উ ই ন্ডো সি ট
বসন্ত কেমন রোগ জানি না। আমাদের ৭/১এ, অনরাইট সেকেন্ড লেনের বারো ঘর বাড়িতে সে হয়তো ঢুকতে ভয় পেত। কখনো কখনো চৌখুপি জানলা দিয়ে সন্ধে নামলে শাঁখের আওয়াজ, নামাজের সুরের সঙ্গে সঙ্গে বৈকালিক হারমোনিয়ামের রিদমিক আর্তনাদ শোনা যেত। হকি মাঠের দিক থেকে ক্রমান্বয়ে হকি স্টিকের ঠোকাঠুকির শব্দ, পাশের বাড়ির শাউড়ি-বউয়ের উদোম চিৎকার সেই সব দিনে দখিনা বাতাসকেও প্রাণপনে আটকে রাখতো। আমরা তো বসন্ত মানে বুঝতাম ‘মায়ের দয়া’। এ রোগ একবার যাকে ধরে তার থেকে শত হস্ত দূরে থাকাই শ্রেয়।
কালুরাম নামে একটা কোকিল ছিল আমাদের বাসায়। সারা বছর সেই কোকিলের কুহুরবে প্রাণপাখি যায় যায়। বিশেষ করে পড়তে বসার সময়টুকু সেই একঘেয়ে কুউউউ কুউউউ ডাক যেন ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।’ বইপত্র ছুঁড়েটুড়ে ফেলে মনে হতো খাঁচা খুলে কালুরামকে উড়িয়ে দিই।
অবশ্য ঋতুচক্রের আবর্তনের খবর সে বেচারা কী করে জানবে? গলির আয়তাকার রোদ্দুরে আলো ছায়ার কাটাকুটিতে, হালকা বৃষ্টির জমে যাওয়া জলে, গুমোট বাতাসে বসন্ত পা রাখতেও চিন্তা ভাবনা করতো। বেচারা কালুরাম, তার যুবক মনের আকুতি জানাতে তাই বছরের বিশেষ কোন ঋতুকে খুঁজে নেয়নি। সারা বছরই তার কাছে একইরকম ছিল।
দোলখেলা নিয়েও আমাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না, কারণ এই দোলের পরেই আসবে পরীক্ষা। কাজেই রঙের কোন বিলাসিতা ছিল না আমাদের এবং কালুরামেরও। জগতের সব রঙ শুষে নিয়ে মিশমিশে কৃষ্ণ গহ্বরের মতো একলা দাঁড়ে বসে গলা ফুলিয়ে ডাক ছাড়ত কালুরাম। সেই ডাক শুনে মনে হতো বসন্ত না জানি কি ভয়ানক ঋতু। দরকার নেই কোনো। ও না হয় থাক রচনা বইয়ের পাতাতে।
এরই মধ্যে একটা হুলো বেড়াল তক্কে তক্কে থাকতো। কীভাবে জানি না কেউ বোধহয় খাবার দিয়ে গিয়ে কালুরামের খাঁচার পাল্লাটা টানতে ভুলে গেছিল। রাতের আঁধারে সেই খোলা পাল্লার ভেতর দিয়ে কালুরাম বেরিয়ে এলো কিন্তু মুক্তির স্বাদ আর তার পাওয়া হোল না। বেচারা দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে উড়তে গিয়েও পারলো না। তক্কে তক্কে থাকা হুলোটা তাকে থাবার নখরে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত করে পালিয়ে গেল। খুব ভোরে উঠে দেখি সারারাত লাল রঙের ফাগে হোলি খেলে ঠিক খাঁচার পাশটিতেই রক্তাক্ত কালুরাম পড়ে আছে। তার রঙ খেলার শখ চিরতরে মিটে গেছে।
৭/১ এ, অনরেইট সেকেন্ড লেনের বাড়িতে তাই বসন্ত-টসন্ত কোনোদিনই কিছু মনে হয়নি। শুধু জানতাম বসন্ত খুব ছোঁয়াচে রোগ। একবার ছুঁয়ে দিলে সারা শরীরে, মুখে দাগ ধরে যায়। সারা জীবনেও সে দাগ মুছবার নয়।