Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ প ন্যা স । পর্ব ১

ম ল য়   রা য় চৌ ধু রী র

জাদুবাস্তব উপন্যাস

malay_roy_choudhury

আঁস্তাকুড়ের এলেকট্রা

রেজিস্ট্রেশানের সময় বানান ভুল করে ফেলেছিল ক্লার্ক নবীন খান্না, মুখে পান সত্ত্বেও পরশ্রীকাতর ফিকে হাসি, ঠোঁটের কোনায় লালচে ফেনা, পেটের ভেতর কৃষ্ণচূড়া ছড়িয়ে চলেছে ফিনফিনে পাপড়ি, টাকের জেদি কয়েকটা চুল ফ্যাকাশে, আলস্য দেখে মনে হয় যেন ঠাকুমার পালঙ্কের পাশে হাঁটু গেড়ে সম্পত্তির আশায় সময় কাটাচ্ছে ।

তখনও পর্যন্ত জংধরা টাইপরাইটার সরিয়ে ঝকঝকে কমপিউটার আর ঝুলেল টুনিবালব নিভিয়ে কুয়াশাময় সিএফএল ঢোকেনি সরকারি দপ্তরে ।

রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের জন্মদিন কে নিশ্চিত করবে; করল একটা ভুল, যেমন নামের ভুল, ভুল লেখা হল বার্থ সার্টিফিকেটে, তোর জন্মদিন পয়লা জানুয়ারি, হ্যাপি নিউ ইয়ার আর হ্যাপি বার্থডে ।

কত মজার, না? উঁহু, তুই বলবি, মোটেও মজার নয় ।

দিল্লিতে প্রথম আষাঢ়ের ফোঁটায় ফোঁটায় ভেজা সকাল, গাড়ির কাচে ওয়াইপার নিজের মনে গাইছে, মুছে দাও মুছে দাও মুছে দাও ।

 

চিরুনিধার বৃষ্টিতে, ভুরুকোঁচকানো হাওয়ায়, সমস্ত ডানা সরিয়ে ফেলা হয়েছে আকাশ থেকে।

রুলটানা শুকনো অশথ্থপাতা ওড়ে। নারকেল পাতার ওপর কাকগৃহিণীর বলাশয়।

ফুটপাতের বালিতে জল সেঁদোবার রিনরিন রিনরিন রিনরিন রিনরিন।

শোনা গিয়েছিল অন্ধের পা রাখার আওয়াজ। বৃষ্টির টুপটাপে সময় পড়ার শব্দ।

ভাসিয়ে নিয়ে গেলি ধাঁধার উড়ন্ত মেঘের পালকে শুয়ে চাই চাই চাই চাই, তোর দাবি।

 

যায়নি মোছা, মুছতে পারিনি রে।

কত জরুরি ছিল মুছে ফেলা।

জগদীশ ব্যানার্জি তখন পানিপথে পোস্টেড, এজিএমইউ ক্যাডার বলে হার্ড পোস্টিঙ ঘুরে এসে আমি দিল্লিতে প্রথম পোস্টিঙে, ওকে বলেছিলাম আসতে, তোকে পছন্দ করার জন্য।

জগদীশ ব্যানার্জির নতুন টাকের ফিকে উঁকির ওপর বৃষ্টি, খবরের কাগজ দিয়ে আড়াল করছে বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি আমার ভালোলাগে, মাত্র কয়েকটা তো ফোঁটা, আদর করতে করতে গড়িয়ে চলে যায় বুকে, পেটে বা আরও তলায়।

আমরা দুজনে, বৃষ্টির পিছু ধাওয়া এড়াতে, প্রায় দৌড়ে ওদের হলঘরে ঢুকতেই, প্রথমে তুই-ই চোখে পড়লি, তোর খিলখিল হাসি, এক বছর বয়সেই। অন্য বাচ্চাদের চেয়ে তোর পা লম্বা, নজরে পড়ে গিয়েছিলি, সবার চেয়ে ঢ্যাঙা।

