স্ম র ণ । পি না কী ঠা কু র
আমাদের বন্ধু, কবি পিনাকী ঠাকুর আমাদের ছেড়ে, এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে কয়েক বছর হলো। অথচ তার মায়াভরা উচ্চারণ, তার কবিতা ক্রমশই আগ্রহী করে তুলছে নতুন নতুন পাঠককে। আমাদের পক্ষে এ বড়ই আনন্দের কথা। কবি পিনাকী ঠাকুরের সঙ্গে আমরা যারা ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, তারা পিনাকীর সহজসরল জীবনযাপনের মধ্যে ভালোবাসবার একটা তীব্র আকুতি অনুভব করেছি প্রায় সময়েই। এক কাপ চা বা একটা পাঁউরুটিও কোনো সঙ্গীকে ভাগ না দিয়ে খেতে চাইত না পিনাকী। আর তারপর সিগারেটের প্যাকেটটাও এগিয়ে দিত ধরাবার আগে।
চা একটু বেশিই খেত পিনাকী। জীবনের অনেকটা সময় সামান্য টিউশনি ছিল তার জীবিকা, চা-পাঁউরুটি ছিল তার রোজকার ব্রেকফাস্ট, দুপুরে ভাত-ডাল-ডিমসেদ্ধ ছিল তার পছন্দের মেনু। আর ছিল তার কবিতা। সকাল থেকে দুপুর, সন্ধে পেরিয়ে রাত পর্যন্ত কোনো না কোনো প্রসঙ্গে পিনাকী ছুঁয়ে থাকত কবিতাকে। কখনো কবিতা লেখা, কখনো কবিতা পড়া, কখনো কবিতার আলোচনা…। এমনকি আমাদের মতো ফিচেল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে রোয়াকের বা পানশালার অশ্লীল হুল্লোড়েও সারাক্ষণ সে ফুট কাটত, মজা করত কবিতায়। বন্ধু বা অগ্রজ কবিদের কবিতার কোটেশন দিত অবলীলায়। এসব নিয়ে পিনাকীর স্টক যেন কিছুতেই ফুরোত না।
পিনাকী ঠাকুরের কবিতাতেও বারবার দেখতে পাওয়া যায় টিউশনিজীবী এই মফস্বলের কৈশোর আর মধ্যযৌবনকে, বিধবা মা আর বোনের দায়িত্ব ঘাড়ে নেওয়া অকৃতদার এক মফস্বলী বৃত্তান্তকে। মফস্বল বাংলার কতো যে প্রান্তে-প্রত্যন্তে ঘুরেছে পিনাকী। বছরের পর বছর। শান্তিপুর, ফুলিয়া, কৃষ্ণনগর, রাণাঘাট, লালগোলা, পাণ্ডুয়া, মালদা, বালুরঘাট। কখনো হয়তো সঙ্গে ছিলাম আমি, কখনো অন্য কেউ। বাঁশবেড়িয়া তো তার বাসস্থান। চন্দননগর-চুঁচড়ো-সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কল্যাণী-চাকদা ছিল তার সাইকেল-চাপা দূরত্ব। বাংলার এইসব জনপদের ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ইতিহাস যেন ধরা আছে পিনাকীর কবিতায়। ধরা আছে টেরাকোটার কারুকার্য, ধরা আছে কবি কৃত্তিবাসের জন্মফলক, ধরা আছে রাজা রামমোহনের জীবন সংলাপ। মনসামঙ্গল আর পদাবলীর বাংলা, রবীন্দ্রনাথ আর লালনের বাংলাকে নিজের সময়ের মানদণ্ডে যেন মেপে দেখতে চেয়েছে পিনাকী। বুঝে নিতে চেয়েছে তার ভবিষ্যৎ গতিপথ। তাই বাগান কেটে গজিয়ে ওঠা ‘হোটেল রাতদিন’-এর দিকে তার কবিতার নজর। টেরাকোটার মন্দির আর মেগাসিটি- এ দু’দিকেই তার কবিতার টানাপোড়েন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঠিক এই জন্যেই ভালোবাসতেন পিনাকীর কবিতা। পিনাকীর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বা ওর ‘নবোন্মেষ’ পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে পুস্তিকায় লিখেওছেন সে কথা। সুনীলদার ভালোবাসা আমরা সবাই অল্পবিস্তর পেয়েছি, কিন্তু পিনাকীকে ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি।
পিনাকী চলে যাবার পরে সকলে তার নামে কতো কিছু করছে। ‘পিনাকী ঠাকুর স্মৃতি দাঁড়াবার জায়গা’ পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের জন্য। বাঁশবেড়িয়া পুরসভা একটা অসাধারণ সুন্দর লাইব্রেরি সংলগ্ন পার্ক তৈরি করে উৎসর্গ করেছেন তার নামে- পিনাকী ঠাকুর উদ্যান। অনেক ছোট পত্রিকা বের করছে পিনাকী ঠাকুর সংখ্যা।
এসবের মধ্যে দিয়েই আমাদের দেখা হয় পিনাকীর সঙ্গে। দেখা হয় তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আর ‘কবিতা সংগ্রহ’র পাতা উল্টে। দেখা হয় তার গল্প-উপন্যাসের সতজ, সবুজ লাইনে লাইনে। দেখা-সাক্ষাতের এই পর্ব যেন চলতেই থাকে সময় পেরিয়ে।