Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

অ ভি ন ন্দ ন   মু খো পা ধ্যা য়

abhi

পশ্চিম মেদিনীপুরের তরুণ প্রজন্মের কবিতাচর্চার খন্ডচিত্র

কবিতাবৃত্তে প্রত্যক্ষ ভাবে জেলার কবিতা এবং মহানগরের কবিতা নামক কোনো বাইনারি না থাকলেও সূক্ষ এবং অস্পষ্ট ভাবে একটি রেখা থেকেই যায় একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। যদিও স্থানভেদে কবিকে চিহ্নিত করা যায় কিনা এই নিয়ে চিরকালীন এক মতভেদ থেকেই গেছে। পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু মত স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন বহুজন। এর কোনোটিকেই একবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না। কিন্তু স্থানমাহাত্ম্য যে কবির কবিতায় ছাপ ফেলে সেই নিয়ে অনেকক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ নেই। ধরা যাক প্রান্তিক এলাকায় বসে একজন কবি যখন লিখবেন তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই স্থানের লোকাল ডায়লেক্ট, ট্যাবু, স্থানীয় প্রবাদ, দৃশ্যমান প্রকৃতি তার কবিতায় ঢুকে পড়তে প্রায় বাধ্য। আবার শহরে বসে লিখলে শহুরে যাপন, চর্যা, ঠেকের ভাষা ঢুকে যাওয়াই স্বাভাবিক। ঠিক এখানেই কবিকে সৎ এবং সাহসী হতে হয়। স্পষ্ট দৃশ্যমানতা এবং জীবনচর্চাকে অস্বীকার না করে, কোনো কৃত্রিম ভাষায় সওয়ার না হয়ে নিজের দেখাটুকুকে যে কোনো আঙ্গিকে এবং শব্দে প্রকাশ করা।

শিল্প এবং সাহিত্যচর্চার দিক দিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বরাবরই অন্য জেলার চেয়ে এগিয়ে থেকেছে বিভিন্ন সময়। সম্ভবত মেদিনীপুরের প্রথম কবি ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন দে যাকে সবাই সু মো দে নামেই চিনতেন। ক্রমশ এই চর্চা বেড়েছে এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাহিত্যও উন্নত হতে হতে পথ চলেছে। এই জেলাতে কবিতা চর্চা করেছেন প্রয়াত বীতশোক ভট্টাচার্য। নিয়মিত কবিতাকে নিয়ে এখনও কাজ করে চলেছেন প্রভাত মিশ্র, বিপ্লব মাজি, অচিন্ত্য নন্দী, সিদ্ধার্থ সাঁতরা, প্রদীপ দেব বর্মন, সনৎ দাস, সুনীল মাজি সহ আরো অনেক সিনিয়ার মানুষ যারা শুধু লেখার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে ক্রমাগত বিভিন্ন কাজে তরুণদের উৎসাহিত করে চলেছেন। কিন্তু পরবর্তী সামান্য কটি কথা যাকে মুখবন্ধও বলা যায়, তা শুধুমাত্র তরুণদের কবিতা নিয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের শূন্য এবং প্রথম দশকের কবিতাচর্চা নিয়ে।

নব্বইয়ের শেষে, শূন্য দশকের শুরু দিকে একঝাঁক তরুণ উঠে এলো তাদের শাণিত কলম নিয়ে। ঋত্বিক ত্রিপাঠী, স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত, রামকৃষ্ণ মহাপাত্র, নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, প্রসূন কুমার পড়িয়া, রাণা দাস, অরুণ দাস, বিশ্ব বন্দোপাধ্যায়,  কমলেশ নন্দ, আনন্দরূপ নায়েক, সুমন মহান্তি, লক্ষ্মীকান্ত মন্ডল, দেবাশিস মহারানা, অভি সমাদ্দার, দূর্বাদল মজুমদার, গৌতম মাহাত সহ আরো বহু কবি যাঁরা বঙ্গকবিতার প্রবাহিত ধারায় আলাদা করে নিজেদের চিনিয়ে নিতে বাধ্য করলেন। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে উন্মাদনা শুরু হলো হইহই করে। বদলে যেতে লাগলো কবিতার ভাষা। চলতে লাগলো দল বেঁধে কবিতা পড়তে যাওয়া, বইপ্রকাশ। বিতর্ক, মতভেদও পিছু ছাড়লো না । সব কিছু নিয়েই পশ্চিম মেদিনীপুরের শূন্য দশকের কবিতাচর্চা এগোতে লাগলো।

প্রথম দশকে পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল লিটল ম্যাগাজিন আকাদেমি গঠন এবং তাঁকে কেন্দ্র করে নতুন কবিদের ঘূর্ণন। এই আকাদেমির সাথে জড়িয়ে গেল বহু তরুণ কবি যারা কবিতাকে ভালোবেসে নিয়মিত নতুন ভাষা, নতুন আঙ্গিকের চর্চা শুরু করলো। লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে উপলক্ষ্য করে তরুণদের কবিতা ভাবনায় এলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে আসা প্রকৃতির নিয়ম। এক্ষত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম হলো না। লিটল ম্যাগাজিন মেলা বন্ধ হলো। যাঁরা নেতৃত্ব ছিলেন তাঁরাও ক্রমে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হলেন।

