Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

অরিজিৎ চক্রবর্তী

arijit

একটি লোক-উৎসব, অনেক প্রথা

‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে...’

চৈত্র ফুরিয়ে আসছে, বৈশাখ শুরু হল বলে। ঠাকুর গো, এই তপ্ত দিনগুলো ভালোয় ভালোয় পার করে আষাঢ়ে আকাশ ভরা মেঘ দিও, আর দিও জল যাতে ঘরে সোনার বরণ ধান ওঠে। ছেলেমেয়ের মুখে দুটো নতুন চালের ভাত দিতে পারি আর ঘরখানার চালে কয়েক আঁটি খড়! চৈত্রের শুরু থেকেই বাংলার নানা প্রান্তে ধ্বনিত হতে শুরু করে- ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে…’

ছোটবেলায় শোনা বহুখ্যাত ছড়াটি সকলেরই জানা— ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই’। ছড়াটির মধ্যে দেশগাঁয়ের অভাবের রূপটিই ফুটে ওঠে। শিবের গাজন— গ্রাম থেকে ‘গা’ আর ‘জন’ মানে জনগণ, অর্থাৎ দেশগাঁয়ের আপামর খেটে খাওয়া মানুষ। গাজন বা চড়কপুজো সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ারই এক প্রতিফলন নয় কি?

এই সময় নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত শিবভক্তকুলের সন্ন্যাস পালন করার সময়। কেউ কেউ আবার শিব-পার্বতী সেজে হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বার হন পথেঘাটে। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আতপচাল, রাঙা আলু, কাঁচা আম, কাঁচকলা এবং অর্থ সংগ্ৰহ করে সন্ধ্যায় তাঁরা পাক করা অন্ন গ্ৰহণ করেন।

চৈত্রের শেষ দিনে উৎযাপিত হয় চড়ক উৎসব। এই উৎসবেরও বেশ কিছু নিয়ম আছে। যেমন চড়কগাছটিকে প্রথমে শিবমন্দিরের কাছের পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। গাজন সন্ন্যাসীরা সেটিকে তুলে আনেন গাজনতলায়। পরে চড়কগাছ পুজো করে তা চড়কতলায় পোঁতা হয়।

এরপরে শুরু হয় মূল চড়কের অনুষ্ঠান। সেখানে প্রকাণ্ড কাষ্ঠদণ্ডের ওপরে আংটায় ঝুলে থাকা জনা দুয়েক সন্ন্যাসীর ক্রমাগত ঘুরপাক খাওয়া পরিচিত দৃশ্য। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্ন্যাসী নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন বেল, কাঁচা আম ইত্যাদি। সে ফল কে ধরবে তাই নিয়ে শুরু হয় হুড়োহুড়ি। সেই ফল হাতে ধরা নাকি ভাগ্যের ব্যাপার এমনই বিশ্বাস।

চড়কের যে দেব প্রতিকৃতি থাকে তাকে বলা হয় ‘পাট’। এটি চার থেকে পাঁচ হাত লম্বা। একটি খণ্ডকাঠ দিয়ে তৈরি। মাথা সূচলো করে নৌকোর আদলে গড়া। মধ্যে শিব-পার্বতীর মূর্তি, শিবলিঙ্গ থাকে। সম্পূর্ণ পাটটি একটি লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়। কাঠের দুই মাথায় ফুলের মালা তেল সিঁদুর চন্দন লাগানো হয়। পুজো শেষে পাট গ্ৰামের বারোয়ারি মন্দিরে তুলে রাখা হয়। চড়কের সাতদিন আগে এটিকে বিশেষ আচার পালন করে নামিয়ে আনা হয়। এই আচারের একটি অন্যতম দিক হলো ‘পাট দান’। যিনি মূল সন্ন্যাসী, মাথায় করে এই পাট মন্দির থেকে নামান। এরপরে এটি স্নানের উদ্দেশ্যে নদী বা পুকুরে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘পাট স্নান’ সাধারণত মধ্যরাত বা ভোরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

‘পাট স্নান’-এর অন্যতম দিক হলো সং নৃত্য। মূল সন্ন্যাসী যখন পাট নিয়ে নদী পুকুরের দিকে যেতে থাকেন, তখন তাঁকে বিভিন্ন অপ্রাকৃত শক্তি বাধা দেয় বলে বিশ্বাস। তা বোঝাতেই অন্যেরা মুখোশ পরে ভূত-প্রেত-দেব-দৈত্য-পশু-পাখি সেজে পাট স্নানে বাধা দেন। একই সঙ্গে চলে ঢাক-বাঁশির বাদ্য বাজনা ও উলুধ্বনি। এর পর স্নান শেষে নির্মাণ করা মণ্ডপে নিয়ে আসা হয় পাট।

