উ প ন্যা স । পর্ব ২
(গত সংখ্যার পর)
নৈনিতাল তোর পছন্দ হল। কত সুন্দর না? জায়গাটা? বিশেষ করে শীতের সময়ে, তুষার দেখতে দেখতে তোর স্কুল ছুটি। বৈদেহীরও প্রিয় ছিল স্কুল আর শহরটা, শুনেছি।
সতীর নয়ন পড়েছিল বলে নৈনিতাল, শুনেছি।
সতীর চোখ, ভেবেছিস কখনও!
অমরিন্দরের মতে সতীর মতন চোখ কোনো মহিলা পেতে পারে না; ওই তিনটে চোখই তৈরি হয়েছিল।
আইডেনটিটিকার্ডে তোর ফোটো, আইগ্লাস দিয়ে এনলার্জ করে দেখে, অনুমান করতে পারি, চোখ দুটো কত সুন্দর, যতো তোর বয়স বেড়েছে, ঠিক জানি, তত সুন্দর হয়েছে তোর চোখ, কালো গভীর আর বেশ বড়ো, যেমন বাঙালি মেয়েদের হয়। কাঁদলে কেমন হয় তোর চোখজোড়া? হাসলে কেমন হয়? কারোর সঙ্গে ঝগড়া করলে কেমন হয়? তোর এখনকার জীবন্ত চাউনিগুলো দেখার বড়ো ইচ্ছা হয় রে।
কবে দেখলাম তোর চোখ ? দেখেছি বৈকি। চোখ বুজলেই দেখতে পাই আর ভাবি কত ভুল যে করেছিল তোর মা তোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে। আমার মনে হয় দূর থেকে লক্ষ্য রেখেছিল, তোকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্য ; তখনই তোর চোখের টান এড়ানো ছিল অসম্ভব।
আমি তোর চোখের টানেই সন্মোহিত হয়েছিলাম। তোর গন্ধে। কেন বল তো ? কারণ তোর গন্ধ অন্য শিশুদের থেকে আলাদা ছিল, তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি, বোতলের দুধ খেয়ে বড়ো হয়েছিস।
এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।
যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।
বড়ো হয়ে উঠলি, বড়ো হয়ে উঠলি, অমাবস্যাকে একরাতে পরিযায়ী করে চলে যাবি বলে !
তোর ক্লাস সেভেনের ডায়রিতে, হস্টেলের ওয়ার্ডেন দেখেছিলেন, একটা পৃষ্ঠায় তুই লিখে রেখেছিস, লাল ডটপেন দিয়ে, “আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” পৃষ্ঠাখানা ছিঁড়ে অমরিন্দরেকে দিয়েছিলেন ওয়ার্ডেন, এই ভেবে যে তুই কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিস।
ওই স্কুলে ছেলেরা পড়ে না, কি করেই বা কোনো ছেলের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হবে, তা নিজেও চিন্তা করেছিলেন ওয়ার্ডেন।
জগদীশ বুঝিয়েছিল অমরিন্দরকে, না, না, ও জেনে ফেলেছে, যে ওর পড়াশুনা থাকা খাওয়া পোশাক আর জীবনে যা প্রয়োজন তা কেউ একজন অলক্ষ্যে যুগিয়ে যাচ্ছে, আর তার জন্য তুমিই দায়ি অমরিন্দর, আমাদের ছেলে আর মেয়ের চেয়ে দামি জুতো জামা উপহার ইত্যাদি কিনে ওর মনে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছ। ও ভাবে, ওকে কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেয়া হচ্ছে।
মেয়ে বৈদেহী আর ছেলে আরিয়ানও প্রশ্ন তোলে, কেন স্পেশাল ট্রিটমেন্ট। শুনেছি।
অমরিন্দর উত্তরে বলেছিল, আর ব্রো-প্রো যে অন্যদের দিয়ে নেতিকে বাংলা-ইংরেজি বই পাঠায়, প্রতি বছর দূর্গাপুজোয় দামি টোম্যাটোরেড পোশাক পাঠায়, তার বেলা ?
