Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ব ই  আ লো চ না

শা শ্ব ত   ক র

kar

"জানলা দিয়ে গড়া একটা বাড়ি"- কিশোর ঘোষের নতুন কবিতার বই

বিবাহ উৎসব

কিশোর ঘোষ

প্রকাশক: হাওয়াকল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড

২৫০ টাকা

পুজোর ছুটি গেল সবে। শারদ সংখ্যা যে কয়েকটা জোগাড় হয়েছিল, তার লেখাগুলো সারা। সাড়া তেমন পাচ্ছিলাম না মনে! মনে জমিয়ে রাখার মতো কথা পাচ্ছিলাম না। বইয়ের তাক হাতড়ে পুরোনো কবিতার বই খুঁজছি। একে একে উঠে আসছে মিহি জ্যোৎস্নার মতো, হাতুড়ির ঘায়ের মতো সব অক্ষরযাত্রা। কবিতা ছুঁয়ে মনে ভেসে উঠছেন কবি। লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় জ্বলজ্বল করছে কবিদের সাক্ষাৎকার। এমনি করে হারিয়ে যেতেকোনো কোনো দিন বেশ লাগে। সেদিন দুপুরের পরে বসেছিলাম ‘উট পালকের ডায়েরি’ নিয়ে। কিশোর ঘোষের প্রথম কবিতার বই। 2009। কবিতায় যাদু।ধুলোর ধুলো আমি। কবির সাথে পরিচয় না থাকাই স্বাভাবিক। তবে প্রকাশক আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ভাই। উটপালকের ডায়েরি পড়লেই আমার মনে পড়ে প্রকাশক বিতানের মাধ্যমেই কবির সাথে পরিচয়পর্ব। দাপট নেই, বরং নিরিবিলি, নির্লিপ্ত। কথা শুনতে ভালো লাগে কবির। পরিচয় গাঢ় হয়। অন্তর্মুখী কবির নানান অভিযাত্রার সাক্ষী হয়ে যাই। কত কবিতা পড়লাম কবির। কত অজানা অভিমুখ। কত বিচিত্র দর্শন। কত গভীরতা।  প্রচারবিমুখ কথাটা তো ক্লিশে এখন, তাই বলছি না। তবেখানিক অবাক তো হই ! সব ধরনের পত্রপত্রিকায় এত লেখার পরেও কেনব খুব বেশি তরঙ্গ ওঠে না! কেন 2009 এর পরে সে অর্থে আর বই পাচ্ছি না কবির? একটু ভুল হলো অবশ্য, মাঝখানে সাবমেরিন নামে একটা সিরিজ প্রকাশ করেছিলেন হাওয়াকল।

