গ ল্প
সকালের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি সেরে কোনোরকমে দুটো ডাল-ভাত মুখে তুলেই রাই দাঁড়িয়ে পড়ে আয়নার সামনে। লম্বা চুলের সামনেটা পাফ করে পিছনে কোনোদিন খেজুর বেণী, কোনোদিন পনি ঝুলিয়ে দেয়। মুখে পাউডার লাগিয়ে আইলাইনার দিয়ে নিপুণ হাতে এঁকে নেয় চোখ। লিপস্টিক তার সাকুল্যে দুটো। তাই-ই জামার সঙ্গে মোটামুটি ম্যাচ করে লাগিয়ে নেয়। প্রতিদিন কলেজ যাওয়ার আগে প্রসাধনে এটুকু সময় তাকে দিতেই হয়। এমনকি বাদ যায় না পরীক্ষার দিনগুলোও। ধ্যাত, যেমন তেমন করে বেরনো যায় না কি! তার ছিপছিপে, একটু বেশিই রোগা কিন্তু লম্বা শরীরটায়, ফিটিংস চুড়িদারে, গলার কাছে জড়ো করা ওড়নায় এইটুকু সাজ না হলে মানায়! বাড়ি থেকে কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে যাতায়াত করার সময় দু-একটা সিটি, ‘তোমায় হেব্বি লাগছে’ গান যে তার উদ্দেশ্যেই ছুটে আসে সে কি আর সে বোঝে না! এই রাস্তাটুকুই তো তার ওড়াউড়ি! বাদবাকি তো সেই কলেজ, লেকচার, ম্যাডামদের চোখপাকানো! কোনো কোনো স্যার অবশ্য একটু আধটু অন্যরকম হাসেন! কিন্তু ওই অব্দিই!
জমে যায় যখন কোনো বন্ধু প্রেমে পড়ে। না না, কলেজের ছেলেগুলোর সঙ্গে না। ওরা মেয়েদের দিকে তাকায় না। রাত থাকতে উঠে মাছের ভেড়িতে কাজ করে। দুপুরে কলেজে এসে ঝিমোয়! প্রেমে পড়ার ছেলেরা হয় অন্য; ওই যে কলেজের বাইরে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মাথায় স্পাইক করা, ডগার কাছটা লালচে, কিংবা অটো চালাতে চালাতে সাইড কাঁচে একঝলক তাকিয়ে চোখ মারে! বন্ধু তখন সুযোগ পেলেই ফিসফিস করে! কবে কলেজের রাস্তায় ওড়না ধরে টান মেরেছে; কবে পিঠে ছুঁড়েছে ফুল; পুরো ‘দিদি তেরা দেওয়র দিওয়ানা’; ভাইজান স্টাইল; কবে সন্ধের আলো-ছায়ায় বাড়ির পিছনের বাবলা গাছের আড়ালে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে! আরো একটু নিচেও নামিয়েছিল হাতটা!
কোথায় রে! গলায়!
না, আর একটু।
কোথায় রে! ওখানে! একদম ভিতরে! আহা বল না বাবা!
তার দু-এক মাসের ভিতরেই বন্ধু নিখোঁজ হয়। বাপ-মা কান্নাকাটি করে আসে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ খোঁজ চালালেও খোঁজ মেলে না। কিন্তু একসময় বন্ধুদের মোবাইলের ইনবক্স ভরে যায় একমাথা টকটকে লাল সিঁদুরে মাখামাখি পাউট করা নানা বিভঙ্গের ছবি। পাশে অবশ্যই স্পাইক করা ভাইজান।
তারপর হারিয়ে যায়। আর কোনো খোঁজ নেই। কোথায় যায়, কী হয়, বন্ধুরাও জানতে পারেনা। তারা তখন শুধু স্বপ্ন বোনে! আহা, পড়াশোনা নেই; বকাঝকা নেই; বরের ঘর; নতুন শাড়ি-জামা; সাজগোজ; সিনেমা-ফুচকা; আর রাতে… উউউফফফ! হাত পা কেমন শিরশির করে!!