যাতে ওর জ্ঞান বাড়ে, কালচার্ড হয়, সেজন্য পাঠায় ; ব্রো-প্রোর মগজে আঁস্তাকুড়ের ভয় কি আর নেই !
তা বইগুলো বৈদেহী আর আরিয়ানই বেশি পড়ে, নেতি স্কুল থেকে ছুটিতে এলেও ম্যাথস ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতেই বসবাস। বৈদেহী বইগুলো পেয়ে সাহিত্যের পোকা হয়ে গেছে ; বাংলা সিডি এনে গান শোনে। শুনেছি।
আমি চেয়েছিলুম তোকে সবচেয়ে ভালো পোশাক আর জুতো কিনে দেয়া হোক ; বই কিনে দেয়া হোক। কিন্তু কি করেই বা তুই জানলি, বিশ্বাস করলি ? বিশ্বাস আর সন্দেহ তো একই ব্যাপার নয়। জানিস তো, মানুষের সন্দেহ হল বিশ্বাসঘাতক প্রক্রিয়া, কিন্তু নিজের ভেতরের আলো-অন্ধকার খুঁজে পেতে হলে সন্দেহ ছাড়া উপায় নেই, না রে ?
তোর কি মনে হয় না যে বিশ্বাস ব্যাপারটা জঘন্য, দূষিত, মন্দ ? বিশ্বাসের বিপরীত হল সন্দেহ, কিন্তু তা যদি বিশ্বাসের উপাদান হয়, তাহলে কি করবি ? তোর মাথায় নিশ্চয়ই এই দোনামনা দোল খেয়েছে, টিং টুং টিং টুং, জানি আমি, ফর শিওর।
পথপ্রদর্শকের হাত ধরে প্রতিবিম্ব পালটে যায়, পাহাড় ফাটিয়ে বের করে আনে প্রতিধ্বনি।
রোদে নিকানো আকাশে তখন ঝুলে থাকে পরিযায়ী পাখির একাকীত্ব।
রোদ্দুর উত্তরায়ন মেনে চললে কী-ই বা করার ! অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো।
সেভেনথ স্ট্যাণ্ডার্ড থেকে তোর প্রতিটি ক্লাসের আইডেনটিটি কার্ড রেখেছি যত্নে, চণ্ডীগড় থেকে ডাকে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল তোর অভিভাবক পরিবার , যখন তোর বারো ক্লাস শেষ হল, আমি তখন সিলভাসাতে পোস্টেড। তুই কি টের পাসনি যে কোথায় গেল স্কুলের আইডেনটিটিকার্ডগুলো ? ওগুলো দেখি মাঝেসাজে, কেমন একটু একটু করে ডাগর হয়ে উঠেছিস; ফিচার্স স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জগদীশের বাড়িতে আছিস বলে তোকেও নাকি বৈদেহী আর অমরিন্দরের মতো দেখতে হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি।
জাঠনি ! ভাবা যায় !
তুই তো বাঙালি ; মোষের দুধ হজম করতে পারিস তো ?
আশ্চর্য না ? তুই কলকাতার আঁস্তাকুড় থেকে এসে যাদের বাড়ির সদস্য হলি, তাদের মা-মেয়ের মতনই দেখতে হয়ে গেলি ক্রমশ, বারো ক্লাস পর্যন্ত তোর আইডেনটিটি কার্ডের ফোটো দেখে তেমনটা অনুমান করতে ভালো লাগে।
তুই কি ঢ্যাঙা হয়েছিস, তোর পাদুটো লম্বা হয়ে চলেছে নাকি, বৈদেহী-আরিয়ানের মতন, জাঠদের মতন? নাচ শিখতে পারতিস, তা নাচ তোর প্রায়রিটিতে নেই, শুনেছি।
ক্লাস টেনে যখন ফার্স্ট হলি, সিস্টার অ্যানি তোর সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাপিয়েছিলেন স্কুল ম্যাগাজিনে, তার কপি আছে আমার কাছে, পড়ে পড়ে মুখস্হ হয়ে গেছে প্রশ্ন আর উত্তরগুলো ; শুনবি ?
তুই তো এখন আমেরিকায়, চাকরি করিস, শুনেছি গাড়িতে অফিস যাস, তবু শোন, তোরই ইনটারভিউ।
সিসটার অ্যানি: তোমার নাম নেটি, এর অর্থ কী ?