আছে, আছে- আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে! এমনি এমনি বলছি না, সঙ্গত কারণ আছে। উটপালকের ডায়েরি পড়ার শেষে ফোনটা ঘাঁটছি, হঠাৎ ফেসবুক পোস্ট দেখলাম- কিশোর ঘোষের নতুন কবিতার বই। আশ্চর্য সমাপতন! তারপর আর কী! মহানন্দে কবির সাথে যোগাযোগ- বই জোগাড়- আর ভেসে পড়া নতুন ভাবনার স্রোতে। স্রোত কিন্তু অন্তরমুখী। ভিতর পর্যন্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে এ বইয়ের কবিতারা। উটপালকের কবি এখন আরও অনেক পরিণত, আরও অনেক তীক্ষ্ণ। ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নির্মাণ চেতনার প্রযুক্তি দিয়ে’ গড়া একটা বাড়ি। কবিতার বাড়ি। শুধুমাত্র জানালা দিয়ে গড়া, চরাচর সেখানে আলো হাওয়া গন্ধ বর্ণ এমন বিভিন্ন নামে খেলে বেড়ায়। উন্মুক্ত মাঠের মতো-দিগন্তের মতো, সাগর, আকাশের মতো খোলা। ভোরবেলা রঙের বাড়ি। ঠিকানা পাঠকের হৃদয়। এমন স্বপ্নের কথাই লিখেছেন কবি সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘বিবাহ উৎসব’। বিতান চক্রবর্তীর অনবদ্য প্রচ্ছদের ভিতর অতি যত্নে গাঁথা কবিতা মালা। আমার পড়া কয়েক প্রস্থ হলো, তবে কবিতা তো, যতবার পড়া যায় অক্ষরের মধ্যবর্তী অর্থগুলো আরও ধরা দেয় যেন! কাজেই চলুন, এই পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার অছিলায় আবার খুঁজে দেখি- কবির স্বপ্নবাড়ির জন্য কতখানি জমি তৈরি হলো আমাদের বুকে! হাওয়া কল প্রকাশিত সুসজ্জিত বইটির দুটি অংশ- বিবাহ উৎসব এবং কবির লাগেজ। দ্বিতীয় অংশের ১৮ টি কবিতায় কবির অভিযাত্রা। প্রেম, বিষাদ, সমাজ, বৈষম্য, শ্রদ্ধা, দেখনদারি, বেদনা, কৃত্রিমতা – নানান ঘাটের দৃশ্যে জারিত হয়ে বয়ে গেছে অক্ষর নদী। জীবনপুরের পথিক কবির অভিযাত্রার সন্ধান মেলে ‘কবির লাগেজ’ কবিতায়। আর প্রথম পর্ব- বিবাহ উৎসব। এই অংশের ছত্রিশটি কবিতা। এখানেও যদি কবি অক্ষর নদীতে বজরাসওয়ার হয়েছেন বলে ভাবা যায়, তবে আগে বলা ঘাটগুলোর সাথেই যোগ হবে প্রেম, সমাজচেতনা, নস্টালজিয়া, ক্ষোভ, রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সহ নিজস্ব দর্শনের।

 

অদ্ভুত ক্ষমতা কবির। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উট পালকের ডায়েরি’ তেও দেখেছি। এখানেও তার হদিশ পাওয়া যায়। অলংকার নিয়ে খেলার ক্ষমতা। অদ্ভুত এক চোখের মালিক, যে চোখে নিজের মতন দেখেন কবি। নিজস্ব কাব্য ভাষা তৈরি হয়। যে দৃশ্য আমার সাধারণ চোখে একরকম, তাকেই সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে দেখতে জানেন। পরিচিত বৃত্তের বাইরে এসে নির্লিপ্ত চোখ পাততে জানেন।  দেখাটাকে অক্ষরে রূপান্তর করতে জানেন। নির্দিষ্ট অমোঘ অক্ষর। নির্মেদ ছোট ছোট অক্ষর মালা। কেমন একজন আরেকজনের সাথে যেন বন্ধনে আবদ্ধ। অথচ নির্মাণের কৃত্রিমতা নেই । স্নিগ্ধতা আছে। ম্যাজিক আছে, সম্পর্কের বন্ধনের রসায়ন আছে, প্রেম আছে। ভালোবাসা -স্বপ্ন -ইউটোপিয়া। আসুন, বইয়ের ভিতর ঘরে ঢোকা যাক। দরজায় কবি লিখছেন: ‘সুষম দুঃখ খেয়ে বেঁচে আছি’ । চমকে উঠছেন কি না?  এ তো আমার আপনার কথা! আমাদেরই ভিতর ঘর জীবনের ছেঁচায়, আঘাতে জমে থাকা দুঃখের বিনিময়ে বেঁচে থাকার ভাত। বাস্তবের পোড়া কড়াইয়ে সেঁকাপোড়া হতে হতে ঘাড় উঁচিয়ে আকাশ আকাশ দেখা আমাদের জীবন। অনন্তের ডাক- ‘নক্ষত্রের ছোট বড় খামে চিঠি পড়তে গিয়ে ঝলসে যায় ‘ আমি’ মেলায় বেচার মতো উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ‘এ বইয়ের কবিতা কিশোর লিখে থাকতে পারেন। তবে কবিতা আর তার
একার নয়। আমাদের। অতি সাধারণ পাঠক। কবিতার অনুপুঙ্খ ব্যাকরণ গরণ- ইত্যাদি ইত্যাদি সব তোলা থাক পন্ডিত সমালোচকের জন্য। আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকুক কেবল কবিতা। বৃষ্টির মতো, খাল বিল- ভাটফুল- যানজট- বিজ্ঞাপন- জন্ম- মৃত্যু- হাসি- কান্না- বিষাদে – প্রেমে স্বতঃস্ফূর্ত জীবন নদীর মতো বয়ে চলা কিশোরের কবিতা। আমাদের কবিতা। কারণ-

