তো বাবার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতাম। তাই বাবা যা বলে, যেমন বলে সেটাই সত্যি।
অবশ্য বাবার স্মৃতির পথ খুব বেশিদিন আলো-আঁধার আটকাতে পারেনি। কারণ তাতে বাবার আলো-আঁধার মিশে গেছিল। যা হয় আর পাঁচজন সাধারণের, ঠিক তেমনই। বাবা তো অসাধারণ কেউ ছিল না। বাবাতে কোনো মুগ্ধতা ছিল না। ছিল একধরণের কষ্ট, বঞ্চিতের কষ্ট, ছিল মন কেমন করা চিনচিনে ব্যথা! কেমন হেরে যাওয়া মানুষের অসহায়তা। না, তাও ছিল না। ছিল হয়তো রগচটা একটা মানুষ, কর্মবিমুখ, নিয়তির নির্মম পাশার দান! অথবা তাও নয়; ছিল চূড়ান্ত মনখারাপের অসুখে ভুগতে থাকা একটা ব্যর্থ মানুষ। এসবই ছিল বাবা। আবার এসবই ছিল না। আমি সেই হাঁ করা ছোটোবেলায় বাবার ব্যর্থতাটুকুই নিয়েছিলাম। হয়তো বাবা-ই সেসব ইনজেক্ট করে দিয়েছিল আমার মধ্যে; আমার সহানুভূতিটুকু আদায়ের জন্য। পাশার দানে তখন আমিও মোহরা।
অথচ মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছুই কি ছিল না তোমার বাবা!! গান, ছবি আঁকা, সেলাই-ফোঁড়াই, পড়ানো কত কীই তো তোমার ভাঁড়ারে ছিল। কিন্তু সেসবের প্রতি না ছিল তোমার সম্মানবোধ, না আর কারো! টাকার অঙ্কে যেখানে যোগ্যতা মাপা হয় সেখানে এসব সুচারুতার কোনো মূল্য নেই। এসবের ফাঁসে পড়ে মা’র মুগ্ধতাটুকুও তুমি নষ্ট করে ফেললে। আর নষ্ট করলে আমার সারল্য।
সে সময় তুমি ছিলে আমার জগৎ; সাইকেলে করে তোমার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে জানতাম তোমার জীবনের কথা। ওই পাঁচ-ছ’ বছরেই তোমার ব্যর্থতার ভার আমি নিয়েছিলাম; পাঁচ বছরের কাঁধে পঁয়ত্রিশ বছরের দায়। কিন্ত সে দায় আমায় নির্মাণ করতে পারেনি। কারণ তাতে মিশে ছিল ঈর্ষা, হীনমন্যাতাবোধ; তাই তা কেবল শত্রু বৃদ্ধি করেছে। কোনো ইতিবাচকতায় পৌঁছে দেয়নি আমাকে। বরং মা’র ব্যর্থতা নির্মাণ করেছে আমায়। মা’র পড়াশোনায় প্রবল আগ্রহ অথচ একান্নবর্তী পরিবার কাঠামোয় যত্ন না পাওয়ার কষ্ট মাকে আমার প্রতি আরো বেশি সচেতন করে তুলেছে। মা’র জীবন অভিজ্ঞতা আমাকে গড়ে তুলেছে। হতে পারে তার পরিসর খুব ছোটো; ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র; তবু তা জীবনের বড়ো প্রেক্ষিতে আমাকে দাঁড় করিয়েছে।
পাশের বন্ধুটি যে অনেকক্ষণ থেকেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে খেয়াল করিনি। অফ পিরিয়ডে শেষ পাতায় মন দিয়ে কি এতো লিখছি তা নিয়ে কৌতুহল। ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে ঠাঁই কোনোদিনই ছিল না। প্রথম পাঁচের মধ্যে টেনেটুনে। সে সময় সেটুকুও আর হচ্ছে না। ততদিনে যে তলিয়ে যাচ্ছি, জানব কি করে! এই কথাটা যে এই লেখায় কতবার লিখতে হবে জানি না। জীবনে কতবার যে তলিয়ে গেলাম আর হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠলাম! সব থেকে মজা যখন একই সঙ্গে শীর্ষেও থাকলাম, একই সঙ্গে স্রোতহীন তলদেশে। এমনটাই জীবনের শেষতম স্ট্যাটাস। না না, আত্মহত্যা করছি মনে করবেন না। কিন্তু একটা সময়ের পর জীবন থেমে যায়! হয়তো সবার হয় না। আমার হয়েছে। জীবন থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই। যা হারিয়ে গেছে তা ফিরে আসবে না। মা বলে যা হারিয়েছে ভাবছিস, তা কোনোদিন তোর ছিলই না। তবু তার জন্যই তো কত লড়াই। লড়াই করে বাবার ব্যর্থতা মোছা গেল! আর নিজের ব্যর্থতা! যা হোক, যা হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কিত দিন কাটিয়েছি, তা হারিয়েই গেছে। আর যা পাওয়ার ছিল তাও শেষ। তাই এবার শুধু নিঃশ্বাস নিয়ে যাওয়া; নিঃশ্বাস নিতে হয় বলে কাজ করে যাওয়া; নইলে জীবনের আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
এই দেখুন কোন কথা থেকে কোথায়! পাশের বন্ধু আত্মজীবনীর পাতায় ওদিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! ধরেও ফেলল শেষপর্যন্ত। ক্লাসশুদ্ধ সবাইকে বলে দিল। হাসতে হাসতে, হেসে হেসে দুলতে দুলতে প্রবল হাসি চাপতে চাপতে বোকা বোকা বন্ধুর ক্যাবলামির কথা। ব্যস, হয়ে গেল। আমি ঢুকে পড়লাম শামুকের খোলসে। এরকমই আমি, শামুকের মতো, সবসময় কেমন ভয় ভয়! কিম্বা কেন্নোর মতো! আঙুল ছোঁয়ালেই গুটিয়ে ছোট্ট। জানি শামুক আর কচ্ছপের পার্থক্য আভিজাত্যে। তবু কচ্ছপ হওয়াও শিরদাঁড়ায় লেখা নেই। তাই তখনই বন্ধ করেছিলাম আত্মজীবনী লেখা। আজ জীবনের প্রায় মধ্য পর্বে এসে আবার বসেছি। যদিও কী যে লিখতে চাই নিজেই জানিনা। ভ্যাড়ভ্যাড় করে ঘটনা বলে যাওয়ার মধ্যে মনের কোনো তৃপ্তি নেই। বলতে চাই সূক্ষ্ম কোনো বোধের কথা; জীবনবোধ বলতেই পারেন। কিন্তু জীবনটাকে এভাবে না দেখাই ভালো। তাতে নিজেকেই বেশি যন্ত্রণা দেওয়া হয়। খুব আফশোস হয় জানেন, মনে হয় এমন কোনো ঐতিহ্যকে যদি বহন করতে পারতাম যার অনেক রকম স্তরায়ণ আছে, রূপক আছে, সরু তারে বাঁধা আছে জীবনশৈলী। তাহলে খুব ভালো হতো। সেই ঐতিহ্যের কথাই লিখতাম। সাধারণের মধ্যেও যা সাধারণ, তার কথার কী মূল্য! তবু কেন যে লিখতে হয়! শুধু কি নিজের কথা জানানো! নিজেকে জাস্টিফাই করার জন্য! জানিনা। শুধু জানি জীবন একঘেয়ে হয়ে উঠলে নিজেকে ভোলাতে হয়। তারই উদ্যোগ।
২
কী মনে হচ্ছে??
এই নিয়ে ক’টা ভূমিকা লিখলি??
সম্বোধির মুখটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছোট হয়ে গেল। পরক্ষণেই ভীষণ কনফিউজড হয়ে বলে উঠল, এতো সংশয়ে ভুগছি কেন বল তো??
