গ ল্প
সামনে সমুদ্র। একটার পর একটা ঢেউ ভাঙছে। চোখের সামনে একটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমা ধীরে ধীরে রক্ত মাংসে রঙিন হয়ে উঠছে। সবকটা রঙকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে অনিন্দ্য। নিজেকে বার কয়েক চিমটি কাটে। তারপর আরও দু-পা এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। পায়ের তলায় আবার সরে যাওয়া বালিগুলো এসে জমাট বাঁধছে। হাওয়ার ঝাপটায় কপালের ওপর থেকে সোনালি সাদা চুল এক ঝটকায় দুই-কুড়ি বয়স কমিয়ে এক অদ্ভুত ম্যাজিকে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে উত্তাল যৌবনে। সময়টা আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিক। কলকাতায় তখন বামপন্থার জোয়ার। চারিদিকে লাল সেলাম, কমরেড কমরেড। ছাত্র রাজনীতিটা মনপ্রাণ দিয়েই করতো অনিন্দ্য। আর নেশা বলতে মিঠুনদা। বলিউডের বাঙালিবাবু। কি মুভস, কি অসম্ভব প্যাশন। এক একটা ডায়লগ আগুন, জাস্ট আগুন। ডিস্কো ডান্সার দেখে ফিদা হয়ে গেছিল অনিন্দ্য। এরকমটাও হয়! এই না হলে মশলা ছবি, মামুলি পেটো নয় পুরো অ্যাটম বোম। আত্রেয়ী অবশ্য এসব থেকে বহু যোজন দূরে। অনিন্দ্যর চেয়ে দু-বছরের জুনিয়র, যাদবপুর ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্ট। প্রেমটা কীভাবে শুরু হয়েছিল! সে সময়ের আর পাঁচটা সাধারণ প্রেমের মতো একেবারেই নয়। প্রথম মুখোমুখি ইউনিভার্সিটির ডিবেট কম্পিটিশন। সবাইকে চমকে দিয়ে পর পর দুবার ইন্টার কলেজ ডিবেট চ্যাম্পিয়ন অনিন্দ্যর হ্যাটট্রিকের স্বপ্নটা ফাতাফাতা করে দিয়েছিল আপাত নিরীহ সাদামাটা চুপচাপ একটি মেয়ে। আত্রেয়ী, নিখুঁত যুক্তি আর অসম্ভব ভালো প্রেজেন্টেশনে মারকাটারি বক্তা অনিন্দ্যও একেবারে ক্লিন বোল্ড। গল্পটা শুরু হতে অবশ্য আরও এক বছর লেগেছিল। প্রথম ছমাস ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ থিওরিতে অপেক্ষা করে অনিন্দ্য আর পরের ছমাস ওকে মিষ্টি করে ঝুলিয়ে রাখে আত্রেয়ী।
দুই।
নীল আইল্যান্ডের এই নীল নির্জনের চেয়ে ভালো হানিমুন আর কী হতে পারে। আকাশ সমুদ্র আর এই নির্জনতার মাঝে এক অদৃশ্য প্রজাপতি, এ যেন এক নতুন আলোকবর্ষ। আত্রেয়ীর কপালে একটা আলতো চুমু খায় অনিন্দ্য। এই মুহূর্তটার জন্যই তো এতটা অপেক্ষা। ওদের কটেজ থেকে কয়েক পা মাত্র হাঁটলেই জল। কটেজটা ঠিক ছবির মতো যেমন ক্যালেন্ডারে থাকে।
– শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়েটা হয়েই গেল, কি বলো…
অনিন্দ্যর কথাটা শুনে আত্রেয়ী ওর চোখের দিকে তাকায়। সে দৃষ্টি অদ্ভুত শীতল, যেন বর্ষার শেষ বারিধারা। হয়তো অনিন্দ্যর চোখের গভীরে আরও একবার নিজেকেই খুঁজে নিতে চায় আত্রেয়ী। হয়তো বা ডেস্টিনি…
– কি হলো, কি ভাবছো?