সাতদিন আগে থেকেই গ্ৰামে গ্ৰামে শুরু হয় ‘পাট নাচানি’ অনুষ্ঠান। সন্ন্যাসীরা মাথায় পাট নিয়ে গ্ৰামে গ্ৰামে ঘোরেন। বাদ্যের তালে তালে নেচে বাড়ি বাড়ি পাট নিয়ে ঘোরেন তাঁরা। যে বাড়িতে পাট নিয়ে যাওয়া হয়, সেই বাড়ির গৃহিণী একটি পরিষ্কার পিঁড়ি অথবা জলচৌকি পেতে দেন পাট নামানোর জন্য। এর পর তেল সিঁদুর চন্দন দিয়ে বরণ করা হয় সেই পাটকে। বরণকালে গৃহস্থের মঙ্গল কামনায় বালা গান পরিবেশন করা হয়। সন্ন্যাসীদের ডাব, কাঁচা আম, শশা, আলু, চাল, কলা উপঢৌকন দেন গৃহিণী।

এবার ‘উড়ো ভোগ’-এর কথায় আসি। চড়ক বা নীল পুজোয় যে ভোগ দেওয়া হয় তা অভিনব। একজন সন্ন্যাসী স্নান সেরে ভোগ তৈরি করেন। ভোগ হিসেবে থাকে শোল ও শিঙি মাছের পোড়া, আতপ চালের ভাত, কাঁঠাল, মিষ্টান্ন ইত্যাদি। একটি ডালায় ভোগগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। সন্ধ্যার পর একজন সন্ন্যাসী সেই ডালা মাথায় তুলে ঢাক-কাঁসি বাজাতে বাজাতে দৌড়োন। এই ভোগ কোথায় নিবেদন করা হবে তা গোপন রাখা হয়। সাধারণত শ্মশান, গ্ৰাম দেবতার থান বা শিবমন্দিরে এই ভোগ নিবেদন করা হয়। নিবেদনের স্থানে চারটি কঞ্চির তির-কাঠি, মাথায় তালপাতা, লাল সুতো, ঘট, আমের পল্লব, ডাব ইত্যাদি দেওয়া হয়। এরপর সন্ন্যাসীরা পুজো শুরু করেন।

সংক্রান্তির আগের দিন সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন শারীরিক কসরত করতে শুরু করেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘কাঁটা বেঁধা’। মাটির উপরে খেজুর-বেল-শিয়ালকুল ইত্যাদি গাছের কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হয়। এই কাঁটার উপরে প্রবীণ সন্ন্যাসীরা গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে থাকেন। সন্ন্যাসীদের শারীরিক আত্মনিপীড়নের আর একটি দিক হলো ‘আগুন সন্ন্যাস’। মাটিতে জ্বলন্ত কয়লা বিছিয়ে দেওয়া হয়। সন্ন্যাসীরা হেঁটে যান সেই আগুনের উপর দিয়ে। শিবের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের এ আর এক পন্থা। সংক্রান্তির আগের দিন সন্ধ্যায় পুজোমণ্ডপকে ঘিরে বালা গানের আসর বসে। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের চড়কের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘খেজুর ভাঙা’ অনুষ্ঠান। সংক্রান্তির দিন এবং তার আগের দিন সন্ন্যাসীরা গাছে উঠে খেজুর ভাঙেন। কোথাও কোথাও আবার শুধু সংক্রান্তির দিন ‘খেজুর ভাঙা’ হয়। সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় শুরু হয় ‘নীলপুজো’। এইসময় মাটি দিয়ে শোয়ানো অবস্থায় একটি দেবমূর্তি তৈরি করা হয়। সে মূর্তি শিবের মূর্তি।

চড়কের আর একটি অন্যতম অঙ্গ ‘অষ্টকগান’। অষ্টক হলো রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নির্ভর গান। আর চড়ক হলো শিবপুজোর অনুষ্ঠান। কিন্তু কী কারণে এবং কখন থেকে শিব পুজোর এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের গীতের সংযোগ ঘটেছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।

গাজন উৎসবের পিছনে পৌরাণিক কাহিনিও রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনি মতে, মহাদেবের উপাসক বাণ রাজা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে রীতিমতো ক্ষতবিক্ষত হয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে নিজের গায়ের রক্ত দিয়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করেছিলেন। আর তারপর থেকেই শৈব সম্প্রদায়ের ভক্তগণ শিবের প্রতি নিজের আনুগত্যের জন্য নিজেদেরকে শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে গাজন উৎসবের আয়োজন করেন।

চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ- এই তিন মাসে বাংলার গ্ৰামে গ্ৰামে কয়েক হাজার গাজন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বাঁকুড়া জেলাতেই দেড়শোর বেশি মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাজনের উৎসবে অনেক বদল এসেছে। তবে অতীতের মতো এখনও গাজন মানে সব স্তরের মানুষের উৎসব। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। বাংলা বছরের শেষ দিনে বাংলার এই উৎসব আসলে মিলনের উৎসব। সব ভেদাভেদ ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আগে মহা-মিলন।

আরও পড়ুন...