তুই: নেটি মানে নিও টেরেস্ট্রিয়াল, শর্টে নেটি রেখেছিলেন আমার ফসটার ফাদার। বাংলায় নেতি।
সিসটার অ্যানি: তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও ?
তুই: আমি অ্যাস্ট্রনট হতে চাই, স্পেস সাইন্টিস্ট হতে চাই। চাঁদের মাটিতে, মঙ্গলগ্রহের মাটিতে হাঁটতে চাই।
সিসটার অ্যানি: কেন ? তোমার সহপাঠিরা বেশির ভাগই ডাক্তার হতে চাইছে, বা কমার্স পড়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে চাইছে, পলিটিশিয়ান, উকিল, বিজনেসউওম্যান হতে চাইছে।
তুই: জানি। আমার ম্যাথেম্যাটিক্স খুব ভালো লাগে, ফিজিক্স ভালো লাগে; সীমাহীনতার বিস্ময় আমাকে মোটিভেট করে। আমি আইআইটিতে কমপিট করতে চাই।
সিসটার অ্যানি : তোমার প্রিয় ফিল্ম নায়ক কে ?
তুই: ব্র্যাড পিট।
সিসটার অ্যানি: কেন ? দেখতে অ্যাট্রাকটিভ বলে ?
তুই: শুধু তাই নয়, উনি আর অ্যানজেলিনা জোলি বেশ কয়েকজন শিশুকে অ্যাডপ্ট করেছেন। একিলিসের ভূমিকায় মানিয়েছিল ওনাকে।
সিসটার অ্যানি : তুমিও বড়ো হয়ে কোনো শিশুকে অ্যাডপ্ট করার কথা ভাবো কি ?
তুই: হ্যাঁ, আমি বিয়ে করব না। কয়েকটি শিশুকে অ্যাডপ্ট করব।
সিসটার অ্যানি: যদি কাউকে তুমি ভালোবেসে ফ্যালো ? কিরকম সঙ্গী চাও ?
তুই: আমি চোখ বুজে তাকে দেখতে পাই, কিন্তু বর্ণনা করতে পারব না। আমি আমার ফসটার ফাদারকে আজও দেখিনি, তাঁকে আমি আমার ফাউনডিং ফাদার মনে করি, আমার প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর মতো পুরুষ আমার পছন্দ, তাঁকেই পছন্দ।
সিসটার অ্যানি: তোমার উড বি হাজব্যান্ড কোথায় তোমাকে প্রোপোজ করুক, তুমি চাও ?
তুই: যদি বিয়ে করি, চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রোপোজ করলে ভালো। তবে আমি ওই পুরোনো প্যাট্রিয়ার্কাল রিচুয়াল রিভার্স করতে চাই, আমিই প্রপোজ করব, সে গ্রহণ করবে। বিয়ে আমি করব না বলেই মনে হয়।
সিসটার অ্যানি: ফিল্ম দ্যাখো, মুভিজ ?
তুই: না, ফিল্ম দেখতে আমার তেমন ভালো লাগে না, ওয়েস্টেজ অফ টাইম মনে হয়।
সিসটার অ্যানি: কোন ধরণের ফিকশান তোমার ভালো লাগে ?
তুই: ফাইভ সিক্সে পড়ার সময়ে হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো ভালো লাগত ; এখন ট্র্যাশ মনে হয়। এখন আমার সিমপ্লিফায়েড শেক্সপিয়ার ভালো লাগে, বিশেষ করে ট্র্যাজেডিগুলো।
সিসটার অ্যানি: কমিকবুকের কোন চরিত্র তোমার পছন্দ ?
তুই: অ্যাস্টারিক্স আর ওবেলিক্স। ওতে আমি নিজের একটা চরিত্র কল্পনা করে নিই, নেটিফিক্স, যে নেটওয়র্কিং করে সকলের সমস্যা সমাধান করে, কেননা ওই কমিকবুকে চরিত্ররা কেবল একের পর এক সমস্যা গড়ে তোলে।
সিসটার অ্যানি: কোন খেলা ভালো লাগে?