কোলে তুলে নিলাম তোকে । 

এটা সেই মুহূর্ত, যা সবায়ের জীবনে আসে, এমনই এক মোড়, যেখান থেকে ফিরে যাওয়া যায় না, সবুজ প্রতিভা, সুরের গমক, মায়া; নিজের অবস্হান এক মুহূর্তের মধ্যে নির্ণয় করে ফেলতে হয়। আমি অনুপ্রাণনা-তাড়িত পুরুষ, ঠিক সময়ে যথার্থ নির্ণয় নিতে না পারলে জীবনের ভারসাম্য গোলমাল হয়ে যেতে পারে, এরকমটা মনে হয়, শেষে জমে-থাকা হতাশা হয়ে উঠবে অত্যন্ত কষ্টকর, ভবিষ্যতে কি হবে আঁচ করে নির্ণয় ঝুলিয়ে রাখতে পারি না।

 

স্পর্শের মর্মার্থ হয়, মর্মার্থের রসায়ন, রসায়নের সম্পর্কে, রেণু, পরাগ, উড়াল, জীবন।

চাউনির কোলাহল, উতরোল শ্বাস। প্রতিরোধে ক্ষয়ে অনড় ঝর্ণাপাথর। জিওল মাছের নিঃশব্দ ছটফট। তোর মতো তোর মতো তোর মতো করে নিয়ে গেলি আমাকে আমার আমি থেকে ছিঁড়ে।

এর মতো, ওর মতো, তার মতো, কারো মতো নয়।

যেন এমন, যেন অমন, যেন তেমন নয়।

 

তোর নাকে নাক দিয়ে আদর করেছিলাম, গালে আর নাভিতে চুমো খেয়েছিলাম, উসকে দিয়েছিলাম তোর খিলখিল, পাখিদের গান শুধরে দেবার হাসি, খাঁজকাটা রোদ্দুরের ডালে-ডালে দোয়েল-কিশোরীরা স্বরলিপি ভুলে যায়, পায়ের তলায় আদর করতে পা গুটিয়ে নিয়েছিলি, ওঃ, তোর সেই মিডাস টাচ।

তোর নাম আমি রাখতে চেয়েছিলুম নীতি, আসলে ওটা আমার ঠাকুমার নাম; উনি আমায় সবচেয়ে বেশি আদর করতেন, খাওয়ার পরও জানতে চাইতেন, কি রে খাওয়া হয়েছে?

 

নকশিকাঁথা, আমসত্ব, শেতলপাটি, তামার পয়সা, গোবিন্দভোগ, কুমড়োবিচির মেঠাই, রেড়ির তেলের গন্ধ, কুপির আলো, পুকুর, ধানখেত, টিয়াপাখি। রামধনু গড়তে শিখছে আকাশ। গাছের ছায়া কিনে নিয়ে গেছে পাইকার। পায়ের শিরায় মাইল-পাথরের স্হায়ীত্ব। ঠাকুমা।

 

একটা ইংরেজি ‘ই’ বাদ পড়ায় তোর নাম হয়ে গেল নেতি; শুনেছি, বন্ধুরা তোকে নেটি নাটি নাট করে দিয়েছে, তা তো আমার দোষ নয়।

শুনেছি, তোর একাধজন ক্লাসমেট খুনসুটি করে নেটা বলে ক্ষ্যাপায়, নেটা মানে শিকনি। তুই একেবারে গা করিস না, তাও শুনেছি, তোর এক সহপাঠিনীর অভিভাবকের কাছে, আমার সঙ্গে সেও তখন পুডুচেরিতে পোস্টেড, কাঁধ শ্রাগ করে নাকি বলিস, সো হোয়াট, আই’ল স্টিক ইট টু ইওর আস, ক্লাস ফোর থেকেই ।

জগদীশের স্ত্রী অমরিন্দর, কখনও হরিয়ানভি জাঠ ছিল, বিয়ের পর মাছভাত খেয়ে, জামদানি পরে, দুর্গাপুজোয় গরদের শাড়িতে সিঁদুর খেলে, জলসায় গলাকাঁপা বাংলা গান গেয়ে, পুরোপুরি বাঙালি, তোকে নিত্তু বলে ডাকে, জানি, নিত্তু বেটি, কি খাবি, বাংলা না পানজাবি রেসিপি, সরসো কা সাগ উইথ মক্কি কি রোটি, ছোলে ভাটুরে, রাজমা চাওয়ল। বলেছে জগদীশ, চেককাটা লুঙ্গিতে বাইফোকাল পুঁছে।

