Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

স্টে থো স্কো প

সং হি তা   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়

sanhita

অন্য অভিমন্যু

“অসহায় লাগছে, বুঝলেন! চার দিন থেকে ছয় মাস, তিন বছর থেকে সাত-আট বছরের বাচ্চাগুলো সময় দিচ্ছেনা একদমই! ভেন্টিলেটারেও লাভ নেই। তার আগেই ফুসফুসের কলাগুলি শক্ত হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভিতরের হাওয়া ভরার বেলুনগুলো। কিছুতেই খুলছেনা! যে কজন বেঁচে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে হাঁপানির প্রবণতা থেকে যাচ্ছে জীবনের মত।”

 না কোভিড নয়। শহরের স্বনামধন্য সরকারি শিশু হাস পাতালের শিশু বিভাগের এক শিশু সকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল   সমসাময়িক আতঙ্ক জাগানো অসুখ নিয়ে! হ্যাঁ, প্রসঙ্গ এডিনো ভাইরাস ঘটিত শিশু রোগ। কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে আরো একটি ভাইরাসের স্থানীয় দৌড়াত্ম যখন সন্ত্রাসের বাতাবরন তৈরি করেছে, একই সঙ্গে জন্ম দিয়েছে, একে ঘিরে অনেক মিথ,আর গুজবের। তার পরিপ্রেক্ষিতেই একবার জেনে  নেওয়া যাক, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে এবং কিছু দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া এই ক্ষুদ্রতম প্রাণের বাহকটির বিষয়ে দু-চার কথা।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এডিনো ভাইরাস কিন্তু মোটেই কোভিড নাইন্টিনের মত অপরিচিত শত্রু নয়। উনিশশো তিপ্পান্ন সালে, আবিষ্কৃত এই  জাতীয়  ভাইরাস, প্রথম পাওয়া যায়, মানুষের এডিনয়েড গ্রন্থি বা টন্সিলের কাছ থেকে। নেদার ল্যান্ডে, সৈন বাহিনীতে পঞ্চান্ন সালে এর প্রকোপ ছিল। বরাবর পরিবেশে থাকা এই ভাইরাস শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে মূলত মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং আমাদের দেশেও দীর্ঘ কাল যাবত বিদ্যমান। সাধারণ সর্দি জ্বর প্রভৃতি অসুস্থতা থেকে ব্রোঙ্কাইটিস  নিউমোনিয়া  পর্যন্ত অসুখ যে  সব জীবানু ঘটিত কারণে হয়, তাদের  অন্যতম এই ভাইরাস। হাম বা হুপিং কাশি, জাতীয় রোগের পরে এই ধরনের অসুখের প্রবণতা বাড়ে। বিশেষত, শিশুদের ক্ষেত্রে, যে সব ভাইরাস, জ্বর শ্বাস কষ্ট বা নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী, তার মধ্যে এই ভাইরাসটির ১, ২, ৫ নম্বর প্রকার ভেদ সচরাচর পরিবেশে বিদ্যমান। কিন্তু এদের মধ্যে মহামারী ঘটায় ৩, ৪, ৭ নম্বর প্রকার ও ভাইরাস। এছাড়াও আরো অনেক ভাইরাস, যেমন রেস্পিরেটারি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জি ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের ভাইরাসের বিভিন্ন শ্রেনী, একই ধরনের রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করে। শিশুদের ক্ষেত্রে তার জটিলতা, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশী। এই সম্ভাবনা বার্ধ্যক্যেও ক্রমবর্ধমান।

এবার প্রশ্ন হলো, বর্তমান প্রেক্ষিতে এই রোগ মহামারীর আকার নিচ্ছে কেন? পুরনো পরিচিত এডিনো ভাইরাস, কি এখন মুখোশের আড়ালে কোন নতুন মুখ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এডিনো ভাইরাসের চরিত্র সম্পর্কে একটু বিশদে যেতে হবে।

পরিবেশ বাহিত জীবানু হিসেবে এর বেশ নাম ডাক আছে। অন্তত সাতান্ন রকমের এডিনো ভাইরাস শুধু মানুষের শরীরে রোগের কারণ।

এ ছাড়াও পাখি ও অন্যন্য স্তন্যপায়ীর রোগ সৃষ্টিকারী এডিনো ভাইরাসও আছে।

অনেকটা কোভিড নাইন্টিনের মত চেহারার, এডিনো ভাইরাসের সারা গায়ে থাকে স্পাইক বাঁ কাঁটা। এই ভাইরাস শ্বাস নালীতে, চোখে, অন্ত্র ও মূত্র থলিতে এমনকি লিভারের মধ্যেও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। গবেষণা বলে, মানুষের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি জনিত সমস্যায়ও এর অবদান আছে!

সংক্রমণের ক্ষেত্রে ও মানুষের শরীরে প্রবেশ পথের নিরিখেও এই ভাইরাস বিচিত্র গামী। মুখ নাক, গলা, চোখের মাধ্যমে, শ্বাস নালী, আর মলদ্বারের পথে এর সংক্রমণ ঘটে। অপরিচ্ছন্ন সুমিং পুলের জল থেকে, পরিবেশের আসবাব পত্রের সংক্রমিত তল থেকে, বাসস্থানের আশপাশে জড়ো হয়ে থাকা আবর্জনায়, ও বর্জ্য জলের মধ্যে, এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। কয়েক প্রকার এডিনো ভাইরাস, আন্ত্রিক রোগ অর্থাৎ গ্যাট্রো এন্টারাইটিসের কারণ।