ঠিক এই সময়ে যখন মনে হচ্ছিল এর পরে কারা তখনই কার্যত বাংলা কবিতায় সকলকে চমকে দিয়ে উঠে এলো একের পর এক নাম। যারা সাহসী, যারা কারুর মুখাপেক্ষী নয়, যারা প্রয়োজনে কবিতা নিয়ে সারারাত জেগে থাকতে পারে, আবার মহামারীর সময় মানুষকে সুস্থ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পাঠ আগ্রহ, কবিতা বিষয়ে সিরিয়াসনেস, অপঠিত অথচ শক্তিশালী কবিদের খুঁজে বার করে পড়া, মানুষের সাথে ব্যবহার, যে কোনো প্রলোভনকে এড়িয়ে চলার দক্ষতা, দ্রুত বিখ্যাত হওয়ার মোহহীনতা ক্রমশই অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিলো পশ্চিম মেদিনীপুরের তরুণ কবিদের।

এবার দেখা যাক শালবনীর মধুপুর গ্রামের মৃণালকান্তি মাহাত কী কবিতা লিখছে।  ‘মহুল বিহা’ নামক কবিতায় সে লিখছে ‘ আজ থেকে আশি বছর আগে আমার ঠাকুমা প্রথম বিয়ে করে ছিল মহুল গাছকে’ কিংবা ‘সঞ্চয়’ কবিতাটি শেষ হচ্ছে এভাবে ‘ডুমুর গাছ, গোরুর বাথান, পুকুর আর কুমিরের আদ্দাশ নিয়ে যাব কর্মু-ধর্মুর সাথে’। খুব স্পষ্ট ভাবে তার যাপন এবং পারিপার্শ্বিকতা উঠে আসছে কবিতার শরীরে। সৌমেন শেখর ‘শীত’ কবিতায় লিখছে ‘তার শ্বেতাভ বস্ত্রের শিরায় ছুটে উঠেছে বৈরাগ্য ধ্বনি, অভিজ্ঞান আলো’।

গভীর অনুধ্যান লেখাটির অলঙ্কার। অনিরুদ্ধ ব্যানার্জী লিখছে ‘আমরা এই মফস্বলে থাকতে থাকতে / প্রেমিক হয়ে যাই।’ অমিত পন্ডিত-এর দেখাটুকু অসামান্য হয়ে উঠছে কয়েকটি লাইনে ‘ ইস্ক নামের পাখিটি গাইছে / নীল সুরে গাইছে / কাছে পিঠে কোনো নদী নেই / তবুও কেউ জল রঙের বৈঠা বাইছে।’ খুকু ভূঁঞ্যা-র আখ্যান মূলক লেখা আপনাকে বাধ্য করবে পুরোটা পড়িয়ে নিতে। একটি কবিতায় সে লিখছে ‘ মৃতের কোনো সহোদর নেই/ ফ্যাকাশে রোদ ডুবে যায়, গলায় মুন্ডুমালা’।  সন্তু মুখোপাধ্যায় লিখছে ‘ একটি পরিধির মধ্যে নিজেকে না আটকে / চোখ খোলো, ফুলকে ভালবেসে দ্যাখো’। সুজিত মান্না লিখছে ‘ বৃত্তের ভেতর দাঁড়িয়ে নিজের বর্গ করছি; দেখছি একই চিৎকার নিয়ে / দীর্ঘকাল বসে আছি’ কিংবা ‘ভূমিকায় একা হয়ে পড়বে তুমি। মনে হবে নিজের অবয়ব যেন / তিরস্কারের ঝাঁক / অথচ/ যে কোনো মুহূর্তেই চোখ বুজিয়ে/ দুই তৃতীয়াংশ মেরুদন্ড বেচে দেওয়া যায়। ‘ অমিত বেরা লিখছে ‘ পবিত্র দুধ, তুমি এসে বসো এ ভাঙা স্তনে’। 

এভাবে অজস্র লাইনের উদাহরণ তুলে এই লেখা পূর্ণ করে দেওয়া যায়, কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সবটুকু সম্ভব হয় না। এরা ছাড়াও অর্পিতা কুন্ডু, আকাশ রায়, রূপক সেনগুপ্ত, সোমা প্রধান, সুজাতা কয়াল, শায়েরি চক্রবর্তী, মৌপর্ণা মুখার্জী, সন্তু জানা, দীপক জানা, সায়ন্ন্যা দাশদত্ত, আগমনী কর মিশ্র, রোমা মন্ডল ব্যানার্জী, সূর্যকান্ত জানা, দেবলীনা সিংহ দাস, সুব্রত দাস, রোহন নাম্বিয়ার, রাজেশ্বরী ষড়ংগী, মধুমিতা বেতাল, কেশব মেট্যা, অর্থিতা মন্ডল, সুমিত মন্ডল, পবিত্র পাত্র, শশীভূষণ পাত্র, প্রসাদ মল্লিক, সন্দীপন বেরা, অসীম ভুঁইয়া, অর্ণব মন্ডল, মঞ্জু হেমব্রম, সৌতিক হাতি, রাখি দে পাঁজা, দোলন চাঁপা তেওয়ারি, নিসর্গ নির্যাস, ধনঞ্জয় দেবসিংহ সহ আরো বহু তরুণ-তরুণী অসামান্য কবিতা লিখে চলেছে বা ক্রমাগত লিখতে চেষ্টা করছে। স্মৃতির বেইমানিতে সব নাম উল্লেখ করা গেল না। এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। আপনারা এদের খুঁজে পড়বেন এটুকুই প্রত্যাশা। নির্বাচিত দশজনের কবিতা এই সংখ্যায় রইলো। কোনো নির্বাচনই নিখুঁত নয়। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে উল্লেখিত কবিদের নিয়ে হয়তো আরো দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ পাওয়া যাবে।

রামকৃষ্ণ মহাপাত্র
রাজেশ্বরী ষড়ংগী
নিসর্গ নির্যাস
অর্থিতা মন্ডল
আকাশ রায়
সুমিত মন্ডল
সৌমেন শেখর
মৃণালকান্তি মাহাত
খুকু ভূঞ্যা
শায়েরি চক্রবর্তী

আরও পড়ুন...