তুই বলতিস, নো নো, আন্টিমা, আমি মাছ ভাত খাবো, মুড়িঘন্ট বানাও না, আঙ্কলবাপির ফেভারিট। শুনেছি।

জগদীশের বড় মেয়ে বৈদেহী বিরক্ত হতো, এতো সাধাসাধি কিসের? যা সবাই খায় তা-ই খাবে । পরে মানিয়ে নিয়েছিল, তোর আপন করে নেবার বৈশিষ্ট্যের আদরে। তোর আয়ত্বে আছে গোপন উষ্ণমণ্ডল, শুনেছি।

অমরিন্দরের বিয়ের সময়ে ঝামেলা করেছিল ওদের এক ভঁয়সাপেটা জাঠ পঞ্চায়েত কর্তা; জগদীশ সিলকের পাঞ্জাবি খুলে, পৈতে দিখিয়ে হেঁকেছিল, আমি হলুম বাঙালি ব্রাহ্মণ, স্যারজি, ব্যানার্জি, সবচেয়ে উঁচু ব্রাহ্মণ ।

ওদের ষণ্ডাদের ব্যানার্জির হাঁটু ছুঁয়ে সে কি পরনাম, পরনাম, পরনাম । এও শোনা, বলেছে অমরিন্দর ।

পৈতেতে বুড়ো আঙুল জড়িয়ে বাপের বয়সী ভুঁড়োদের পাগড়িতে হাত রেখে জগদীশ বলেছিল, জিতে রহো পুত্তরজি, ফুলো ফলো, পিও পিলাও ।

বিয়ে হল, বিয়েতে মদ খেয়ে ব্যাণ্ডবাজিয়েদের তালে-তাল নাচ হল, জগদীশ যৌতুকে পেল গুড়গাঁওয়ে জমি, যার ওপর ও দোতলা বাঙলো তুলেছে, আর ঘুষের টাকায় তাকে ক্রমশ ফিল্মসেটের মতন করে ফেলেছে, মায়াবি। ঘুষের টাকায় কলকাতায় নিউটাউনে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে, অমরিন্দরের নামে, মায়াবি। চণ্ডীগড় ছেড়ে বেরোতে চায় না, তাই। ছুটিতে বোতলক্রেট গুড়গাঁও কিংবা যেখানে আমি বা কোনো বাঙালি কলিগ পোস্টেড; থ্রি চিয়ার্স।

ঘুষের টাকা নেবার জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলে আর বছর দুয়েক পরে বন্ধ করে আবার অন্য অ্যাকাউন্ট খোলে; কখনও নিজের নামে, কখনও অমরিন্দরের নামে, কখনও শিডুল্ড ব্যাঙ্ক, কখনও প্রায়ভেট ব্যাঙ্ক, কখনও আরবান কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, কখনও টয়লেটের লফ্ট ব্যাঙ্ক, কখনও পুজোর ঘরের ফাঁপা দেয়ালে আনারকলি ব্যাঙ্ক।

গলা অব্দি কুয়াশায় ডোবা মানুষের নাম না-পালটাতে পারার মজাদার অসুখের আনন্দ। চাঁদবণিক প্রায়ভেট লিমিটেড বললে, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। প্রতি বদলির বিদায় সম্বর্ধনায় একই বক্তৃতা দ্যায়, লিখে রাখা আছে।

সকালে স্নানের পর গামছা-কোমর জগদীশ, টাকের চুল ফুরিয়ে গিয়ে করোটিতে রূপান্তরিত, বাঁহাতে পেতলের ছোটো ঘন্টিতে টুংটাং, ডানহাতে দুশো এম এল গঙ্গাজল, গ্যাঁদাপাপড়ি, দরোজায় দরোজায়, সংস্কৃত মন্তরের ফিসফিস, বৈশাখ জৈষ্ঠ আষাড় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক অঘ্রাণ পৌষ মাঘ ফাল্গুন চৈত্র, কিছুটা ঝুঁকে, যেন সময়ের সঙ্গে বেমানান আধ্যাত্মিক কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার ।

