Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ক্যা ন ভা স

শু ভ   চ ক্র ব র্তী

suvo

শূন্যের উপলব্ধি : ধর্মনারায়ন দাশগুপ্ত

‘আমার ছবিতে শুন্যতার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে উপরের দিকে তাকালে মহাশূন্য মুক্তির স্বাদ দেয়। তাই আঁটসাঁট কাঠামোর পরিবর্তে পটের কিছুটা অংশ ফাঁকা রাখি। …বর্তমান যুগের মানুষের পায়ের তলায় মাটি নেই আর। আমরা এক অনিশ্চতায় ভেসে বেড়াচ্ছি। প্রতিদিনের পরাজয়ের মধ্যেও এক অপূরণীয় স্বপ্ন নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। তাই আমার ছবির নায়ক-নায়িকারা কখনো ভাসে, কখনো ওড়ে।’

লড়াই / ধর্মনারায়ন দাশগুপ্ত

ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্তর ছবির চরিত্রগুলো অনেক সময় মধ্যাকর্ষণ শক্তির নিয়ম না মেনে শূন্যে ভাসমান। অর্থাৎ তারা স্বাভাবিক নয়, শুধুই কি চরিত্র চরিত্রের পাশাপাশি ঘরের দরজা-জানলা, মানুষবিহীন পাঞ্জাবি এমন অনেক কিছুই যা ছবির প্রয়োজনে এসেছে সবই বাতাসে ভাসমান। কেন এইরকম তাঁর ছবির একটা বিষয় হয়ে উঠল ? কেউ কেউ মনে  কারণ এইসব ছবির চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংকট ব্যক্ত করছে। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পায়ের নীচে মাটি নেই তাদের শিকড় থেকে উপরে ফেলা হয়েছে। এর কারণ কি তাহলে শিল্পীর নিজেরই জীবনের একটা সঙ্কটময় সময়কে ধরে রাখা হয়েছে? এর একটা উত্তর আমরা পাই তাঁরই ছবির মধ্যেই । যেখানে স্বপ্ন ও শূন্য তাঁর ছবির একটা বিষয় হয়ে উঠছে। ধর্মনারায়ণ ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরার ধর্মপুরে জন্মেছিলেন। তাঁর বাবা কাজের সূত্রে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন। ধর্মনারায়ণ সে-সব স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। আঠেরো বছর বয়সে তিনি ত্রিপুরা ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হন। তাঁর জীবনের প্রথম আঠেরোটা বছর অর্থাৎ গত শতাব্দীর চার এবং পাঁচের দশক এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়কাল। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ঘটনা ধর্মের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশকে ভাগ করে দেওয়া। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ। উদ্বাস্তু সমাজ এবং কালোবাজারি। এই সময়টা, অর্থাৎ দেশ ভাগের পূর্বাপর সময় বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর আশাভঙ্গ অনেকের মতোই ধর্মনারায়ণকেও বিক্ষুব্ধ করেছে।

তাঁর লেখার মধ্যেও আমরা স্বপ্ন ও শূন্যকে স্পর্শ করতে পারি । সে অর্থে তাঁর সামগ্রিক ছবির বিষয় হয়ে উঠতে চায় বিপন্নতার প্রবাহ। শান্তিনিকেতনে তাঁর ছাত্রবৃত্তি নেওয়াকে তিনি পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা করেছেন অর্ধ-শিক্ষিত এক কিশোরের নতুন জীবন পাওয়া। অর্থাৎ এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি ধর্মনারায়ণের কৈশোরবেলার স্বপ্ন ছিল শান্তিনিকেতনে পাঠ নেওয়া। আর শান্তিনিকেতনে এসে তিনি শিক্ষক হিসাবে পেলেন বিনোদবিহারী আর রামকিংকরের মতো শিল্পীদের। চার বছরের শিক্ষার পর ধর্মনারায়ন ফিরে যান ত্রিপুরায় তাঁর জন্ম ভিটেয়। কিন্তু সেখানে  কিছুতেই তাঁর মন বসছে না। ফিরে এলেন কলকাতায় । তখন সমগ্র বিশ্বের একটা টালমাটাল অবস্থা একঅর্থে বিস্ফোরণের দশক বলা যায় । তার প্রভাব কলকাতায় আছড়ে পড়ছে। যখন  কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন, হাংরি জেনারেশনের উম্মাদনা, সোসাইটি ফর কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট। ঠিক এই সময়ের দন্ধিক্ষণে ধর্মনারায়ণ এসে পৌঁছালেন কলকাতায়। তখন এই শহরে তাঁর সমসাময়িক কিছু তরুণ চিত্রশিল্পী নিজেদের স্বকীয়তা আবিষ্কারের চেষ্টায় নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন। কেউ কেউ তারই মধ্যে পশ্চিমী শিল্পকলায় ঝুঁকছেন। কেউ আবার সম্পূর্ণ দেশজ উপাদানে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছেন। শান্তিনিকেতন পর্বে ধর্মনারায়ণ রাজস্থানী ও পাহাড়ি চিত্রকলায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার সঙ্গে তান্ত্রিক শিল্পকলা চর্চাও করেছিলেন। কলকাতায় এসে তিনিও  তাঁর সতীর্থদের মতো পশ্চিম ইউরোপের শিল্পকলায় মনোনিবেশ করেন। বিশেষত এক্সপ্রেশনিস্ট আর সাররিয়ালিসম্ অনুশীলন করেছিলেন।

