স্ম র ণ । পি না কী ঠা কু র
কিছু লেখা লিখতে বসলে এমন হয়। স্ক্রিন থেকে নেমে আসে একটা মায়াবী সাইকেল। তার চাকায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মুহূর্তগুলো। থেমে যাওয়া সময় থেকে ধোঁয়া উঠছে চায়ের। এখুনি একটা প্রায় ফাঁকা রেলস্টেশনে সন্ধে নামবে। সাইকেল গ্যারেজগুলোতে টিমটিম করে জ্বলে উঠবে জোনাকি। এখান থেকে সবকিছু কি আর একবার শুরু হতে পারতো? একটা রিওয়াইন্ড বাটন…
-“আপনি সৈকত বলছেন? এবারের কৃত্তিবাসে আপনার কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে…”
পরের কথাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে, আসলে ওই ঝাপসা কথাগুলোর ওপারে একটা উজ্জ্বল দেখা হওয়া অপেক্ষা করে ছিল। সদ্য একুশ পেরিয়েছি। জীবনের অঙ্কে একঝাঁক শূন্যের পাণিপার্থী তখন। একদিকে কবিতার বিস্ময় চোখ অন্যদিকে মস্তিষ্কের সার্কিটে হাই-রাইজ স্বপ্ন। সেদিন সন্ধে নামবে নামবে, বলাগড় গ্রাম, মোরাম বিছানো রাস্তা, বেশ কিছু দূরে চা দোকানের সামনে শীতের আগুন জ্বালিয়েছে কেউ। সেদিন মানে অবশ্য বছর দশ আগের এক ইথার সন্ধে। একটা আমি তখন ওই গ্রামেরই একটা স্কুলে পড়াই, আর একটা আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। দিনভর ডক্টর জেকিল মিস্টার হাইড, কখনও হেড কখনও টেল। আর এর মাঝেই একটু আধটু লেখার চেষ্টা। অকাজের মধ্যে দুটো রোগা পাতলা বই বেরিয়েছে। যদিও নিজে মুখে সে কথা বলতে একটা কিন্তু কিন্তু সংকোচ। বলাগড়ের ওই রাস্তাটার সঙ্গে আমার ছিল বছর আটেকের সখ্যতা। মাঝে মাঝে অবশ্য নতুন রাস্তার খোঁজে বেশ কয়েকবার ছেদ পড়েছে বন্ধুত্বে। কিন্তু সে সব কমা দাড়ি সেমিকোলনের উর্দ্ধে একটা মনসুন সাইকেলে পেরিয়ে গেছি কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ। সে সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম। শুধু মনে হয়েছিল মুঠোফোনের ওপারে একটা জলজ্যান্ত কবিতা। সে কন্ঠস্বর এখনও জীবন্ত আমার কাছে।
-“গড়িয়াহাটের যোগাযোগ চেনেন?
চলে আসুন শনি মঙ্গলবার দেখে, দুপুরের দিকে। লেখক কপিটাও নিয়ে যাবেন সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা…”
আমি কিছু না ভেবেই জবাব দিলাম,
-“হ্যাঁ, চিনি ” তারপর দীর্ঘ পজ
ফোনের ওপারে চুম্বনের ক্ষত, ফোনের ওপারে রূপ লাগি আঁখি ঝুরে…
আসলে আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সাইকেল থেকে নেমে সামনের পুকুরপাড়ে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। শীতকাল, সন্ধে নামার আগে পুকুরের ওপর একটা হু হু একটা নেই নেই একটা শূন্যস্থান চাদর পেতে দিয়েছিল মনকেমনের…আসলে সে দিনটাও ছিল ডিসেম্বর
-“আপনার কবিতাগুলো বেশ ভালো লেগেছে, নতুন লেখা নিয়ে আসবেন। শুনবো। “
এরপর আপনি থেকে তুমি হতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই গড়িয়াহাটে কৃত্তিবাস দপ্তরে প্রথম দেখা পিনাকীদার সঙ্গে। তারপর কবিতা আড্ডায় দুপুর গড়িয়ে সন্ধে। সেই সন্ধেটা গড়িয়াহাট থেকে কবে যেন বাঁশবেড়িয়ায় শিফট হয়ে গেল। সালটা ২০১৩, “ঘুমন্ত পৃথিবীর রেপ্লিকা”র পাণ্ডুলিপি তৈরি করছি, দিনের পর দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বাঁশবেড়িয়া নেমে গেছি, তারপর স্টেশন থেকে বেরিয়ে সেই চা দোকান। কত সন্ধে এভাবেই কেটে গেছে। একটার পর একটা কবিতা শুনিয়ে গেছি বসন্ত মাস্তানকে। আসলে পিনাকীদার কাছে একটা বিস্ময় চোখ ছিল, আর ছিল আকাশের মতো বড়ো একটা মন। ওঁর আন্তরিকতা আর সারল্য মাখা সেই হাসি আজও জোনাকি হয়ে ঘুরে বেড়ায় আমার মনকেমনের সন্ধেগুলোতে।
পিনাকীদা চলে যাবার পর আর বাঁশবেড়িয়া যাইনি। সেই চা দোকান, সেইসব কবিতা সন্ধে আর একটা ম্যাজিক সাইকেল আজও তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি লিখে চলেছে।