পুজোর ঘর পাথর-মাটি-কাঠ-পেতলের দেবী-দেবতায় ছয়লাপ, দেয়ালের পেরেকে-পেরেকে কুড়ি-পঁচিশ বছরের পুরোনো বাংলা ক্যালেণ্ডারের দেবী-দেবতা, থাক-থাক পাঁজি, পুজোর বই, পাঁচালি, পিলসুজ, পুজোর ন্যানো সাইজের থালা-ঘটি-বাটি, রুপোর; হেসে, গলার লাল শালুতে শালিগ্রামশিলা ঝুলিয়ে, বলেছিল ওর পার্টটাইম পুরুত অবিনাশ ভট্টচাজ্জি, যে নিজেই গজগজ করে দেবী-দেবতারা সংস্কৃত মরা ভাষা থেকে আজও বেরোতে পারেনি, বুঝতে পারে না কোন বিসর্গের কি অর্থ।

জগদীশের জ্বরজারি হলে, অমরিন্দর, কালোর চেয়ে কালো কলপে ভেজা চুল, কোমরে এক গামছা বুকে আরেক, আজও জিগ্যেস করে, এর পর কোন মন্তর? গামছা যায় কলকাতা থেকে, বাঙালি জুনিয়ার অফিসারদের দৌলতে । অবশ্যই লাল, অবশ্যই সবচেয়ে বড় মাপের, যদিও অমরিন্দরের জাঠনি বুক ঢাকতে পারে না সে-গামছা, পেটে সিজারিয়ানের কাটার দাগ উঁকি দিয়ে ঝোলে । তিন বছর লেগেছিল শাঁখ-বাজানো শিখতে, শুনেছি।

কী করে আপনাদের পরিচয় হল, অমরিন্দর তো দু-এক ইঞ্চ লম্বা, জানতে চেয়েছিলাম ।

জগদীশ বলেছিল, ভাঁজের প্রতিভায় ছিল সীমাভাঙার টান, জগদীশেরই দপতরে, পানিপতে, এসডিও অফিসে এসেছিল কোনো কাজে । ব্যাস, বাস্তববাদিনীর উদ্যমের  সঙ্গে বলগাছেঁড়া কল্পনা ; দেহের আনাচে-কানাচে টই-টই জাঠনির অবিমিশ্র উপঢৌকন ; ধুলোয় মোচড় দেয়া গন্ধ । জাঠনির মতো উরু পাবেনা ভারতে ; মোষের দুধ-দই খায়, গোরু একদম নয়।

পানিপতের রঞ্জক গোলাপ, সাদা গোলাপ, লাল গোলাপ, হলুদ গোলাপ, কমলা গোলাপ, গোলাপি গোলাপ, কালো গোলাপ, ইরানি গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ ; শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম, চোখ কলম । আহাআহা। দেহজুড়ে চুমুর দাঙ্গা ।

 

সংবেদনশীল আলোড়ন, জলসিক্ত উড়ন্ত ছাতা ।

শান্তির মৌনতা হাওয়া থেকে হাওয়ায়, স্হান থেকে স্হানান্তরে ।

উতরোল কোলাহল।

 

অমরিন্দর:  যাক ওই করওয়া চৌথের জুঠঝামেলা থেকে বাঁচলুম, না খেয়ে থাকো সারাদিন, ওসব আমার দ্বারা হবে না, চালুনি দিয়ে বরের মুখ দেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে আমি সিঁদুর-খেলা খেলে তাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখব। বরকে বরং আলুর পরোটা, মেথি-শাকের পরোটা, পুদিনার পরোটা, বেসনের পরোটা, কিমার পরোটা খাওয়াবো, সিঁদুর খেলা থেকে ফিরে, ঘিয়ে চপচপে পরোটা। করওয়া চৌথ হল চালুনি কারখানাগুলোর কারসাজি; নয়তো কবেই বন্ধ হয়ে যেত, পুরোনো কারখানা বন্ধ হয়ে এখন বের করেছে প্লাস্টিকের চালুনি।

সাহেবরা চাঁদে গিয়ে গোসল করে এলো, সেই চাঁদের দিকে তাকাও, মানে হয় কোনো, অ্যাঁয়জি !