তুই: ফুটবল।
সিসটার অ্যানি: কোন টিমকে সমর্থন করো?
তুই: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
সিসটার অ্যানি: কার কবিতা ভালো লাগে?
তুই: টি এস এলিয়ট, কবিতায় গল্প না থাকলে ভালো লাগে না।
সিসটার অ্যানি: ওনার কবিতা তো বেশ কঠিন, বুঝতে পারো ?
তুই: বুঝতে বিশেষ পারি না, অনুভব করতে পারি।
সিসটার অ্যানি: বেঙ্গলি পোয়েট্রি পড়ো না ?
তুই: না, পড়ি না , পড়তে ইচ্ছা করে না। আমার বেঙ্গলি বার্থ পোয়েটিকাল নয়, আই অ্যাম এ ডিসাকার্ডেড বেঙ্গলি। তবে একজন বেঙ্গলি কবির আত্মহত্যার ঘটনা আমায় সন্মোহিত করেছে।
সিসটার অ্যানি : তোমার প্রতি বছরের ডায়েরিতে একটা লাইন লেখো, “ আই নো, সামওয়ান ওনস মি, বাট ইজ সিক্রেটলি ট্রাইং টু ডিজওন মি।” তুমি কি ঈশ্বরের কথা ভেবে লেখো ? নাকি তুমি কবিতা লিখতে চাইছ?
তুই : হ্যাঁ, উনি আমার ব্যক্তিগত ঈশ্বর, আমার ফাউনডিং ফাদার। ওই লাইনটা লিখে ওনার আরাধনা করি, সম্পর্ক পাতাই। আই লাভ হিম ইন অ্যাবসেনশিয়া।
এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।
যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।
জগদীশ একবার বলেছিল, নিজের ছেলেমেয়ের চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসে, ও যা চায়, তুই তেমন করেই গড়ে তুলছিস নিজেকে, কখনও অবাধ্যতা করিস না। প্রায় তোর মতনই ওদের গায়ের রঙ ; জগদীশের রঙ পেয়েছে দুজনেই। হাইট পেয়েছে অমরিন্দরের। ফর্সা হলে তিনজনের মধ্যে কমপ্লেক্স গড়ে উঠত, সে আরেক হ্যাঙ্গাম। কী করে এরকম মানিয়ে নেবার চরিত্র পেলি রে ?
বৈদেহী আর আরিয়ানের খারাপ লাগতে পারে, তুই ওদের বাবা-মায়ের ওপর ভাগ বসাচ্ছিস ভাবতে পারে বলে, জগদীশকে আঙ্কলবাপি আর অমরিন্দরকে আন্টিমা সম্বোধন আবিষ্কার করে ফেললি। সবই অবশ্য শোনা, একবছর বয়সের পর তো আজও দেখিনি তোকে, আর ওদের ছেলেমেয়েকে।
জগদীশ জানিয়েছিল, বৈদেহী আর আরিয়ান নাকি চাইত না যে তুই বাপি আর মা বলে সম্বোধন করিস ওনাদের, বাপি আর মা কেবল ওদের।
তুই জেনে ফেলেছিস যে তোর জন্মের পরেই তোর মা তোকে অনাথ করে দিয়েছিল ; অনাথ শিশুদের হামাগুড়ি থেকে কেউ একজন তোকে পছন্দ করে তুলে দিয়েছিল ‘এডুকেট এ গার্ল চাইল্ড’ সংস্হার হাতে।
বৈদেহীর সঙ্গে ঝগড়ায় ওর আলটপকা মন্তব্যে সন্দেহ হয়েছিল তোর ; তারপর জগদীশ-অমরিন্দরের কথাবার্তা শুনে ফেলে থাকবি কখনও। ওরা দুজনেই মদ খাবার পর বড্ড বকবক করে, বিছানায় শুয়েও গ্যাঁজায়, ব্রো-প্রোর টাকা এসে পড়ে আছে রেলিভ্যান্ট অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দাও, এই ধরণের কথাও বলাবলি করে থাকবে।
