Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গ ল্প

শ্রী জি ৎ  দা স

golpo2

গল্পবুড়োর গল্প

এক 

অলস দিনগুলোর ঘুম শান্তির হয় না। দীর্ঘ হয় কিন্তু গাঢ় হয় না। ঘুম গাঢ় হলে ভালো স্বপ্ন আসে। দীর্ঘ হলেও স্বপ্ন আসে। কিন্তু কিছু দুশ্চিন্তা তার মধ্যে মিশে যায়। স্বপ্ন সে যেমনটাই হোক, দেখতে মন্দ লাগে না। অবচেতনে অনুভূতির যে সূক্ষ্ম দড়ি বাঁধা থাকে তাতে একটু টান পড়লেই আবার সব ঠিকঠাক। সপ্তাহে দু’একদিন রাতে তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বিছানায় যাওয়া নিয়ম করে নিয়েছি। শহরে থাকলেও এমনটা করতাম। শহরে তাড়াতাড়ি মানে এই রাত এগারোটা। গ্রামের কিছুটা মন্থর জীবন গতিতে সেটা ন’টা কিংবা সাড়ে ন’টা। বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে এসে আছি। ডাক্তারবাবু বলেছেন, এখন আমার এক মাস বিশ্রামের প্রয়োজন।  চার হপ্তা হতে আর দুদিন বাকি। শহুরে জীবনটাকে এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়। সেই আটটায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে, দু’টি গরম ভাত মুখে দিয়ে ভিড় বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস দৌড়নো। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করা। বড়বাবুর বকুনি, সহকর্মীদের খেলো হাসিঠাট্টা, যানজট, গাড়ির ধোঁয়া, আবার সন্ধে ছ’টা নাগাদ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা।

এখন বিকেল বেলা ছাদে উঠি কিংবা বুড়ি নদীর ধারটায় গিয়ে বসি। মাঝেমাঝে মনে হয় চুয়াল্লিশ নম্বর বাস, মারগারেট বিল্ডিং, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার কিংবা গোটা শহরটাই এই পৃথিবীর মধ্যে নয়। হতেই পারে না এই পৃথিবীর। বুড়ি নদীর বয়ে যাওয়া জলে বিকেলের শেষ রোদটা এসে লাফায়। এই সময়টা নদীর ধারে খুব শীতল অথচ মৃদু একটা হাওয়া দেয়। আগেও যে ক’বার এসেছি, দেখেছি দুটো শামখোল নদীর তীরে কাঁটা ঝোপের পাশে বালিয়াড়িতে লড়াই করে। আমার মতো একটা কুকুরও তাদের দাঁড়িয়ে দেখে মাঝে মাঝে। আজ দেখি ওরা একটা গুগলি নিয়ে টানাটানি করছে। কিন্তু শামখোল এ অঞ্চলে আগে পাওয়া যেতো না, ইদানিং বোধহয় আসছে। আচ্ছা শামখোলে কি গুগলি খায়?

-“হ্যাঁ খায় তো।” পাশ থেকে একটা বুড়োর গলার আওয়াজ আসে। কখন আমার অজান্তেই একটা থুত্থুড়ে লোক আমার পাশে ঘাসের ওপর এসে বসেছে। পরনে এক অদ্ভুত জোব্বা, অনেকটা জাদুকরদের মতো। গায়ের রং ফর্সা, গালের চামড়া ঝুলে পড়েছে। ছোটো ছোটো চোখের দুটো পাতার মাঝে অনেকটা ফাঁক। এ দেশীয় লোকের মুখের গড়ন এমনটা হয় না। লোকটাকে দেখে তবু মনে হলো আগে কোথাও যেন দেখেছি। কিন্তু আমি তো কথাগুলো মনে মনে ভাবছিলাম! লোকটা বুঝলো কীভাবে? তাছাড়া বলা নেই কওয়া নেই এমন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবার দরকারটাই বা কী! বুড়ো লোকটাকে বললাম, “আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”