জগদীশ: কিন্তু তুমি লাঞ্চ আর ডিনারে কাঁচা পেঁয়াজ কামড়ে খাবার অভ্যাস ছাড়তে পারলে না।

অমরিন্দর: তোমার শুঁটকি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারি, আর তুমি কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ সহ্য করতে পারো না? প্যার মোহব্বত প্রেম ভালোবাসা হল গন্ধের আপোস। বাজারে পেঁয়াজ না এলে হরিয়াণার সরকার উলটে যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাজারে মাছ না এলে কি সরকার ওলটায়?

জগদীশ: অমন কখনও হয় না, মাছ আসবেই, বাঙালি মাছ খাবেই, যত দামই হোক, সরকারকে ফেলবে না। সেখানে সরকার পড়ে মাৎস্যন্যায়ে।

অমরিন্দর: তোমরা বাংগালিরা পরৌনঠাকে পরোটা বলো কেন, অ্যাঁয়জি?

চাবির ঘোলাটে ফুটোয় যাবৎজীবন চোখ। অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে-আনা সকালের বিকল্প।

সান্নিধ্যের নৈকট্য ঘিরে অফুরন্ত অবসর। প্রেম-টিকলিং নিড়ুনি।

কৃষ্ণবিবরের অচিন্ত্যনীয় ভর, আলো পর্যন্ত বেরোতে পারেনি।

জগদীশ আর অমরিন্দর আমাকে ব্রো-প্রো বলে ডাকে, এল বি এস ন্যাশানাল অ্যাকাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশানে ট্রেনিঙের সময় থেকে আমাকে সকলে ব্রো-প্রো করে নিয়েছে, ব্রাদার প্রভঞ্জন । জগদীশ আমার চেয়ে পাঁচ বছরের সিনিয়র, ঘোঁৎঘাঁত বিশেষজ্ঞ । ও ঠিক খবর রাখে  কখন বিরোধীদলে চলে যাবার কথা চিন্তা করছে সকালবেলার সূর্য ।

তুই কি কখনও আমার নাম জানতে পারবি নেতি ?  

আমার গোপন কোষাগারে তোর নাম নেতি থেকে ইতি করে নিয়েছি; তুই জানিস না, জানতে পারবি একদিন, যখন আমার উইলে তোর নাম থাকবে, আমি এতদ্বারা আমার স্হাবর ও অস্হাবর সমস্ত সম্পত্তি নেতি ওরফে ইতি ব্যানার্জিকে । তেমনই তো ভেবে রেখেছিলাম রে ।

পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে তার আগেই সব জেনে ফেলেছিলি; তোর গায়ে গোখরোর ঠাণ্ডা রক্ত। কোনো যুবতীর গা এত ঠাণ্ডাও হয় ! প্রতিশোধ নেবার ষড়যন্ত্র শিরায়-শিরায়, রসতরঙ্গিনী তুই। তোর দুই হাতে অ্যানাকোণ্ডার দমবন্ধ করা পাকের পর পাকের পর পাকের পর পাক, উফ কি ঠাণ্ডা, আঁস্তাকুড়ের হেমন্তের শীতেল জঞ্জালের জাপট।

চব্বিশ বছরের শ্যামলী দীর্ঘাঙ্গী, জানি না কেমন দেখতে হয়েছে তোকে, খুঁজে বেড়াচ্ছিস তোর নামকরণকারীকে, জন্মদিন নির্ধারণকারীকে, যেন তোর অস্তিত্বকে সেই লোকটা করায়ত্ব করে গুমখুন করে লুকিয়ে রেখেছে নিশুতি রাতের পোড়োবাড়ির সিঁড়ির স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে।