দু-একজন যে একেবারে ফিরে আসে না তা নয়! সিঁদুর, শাঁখা পলা লোহা বাদ দিয়ে কুমারী মেয়ের মতো আসে! জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। দু-একমাস বাপের ঘরে থেকে এবার বাপের দেখে দেওয়া ছেলেকে বিয়ে করে। অনেকে আবার বাচ্চা কোলেও ফেরে। তারাও বিয়ে করে। একটু বেশি বয়সী বর জোটে তাদের। কিন্তু এসব ঘটনার মাঝেই কলেজের ম্যাডামরা কেবল ভয় দেখায়! বলে- মন দিয়ে পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। তারপর বিয়ে করবে।
বলে- প্রেম তো হতেই পারে। প্রেমিককেও বলো তোমার মতো পড়াশোনা করে চাকরির চেষ্টা করতে!
বলে- বিয়ের লোভ দেখিয়ে এ অঞ্চল থেকে মেয়ে নিয়ে নোংরা জায়গায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। তোমরা চাও তেমন জীবন? এখন কষ্ট করলে সারাজীবন মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে!
আরে বাবা! ম্যাডামগুলো যেন কী! নিজেরা বিয়ে করে বসে আছে! আমাদের বেলা যতো আপত্তি! ভালোবাসলে আর অপেক্ষা করা যায়! মনটা ছটফট করে না! শরীরটা আছাড়ি-বিছাড়ি করে না!
অবশ্য ঋতী ম্যাডাম আলাদা। বিয়ে-টিয়ে করেনি! অথচ বেশ দেখতে কিন্তু! একমাথা কোঁকড়া চুল। কি ঘন! অথচ বড়ো চুল রাখে না। সকলের সঙ্গে কেমন হেসে কথা বলে। ঋতী ম্যাডামের ক্লাসে নেতিয়ে পড়া ছেলেগুলোও কেমন চাঙ্গা হয়ে যায়! শুধু যখন প্রেমের কবিতা পড়ান, জীবনানন্দ কিংবা গালিব, কেমন উদাসী হয়ে দূরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে বলতে থাকেন! সব কথা ভালো বোঝা যায় না। ক্লাসটা থমথমে ভারি হয়ে ওঠে। উনি চুপ করলেই রাইদের কারো কারো ভিতর থেকে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
যাক গে! বাবা-মাকে চেঁচিয়ে বলে বেরোতে গিয়েই দরজায় হোঁচট খেল রাই। আরে, সামনের ছোটো পাঁচিলটায় কিশোরদা বসে আছে না!
তুমি কবে এলে?
কিশোর এক থাবলা সাদা থুতু পাশের জমিতে ফেলে ব্রাশ চিবোতে চিবোতে বলে- এই তো কালই।
বাব্বা, কত্ত বছর বাদে!
হ্যাঁ, ছ’বছর।
তুই কি কলেজ যাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
আর কতো পড়বি?
এই তো আর দুটো সেমেস্টার!
ও।
রাই বেরিয়ে আসে।
পরদিন বড় রাস্তা পার করে পুকুর পাড় ধরে কলেজের রাস্তাটায় ঢুকতেই সোঁওওওও করে একটা সাইকেল ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে দাঁড়ায়। রাই বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করছিল। খেয়াল করেনি। কিশোর ডাক দেয়- এদিকে শোনো।
রাই অবাক হয়। পিছন থেকে বন্ধুরা গুঁতো মারে। রাই এগিয়ে যায়।
এটা তোমার জন্য। একটা প্লাস্টিকে মোড়া লাল মতো কী যেন এগিয়ে দেয় কিশোর।
রাই নেয়।
কিশোর এঁকেবেঁকে সাইকেল চালিয়ে সিটি দিতে দিতে অদৃশ্য হয়।
রাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বন্ধুরাও হাসে। এসব ইশারা ওদের পরিচিত। প্যাকেট খুলে দেখা যায় একটা লাল রঙের ওড়না; জরি-চুমকিটুমকি বসিয়ে খুব কাজ করা। বন্ধুরা গান ধরে ‘লাল দুপট্টা উড় গয়ারে হাওয়াকে ঝোঁকে সে…’
ব্যস, তারপরই হয় বাবলা, নয় অশ্বত্থ, নয় অন্ধকার পুকুরের পাড়… শরীরী খেলায় মেতে ওঠে রাইয়ের কুমারী মন।
সেদিন সন্ধেবেলা বসে বসে কলেজের মিড-সেমের খাতা দেখছিল ঋতী। একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। কলেজের কোনো স্টুডেন্টরই হবে!
