উ ই ন্ডো সি ট
রবিবারের ছুটি আর আলসেমির দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার আগেই যখন আকাশ ভেঙে গুমগুম করে তুমি নেমে আসছো… আমার আর তখন এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না৷ ইলশেগুঁড়ির মতো ভিজে হাওয়ার পাখনায় ছুটে চলে যেতে চাইছি, যেখানে আমি কোনওদিন যাইনি৷ যাবো না হয়ত কখনও৷ অথচ এখন তোমার জানলার গ্রিল জড়িয়ে উইন্ড চাইমের জলতরঙ্গে বাজতে চাইছি৷ পাঁচিলের ওপাশে গ্যারেজের ধারে শিবমন্দির থেকে গুমগুম শনশন ঝরাপাতা বসন্তধুলোয় মিশে যাচ্ছে৷ এই যে হাওয়া আর জল, কাঁচ কেটে কেটে ঝনঝন করে উঠছে। রান্নাঘরে ফুটন্ত চা পাতার গন্ধ… জানলাটা ভেঙে ফেলতে পারো না? আমাকে নিয়ে যেতে পারো না? দাবিহীন, সর্বদোষসহ… মিথ্যা করে ফিসফিসিয়ে বলো,
“পারি… আজকে রাতে সবই পারি৷”
মিথ্যার ধমনীতে সত্যিটুকু অন্তত একবার বইতে দিতে হয়।
টিনের চালের উপর সন্ধ্যারাতে, বারিষ আর বসন্ত ধুলোর যুদ্ধ লাগলে… টুপটাপ টুপটাপ পরাগ ঝরে পড়ে। কান পেতে শোনো একবার… ভেজা মাটিতে আদরের গন্ধ লেগে আছে৷
ঠিক কতদূর গেলে সেই ঠিক ঠিকানাটা আসবে আমি জানি না… যেখানে সবটুকু ‘আমাদের’ হয়ে যায়। ‘আমার’ বলেই তো আসলে কিছু নেই। আজীবন ‘আমাদের’ হতে চাওয়া৷ এই যে দোতলার জানলার কাঁচের উপর চিড়িক মেরে একটু লাজুক গোলাপী হাসি হেসে বিজলি ঝরে যাচ্ছে… আর কিলো কিলো কিলোমিটার পার করে আমি পলকে পৌঁছে যাচ্ছি একটা অপরিচিত জীবনের কাছে৷ অপরিচিত না পরিচিত? প্রথম জনের ভাড়াবাড়ির আলসেতে ঝুলত মানিপ্ল্যান্ট। দ্বিতীয় জন কবি ছিল… মাধবীলতার ঝাড়টা ফুলে ভরে থাকত আমাকে ভিজিয়ে দেবে বলে। তৃতীয়ের বারান্দায় কবেকার ব্যবহারে দীর্ণ একখানা ভাঙা সাইকেলের উপর সাদা বাদামী বিড়ালটা রোদ পোহাত বারোমাস৷ একদিন পাশের পাড়ার কুকুরটা ওর নরম ঘাড়টা মটকে দিলো, তৃতীয়কে প্রথম কাঁদতে দেখলাম। সেদিন সারারাত সে কবিতা লিখেছিল৷ চতুর্থীর আলো অথবা আলেয়াকে দেখি, শীতের রাতে বিড়ালছানাটিকে নিজের কম্বলে বুকের ওম দিয়ে ঘুম পাড়াতে। উঁহু… আমার আর ক্লান্তি লাগে না, যখন দেখি… মানুষের পর মানুষ বদলে যায়… বিড়ালটুকু বারেবার ফিরে ফিরে আসে৷ তুমি বলো, বিড়াল স্বার্থপর। আমি ভাবছি, বিড়াল নিজের বাসাটুকু সঠিক চেনে… ঠিকানা লাগে না তার। অথচ যারা ঠিকানা হারিয়ে আশ্রয় পেতে আসে আর ঠিকানা খুঁজে নিয়ে হারিয়ে যায়, তাদের সবাইকে আমরা মানুষ বলি৷ বিড়ালেরা সন্ধ্যায় ঠিক ঘরে ফিরে আসে… আঁচড়ে দিলেও সে আমার বুকেই ঘুমায়। শুধু মানুষ একবার চলে গেলে, তারা কখনও ফেরেনি আজও…
ঠিক যেমন এই শেষ দুপুরের বৃষ্টি খড়খড়ি ছাপিয়ে বুকের ভিতর অব্দি ভিজিয়ে দিয়ে বলছে… ‘হারায় শুধু চোখে।’ বিড়াল কখনও ঠিকানা ভোলে না। তবে সেই ‘তাহারা’ মানুষ তো… বন্ধ দুয়ারে কড়াও নাড়ে না৷ ট্রেনটা হু হু বেগে এগিয়ে চলে নগর-শহর ছেড়ে ভোরের আলো মেখে। খোলা জানলার হাওয়া আমাকে ভিজিয়ে দিতে থাকে ক্রমাগত। চায়ের ভাঁড় থেকে বসন্ত উড়ে যায় ধোঁয়ার সঙ্গে। আমি চা-ওয়ালার ফ্রক পরা মেয়েটিকে কোলে বসিয়ে অচেনা গাছ চিনতে শুরু করছি আজকাল। সকালের আলো মেখে, অনামী চাষির শিশুরা নির্মল আনন্দে ছুটন্ত ট্রেনের জানলার দিকে হাত নাড়িয়ে ছুটছে আজও… ঘন খেত আরও ঘন হয়ে আসে। আমার অপু-দুর্গাকে মনে পড়ছে। তোমাকে মনে পড়ছে। কোলের অচেনা মেয়েটিকে অক্ষর শেখাতে শেখাতে মনে জাগছে… শিখে গিয়েছি বিচ্ছিন্নতা… শিখে গিয়েছি বুকের ওমের আপনত্ব। ভালোবাসতে নৈকট্য লাগে না, আপনত্ব আর সততা লাগে। নিজের ভিতরে থাকা আমির সঙ্গে কথা বলব… যার সঙ্গে এতদিন পরিচয় ছিল না। বিড়াল এবার বাসা বানাবে… চোরাবালি-বিহীন ভালোবাসা।