শিমুলের পাকা ফল ফেটে রোঁয়া উড়ছে, তুই তাদের ধরতে চাইছিস, শিমুলের লাল টকটকে ফুলগুলো শুকিয়ে তৈরি করেছে রোঁয়াবীজ, সেগুলোকে উড়িয়ে চলেছে দূরান্তরে, কোথাও গিয়ে অঙ্কুর তুলে লুকিয়ে গাছ হয়ে উঠবে, বসন্তের আকাশকে রাঙিয়ে দেবে ।

তুই কি চাস না যে বিশাল একটা শিমুলগাছ সবুজ মুকুট মেলে আকাশের চিরনবীন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছুঁয়ে দেখুক, মেখে নিক বসন্তের উদাসীন রক্তাক্ত তাড়না, বল তুই?

আমারই মস্তিষ্কে ওই গাছ পুঁতে দিবি, রোঁয়া উড়বে, আঁচ করিনি। তুই মারাত্মক। বৃষ্টি ফোঁটারা কি হলুদ পাতার রঙ তুলতে পারে, বল তুই? মোম-আলোয় শ্যামাপোকা নাচতে ভোলে না।

প্রেপ থেকে তোকে ভর্তি করা হল নৈনিতালের সেইন্ট মেরি কনভেন্ট হাই স্কুলে, বোর্ডিঙের অঢেল, সিসটাররা ছাত্রীদের সুখসুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখেন, স্কুলের রেজাল্টও ভালো হয় প্রতিবছর । ফিস বেশি হলেই বা, আমার মাইনেটা আছে কি জন্য ! ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত টানা পড়লি সেখানে । ব্যাস, জিভে সেই যে কনভেন্টি অক্সব্রিজ ইংরেজি ঘাঁটি গাড়ল, তা কখনও ছাড়ল না তোকে । এও শোনা, সূত্র অমরিন্দর, টেলিফোনে, আমি তখন পোর্ট ব্লেয়ারে ।  

জগদীশের মেয়ে তোর চেয়ে চার বছর সিনিয়র, ও কি জিভে অক্সব্রিজ কনভেন্টি ইংরেজি জড়াতে দিয়েছে? বলেনি কেউ, কেনই বা জানতে চাইব, বল? আমার আগ্রহের কেন্দ্রে তো তুই। ওই স্কুলের বোর্ডিঙেই তো ছিল বৈদেহী।  

কত ইচ্ছা করছিল, তবু ভর্তির সময়ে আমি স্কুলে যাইনি, কিন্তু নৈনিতালে গিয়েছিলাম, উদ্বেগ, উদ্বেগ, যাতে তোর অ্যাডমিশানে অসুবিধা না হয় । এডুকেট এ গার্ল চাইল্ডের দপ্তরের পর আমি তোকে আর চাক্ষুষ দেখিনি, কেবল ফটোতে যা । তারপর থেকে, জগদীশের মেয়ে আর ছেলেকেও দেখিনি। ওদের বাড়িতে আমি যাই না, তোর কারণেই যাই না ।

এনজিওর মনোবিদ তনজিম হায়দার বলেছিল, আপনি নেতির সামনে কখনও যাবেন না, স্মৃতিতে আপনার মুখ থেকে যাবে, খুঁজবে আপনাকে, শেষে আপনাকে না পেলে ডিসগ্রান্টলড আর রিভেঞ্জফুল ফিল করবে; আপনি তো তা চাইছেন না। অচেনা একজন মানুষ ওর সমস্তকিছু ফানডিং করছে জানতে পারলে হীনম্মন্যতার দোষ ফুটে উঠবে চরিত্রে ।

আমি চেয়েছি তুই বোল্ড হয়ে ওঠ। তাই বলে এরকম বোল্ড, অ্যাঁ?

শাদা ঘোড়া, কেশর হাওয়ায়, দৌড়োচ্ছে, সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে, ওই দূরে সূর্য, ওই দূরে পূর্ণিমার চাঁদ, দৌড়চ্ছে ঘোড়া, ওই দূরে ঝড়, ওই দূরে বৃষ্টি ।

ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ ক্লপ… মরুভূমিতে ঘোড়ারা দৌড়োলে বালি ওই শব্দকে শুষে নেয়।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...