আত্রেয়ী হাসে, কোনও কথা বলে না। কিন্তু সে হাসিতে অনেক না বলা চলকে ওঠা দুধের মতো হঠাৎ ফুলে উঠে থিতিয়ে যায়।
এজি বেঙ্গলে এই চাকরিটা পাওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই অনিন্দ্যর বিয়ে। দু-বাড়িতে দেখে শুনে যেমনটা হয় সেরকম নয়। আত্রেয়ীরা ব্রাহ্মণ আর ওরা রায়, নমশূদ্র। সুতরাং দুই বাড়ির অমতে, তবে পালিয়ে নয়। একদম সবার চোখের সামনে সদর্পে বুক ফুলিয়ে সোজা আন্দামান। নির্বাসন নয় বিয়ে করতে। একান্তে। যেহেতু ডিসিশন দুজনের তাই ভালো-মন্দ সবটা দুজনের। শুধু দুজনের। আর তাই বিয়ে নামক এই বিশেষ দিনটিতে আর কাউকে কোট আনকোট অ্যালাউ করেনি ওরা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বিষয়টা মোটেও সহজ ছিল না। আজ ভাবতে অবাক লাগে।
– চলো আর একটু এগোই
আত্রেয়ীর কথায় হঠাৎ ঘোরটা কেটে যায় অনিন্দ্যর। মনে মনে ভাবে বয়স হচ্ছে। মুখে বলে
– জানো, আজ খুব হালকা লাগছে। যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম…
কথাটা শেষ করার আগেই আত্রেয়ী ওকে নিজের দিকে টানে। কপালে আলতো করে একটা চুমু খায়। তারপর অনিন্দ্যর হাতটাকে শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নেয়।
– কিছু কথা কখনও বলতে নেই, এই যেমন ধরো এই নির্জনতার ভাষা…
বলতে নেই, বুঝলে
শুধু উপলব্ধি করো, আমি বুঝি, সব বুঝি…
অনিন্দ্যর চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে। আত্রেয়ীর আঙুলের সঙ্গে আঙুল। স্বর্গীয় এ স্পর্শ-সুখ। সাদা বালির ওপর একটার পর একটা ঢেউ ভাঙছে। ঢেউ ভাঙছে আত্রেয়ীর বুকের ভিতরেও। একটা নিঃশব্দ বিপ্লব, জলে পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুজনে। সবকিছু থেকে দূর, অনেকটা দূর।
তিন।
এই জানলাটা থেকে আকাশ দেখা যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা নিজের মতো করে। আঠেরোশো স্কোয়ারফিট ঝাঁ-চকচকে অন্যের সংসারের চেয়ে এই ঘরটা অনেক শান্তির। ছেলে যতই নিজের হোক, বৌমা কখনও নিজের হয় না। হাজার হোক অন্য গাছের ছাল। আর বাস্তবে বেশি ভালো ছেলেদের হয়তো কিছু করারও থাকে না। তা যাই হোক, গত এক বছর এই বৃদ্ধাশ্রমে বেশ চমৎকার আছে আত্রেয়ী। এটা নামেই বৃদ্ধাশ্রম, তবে ফেসিলিটির দিক থেকে বেশ কয়েকটা স্টার দেওয়াই যায়। একটু ইন্টেরিয়র হলেও কী নেই! বিরাট বড়ো বাগান একটা ছোট্ট পুকুর কতো গাছ কতো কতো পাখি। ভালো লাগে, শহর থেকে দূরে এই ছোট্ট একটা জগৎ। কোনও প্রশ্নোত্তরের দায়ভার নেই। সকালে উঠে একটু পায়চারি করে আত্রেয়ী। এই একটা বছরে এখানে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সখ্যতাও তৈরি হয়েছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। সারাদিন নানা অ্যাকটিভিটিতে কেটে যায়। খাবার দাবারের চিন্তা নেই, এদের সবকিছু একদম টাইমে টাইমে। মাঝে মাঝে নাতনিকে নিয়ে ছেলে আসে। দেখে যায়। আর ভিডিও কল তো আছেই। একটা বয়সের পর এই বেশ ভালো। সংসারে বোঝা হয়ে থাকার চেয়ে নিজের স্বাধীনে…এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রায়শই রাতে ঘুম ভেঙে যায়। তারপর আর ঘুম আসতে চায় না। এক একদিন বই নিয়ে বসে। এখনও এই একটা অভ্যেস ওকে ছেড়ে যায়নি। ছেলে গতমাসে একটা কিন্ডেল দিয়ে গেছে। সব সময় সব বই তো