ধর্মনারায়নের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শিত হয় ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার পার্কস্ট্রীটে। সেখানে তিনি রেখেছিলেন বাইশটা জলরঙের কাজ এবং আটটি তৈলচিত্র। এবং তার পরের বছর দিল্লিতে তাঁর দুই বন্ধু রামকৃষ্ণান ও দেবীপ্রসাদ সাহার সঙ্গে যৌথ চিত্রপ্রদর্শন করলেন। এখানে আমরা দেখতে পাই তাঁর কাজের মধ্যে এসে পড়েছে সাররিয়ালিজম্ । কিন্তু তখনও ধর্মনারায়ন তাঁর ভিন্নতাকে আবিস্কার করতে পারেননি । আরও দুবছর পর ধর্মনারায়ন তাঁর পথের দিশা খুঁজে পাবেন যখন আমরা দেখি গণেশ পাইন, লালুপ্রসাদ সাউ, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রভৃতির সঙ্গে কলকাতায় যৌথ চিত্রপ্রদর্শনে তিনি অংশ নিলেন সেখানে তাঁর কিছু বড় কাজের ডিটেলিং প্রসংশিত হলো। আমরা যদি তাঁর ছবি তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি তাহলে বুঝতে পারব আত্মসংকট থেকে বিশ্বসংকটে তাঁর ছবির ব্যাপ্তি আর এই কারণেই তিনি বারবার ছবির ফর্ম ও কন্টেন্ট বদলেছেন।

আর এর একটা উত্তর আমরা পাব সাতষট্টি সালে লালুপ্রসাদের সঙ্গে যৌথভাবে আরও একটি প্রদর্শনীর কথা মনে করতে পারলে । এখানে দু-ধরনের ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। পোট্রেইট ছিল। ছবির মুখগুলো ভয়ার্ত, আতঙ্কিত। ‘ছয়ের দশক জুড়ে পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ছবিতে। দ্বিতীয় ধরণের ছবি মূলত  ফ্যান্টাসি চেতনায় । বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে দেখা, মধ্যবিত্ত মানুষ যেন  তাঁর ছবিতে কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে এল। এরপরে ১৯৭০ সালে তাঁর ছবিতে একটি গাড়ি মূল চরিত্র হয়ে উঠল। আমরা বুঝতে পারলাম ধর্মনারায়ণ তাঁর পথ খুঁজে পাচ্ছেন। গাড়িটি প্রতীক হিসেবে ছবির বিষয় হয়ে উঠল । এই সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় ধর্মনারায়ন সৃষ্টি করলেন ভিন্ন এক আঙ্গিক । আমরা দেখলাম শূন্যে পাঞ্জাবি ঝুলছে। রক্তভেজা পাঞ্জাবির গায়ে বুলেটের চিহ্ন। তরুণ প্রজন্মের রক্তক্ষরণে তিনি বিচলিত হয়েছিলেন। ব্যথিত হয়েছিলেন। বিক্ষুব্ধও। এর পরই ধর্মনারায়নের ছবির বিষয় হয়ে উঠল মধ্যবিত্ত শ্রেণী।

অর্থাৎ তাঁর ছবিতে ধরা পড়ল বলবার এক ভিন্ন ধরণ। যাকে আমরা লৌকিক আঙ্গিক বলতে পারি।

আর শুধু তাই নয়, ছবির আরও ভিন্নতা আনতে বেছে নিলেন এগ টেম্পারা পদ্ধতি। মোটা কাপড় ক্যানভাসের মতো ফ্রেমে বেঁধে তার ওপর ডিমের সাদা অংশ, জিঙ্ক অক্সাইড মিশিয়ে প্রাইমার হিসেবে ব্যবহার করে তারপরে ছবি আঁকা গভীরতা আনতে মাউথ-স্প্রে পদ্ধতি ব্যবহার ধর্মনারায়ণের বৈশিষ্ট্য।

আরও পড়ুন...