হ্যাঁ, বলছি।
ম্যাডাম, রাই বিয়ে করেছে।
কে রাই?
ম্যাডাম, ওই যে ফিফ্থ সেমেস্টারে পড়ে না! লম্বা করে! দেখতে ভালো!
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। কী হয়েছে?
ম্যাডাম, ও বিয়ে করেছে।
সে কী!
হ্যাঁ ম্যাডাম, আর কালকেই বম্বে চলে যাচ্ছে।
মানে? বম্বে কেন? তুমি কে বলছো?
ওর বর বম্বেতে থাকে ম্যাডাম। বরের মা বারে নাচে। ওকে ওখানেই নিয়ে যাচ্ছে।
ঋতীর কান দিয়ে খানিকটা গরম হাওয়া বেরিয়ে গেল। কোনোরকমে জিজ্ঞাসা করল- তুমি কে?
ফোনটা কেটে দিল। ছেলেটা কিছুতেই নিজের নামটা বলল না।
যাক, সেটা পরে ভাবলে চলবে। আপাতত ঋতী প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে সবটা জানাল। স্যার বললেন- দাঁড়াও, স্টিফেন আছে, সজল আছে; ওরা লোকাল লোক। আমি আগে দেখি ব্যাপারটা কী!
প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে। ঋতী পায়চারি করেই যাচ্ছে। বাবা বলছে, তুই এতো টেনশন করছিস কেন? প্রিন্সিপাল স্যার তো ব্যাপারটা দেখছেন!
তুমি বুঝতে পারছ না বাবা! মেয়েটাকে পাচারের চেষ্টা করছে! মেয়েটা দেখতে ভালো। পড়াশোনাটাও খারাপ করে না।
ঋতী হাতের তালুতে অন্য হাত মুঠো করে মারে। এতো করে বোঝাই! এতো বলি! তবু সেই ভুল করল!! ঋতীর অস্থির লাগতে থাকে।
আরো বেশ খানিকটা সময় পার করে প্রিন্সিপাল স্যার ফোন করে। ঋতী শোনো, ওই ছেলেটি এর আগেও একটি বিয়ে করেছিল। সেই বউ পালিয়ে এসে এখানে আবার বিয়ে করেছে।
কেন স্যার? পালিয়ে এসেছে কেন?
সেটা বলতে চাইছে না।
তবে কাল ওদের বিকেল চারটেয় ট্রেন। তার আগে দশটার মধ্যে কলেজে আসতে বলেছি।
আসবে স্যার? পালিয়ে যাবে না তো?
আমি লোকাল থানার ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। সাদা পোশাকে পুলিশ নজর রাখবে।
ঠিক আছে স্যার। আমি কাল দশটার আগেই পৌঁছে যাব।
চিন্তা কোরো না। মেয়েটাকে বাঁচাবোই।
পরদিন কলেজ পৌঁছেই ঋতী দেখা করে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে। অন্য কয়েকজন অধ্যাপকও বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। স্যার বলেন- দে অলরেডি হ্যাভ ডান হোয়াটএভার দে ওয়ান্ট টু ডু। অ্যান্ড উই কান্ট ক্যানসেল দেয়ার ম্যারেজ, বিকজ দে আর অ্যাডাল্ট!