‘একা না একা না অন্ধকার- সম্পর্কে আমরা বেদনার আত্মীয়স্বজন।’ (কথোপকথন) সমাজ। কুয়াশায় ঢাকা সমাজ। বহুরূপী। মাস্কিং ডিমাস্কিং এর চাতুর্যে খানাখন্দ অন্ধকার ঢেকে বিষাদের পাত্রে আনন্দের মদ ঢেলে দেওয়া রাষ্ট্রশক্তি। কথা উঠে আসে কবিতায়। পরপর কয়েকটা পংক্তি উল্লেখ করি এ প্রসঙ্গে—


‘কীটনাশক খেয়ে
কৃষি খেত মারা গেল রাতে
কৃষকের দেহ পাওয়া গেল সকালে
নীল ধান খেতে।’ (এগ্রিকালচার)


‘ভোট সারাই হচ্ছে রাস্তায়।
বড় মুরগি ছোট মুরগির পেটে লাথি মারছে।
কাঁদছে কসাই।’  (চিড়িয়াখানা)


‘শহরের একদিকে বসতি খিদের
অপর দিকের তাতে পেট ভরে যায়। (শহর শহর)


আজ নয়, দীর্ঘ কুড়ি বছর কবি দেখছেন লিখছেন। সাজাচ্ছেন মনের ভেতরটাকে। এখন কবির চোখ অন্যভাবে দেখে। সেই স্বতঃস্ফূর্ততা অনায়াসে পাঠকের ভিতর ছুঁয়ে যায়। কষ্ট করে ট্রান্সফার্ড এপিথেট নির্মাণ বিনির্মাণ করতে হয় না। অনায়াস স্বাভাবিক হওয়ার মতো কিশোরের কবিতাকে দোলা দিয়ে যায়। ট্রান্সফার্ড এপিথেটের মনোগ্রাহী নিদর্শন গোটা বই জুড়ে। কয়েকটি উল্লেখ—

‘হলুদ পাখির কাচ, মরা হ্যারিকেন
হাতল ভাঙা জ্যোৎস্নার মাঠ
আমাদের সিড়ির তলায় জমে আছে।’ (সিঁড়ি)

‘হাওয়া দিলে ধানক্ষেতের
ক্যালেন্ডার দোলে…’ (তর্পণ)

‘নিজেরই মৃতদেহ মুড়ি দিয়ে
লোকটা শুয়ে পড়ল।’ (মুখ নেই ফেসবুক আছে)


‘সকাল ঝাঁট দিচ্ছে উঠোন,
উনুন আঁচ দিল অরুনদাকে।’ (প্রভাত ফেরি)

‘হাওয়ায় হলুদ ছাদ উড়ছে।’ (হাওয়া)

নিজস্ব দর্শন আছে কবির। জাতক কাহিনি, ভিখিরি,  মরণের পরে, হাওয়া— এরকম অনেক কবিতা তার স্বাক্ষর। বীজগণিত,  শ্যামাসঙ্গীত কিশোরের একান্ত নিজের ভাবনার ছবি দেখায়। একটা বলি—

‘দেহ এক ছায়াপথ
এক বৌদ্ধ ভিক্ষুক যে দুর্গম পথে পথে
আত্মার ধর্ম প্রচারে এসেছেন’  (জাতক কাহিনি)

