ব ই আ লো চ না
দূরত্বে রচিত অন্ধকার
দেবাশিস চন্দ
ছবি: যোগেন চৌধুরী
প্রকাশক: কবিতা আশ্রম
৩০০ টাকা
‘কলকাতা, ২৩ মার্চ, ২০২০। বিকেল ৫টায় নেমে এল লকডাউনের খঁাড়া। তারপর মাসের পর মাস স্তব্ধ জনজীবন। অন্তরিন জীবনে তছনছ হয়ে গেল সব কিছু। এক ধাক্কায় পাল্টে গেল যাপনের ধারাপাত। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে ‘বিপর্যয়ের কানাগলি’তে দিশেহারা সবাই ‘এঁটেছে খিল অন্দরে বাহিরে।’ পেছনের মলাটে বইটি সম্পর্কে যে লেখা রয়েছে তা থেকে এই উদ্ধৃতি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে আচমকা নেমে আসা অতিমারীর বিপর্যয়ের ফলে যে দূরত্ব রচিত হল মানুষে মানুষে, যে অসহায় পরিস্থিতি তৈরি হল তারই নানা দিক উঠে এসেছে দেবাশিস চন্দের কাব্যগ্রন্থ ‘দূরত্বে রচিত অন্ধকার’–এ। সঙ্গতে রয়েছে যোগেন চৌধুরীর অসাধারণ সব ছবি। এই বই কবিতা–ছবির বিরল যুগলবন্দি। শুধু আঁকা নয় যোগেন চৌধুরী পুরো বইটি ডিজাইন করে দিয়েছেন। গতানুগতিকতার বাইরে এ এক অন্যরকম জলতরঙ্গ বাংলা বইয়ের গ্রন্থসজ্জায়। ‘নতুন রকম কিছু’ শিরোনামে যোগেন চৌধুরী লিখছেন— ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, সমাজের নানাবিধ বিপর্যয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, কর্মহীনতা— সব কিছু কবিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। তার কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা এক ‘অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারের দিকে—’ পৌঁছে যাই। আরও লিখছেন শিল্পী—‘কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে আমি বিশেষভাবে জড়িয়ে আছি। বইয়ের প্রচ্ছদ, ভেতরের রেখাচিত্র এবং গ্রন্থসজ্জার দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছে। আমি সেক্ষেত্রে প্রথাগত নিয়মের বাইরে গিয়ে নতুন রকম কিছু,করার কথা ভেবেছি।’
দেবাশিস চন্দ নিজেকে বলেন ‘শব্দশ্রমিক’। কবিতার পাশাপাশি শিল্পকলা নিয়ে লিখেছেন তিনটি বই এবং তাঁর সম্পাদনায় নয়া দিল্লির নিয়োগী বুকস থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেশ–বিদেশে সমাদৃত পশ্চিমবঙ্গের ২২ জন শিল্পী ও একজন ভাস্করের লেখা কবিতা–ছবির দ্বিভাষিক সঙ্কলন ‘ছবি আঁকিয়েদের কবিতা– Visual Rhapsody’।
‘কেউ কি জানত একদিন এই জনপদ হয়ে যাবে/ ভাইরাস–চিহ্নিত, শীতঘুমে যাবে ভোরের মায়া!’ (শীতঘুম)— এই বিস্ময়ের কাছে কবির সঙ্গে পাঠকও বিস্মিত না হয়ে পারেন না। নিভৃতবাসের নির্বাসনে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মন। মন কেমনের নৌকো ভেসে চলে পারাপারহীন, অবলম্বনহীন, আশ্রয়হীন। মানবিক দূরত্বের জারি হওয়া পরোয়ানা দুঃখ ও আনন্দ বিনিময়ের পথে বিছিয়ে দেয় কঁাটা। মন খারাপের ঘুড়ি উড়তে থাকে মেঘের সন্ন্যাসে।
কী দুরূহ এই বেঁচে থাকা! কী নিদারুণ এই যাপিত জীবন ! ‘স্পর্শহীন বেঁচে থাকা এক দুরূহ পাটিগণিত/ সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই অবসাদঘুম চেপে বসে/ চৌকাঠে স্থির সময়, অতিমারীর নিত্যনতুন/ থিমসঙ কামড়ে ধরছে ভয়ে বোবা ড্রইংরুম (দুরূহ)’— যন্ত্রণাময় কারাগারে ছটফট করতে থাকা অসহায় এক যাপন শব্দরূপ পেয়েছে, ভাষা পেয়েছে দেবাশিসের এই কবিতায়।