সেটাই তো আমিও জানতে চাইছি! বললাম বটে, তবে মনে মনে সম্বোধির সংশয়ের জায়গাটার একটা আন্দাজ করতে পারি আমি! এমনিতেই মেয়েটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো; ওর জীবনের কথা লিখলে সে বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়বে বই কমবে না!
ঠিক সংশয় নয় জানিস! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কী হবে লিখে!! আর কীই বা লিখব!! সম্বোধি টেবিলে পড়ে থাকা চায়ের কাপের দাগে আনমনে আঁচড় কাটতে থাকে।
দেখ, কী লিখবি সে তোর থেকে ভালো আর কে জানে! উপাদান তো কিছু কম নেই তোর হাতে!
হ্যাঁ, তা আছে! জানিস তো মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয়, আমার জীবনটা যদি আমার না হয়ে অন্য কারো হতো!
তাতে কী হতো!
আমি তার জীবনের গল্প লিখতাম।
তো তুই তো এখনো অন্যের জীবনের গল্পই লিখতে পারিস। আত্মজীবনীই লিখতে হবে কে বলেছে!
না না, তুই ঠিক বুঝতে পারছিস না! আমি এই ঘটনাগুলোই অন্যের জীবনে… সম্বোধি থেমে গেল।
তবে তুই চরিত্র তৈরি কর। লেখকের নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব দিয়ে পুরো বিষয়টা দেখ! বললাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম সম্বোধি গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। এই লেখাটা না লিখে ও থাকতে পারছে না। অথচ লিখে উঠতেও নানা সমস্যা।
সম্বোধি শুনতে পেল না আমি কি বললাম। ও হয়তো তখনও মনে মনে সাজাচ্ছে ওর পুরোনো যুক্তি। ওর বাবা-মায়ের আপাত ব্যর্থতা ওকে জাস্টিফাই করে দেখাতে হবে। তথাকথিত ‘সাফল্য’ না থাকলেও সফল হওয়ার সমস্ত উপাদান তাদের মধ্যে ছিল। পরিস্থিতির চাপে নষ্ট হয়ে গেল। সেটাই ও জানাতে চায় ওর আত্মজীবনী জুড়ে। সঙ্গে এটাও জানাতে চায় যে অন্যরা যে মনে করে ও চূড়ান্ত সফল, সেটা আসলেএকটা মিথ্যে। ওর সফলতা ও বেঁধে রেখেছিল অন্য তারে। সে তার ছিঁড়ে গেছে। তারপর ও নিজের পথ বদলেছে। সম্পূর্ণ বিপরীত একটা পথে হাঁটতে ওর খুব কষ্ট হয়েছিল। তবু হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল। সে পথেই ওর চাকরি, বাড়ি, গাড়ি। শুধু সফলতাটুকু ওর অধরা থেকে গেল।
আপনাদের কাছে সবটাই খুব রহস্য মনে হচ্ছে, তাই না! রহস্য কিছুই নয়। একটা মানুষ জীবনের দুই চতুর্থাংশ পথ পার করে নিজেকে ফিরে দেখছে। অথবা এই দুই চতুর্থাংশ যাপন জুড়ে যে লড়াই সে চালাল তা আর পাঁচজনকে জানাতে চাইছে। লড়াই করে সে সফল না বিফল সে প্রশ্ন অবান্তর। আসলে সাফল্য-ব্যর্থতা এসব তো চূড়ান্ত আপেক্ষিক তাই না! এই আপেক্ষিকতাই সম্বোধিকে যন্ত্রণায় ফেলেছে। দীর্ঘ লড়াই সেরে এসে… তাই বা বলি কি করে! লড়ছে তো ও আজও… শুধু সম্বোধিই কেন! আমি, আপনি, আমরা নিরন্তর কি একটা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি না! এ লড়াই জীবনের লড়াই; জীবন যুদ্ধ; হয়তো এর নামই বিপ্লব! জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে এমনটা আর কে কবে ভাবতে পেরেছে! সেই ভাবতে পারা বিপ্লবের কাউন্টার পার্ট। কিন্তু তার মধ্যেও একটা বিপ্লব আছেই। বিপ্লব, না ভাবতে চাওয়ার বিপ্লব! এইসব ভাবনাতেই মেয়েটা নাজেহাল হয়ে গেছে!