ইয়েস স্যার।
সো আওয়ার ইনটেনশন ইজ জাস্ট টু কিপ গোয়িং দ্য গার্লস স্টাডি অ্যান্ড অলসো টু স্টে হার হিয়ার ইন হার পেরেন্টস কেয়ার!
ইয়েস স্যার। উই জাস্ট ডোন্ট অ্যালাও হার টু গো উইথ হার হাসব্যান্ড!
প্লিজ ঋতী। ডোন্ট বি এক্সাইটেড! উই মাস্ট ট্যাকেল ইট ভেরি ট্যাক্টফুলি!
সরি স্যার। ওকে স্যার।
লেটস গো। দে হ্যাভ অলরেডি কাম।
ঘরে ঢুকেই ঋতীর চোখ পড়ে যায় রাইয়ের ওপর। একমাথা সিঁদুর লাগিয়ে, রোগা রোগা হাতে চারটে শাঁখা পলা নোয়া চাপিয়ে লাল রঙের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে। ওকে দেখেই ঋতীর মনে হয় ওর সারা শরীর-মন ক্ষতবিক্ষত করে বুঝি অতো লাল রঙ পাওয়া গেছে!!
দেখুন স্যার, আমি আমার বৌমাকে পড়াব। মুম্বাইতে কলেজে ভর্তি করে দেবো। ও যতদূর খুশ পড়বে! রাইয়ের শাশুড়ি বলছে ভাঙা ভাঙা বাংলায়। বেশ ভারিক্কি চেহারা তার। সাজগোজে খুব একটা ভদ্রতার ছাপ নেই। তার হাবেভাবে তার পেশার একটা আন্দাজ করা চলে।
ঋতী বলে, রাই তো বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে। মুম্বাইতে সেটা কীভাবে সম্ভব?
আরে বাংলা পড়বে না তো, অন্য কিছু পড়বে!
রাই বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। ওর পক্ষে হিন্দি, মারাঠি বা অন্য ভাষায় পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। আর তাতে তো সময়ও নষ্ট হবে!
স্যার বলেন- ওর আর দুটো সেমেস্টার বাকি আছে। এখানে ওকে পড়াশোনাটা শেষ করতে দিন। মাত্র তো একটা বছর, তারপর না হয় মুম্বাই যাবে!
ঋতী বলে, গ্র্যাজুয়েট হয়ে থাকলে পরে চাকরির চেষ্টা করতে পারবে।
শুনে মহিলা কেমন ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে।
এতক্ষণ কিশোর বা রাই, রাইয়ের বাবা-মা একটা কথাও বলেনি। ওরা যেন ভয় পেয়েছে। চুরির দায়ে ধরা পড়েছে। হঠাৎ কিশোর ঋতীর পা চেপে ধরে। ঋতী চমকে উঠে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিতে চায়। স্যারও অবাক। কিশোর ওঠে না। বলে- আপনি ওকে এখানে রেখে দিন ম্যাডাম। ও পড়াশোনা করুক। আপনার পায়ে ওকে জায়গা দিন।
রাই জোরে কেঁদে ওঠে।
দরকার পড়লে আমি এখানেই কোনো কাজ ধরে নেবো। ওকে যেতে হবে না!