এই অসহায়তা কিংবা অচলায়তনের বন্দিত্ব বর্ণনাই কবি দেবাশিসের একমাত্র উচ্চারণ নয়। সাধারণ, শ্রমিক, প্রান্তিক, কায়িক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল মানুষদের দুর্দশা ও দুর্ভোগ তঁার সহানুভূতিশীল দৃষ্টিকে বিপন্ন করেছে বার বার— ‘ভাতের গল্পে মুখ ফেরায় রাষ্ট্র (কঁাপে বিশ্বাসের নোঙর)’, ‘রাষ্ট্র তো হঁাটতে বলেনি, রাষ্ট্র তো বলেনি বাড়ি ফিরে যেতে,/ রাষ্ট্র বলেছে যক্ষপুরীতে শ্রম দাও, তৈরি করো স্বর্ণ সিংহাসন/ রাষ্ট্র চেনে ভোটার— সংখ্যায় গুনতি, বেচুবাবু রাষ্ট্র চেনে বাজার/ মানুষের নেই তার প্রয়োজন (রাষ্ট্র চেনে বাজার)।’ বা, ‘হেঁটে চলেছে একটি দেশ,/ যে হঁাটার কোনও শেষ মাইলস্টোন নেই,/ যে দেশ ভাতের বদলে রক্ত তুলে দেয়/ শিশুর মুখে, পথে পথে থ্যঁাতলানো সূর্যমুখী,/ যে দেশ জানে না তার লোকের ঠিকানা,/ শরীরের ঘাম পরিযায়ী হয়ে উড়ে যায়, (থ্যঁাতলানো সূর্যমুখী)’। এরই সঙ্গে যু্ক্ত হয়েছে রাজনৈতিক চাপান–উতোর, যা কবির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি— ‘দ্বিধা–দ্বন্দ্বের করোনাক্রান্তি/ উতরোল বিবিধ বাণিজ্য সাম্পান/ দাদা যদি বলে ইহা দিদি বলে উহা/ এই চাপানো–উতর তুমি চাহ নাই (চাহ নাই)’, অথবা ‘তিনি বাংলার প্রভু/ তিনি বাংলার বাবু (একলা বৈশাখের গান)।
কিন্তু শুধুই কি দুঃসহ যাপন? মৃত্যু, বিপর্যয়, দুর্দশা, কর্মহীনতা? রাষ্ট্রিক উদাসীনতা ও রাজনৈতিক কাজিয়া? শুধু অন্ধকার, বিধুরতা? হতাশার বিপ্রতীপে ভয়ের ও ত্রাসের বিপরীতে আলোকরেখার উদ্ভাসটিও কবি এঁকেছেন অপরূপ মায়ায়, ভালবাসায়, আশ্চর্য আশাবাদে— ‘আসুক নতুন বৃষ্টি/ ভেসে যাক/ সব পাপ, বিদ্বেষ/ উড়ুক প্রজাপতি/ জোনাকির/ কারুসরণিতে/ বাজুক শঙ্খ/ ভয়ের আগুন/ নিভে যাক/ পরিযায়ী মেঘের/ কুসুমে স্নান সেরে/ মানুষ আবার/ মানুষ হোক (অন্তরিন)’। যে কবি বলেছিলেন ‘মানুষ ভুলে যাওয়া এই দেশ আমার নয় (থ্যঁাতলানো সূর্যমুখী), যিনি লিখেছিলেন ‘বাতাসের পাশে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া পথ নেই কোনও (গোপন)’, ‘ধোঁয়াশা অঁাকা ভয়ের ডোরাকাটা দাগ (অদৃশ্য)’ তিনিই বলে উঠছেন— ...সামাজিক দূরত্বের/ অসামাজিক বর্শাফলকের রক্তচোখে চোখ রেখে/ তোর কাছে যাই, এগিয়ে আসা ঝরনার শব্দমূর্ছায়/ ধুয়ে নেব সব পাপ, হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে/ উড়ে যাব আকাশে, বর্ষার পোয়াতি মেঘ দেবে ছায়া,/ রাজপথ, নির্জন বারান্দায় ছড়িয়ে যাবে সম্পর্কশেকড়,/ দূরত্ব–মানচিত্রের কণ্ঠনালি চেপে ধরে শেখাব সহবত,/ বুক চিরে দেখাব ভাল থাকার আলোকিত শিলালিপি (পলাশমিতালি)। কবি বলে ওঠেন— ‘দূরত্ব শাসনের উদ্ধত তর্জনী এক ফুঁয়ে/ উড়িয়ে বলি, দূরে নয়, কাছে কাছে স্পর্শে/ স্পর্শে জীবনের বৃন্দগান,... নৈঋত কোণের ঝড়ে উল্টে যাওয়া ঘর/ নতুন করে সাজাই, মধ্যরাতের পাগলা ঘণ্টি ঘুম কেড়ে/ নিলে ভয়কে তুড়ি মেরে সামাজিক দূরত্বের অষ্টপ্রহর বেজে/যাওয়া বিষাদহুকুম হটিয়ে এসো পাশে বসি, ভরসার বন্ধনে ফিরে/ পাই হারানো ঠিকানা, অন্তরিনের শেকল ছিঁড়ে স্নান হেমন্তের শিশিরে (ছুঁয়ে থাকি)’। অনন্ত এক প্রত্যাশায় কবির অনুপম উচ্চরণ— ‘কাচের মতো ঠুনকো অবিন্যস্ত সময় যাবে একদিন মুছে/ নতুন পৃথিবী দঁাড়িয়ে আছে সমুদ্রকল্লোলের মতো সত্য (নতুন পৃথিবী)।’