হঠাৎ সম্বোধি যেন চৈতন্য ভেঙে বলে উঠল, কি হচ্ছে বল তো! গল্পের ভিতর ঠেলেঠুলে অন্য গল্প চলে আসছে। কিসসার ভিতরে কিসসা যেমন জড়িয়ে থাকে। একটা গল্প লতায় পাতায় চলছে চলছে… শেষ হচ্ছে না। প্রসঙ্গান্তর এসে পড়ছে। কেমন যেন একটা বৃত্ত… তার আগা মাথা কিছু নেই। ঘুরে চলেছে…
একটা সাপ নিজেই নিজের লেজ থেকে নিজেকে খাচ্ছে! অক্ষয় মালবেরি আর কি…
ঠিক বলেছিস।
তাতেই বা অসুবিধে কী! তোর আখ্যানের ধরনধারণ যদি তেমনটাই হয়! নিটোল গল্প থাকে না তো আসল জীবনে। সব ছেঁড়া ছেঁড়া… একটার সঙ্গে একটা জড়িয়ে মড়িয়ে…তুই তোর জীবনের প্রথম আঘাতের গল্পটা দিয়ে শুরু কর না!
কাকাদাদুর গল্পটার কথা বলছিস?
হ্যাঁ, উনি যে সদ্যোজাত তোকে না দেখেই চলে গেলেন, মেয়ে হয়েছিস বলে, কালো বলে তোর জন্মটাকেই অস্বীকার করতে চাইলেন, সেটা লেখ।
কিন্তু আমি তো এখন আর বুঝতে পারি না রে ওই ঘটনাটা আদৌ সত্যি কি না! হয়তো অন্য কিছু ঘটেছিল; বাবা নিজের মতো করে তার একটা ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করেছিল।
হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে!
কারণ ভাব, কাকাদাদু পরবর্তীকালে আমাকে কি ভালোটাই না বেসেছে!
হতে পারে। কিন্তু তোর সেই ছোট্ট বয়সে এই ঘটনা তোর মনে যে নিদারুণ আঘাত দিয়েছিল, সেটা তো তুই-ই বলেছিস!
হ্যাঁ বলেছি। জানিস তো, আমি তো খুব ছোটো থেকে নিজের কথা লিখতে চাইতাম! লিখতে বসেই প্রথমে এই ঘটনাটার কথাই লিখতাম। কাকাদাদু হসপিটালে এসে মার সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছে। আমাকে না দেখেই!
প্যাথেটিক! তোর বাবা ওইটুকু একটা মেয়ের কাছে এই গল্প যে কি করে করলেন!
অনেকটা বড়ো হয়ে পরে জেনেছিলাম আসলে আমার ঠাকুমাই আমাকে চায়নি। মেজছেলের রোজগার কম বলে মেজছেলের সন্তান না আসাই ভাল।
ওয়েল, দেখ, ভালো করে ভাবলে তার একটা যুক্তি আছে।
হয়তো আছে! কিন্তু তাতে আমি যে ভীষণ আনওয়ান্টেড ছিলাম সেটা বারবার উঠে আসছে।
এই ভাবনাটাই তোকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তুই একটা থটপ্রসেসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিস। এটা থেকে তোকে বেরোতেই হবে। আর যতক্ষণ না তুই ভিতরের কথাগুলো বলে ফেলছিস, ততক্ষণ তোর ভিতরে এই একটা যন্ত্রণা তোকে কুরে কুরে খাবে… তুই লেখ সম্বোধি। সবরকম বিরোধিতা উপেক্ষা করে, সমস্ত কনফিউশন কাটিয়ে তুই লেখ!
সম্বোধি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে কেমন ঘোরের মধ্যে উঠে যায়। ওর না লেখা উপন্যাসের জটিল আবর্তে হয়তো হারিয়ে যায়!