মু ক্ত গ দ্য
১।
অনেকদিন ধরে কিছু লেখা আসছে না। লিখব লিখব মনে করি, কিন্তু লেখা আসে না। কেমন একটা দমবন্ধ অবস্থা মনের। বাইরের বাতাসে ফাল্গুনী হু হু শুরু হয়েছে সবে। সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে এমন সময়। লেখা আসে না। মন চলে যায় কোনও হাটের ভিড়ে। প্রেমিকার হাত চিনে নিতে চায়। তার হাত ধরে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে চায়। কতো বছর হল সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। ইচ্ছে করছে হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট খাই। সিগারেট অথবা চা খাওয়ার কথা এলে হরিদ্বারের অবাঙালি সহকর্মীরা খিল্লি করে আমাদের নিয়ে। বলে- বাঙ্গালি লোগ চা’য়, সিগ্রেট খাতে হ্যাঁয়, পিতে নেহী। নিজেকে নিয়ে এই খিল্লিতে আমি নিজেও ওদের সঙ্গে হাসিতে মাতি। জানি এই হাসি মেকি, জানি এই খিল্লি একটা হিংসে থেকে। বাঙালির মতো প্রেমিক অথবা প্রেমিকা তারা হতে পারবে না। বাঙালি ছক ভাঙতে জানে। পান করুক বা খাক, সে প্রেমিকার সঙ্গে শেয়ার করার আনন্দ জানে। কী কথায় কী কথা এসে যায়। যাই হোক, এবারের কলকাতা বইমেলায় জহরদা যখন সিগারেট দিলো ফেরাতে পারলাম না। ৯ নম্বর গেটের বাইরে সিগারেট খেতে খেতে সেই পুরনো দিনের আনন্দ ফিরে পেয়েছিলাম।
২।
যবে থেকে কলকাতা বইমেলা চিনি, তবে থেকেই আমার ইচ্ছে এক চড়ুই পাখির মতো আকাশে উড়ে উড়ে, এক পরিযায়ী সারসের মতো ভেসে ভেসে, চারদিকে চক্কর দিতে দিতে বইমেলা দেখব, তার ভিড় দেখব, ভিড়ের মধ্য থেকে প্রিয় স্টল ও লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলগুলি খুঁজে নেব। এবারে শিয়ালদা থেকে করুণাময়ী মেট্রোতে যেতে যেতে সেই সাধ পূরণ হতো কিছুক্ষণের জন্য। মনে হতো পুরো বইমেলাকে চারদিক থেকে চরকি পাক দিয়ে তারপর যদি মেট্রো ট্রেনটি আমাদের নামাতো তবে বেশ মজা হতো।
এতো ভিড় বইমেলায় ভাবা যায়! যেন দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার ভিড়। ভিড় বই কিনছে, ভিড় ছবি কিনছে, ভিড় চাটপাপড়ি খাচ্ছে। কেউ কেউ এই খাবারের স্টল দেখে খিল্লি করে। আমার তো ভালোই লাগলো। মনে হলো আমার মা’কে যদি নিয়ে আসতাম, আমার বউকে যদি নিয়ে আসতাম; আমার মা তো ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বাঙলায় নিজের নামটুকু শুধু লিখতে পারে, পড়ায় তেমন সড়গড় নয়, আমার বউ তো বই পড়তে ভালোবাসে না; ওরা না হয় পথের ধারে বসা জুয়েলারি কিনত, কোনও ফুডস্টলে বসে ফিস্ ফিঙ্গার খেতো; আর দেখত কত লোক শুধু বইকে ভালোবেসে এখানে আসে, কত দূর দূর, ভিনপ্রদেশ, ভিনদেশ থেকে পাঠকেরা আসে- এসব দৃশ্য দেখে তারা ভাঁড়ের চা’য়ের স্বাদের মতোই অবাক হতো!
