বি শে ষ র চ না
গত সংখ্যা পর
‘ভারতে ঐশ্বরিক প্রকাশের দুটি বই রয়েছে: পবিত্র বেদ এবং দিবান-এ-গালিব’
আবদুর রহমান বিজনৌরী
গালিবের কবিতার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং মৌলিক সমালোচনা হল হালি’র ইয়াদগার-এ-গালিব (1897) , যদিও হালি এই সত্যটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন যে আব-এ-হায়াৎ (1881) মুহাম্মদ হোসেন আজাদ রচিত উর্দু কবিতার উপর একটি প্রথম ভাষ্য (বা তাজকিরা)। যাকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যের ভিন্ন এক আদর্শ গঠনের একমাত্র বই। এবং আমরা এও জানি যে এই বইটিকে উর্দু কবিতার প্রথম কালানুক্রমিক ইতিহাস হিসাবে গণ্য করা হয়। এবং এই কারণেই বলা হয় আব-ই হায়াত উর্দু কবিতা সম্পর্কে উপাখ্যান এবং ঐতিহাসিক তত্ত্ব উভয় প্রবাহের জন্য আমাদের কাছে আব-এ-হায়াৎ হয়ে ওঠে একটি প্রভাবশালী উৎস । 1883 সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণটি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য কয়েকটি স্কুলে সরকারী পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ কেউ মনে করেন ইয়াদগার-ই-গালিব যদি আমাদের হাতের কাছে না থাকত তাহলে গালিবের কবিতা নিয়ে সমালোচনামূলক আলোচনা শুরু হতে হয়ত অনেকটা সময় লেগে যেত। আমরা হালি’র ইয়াদগার-ই-গালিব পড়তে গিয়ে দেখি হালি গালিবের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন প্রবাহকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন তেমনই তাঁর ব্যক্তিত্বকেও আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।। হালি লিখেছেন গালিবের মেজাজের ভিন্নতাকে তাঁর কাব্যিক আঙ্গিকের মতোই রহস্যময় । তিনি কতটা ভিন্ন তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে এবং তাঁর অভ্যাস অন্যদের থেকে এতটাই ভিন্ন যে আমরা গালিবের কবিতাকেও স্পর্শ করি তাঁর অভ্যাসের অংশ হিসেবে। গালিবের বন্ধুদের নিয়ে যেমন হালি লিখেছেন তেমনই গালিবের সমালোচকদেরকে নিয়েও তাঁর লেখায় ধরতে চেয়েছেন, এবং আমরা তাঁর অনুভবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি যখন তিনি গালিবের কবিতাকে ভিন্ন এক মগ্নতায় বিশ্লেষণ করছেন এবং ইয়াদগার-ই-গালিব-এর শেষের দিকে গালিবের ফার্সি ও উর্দু কবিতার বিস্তৃত নির্বাচন আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। হালি তাঁর লেখায় চিঠিপত্রের উপাদান এমনভাবে ভিন্ন আঙ্গিক অনুসরণ করেছেন এর থেকে অনুমানের একটা ভীত গড়ে দিয়েছিলেন সে বিষয়ে আমরা মনে করি কিন্তু তিনি এটা প্রমাণ করেছিলেন যে গালিবের মতো এত গাঢ় লেখা আর কেউ লিখতে পারবেন না। কিন্তু কেউ কেউ তো প্রশ্ন করতেই পারেন কী এমন আছে তাঁর লেখার মধ্যে যা হালিকে ভিন্ন এক পথ অনুসরণ করতে হলো ? কেন তাঁকে এত উপাদানের মধ্যে বিষয়টিকে প্ৰমাণ করতে হলো ? হয়তো এই একটি কারণও গালিবকে এই ভিন্নতাকে থেকে ভিন্ন করেছে কেননা হালি নিজের বক্তব্যকে গাঢ় করতে গিয়ে সমস্ত বিশ্লেষণ সমস্যার জন্ম দিয়েছেন । হালির মূল্যায়নে আমরা যে গালিবকে স্পর্শ করতে পারি তা সম্পূর্ণ হালির ব্যক্তিগতকৃত গালিবের প্রতিলিপি। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারি না কারণ গালিবের কবিতার ভাষা সেই ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে যা হালি স্পর্শ করেছেন । আর এখান থেকেই সমালোচনার একটা পথ আমাদের খুলে যায়। হালি গালিবের প্রথম দিকের কবিতা সম্পর্কে অন্যদের মতামত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন : ‘লোকেরা মীর, সৌদা, মীর হাসান, জুরাত এবং ইনশা-এর মতো কবিদের সরাসরি এবং সহজে বোঝার মতো কবিতা শুনতে অভ্যস্ত ছিল কারণ তারা তাদের কাজে প্রতিদিনের ভাষা ব্যবহার করতেন। যদিও প্রাত্যাহিক কথোপকথনের বর্তমান বাগধারায় ব্যবহৃত সরল ভাষাটি অনেকের কাছে আনন্দদায়ক ছিল, সেখানে একটি সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে একটি কার্যকর কাব্যিক যুগলই কবির হৃদয় থেকে এসেছে এবং তারপর তা তাৎক্ষণিকভাবে শ্রোতার হৃদয়ে প্রবেশ করেছে।’ কিন্তু আমরা যদি হালির মতো করে গালিবের প্রথম দিকের কবিতার দিকে তাকাই তাহলে হালির মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে হবে যে গালিবকে এখানে তেমন করে পাওয়া যাবে না তাঁর কবিতায়, কেননা গালিবের কবিতায় তেমন কোনও শব্দ ব্যবহার নেই যা মনে হতে পারে এ-শব্দ আমাদের খুব পরিচিত বা প্রাত্যহিক জীবনে সেইসব শব্দ খুব বেশি মানুষ ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানে বলার অর্থ এই নয় যে গালিবের সামগ্রিক কবিতায় এমন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যেতে পারে বরং কিছুটা ভিন্ন তাঁর শব্দ চয়ন তাঁর সামগ্রিক রচনায় । হালির বক্তব্য ছিল গালিবের কবিতার ভাষা ছিল রহস্যময় এবং কঠিন এবং আমরা যদি তাঁর কাব্য যুগল দেখি তাহলে দেখতে পাবো সেখানে উচ্চারণ আমাদের উর্দু থেকে ফার্সিতে নিয়ে যায় তাঁর কবিতার আঙ্গিক । যেখানে একটা শব্দও ফার্সি বা উর্দুকে আলাদা করে দিচ্ছে না বরং গালিবের কবিতায় আমরা স্পর্শ করি ভিন্ন ভিন্ন লৌকিক আঙ্গিক যা আমাদের সামগ্রিক চেতনায় বিস্তারিত করে। গালিবের কবিতার আঙ্গিকে এমন কিছু শব্দের ভিন্নতাই গালিবকে আর সবার থেকে আলাদা করেছে এবং মনে করা হয় গালিবের কবিতায় এমন কিছু ভিন্নতা আছে এর আগে কখনও ফার্সি ও উর্দু ভাষায় আমরা দেখতে পাইনি। পাঠকের দিক থেকে এই দেখাটা অবশ্য সবসময় যে খুব সহজ তা নয়। কেননা হালি মনে করতেন ভাষার ভিন্নতা ও ফার্সি ভাষার উদার চেতনায় এমন এক রহস্যময় আবেগ আছে যা গালিবের পাঠকের কাছে এই ভিন্নতাই অদ্ভূত তা নয় বরং হালি মনে করেন ভাষার গঠনের প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার কেননা গালিবের সমসাময়িক সমালোচক এই ভিন্নতাকে কখনও গালিবের আঙ্গিক মনে করেননি বরং তাঁরা সহজ বিষয়টিকেই গালিবের দুর্বলতা মনে করেছেন সবসময়। গালিবের ধারণার ঘনত্ব ও উদ্ভাবনী শৈলীর জন্য গালিব সমালোচিত হয়েছেন বারবার ।
কুমরি কাফ-এ-খাকাস্তার ও বুলবুল কাফস-এ-রং
এয় নালা নিশান-এ-জিগর-এ- সোখতা কেয়া হ্যায়’
হালি গালিবের একটি দ্বিপদী উধৃতি দিয়ে বললেন : ‘ আমি নিজেই মির্জাকে এই দ্বীপদীটির অর্থ ব্যাখ্যা করতে বলেছি। গালিব বলেছিলেন যে তুমি এয় [সম্বোধনের একটি রূপ] এর জায়গায় জুজ [ব্যতীত] পড়লে অর্থটি তোমার কাছে পরিষ্কার হবে। যুগলটির অর্থ হল বন্দী পায়রা, যেটা ধুলো রঙের, আর বুলবুল যেটা প্রায়শই নিজের রঙের সৌন্দর্যে খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে ,শুধুমাত্র বিলাপের মাধ্যমে প্রেমে তাদের কষ্টের প্রমাণ দিচ্ছে । পায়রা চাঁদের জন্য বিলাপ করে এবং বুলবুল ফুলের দিকে তাকিয়ে বিলাপ করে। আসলে আমরা যদি তাঁর সমগ্র রচনার দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব যে গালিবের ভিন্নতা ঠিক কোথায় । গালিব অন্তমিল নিয়ে যতটা ভাবতেন বলে আমাদের মনে হয় ঠিক তার বিপরীত ঘটনাই ঘটছে বারবার, কেননা গালিবের কবিতায় শব্দের উদ্ভাবন ছিল আঙ্গিকের একটা চিহ্ন। আর এই যে কিছু আগে হালির যে যুগলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলা হলো তার শব্দ ব্যবহার তাঁর নিজের উদ্ভাবন। হালি এই ভিন্নতাকে বোঝাতে গিয়েই বললেন এক ব্যাক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে মির্জা যদি এয়-এর পরিবর্তে