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি ওঠো। ওঠো।
ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে স্যার বলেন- আমরা তো রাইকে পড়ানোর কথাই ভাবছি। সেইজন্য তো তোমাদের এখানে ডেকেছি কথা বলব বলে।
ওরা প্রিন্সিপাল স্যার আর অধ্যাপকদের হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে চলে যায়। শুধু শাশুড়ি মা’র বিরক্তি টা চাপা থাকতে চায় না। নিজের ছেলেকে গজগজ করে কী যেন বলতে থাকে। রাই ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকে।
পরদিন থেকে রাইকে ক্লাসে দেখে ঋতী কিছুটা স্বস্তি পায়। বন্ধুরা রাইকে নিয়ে হৈ হৈ করতে চায়। ঋতী গুরুত্ব দেয় না। সকলকে বুঝিয়ে দিতে চায় বিয়ে করে রাই জীবনের কোনো মহান ব্রত পালন করেনি। বরং তার যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনাই তৈরি হয়েছিল। মনে মনে ভাবে, আগামীতেও যে মেয়েটার কপালে কী দুর্ভোগ আছে! নজরে নজরে রাখতে হবে ওকে।
রাই কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত দুর্ভাবনা কাটিয়ে ওঠে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করে, সাজগোজ করে; চেহারায় ওর একটা বেশ ঢলঢলে ভাব এসেছে; ফলন্ত লাউ ডগাটির মতো।
কলেজের অ্যানুয়াল স্পোর্টস। এবারে বেশ বড়ো করে আয়োজন করা হয়েছে। স্টুডেন্ট সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে। নতুন নতুন স্ট্রিম খোলা হচ্ছে। স্যার তাই এই অঞ্চলের বেশ বড়ো মাঠটাই ভাড়া করেছেন। কলেজের নিজস্ব মাঠটা ছোটো; জায়গা কম। স্টুডেন্টদের ন’টার মধ্যে চলে আসতে বলা হয়েছে। সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ছোটো করে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; তারপর প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তৃতা; তারপর এমএলএ স্পোর্টস-এর উদ্বোধন করবেন।
রাই আজ খুব সেজেছে। নাচের দলটাকে ও লিড করছে। সঙ্গে আছে দেবযানী। হৈ হৈ করে স্পোর্টস হলো; এক একটা রাউন্ডে সে কি উত্তেজনা! সবচেয়ে বেশি মজা হয়েছে টিচারদের ব্যালেন্স রেসে। পছন্দের টিচারদের নিয়ে স্টুডেন্টদের সে কী উন্মাদনা! সব মিটতে মিটতে প্রায় পাঁচটা বেজেছে। মাঠ খালি করে স্টুডেন্টদের রওনা করিয়ে তবে ঋতীরা বাড়ি ফিরেছে। সারাদিনের ক্লান্তি, হৈ চৈ… দিনটার রেশ যেন কাটতেই চাইছে না।
রাত তখন সাড়ে বারোটা হবে। ঋতীর ফোনটা বাজছে। ঋতী ধড়মড় করে উঠেছে। পাশের ঘর থেকে বাবাও ছুটে এসেছে। ছোটোমামু অসুস্থ; কিছু হলো না তো! ঋতী দেখে স্টিফেন ফোন করছে।
হ্যালো?
ম্যাডাম, স্টিফেন বলছি। কলেজের একটা মেয়ে পালিয়েছে। পুলিশ আপনাদের ওই রাই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছে।
ঋতীর পুরোটা মাথার ওপর দিয়ে যায়। কে পালিয়েছে? রাইকেই বা তুলে নিয়ে গেছে কেন?
ম্যাডাম, স্যারকে ফোনে পাচ্ছি না। তাই আপনাকে বলছি।
কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলো?
সবটা জানি না ম্যাডাম।
আচ্ছা, আমি দেখছি।
ঋতী প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে; সুইচড অফ। একটু চিন্তা করে সরাসরি থানার ওসিকেই ফোন করে।
ও, আপনি তদবির করছিলেন না এই মেয়েটাকে আটকাবার জন্য?
হ্যাঁ, মানে, কী হয়েছে?
কী আবার হবে! এরা সব লোকালি র্যাকেট চালায়!
কী বলছেন আপনি এসব!
যা বলছি ঠিক বলছি। ফোনটা কেটে যায়।
ঋতী ঘামতে শুরু করেছে। রাই র্যাকেট চালায়! রাই!