-“চিনবেই বা কেমন করে? আমার বাড়ি তো এ দেশে নয়। টরেগারমা বলে কোনো জায়গার নাম শুনেছো কখনো? সেখানেই আমার আসল ঘর ছিলো। আমার ছোট্ট খড়ের ঘরের সামনে ছিলো নীল সমুদ্র। বালুচরে ছোটো ছোটো শিশুরা সকাল বিকাল খেলা করতো। ভোরবেলা ডিঙি নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম আমি। সেই মাছ গ্রামের বাজারে বিক্রি করে আমার একার সংসার ভালোভাবেই কেটে যেতো। বিকেলে সমুদ্র তীরে খেলতে আসা বাচ্চারা সন্ধেয় গিয়ে জুটতো আমার ঘরে, গল্প শুনবে বলে। ল্যাম্পের আলোয় বসে দেশ বিদেশের রূপকথা কিংবা সমুদ্রের অদ্ভুত সব প্রাণীর গল্প শোনাতাম তাদের। তাই তারা আদর করে আমায় ডাকতো ‘গল্প বুড়ো’।”

কাল অফিসে যোগ দিতে হবে। ভোরেই বেরবো। এক মাসের লম্বা একটা ছুটি একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছিল। শরীরটা মোটেও ভালো যাচ্ছিল না। কাজে কিছুতেই মন বসতো না। এখনো যে বিশেষ ভালো আছি তা নয়। নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক মাস পর আমাকে দেখে, বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদার দশটা মোটা ফাইল দিয়ে হয়তো চোখ পাকিয়ে বলবেন, “অ্যাদ্দিন খুব ফাঁকি মেরেছো। আজকের মধ্যেই এগুলো শেষ করো।” এসব কাজ কারই বা ভাল্লাগে! তার ওপর আবার এই বুড়োটা কীসব ভুলভাল গল্প শোনাচ্ছে। বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “সবই তো বুঝলাম! কিন্তু আপনি এদেশে এলেন কেমন করে? আপনার নামটাই বা কী? সেসব কিছুই তো বললেন না।”

-“আমার নাম তিইমা ল্য মাতসু। অতো বড় নামে কাজ নেই। তুমি আমায় গল্পবুড়ো বলেই ডাকবে। সবাই তাই ডাকে। এবার আমার এখানে এসে পৌঁছনোর ব্যাপারটা বলি। সেদিন ছিলো ঝড়ের রাত। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে একখানা গল্পের বই হাতে বিছানায় ঢুকেছি, এমন সময় দরজার কড়াটা কেউ সজোরে নাড়তে লাগলো। দরজা খুলতে দেখি একটা কমবয়েসি ছেলে দাঁড়িয়ে। পিঠে তার একটা ঢাউস বোঝা, বড় বড় বাবরি ছাঁট চুলগুলো ঝড়ের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেছে। সে আমায় জানালো আজ রাতটুকুর জন্য সে আমার আশ্রয়প্রার্থী। খাবারদাবার কিছুই লাগবে না, কেবল একটু শোবার জায়গা দিলেই হবে। চাইলে এর জন্য উপযুক্ত মূল্য দিতেও সে রাজি। একেই অতিথি দেবতার সমান, তার ওপর ঝড়ের রাতে এই অবস্থায় শত্রুকেও ফিরিয়ে দেওয়া চলে না। আমি তাকে সানন্দে আমার ঘরের ভিতরে ডাকলাম। বিনামূল্যেই তার রাত্রিবাসের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলাম আমার ছোট্ট ঘরে। ছোকরার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সে পেশায় জাদুকর। দেশবিদেশে জাদু দেখিয়ে মানুষজনের মনোরঞ্জন করে। পাশের গলদের গ্রামে যে মেলা বসেছে সেখানেই আজ তামাশা দেখানোর কথা ছিলো তার। কিন্ত হঠাৎ ঝড় আসায় সে মেলা ভেস্তে যায়। কাল সকালেই এখান থেকে সে আপন দেশে রওনা দেবে। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে জাদুকর ছোকরাটি অত্যন্ত পরিশ্রান্ত ছিলো। পরনের জোব্বাটা খুলে সে খুব তাড়াতাড়ি বিছানা ধরলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমের মাঝে নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। রূপকথা পড়ে আর রূপকথার গল্প শুনিয়ে আমার মনে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল জাদুকর হওয়ার। সে শখ পূর্ণ যদিও হয়নি। কিন্তু চোখের সামনে জাদুকর ছোকরার খুলে রাখা জোব্বাটা দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ওটা গায়ে দিয়ে নিজেকে কেমন লাগে দেখবার ভারী শখ হলো। জোব্বাটা গায়ে দিয়ে জাদুকরের পোঁটলা হাতড়ে একখানা আয়না বের করলাম। সেটা নিয়ে মুখ দেখতে গিয়েই তো যতো বিপত্তি। সোজা একেবারে এ দেশে এসে উঠলাম। এই দেখো আমার গায়ের পোশাক, এটা ওই জাদুকরেরই জোব্বাটা।” বলে কী লোকটা! পাগল-টাগলের পাল্লায় পড়লাম বোধহয়। এমনটা আবার হয় নাকি!