‘দূরত্বে রচিত অন্ধকার’ কবিতা বইতে কবি দেবাশিস করোনাকালের অন্তঃসারশূন্য মধ্য ও উচ্চবিত্তের ভার্চুয়াল সর্বস্বতাকে ব্যঙ্গ করেছেন— ‘অমুকে কবিতা লিখছে, তমুকে ধারাবাহিক,/ বানাচ্ছে সিনেমা, ফেসবুকে হেড়ে গলায় গান, দিগন্ত থেকে দিগন্তে/ উড়ছে খুশির অঁাচল, মোমের মতো নরম গালের চুম্বিত আহ্লাদ,/ বিনি পয়সার ভোজ, ফেসবুকের পাতায় পাতায় উড়ছে রংমশাল,/ পরস্পরের পিঠ চুলকোতে চুলকোতে আর পিঠই পাওয়া যাচ্ছে না... ফেসবুক উপচে পড়ছে খাবারের ছবিতে, মদ্যপানের আব্দারে,/ ইন্ডিয়ার বাবু–বিবিদের পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, ছুটির আমেজে দিবানিদ্রা,/ ভোজের পর ভোজ, সকালে, দুপুরে, বিকেলে, রাত্রে, টেবিল উপচানো/ খাবার, কত রং, কত বাহার, কত কিসিমের আয়োজনে আয়োজনে/ গড়ায় সকাল থেকে রাত, যৌনক্রীড়া, লোভের ক্রিমি কিলবিল করে/... অথচ ‘হেঁটে চলেছে খিদের ভারত, ভাইরাসের ভারত, অন্ধকারের ভারত,/ যে ভারতকে চেনে না ইন্ডিয়া, (লজ্জা দিবেন না)’। অথবা ‘জঁাতাকলে পড়িয়া গিয়া/ বাবু–বিবিরা কবিতা গল্প পাঠ করিয়া/ গান, আবৃত্তি, নাচ করিয়া, তবলা ঠুকিয়া/ বাহির ভুবন খুঁজিয়া বেড়ায় (জঁাতাকল)’। কবি দেবাশিস ক্রমশ আগ্রাসী ও অপ্রতিরোধ্য তঁার সামুহিক ক্রোধ ও ঘৃণায়, বিতৃষ্ণায়, ফেসবুকীয় অন্তঃসারশূন্যতায়।
বিপন্নতার ভিতরে ভিতরে আকাঙ্ক্ষা ও মিলনের দুরূহতার এবং অতীত যাপনের স্মৃতিতে উদ্বেল কবি। অন্ধকারের মধ্যেও আশার আলো দেখেন। কারণ অন্ধকারই তো জীবনের শেষ কথা নয়— কতদিন হয়ে গেল যুবতীর আঁচলের ছায়া/ পড়ে না, স্তনবৃন্তের কুসুমিত তাপে শরীর/ সেঁকতে না পারার দুঃখ নিয়ে শুয়ে আছে (ভয়)’। অথবা ‘যাব না ভেসে নৈরাজ্য–জঞ্জালে/ আছি হে আছি দেখে যাও বালিকা/ তোমার হাত ধরেই বেঁচে আছি (যাব না ভেসে)। কিংবা ‘তোমার স্তনের স্বর্ণচাপা আলোয় চাপা পড়ে যায়/ সব আতঙ্ক, মানুষের সব পাপের প্রাচীর ছাই হয়’ (আলো)।
কাব্যগ্রন্থের চিত্রকল্পে মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠে চমক— ‘জ্বলন্ত সূর্যকে ঢেঁকিছঁাট দিতে দিতে চাষিবউ/ অপেক্ষা করে কখন জ্বলে উঠবে সোহাগের আলো’ (কঁাপে বিশ্বাসের নোঙর)। অথবা ‘দিগন্তে উড়ে যায় সবুজ সাইকেল (ভোর)’। কিংবা ‘গোধূলির/ করুণ মায়াকাজালে/ অন্ধ চোখ/ জমে জমে/ পাললিক শিলা/... নাগরিক/ চালাকির গায়ে/ টাঙিয়েছে/ অর্থহীন এক/ ব্যর্থ পথলিপি (অন্তরিন)’। আরও লক্ষ্য করি— ‘খরগোশের মতো তুলতুলে সঙ্গিনী/ সন্দেশের মতো সারবান পুত্র–কন্যা (একলা বৈশাখের গান)।’ দেখি— ‘তিনি তো/ কান্নাকে/ আনন্দগানে/ ভিজিয়ে/ ব্রেকফাস্ট সারেন/ অন্তরিনের অস্থিরতা/ মিশিয়ে লাঞ্চ/ অজানা অন্ধকার/ দিয়ে ডিনার (একলা বৈশাখের গান)’। এরকম আরও অনেক।
ঝকঝকে ছাপা, উৎকৃষ্ট কাগজ, নিপুণ বঁাধাই— এরকম একটি কাব্যগ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য কবিতা আশ্রমকে ধন্যবাদ।