পাওয়া যায় না। এই যন্ত্রটা বেশ ভালো যখন যা ইচ্ছে ডাউনলোড করে পড়া যায়। বয়স একষট্টি হলে কি হবে, টিপটপ আত্রেয়ীকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এই বয়সে যথেষ্ট আপডেটেড। মনের ওপর দিয়ে যতই ঝড় বয়ে যাক চেহারায় একটা আভিজাত্যের ছাপ তো আছেই। ছেলে আইটি প্রফেশনাল, ওয়েল এস্টাব্লিশ। আত্রেয়ীর এক কলিগের মেয়ের সঙ্গেই বছর পাঁচ আগে রীতিমতো দেখেশুনে সম্বন্ধ করেই একমাত্র ছেলের বিয়ে দেয় আত্রেয়ী। বিয়ের দু-বছরের মধ্যেই আসে দিয়া। মানে নাতনি। আর তার জন্মের ঠিক দু-দিন পরেই আরিত্রর বাবা মানে আত্রেয়ীর স্বামীর হঠাৎ মৃত্যু। আর তারপর একটা ঝড়ের মতোই জীবন তার গতিপথ বদলায়। নিজের হাতে গোছানো সংসার একদিন হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে যায়। হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম। আজ আর কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু সত্যিই কি কোনও আক্ষেপ নেই! স্যুটকেস খুলে পুরোনো বেশ কিছু জিনিস বের করে আত্রেয়ী। একটা ডায়েরি, একটা পুরোনো এইচ এমটি হাতঘড়ি, বেশ কিছু ফটোগ্রাফ আর কয়েকটা চিঠি। এই শেষ বয়সে পৌঁছে সম্বল বলতে এটুকুই তো ওর নিজের। শুধুমাত্র নিজের।
চার।
এই বয়সে আর একবার বিয়ে করার বেশ একটা মজা আছে যাই বলো। সেকেন্ড হানিমুন বলে কথা। আজকের দিনটা আমার জীবনের বেস্ট ডে। আমার তো এখনও মনে হচ্ছে সেই চল্লিশ বছর আগে আমাদের সময়টা থেমে আছে। জানো সমুদ্রের চোখে সত্যিই এক অদ্ভুত নেশা আছে। বড়ো গভীর। মায়াবী। বিশ্বাস হচ্ছে না! আমাকে ছুঁয়ে দেখো। সবকিছুই বড্ড আগের মতো। আত্রেয়ী ফিল করে, আজও একই রকম ভাবে ফিল করে অনিন্দ্যকে। সত্যিই কি ও আজও সেই সময়টা থেকে এগোতে পেরেছে! চল্লিশটা বছর কেবল একটা সংখ্যা মনে হয়। নীল আইল্যান্ডের সেই কটেজের বাইরে হাতে হাত রেখে বসে আছে দুজনে। সামনে সমুদ্র। একটার পর একটা ঢেউ ভাঙছে। এই নির্জনতার ভাষা বড্ড পরিচিত দুজনের। অনিন্দ্যর কাঁধে মাথা রাখে আত্রেয়ী। সত্যিই বড্ড হালকা লাগে নিজেকে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে জীবনের কাছে আর কীইবা চাওয়ার থাকতে পারে।
ঘড়ির দিকে তাকায় আত্রেয়ী। রাত দুটো বাজে। এবার শুয়ে পড়তে হবে। নাহলে শরীর খারাপ করবে। কাল সকাল সাড়ে দশটায় ফ্লাইট। সাতটার মধ্যে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে বলেছে অভিষেক। অভিষেক এখানকার ম্যানেজার। খুব এফিসিয়েন্ট। সবদিক দিব্বি সামলায়। বিছানায় ওপর থেকে আবার সবকিছু যত্ন করে গুছিয়ে স্যুটকেসে ভরে রাখে আত্রেয়ী। বাথরুমে গিয়ে হালকা করে একটু চোখে মুখে ঘাড়ে জল দেয়। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরপর দশটা ডিজিট লিখে ডায়াল করে…
পাঁচ।
অনিন্দ্য সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। হাওয়ার ঝাপটায় কপালের ওপর এসে পরে সোনালি সাদা চুল। পায়ের তলায় সরে যাওয়া বালিগুলো জমাট বাঁধছে আবার। হঠাৎ চারিদিকের নির্জনতা ভেঙে বেজে ওঠে মোবাইলটা। কিন্তু এখন এতো রাতে কে ফোন করবে! স্ক্রিনের দিকে তাকায়। একটা আননোন নাম্বার। রিসিভ করে বুকের কাছে ফোনটা ধরে। ফোনের ওপারে তখন কথা খুঁজছে চল্লিশ বছরের নির্জনতা। এই নির্জনতাটা দুজনেরই খুব চেনা…