ঋতী রাজদীপকে ফোন করে। ও কলেজের কাছাকাছিই থাকে। ওরা দু’জনে মিলে ওই রাতেই পৌঁছোয় থানায়। রাই ঋতীকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে- ম্যাডাম আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি। আমি কিছু করিনি। ঋতী দেখে রাইয়ের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে। কষ কেটে রক্ত পড়ছে। ঋতী আগলে নিয়ে ধরে রাইকে।
আপনারা ওকে মেরেছেন?
ম্যাডাম, আপনি জানেন না ও কতো ধুরন্ধর! ওই সরিয়েছে মেয়েটাকে। ক’দিন ওর সঙ্গেই দেখা যাচ্ছিল। শেষবারও ওর সঙ্গেই দেখা গেছে!
সেই জন্য আপনি ধরেই নিচ্ছেন দেবযানীর মিসিং-এর পিছনে ওর ভূমিকা আছে। ওরা দু’জন ভালো বন্ধু অফিসার!
ওসব বন্ধু-টন্ধু অনেক দেখা আছে ম্যাডাম! আরোও দু’ঘা পড়লে সব বেরিয়ে আসবে!
ওর এগেন্সটে আপনাদের চার্জটা কী? কোনো এফআইআর হয়েছে?
সোমত্থ মেয়ে পাচার হলে বাপ-মা এফআইআর করে! কী বলছেন ম্যাডাম!
আপনি বিনা চার্জে ওকে থানায় এনে টর্চার করছেন? এটা তো পুরো বেআইনি!
আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না ম্যাডাম!
অবস্থা হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে রাজদীপ কথা বলতে এগোয়। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। সে রাতে রাইকে ছাড়া হয় না।
পরদিন প্রিন্সিপাল স্যার থানায় এসে কথা বলে রাইকে বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ রাইয়ের পিছন ছাড়ে না। বারবার বাড়িতে হানা দেয়; ভয় দেখায়; হুমকি দেয়। রাই কলেজ আসা বন্ধ করে দেয়। ওদিকে দেবযানীর কথা ভেবে ঋতীর কেমন পাগল পাগল লাগে। ইতিমধ্যে রাইয়ের শাশুড়ি এসে হাজির হয়েছে। রাইয়ের বন্ধুরাই ঋতীকে জানায়।
প্রায় পনেরো দিন পর দেবযানী ফোন করে ওর বাবার নম্বরে। ও বিয়ে করেছে। যোধপুরে আছে। ভালো আছে। শুরু হয় পুলিশী তৎপরতা। যোধপুর পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ করে কলকাতা পুলিশের একটা টিম উদ্ধার করে আনে দেবযানী আর ওর বরকে। ছেলেটা এ অঞ্চলেরই। বিয়ে করে যোধপুরে মামারবাড়ি পালিয়েছিল। দেবযানী ফিরলে এখানে ওর ধুমধাম করে বিয়ে হয়। হানিমুন তো আগেই সারা হয়ে গেছিল। দেবযানী তাই এবার পড়াশোনায় মন দেয়। ফাইনাল পরীক্ষাটা দিতে হবে না!
ওদিকে এলাকায় বদনাম হওয়ার অজুহাতে শাশুড়ি রাইকে নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দেয়। এবার আর কলেজকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। খুব শিগগিরই ট্রেনিং কমপ্লিট হয় রাইয়ের। মুম্বাইয়ের এঁদো গলির মদের ঠেকে বুক-পিঠ প্রায় খোলা ব্লাউজ আর নাভির নিচে কোমরের ভাঁজ দেখিয়ে হাঁটু অব্দি ঘাঘরা পরে কাস্টমারদের খুশি করতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয় রাইকে! ওর লাল জরিদার ওড়নাটা এখন রঙ্গিলা আশিকদের গলায় দোল খায়। শুধু কিশোর বসে বসে ভাবে কোথায় যেন সে পড়েছিল দুটো লাইন…
তোমাকে যে ছেড়ে যাই সে তোমারই জন্য
শ্রীরাধা যায় না কভু মথুরা জনারণ্য!