আমি তোকে দিতে চেয়েছিলাম কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের বসন্তকাল, শীতের পশ্চিমবাংলার ফিনফিনে গ্রামীণ রোদ, চিরসবুজ অ্যামাজন অরণ্যের ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও পাখিদের রঙিন উড়াল।
তুই চাইলি আরও ওপরের আকাশে ভেসে বেড়াবার স্বাধীনতা, আরও উঁচু, আরও উঁচু, আরও উঁচু, বাধাবন্ধনহীন নীল, যেখানে পাখিদের ডানার রঙ কালো বা ধূসর।
যে আঁস্তাকুড়ে অবহেলায় ভোররাতের শিশিরে ভিজছিলিস তা পশ্চিমবাংলায়; তোর রোষ চাপিয়ে দিলি পশ্চিমবাংলার ওপর, কলকাতা শহরের ওপর।
জানি, ব্লু-গোল্ড পোশাকে তোকে মানায়। কিন্তু আমার পছন্দ টোম্যাটোরেড লাল রঙের পোশাক।
কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতের কথা কেন বলছি বলতো ? তোর গায়ের রঙ শ্যামলা, বৈদেহীর চেয়ে এক পোঁচ বেশি,শুনেছি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর ওই সমুদ্র সৈকতে পয়লা জানুয়ারি অজস্র মানুষ-মানুষীর ভিড় হয় ; অন্য সময়েও নগ্নিকারা শুয়ে থাকেন বালির ওপর নরম ম্যাট বিছিয়ে। তারা তোর মতোই শ্যামলী, অনেকে কৃষ্ণাঙ্গীও। কেবল শেতাঙ্গিনি আর শেতাঙ্গদের জমায়েত তোকে বিব্রত করত, যেমনটা ইউরোপের সমুদ্র সৈকতগুলোয় হয়। গোয়ার সমুদ্র সৈকতের কথাও বলতে পারতাম, সেখানে রাশিয়ার নগ্নিকারা ভারতীয় চোরাদর্শকদের হাতছানি দ্যায়।
যখন রিও ডি জেনেরিও আর সাও পাওলো যাবি, দেখিস সেখানকার কার্নিভাল, চোখ জুড়িয়ে যাবে, ইচ্ছা করবে কার্নিভালের নর্তকীদের সঙ্গে নাচতে।
আমি তো ছিলাম রিও ডি জেনেরিওর ভারতীয় এমব্যাসিতে, ট্রেনি হিসাবে, প্রোবেশানারি পোস্টিঙের আগে। সেসময়ে পরিচয় হয়েছিল দূতাবাসের অফিশিয়াল ট্রানস্লেটর-ইনটারপ্রেটার কণিকা হালদারের সাথে, হৃদ্যতা বলতে পারিস; দজনেই বুঝতে পারছিলাম একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি, বাঙালি বন্ধুর অভাব মেটাতে, বাংলায় কথা বলার লোভে। আমরা দুজনেই টের পেয়েছিলাম যে প্রেম বিয়ে সংসার করা টাইপের নই, দুজনেই, ক্যারিয়ারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে শেষকালে, জীবনকে রুদ্ধ করে দেবে, পরস্পর আলোচনা করে আর এগোইনি।
কোপাকাবানা সমুদ্র সৈকতে অন্য যুবক-যুবতীরা চুমু খাচ্ছিল, দেখাদেখি বলতে পারিস, আমরাও খেলাম, কণিকা হালদার বলল, ছিঃ, চুমু জিনিসটা নোংরা, স্মেলি, কি যে হয় চুমু খেয়ে।
আমারও মনে হয়েছিল, একে তো ভালোবাসি না, কেনই বা একে চুমু খাচ্ছি, এর মুখে ক্যাণ্ডললাইট শুয়োর-ডিনার খাবার দুর্গন্ধ। ব্যাস, আমার জীবনে শেষ তরুণী।
এখন ভেবে দেখলে, মনে হয়, ভাগ্যিস কণিকা আর আমি জড়িয়ে পড়িনি। পড়লে, তোকে অন্য কেউ স্পনসর করত, আর আমার জীবনের অভিমুখ থাকত না কোনো।
অভিমুখ সব সময় যে নিজের নির্ণয়ের ওপর নির্ভর করে না, তাও জেনেছি, পরে।
ক্রমশ