 কোভিড ভাইরাসের তুলনায় এই ভাইরাসের পরিবেশের প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার ক্ষমতাও বেশী। শুষ্ক, পরিবেশে, ঘরের উষ্ণতায়, বিশেষ প্রকার এডিনো  ভাইরাস আর্দ্রতা নির্বিশেষে বেঁচে থাকে বারো সপ্তাহ পর্যন্ত। এই ক্ষমতা  এর পোলিও ভাইরাসের চেয়েও বেশী।

সাম্প্রতিক কালে, আন্ত্রিক সংক্রমণের মহামারীর ক্ষেত্রে, বিভিন্ন খাবার তৈরি বা পরিবেশক সংস্থা ও রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে, নরোভাইরাস নামক কুখ্যাত ভাইরাসের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে এডিনো ভাইরাসের কিছু প্রকারের। এডিনো ভাইরাস জনিত সঙ্ক্রমণ ক্ষেত্রেও শিশুদের শরীরে ভয়াবহ আকার ধারন করে। যে কোনো রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা ও খাদ্য সংরক্ষণের  ব্যবস্থা  এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে  প্রাথমিক প্রয়োজন।

বর্তমানে, প্রাকৃতিক আবহাওয়াগত তারতম্যের কারণে, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম ইত্যাদী রোগ জীবানুর উপস্থিতির  প্রভাবে,এবং কোভিড পরবর্তী কালে সামগ্রিক ভাবে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, এই ভাইরাস জনিত মহামারী দেখা দিয়েছে। যে শিশুরা স্বভাবত শ্বাস কষ্ট বা সর্দি কাশিতে বেশী ভোগে, তাদের মধ্যে এই রোগের জটিলতার সম্ভাবনা বেশী। যেমন বেশী, বয়সের তুলনায় অপুষ্ট বা কম ওজনের শিশুর, এবং যে শিশু প্রথম ছয় মাস মাতৃদুগ্ধ পায়নি তার।

সুতরাং, মানুষের সামাজিক জীবনে, বিনোদনের মধ্যে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না, এলাকায় আবর্জনা জমিয়ে রাখা, দূষিত জলের নিকাশী ব্যবস্থা না থাকা, যে অভ্যেস ও পরিস্থিতি  বর্তমানে আমাদের জীবন যাত্রার দৈনন্দিন চিত্রে সর্বদা বিদ্যমান, সেগুলোই এই মহামারী সৃষ্টিতে বিশেষ ভুমিকা পালন করেছে এ কথা বলা বাহুল্য।

অবশেষে প্রতিরোধের প্রশ্ন। এডিনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে এ দেশে এখনো কোন টিকাকরণের ব্যবস্থা নেই। উপরন্তু, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মত, এই ভাইরাসের বহু মিউটেশান এবং প্রকারভেদ থাকায়, টিকাকরণ থাকলেও তা খুব কার্যকরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রত্যেক বছর নতুন প্রকারভেদ থাকায় এর টিকা শুধু সেই বছরের জন্যই কার্যকরী থাকে। তাহলে উপায়?

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, রোগ প্রতিরোধে এযাবত আলোচিত সম্ভাব্য সংক্রমণের কারণ থেকে শিশুকে ও নিজেকে নিরাপদ রাখার কথা।

শিশুদের ক্ষেত্রে যে কোন রোগেই আপ্দকালীন তৎপরতা বুদ্ধিমানের কাজ। এদের শরীরে রোগ জটিল হতে দেরী হয়না, এরা ভাব প্রকাশে অক্ষম, আবার সময়মত চিকিৎসা হলে খুব দ্রুত আরোগ্যও লাভ করে।

যে কোন শিশুর, মায়ের দুধ টেনে খেতে না পারা, সর্দি, সামান্য জ্বর হলেই দ্রুত চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ।

 একটু বড়দের ক্ষেত্রেও সর্দি কাশি, হাঁচি, জ্বর, এবং সব বয়সেই ডায়রিয়া, বমি, ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে এই রোগ শুরু হতে পারে। শ্বাস কষ্ট, বা স্বাভাবিকের  চেয়ে দ্রুত শ্বাস, নেতিয়ে পড়া, এর লক্ষণ  হতে পারে। তাই সামান্য অসুস্থ থাকতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। প্রয়োজনে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হলে এ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হতে পারে।

রোগের লক্ষণ এখন বিচিত্র। জ্বর সর্দি কাশি ইত্যাদী ছাড়াও অল্প সময়ের মধ্যে, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, বুকে জল জমা, শুরু হয়ে বহু শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে।

 প্রাথমিক কয়েক মুহূর্ত, যাকে ডাক্তারী ভাষায় স্বর্ণ মুহূর্ত বলা হয়, শিশুদের ক্ষেত্রে সেই সময়ের পরিসেবা জীবনদায়ী হতে পারে। জনস্বাস্থ্যের নিরিখে, নিজের স্বাস্থ্যের মালিকানা, ব্যক্তি এবং পরিবারের ওপর থাকার কথা, তাই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। পরিশেষে মনে রাখতে হবে, জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচি অনুসারে শিশুদের টিকা সময়মত দিলে, বিভিন্ন ভাইরাস ও জীবানুর প্রতিরোধ ক্ষমতা সহজে জন্মায়।

 অকারণ গুজব বা আবেগে সামিল না হয়ে আর একবার আমাদের  মহামারীর মোকাবিলা করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে একশো  ভেন্টিলেটারে পরপর  শায়িত শিশু হোক, আর বেসরকারি নার্সিহোমের ঝাঁ চকচকে পরিবেশে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকা  শিশু, পরিবার তথা সমাজের মূলধন আগামী প্রজন্মই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের! ভাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে! চক্রব্যূহে একা অভিমন্যু প্রজন্মকে দূষণ আর জীবানু বেষ্ঠিত অসুস্থ, বিবর্ণ জীবন উপহার দিয়ে লড়তে পাঠালে আমরা ভালো থাকবো তো?

আরও পড়ুন...