ক্ষোভ প্রক্ষোভ- অক্ষরে প্রতিবিম্ব। জীবনের খুঁটিনাটি, কলহ, দাম্পত্য, শরীর , বঞ্চনা, বিষাদ, আরোগ্যের খোঁজ, অবসর- সবাই জায়গা খুঁজে নিয়েছে অক্ষরে। ওই যে বলেছিলাম, কবিতা আর কবির নেই পাঠকের:

‘মানুষ ঘুরতে যায় সেরে উঠতে, শহরের মতোন
দুরারোগ্য থেকে দূরে যেতে চায় সে, ক্ষতবিক্ষত গভীর রাতের ট্রেনে…’
(আরোগ্য  ট্রাভেলস )
‘যাদের কাছে চশমা আছে
চোখ ফেলে এসেছে তারা গতজন্মে’

কী তীব্র শ্লেষ! যে মানুষগুলো বদলে গেছে, অথচ যারা দেখতে জানতেন, দেখার কথা বলতেন, বদলের গান গাইতেন- তাঁরা আজ দৃষ্টিহীন।  যে দৃষ্টি প্রতিক্রিয়াহীন,  তা তো না দেখারই সামিল! ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ- পৃথিবীতে আজ’— জীবনানন্দের কবিতা মনে করায়। আপোষের ভাত। শ্মশানের ফুল। ক্যাকটাসের ফুল। মৃত্যু উপত্যকায় কবির শৃঙ্খল অস্তিত্ব, তবু মুক্ত কবিতার অক্ষর ওড়ে। ক্ষোভ ব্যক্তিগন্ডী ছাড়িয়ে যায়।


‘এখানেই একজন কবি কলম কেনার পয়সা কুড়োতে আসে’   

(খবরের কাগজ )

সম্পর্কের রসায়ন- সম্পর্কের বন্ধন ঘুরে ফিরে আসে কবিতায়। প্রেম প্রজাপতির মত কবিতায় ওড়ে। প্রেমের কবি কিশোর। সে প্রেম শরীর ছুঁয়ে থাকে। শরীর থেকে অনন্তে তার অভিমুখ। বিভাব কবিতা ‘বিবাহ উৎসব’ সেই প্রেমের ছবি। প্রেমিকা আকাশ, প্রেম জীবন আঁকড়েই চরাচরমুখী।

‘যেদিকে জানলা নেই
ঘরের সেই পাশে তোমার প্রয়োজন বসে আছে,
তোমার কপাট খুলবো একে একে আর
আমার দরজা জানালার চোখ খুলে যাবে…’

(বিবাহ উৎসব, এক)

ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা হাত ধরাধরি করে আছে কিশোরের কবিতায়। তর্পণ, মা, অলৌকিক- মনে জায়গা করে নেবেই।  কিশোরের মা লেখার অক্ষর ছুঁয়ে কখন আমাদের মা হয়ে উঠবেন। স্নেহশীলা, সর্বংসহা,সর্বজয়া, দুর্গতিনাশিনী, দশভুজা মা আমাদের। ভালোবাসার গাছ। স্নেহের
আকাশ। নিশ্চিন্ত আশ্রয় আমাদের—

‘সন্তানের পাতে স্নেহ বেড়ে দিয়ে তবে নিজে খাবে’ (অলৌকিক)

এই এক সমস্যা! কবিতা যেখানে মলাট পেরিয়ে, কবিকে ছাড়িয়ে বুকের ভিতরে বাড়ি বানিয়ে ফেলে, সেখানে বাড়ির লোকের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আর বাঁধ মানে না। বলতে গেলে তাই গোটা বইটাই বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা তো উদ্দেশ্য নয়। ঠিকও নয়। বরং আপনারা পড়ুন সুজন পাঠক। জীবনের মুহূর্তগুলো যা একান্ত নিজের, সেই মুহূর্তের ছন্দিত অক্ষরমালা তো আসলে আপনার কবিতাই। আপাত ব্যস্ততার কুয়াশায় ঝাপসা আপনার সেই কবিতাগুলোর আর একবার সান্নিধ্য পেতে তাই কিশোর ঘোষের ‘বিবাহ উৎসব’ পড়েই ফেলুন।

 

আরও পড়ুন...