তবে তারা আসতে পারেনি তো কী হয়েছে! আমার সঙ্গে গিয়েছিল আমার এক লতানো পাতানো মাসিমা। ষাটোর্ধ্ব এই মাসিমা একলা একটি মফঃস্বলি ফ্ল্যাটের জানলার শিক ধরে বেয়ে ওঠা এক বৃক্ষলতার মতো। তার ভাবনাগুলো তাকে লতাপাতার মতো কখনো জানলার বাইরে নিয়ে যায়, কখনো ভেতরে টেনে রাখে। মাসিমা ফুটপাথ থেকে নজরুল কেনে, রবি’র এতো ভ্যারাইটি দেখে মাসিমা কনফিউস্ড, কাকে ছেড়ে কাকে নেবে, আমাকে জিজ্ঞেস করে। মাসিমা যখন ‘ভাবো, ভাবো। ভাবা প্র্যাক্টিস করো’- লেখা ঋত্বিক ঘটকের পোর্ট্রেট কিনলো- আমি ভাবতে শুরু করলাম।
মাসিমা আমাকে ফিস্ ফিঙ্গার খাওয়াল, আমি মাসিমাকে চা খাওয়ালাম। মাসিমা চায়ে চুমুক দেয়, চা মাসিমাকে দেখে, আমি সেই ছবি তুলে রাখি দেখে মাসিমা হাসে, হাসে কিশোরীর মতো! মাটির ভাঁড় মাসিমাকে দেখে অবাক হয়!
৩।
সত্য যদি একটাই হয়, মানুষ তবে সব তার কার্বন কপি। মানুষ প্রেমে পড়ে, প্রেমে পড়ে সেও কার্বন কপি! মানুষ ভালোবাসে, ভালোবাসে সেও কার্বন কপি! মানুষ যেখানেই যায় সেই কার্বন কপি খোঁজে!
৪।
এতো বড় রাজপথ! অথচ পথের দু’পাশে কাঠের ডালা দেওয়া পুরনো আমলের দোকানের সামনে প্লাস্টিকের বস্তার পাহাড়। ধবধবে সাদা পরিষ্কার। দোকানের ভেতরে একটি কি দু’টি লোক গদি পেতে বসে আছে ততোধিক ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবীতে! পঞ্চাশ বছর আগে এই প্লাস্টিকের বস্তা ছিল না, ছিল চটের বস্তা! ব্যবসাই চট-কে প্লাস্টিকে পরিণত করেছে। মানুষকেও! এ কোন্ কলকাতা! এ কোন্ কলকাতা ভাবতে ভাবতে শোভাবাজার স্ট্রিট দিয়ে এগিয়ে যাই। মিত্র ক্যাফের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরনোর এখনো অনেক বেলা! শখের কয়লাগুলো এখনো ঘুমিয়ে আছে। অথচ কষ্টের কলকাতা, খেটে খাওয়া কলকাতার ঘুম অনেক আগেই ভেঙে গেছে। বিহারি দোকানি তার ফুটপাতের দোকানে কয়লার আগুনে রুটি সেঁকছে। কিশোর ছেলেটি তার ক্ষুধায় পাওয়া পথচারীদের প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছে সেই রুটি। হাঁটু পর্যন্ত গামবুট পরা সাদা পোশাকের এক পুলিশ জওয়ান তার এনফিল্ড থেকে নেমে এলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বাঁধাকপির ঘ্যাঁট ও চারটে রুটি সকাল সকাল সাঁটিয়ে দিলো। টাকাটা দিতে কিন্তু ভোলেনি। একজন প্রৌঢ়া ও একটি যুবক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কাঠের বেঞ্চিতে প্লেট রেখে খাবার খাচ্ছে। হয়তো তারা মা ও ছেলে। হয়তো তারা সকাল সকাল কোনো অফিসের কাজে এসেছে, অথবা পেনশন তুলতে ব্যাঙ্কে!
এত মানুষকে সামান্য রুটি-সব্জি খেতে দেখেও আমার খিদে পেয়ে গেলো। আমি অর্ডার করলাম চারটে রুটি ও সব্জি। নেহা অর্ডার করল লুচি আর আলুর দম। দোকানি ছেলেটি আমার প্লেটে দুটি গরম আর দুটি ঠান্ডা রুটি রেখে হাতে ধরিয়ে দিল।
কলকাতার এতো এতো পুরনো বাস ও ট্যাক্সির ধোঁয়ার কূট গন্ধ কিন্তু রুটি ও সব্জির গন্ধকে চাপা দিতে পারেনি। আরেকটু বেলা হলে কী হবে জানি না।