-“জানি হয়তো আমায় পাগল ভাবছো তুমি। ভাববারই কথা। কিন্তু কী জানো, এ বিশ্বের অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা নেই। এই পৃথিবীতে দু’চোখ দিয়ে তোমরা যা দেখো তার সবটার পিছনে কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করো। কিন্তু দু’চোখ খোলা রেখে ততোটুকুই দেখা যায় যতোটুকু আমাদের দেখতে দেওয়া হয়। সব জিনিসের ব্যাখ্যা হয় না। ঘুমের মাঝে চোখ বন্ধ করেও তো কতো জিনিস দেখা যায়। ইচ্ছেমতো ছোটোবড় জগৎ বানানো যায়। ঘুম ভাঙলেই সে জগৎ ভেঙে গেলো তেমনটা নয়। স্বপ্নের চরিত্রগুলোরও একটা জীবন আছে। তা বাস্তবের অত্যন্ত সমান্তরাল। তাছাড়া কোনটা বাস্তব কোনটা স্বপ্ন তা বলার আমরাই বা কে! যাই হোক, আমার মনে হয় তোমার আরো ক’দিন বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। কাল অফিস থেকে একবার ঘুরে আসতে পারো। সবার সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগবে। আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিও। আমার বাড়ি ফিরতে সুবিধে হবে। এখান থেকে টরেগারমা কম পথ নয় তো!”

ঝুপ করে কখন সন্ধে নেমে গেছে। নদীর ওপারটা আর দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটার চোখ দুটো জ্বলছে। আমি মুখ ঘোরাতে না ঘোরাতে বুড়ো লোকটা হাওয়া!

 

দুই

শৌর্য আজ অফিস এলো দীর্ঘ এক মাস পর। বাড়ি থেকে নিজের গাড়িতেই এসেছে আজ। সঙ্গে স্ত্রী অথৈ-ও আছে। হাফ-ডে অফিস করে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। শৌর্যকে এতোদিন পর দেখতে পেয়ে সহকর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। গোমড়ামুখো পুলকবাবু পর্যন্ত এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “ওয়েলকাম ব্যাক।” বড়বাবু মনোরঞ্জন হালদারের ঘরে ঢুকতে তিনি ফাইল ছেড়ে শৌর্যের দিকে মন দিলেন। শরীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, রাজনীতি-খেলা নিয়ে গল্প জুড়ে বসলেন শৌর্যের সঙ্গে। কথার ফাঁকে বড়বাবু শৌর্যের দিকে এগিয়ে দিলেন একটা কাগজ। সরকারি স্ট্যাম্প দেওয়া কাগজটা দেখিয়ে তিনি বললেন, “আরো দশদিন বিশ্রাম নাও। আমি হাই অথরিটির অনুমতি জোগাড় করে এনেছি।” কিন্ত বিশ্রাম আর ভালো লাগছে না শৌর্যের। এবার ও কাজে ফিরতে চায়। তবু বড়বাবুর মুখের ওপর কিছু বলতে পারলো না সে। লোকটাকে যতোটা খারাপ ভাবতো শৌর্য, অতোটাও খারাপ নয়। বেরনোর সময় দারোয়ানটাও শরীরের খবর নিলো। শৌর্য গাড়িতে উঠে বসতে অথৈ-এর ইশারায় ড্রাইভার ফ্লাইওভার ধরলো।

মারগারেট বিল্ডিং-এর সামনে এসে থামলো গাড়িটা। শহরের বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ সুতমাল্য মাইতির বাড়ি। শৌর্য বাড়িতে লাগানো সাইন বোর্ডের লেখাগুলো উল্টো করে পড়ার চেষ্টা করে। শব্দগুলো ওর চেনা চেনা লাগছিল। অশীতিপর বৃদ্ধ সুতমাল্য বাবু বাড়ির সামনের বাঁধানো পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিলেন। অথৈ একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে চললো। চোখে তার জল টলটল করছে। এ অশ্রু কৃতজ্ঞতার। 

আরও পড়ুন...