যুজ ব্যবহার করতেন এবং দ্বিতীয় লাইনটি যুজ নালা হিসেবে লিখতেন নিশান তেরে সিভা ইশক কা ক্যায়া হ্যায় তাহলে অর্থটা পরিষ্কার হয়ে যেত। হালি বলেছেন লোকটি ঠিক ছিলেন, কিন্তু মির্জা সাধারণ অভিব্যক্তির ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন এবং চমক লাগা পথে চলতে পছন্দ করেননি। এটা তিনি কখনো চাননি যে তাঁর যুগল ব্যাখ্যা করা খুব সহজ হয়ে উঠুক, তিনি তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তিতে যে কোনও মূল্যে উদ্ভাবনীতা পছন্দ করতেন অন্য কিছুর চেয়ে (1897: 103)
কেননা গালিব নিজেই এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন আর তাই তাঁর একটি যুগলের মধ্যে আমরা দেখতে পাই হালির বিশ্লেষণের ইশারা গালিবের ভিন্নতাকে আরও স্পষ্ট করছে ।
আতে হ্যায় গাইব সে মজামিন খেয়াল মে
গালিব শরির-এ-খামাহ নওয়া-এ-সুরোশ হ্যায়।
গালিব বলতে চেয়েছেন ‘আমি একটি অজানা উৎস থেকে এই চিন্তা পেয়েছি যদিও আমার একটি ধারণা আছে, আমি শুনতে পাচ্ছি ফেরেশতারা একটা কাগজে একটা আঁচড়ের আওয়াজ দিয়ে লিখে রেখেছে।
এটা ঠিক যে আগের যুগলের দ্বিতীয় লাইন পরিবর্তন করে অর্থ পরিষ্কার হয়ে যেত কিন্তু যুগলের অস্বাভাবিক উদ্ভাবন শৈলীর নির্মাণ ধ্বংস হয়ে যেত। আর তাই এরপর হালি বলবেন : ‘আমির খসরু ও ফয়েজীর পর ভারতের মাটিতে মির্জার মতো মহান ও বহুমুখী কবি আর কেউ নেই। এবং যেহেতু সময় পরিবর্তিত হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্যও কোন আশা নেই যে অত্যাধুনিক শাস্ত্রীয় শৈলীর কবিতা এবং নিপুণ গদ্যের উপর এমন প্রতিভাবান ব্যক্তিরা আবার কখনও এই মাটি থেকে উঠবে।’ কেননা হালির ধারণা ছিল গালিব সবসময় কবিতার প্রচলিত এবং সুস্পষ্টকে এড়িয়ে যেতেন এবং জীর্ণ তিক্ত অভিব্যক্তির প্রতি অবজ্ঞার সাথে তাকাতেন যা তার সময়ে প্রচলিত ছিল’ (হালি 1897: 104)।
হালি একটি বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেছেন যখন বেনারস বা লখনউ থেকে কেউ গালিবকে দেখতে আসেন এবং জিজ্ঞাসা করেন যে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো যুগল লেখা হয়েছে কিনা এর মধ্যে।
যুগলটি আসলে সৌদার শিষ্য মীর আমানি আসাদ লিখেছিলেন। আসাদ জাফা পার বুতন সে ওয়াফা কি মেরে শের শাবাশ রহমত খুদা কি। (হালি 1897: 105)
এই পংক্তি শুনে গালিব মন খারাপ করে বললেন, ‘যদি এই দোঁহাটি অন্য আসাদের হয়, ঈশ্বরের কৃপা হোক! এবং যদি এই আমার অন্তর্গত
[তার নামও আসাদ ছিল] তাহলে ঈশ্বরের অভিশাপ আমার উপর পড়ুক’ (হালী 1897: 105)।
এই ধরনের সাধারণ, নিত্যনৈমিত্তিক, অভ্যাসগত, সাধারণ এবং গড় চিন্তাভাবনা এবং শব্দের মধ্যে জরাজীর্ণ যোগসূত্র যা এই যুগলটিতে প্রকাশ করা হয়েছে তা গালিবের উদ্ভাবনী বুদ্ধিবৃত্তিক স্বভাবের বিরুদ্ধে ছিল।
এটা ঠিক যে, কবিতায়, ভাষার অভ্যাসগত, সুস্পষ্ট এবং সাধারণ কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়। উপরের যুগলটি একটি ভাষাগত চিহ্ন প্রবাহকে উপস্থাপন করে যা নিয়মিত এবং সাধারণ। এর অর্থ হল গালিবের অবচেতন মনে কিছু অসাধারণ উপাদান ছিল যা তাকে সুস্পষ্ট এবং সাধারণকে প্রত্যাখ্যান করে এবং একটি উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল পথে নিয়ে যায়। অন্য কথায়, প্রাপ্ত বা প্রচলিতকে একটি মোচড় দেওয়ার জন্য তার ভিতরের তাগিদ ছিল যাতে চিন্তাটি নিজেই ঘুরে যায়। হালি অন্যান্য উদাহরণ উল্লেখ করেছেন যা আমাদের দেখায় যে গালিব কেবল তার কবিতার আঙ্গিকেই আলাদা ছিলেন না, তার চেহারা, পোশাক, জীবনের সবচেয়ে সাধারণ জিনিসগুলির সাথে তার আচরণের ক্ষেত্রেও এতটাই আলাদা ছিলেন যে এমনকি তার বেঁচে থাকা এবং মারা যাওয়ার ধারণাগুলিও ছিল ভিন্ন।