Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গ ল্প

ত থা গ ত  দ ত্ত

tatha

ফ্যান

রুদ্র এক কাপ কফি নিয়ে বসল, ধোঁয়া উঠছে কফি থেকে। গরম কফি। তবে বেশিক্ষণ গরম থাকবে না। ঠাণ্ডাটা ভালই পড়েছে কলকাতায়। রুদ্র একটা সিগারেট ধরাল। পরপর দু’টো রিং ছাড়ল। ঘরের জানলা দরজা বন্ধ। আস্তে আস্তে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকল উপরের দিকে। রুদ্র’র আবার আহেলির কথা মনে পড়ে গেল। 

 চার বছরের সম্পর্কটা হঠাৎ এভাবে শেষ হয়ে যাবে, রুদ্র কোনোদিনও তা ভাবেনি। রামশঙ্করবাবুর বেশ চালু ব্যবসা। শিলিগুড়িতে বড় শাড়ির দোকান। দু’জন কর্মচারী আর সঙ্গে রামশঙ্করবাবু নিজে।  রুদ্রও বিগত কিছু মাস ধরে দোকানে বসা শুরু করে দিয়েছিল। অবশ্য, দোকানে বসার পিছনে আহেলির ভূমিকা রয়েছে। রামশঙ্করবাবু, তাঁর স্ত্রী মিতাদেবী অনেক বলেও রুদ্রকে ব্যবসামুখী করতে পারছিলেন না। কিন্তু আহেলির সঙ্গে পরিচয়, তারও কিছুদিন পর ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি মিলে একটা তাগিদ তৈরি হয়েছিল রুদ্র’র মধ্যে। যার ফলে সে উপার্জনের দিকে এগোতে বাধ্য হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে রুদ্র কর্মবিমুখ। রুদ্র আসলে শিল্পী। সে খুব ভাল ছবি আঁকতে পারে। তাই ধরাবাঁধা কাজের প্রতি তার একটা ভীষণ অনীহা ছিল প্রথম থেকেই।    

কফিটা শেষ করে রুদ্র একটা অর্ধসমাপ্ত ছবি নিয়ে বসল। রুদ্র আহেলির একটা ন্যুড করা শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে। তারপর পরিস্থিতির চাপে ছবি আঁকার মানসিকতা তার সম্পূর্ণভাবেই নষ্ট হয়ে গেছিল। আহেলির দু’টি স্তনের মাঝখানে হালকা একটা আলোছায়া দিতে দিতে রুদ্র’র মনে হল আহেলির কাছ থেকে দূরে থাকার জন্যই তো এরকম সামান্য একটা চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে আসা। তাহলে নতুন করে আবার সেই আহেলির কাছে এভাবে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণই হয় না। বুকের কাজটুকু করে নিয়ে রুদ্র মুখমণ্ডলে রঙের আস্তরণ ফেলতে শুরু করল নতুন করে। রাত বাড়তে থাকল, আর পাল্টাতে থাকল মেয়েটির মুখ। 

মুখ থেকে রুদ্র আবার বুকে চলে এলো। একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো তার মনে পড়তে থাকল। কয়েকবার মাত্র প্রদর্শিত হয়েছে তার ছবি, আপাতত। ছবি দেখে আহেলি মুগ্ধ হয়েছিল। পরিচয় আর তারপর সম্পর্ক শুরু হয়েছিল আস্তে আস্তে। আহেলি ভীষণভাবে উৎসাহ দিয়ে গেছে তাকে। বারবার বলেছে, ‘এখানে থেকে হবে না, রুদ্র। কলকাতা তোমাকে যেতেই হবে।’ এমনকী ব্যবসায় ঢোকার পর আহেলি বলেছে, ‘ব্যবসা যেন তোমার শিল্পসত্ত্বা গ্রাস করতে না পারে। একটা ছবির জন্য তোমার যা করার দরকার, তাই করবে রুদ্র।’  আর সেটাই যেন কাল হল শেষে। দিন পনেরো আগের কথা, রুদ্র একজন মহিলা মডেলকে নিয়ে কাজ করা শুরু করল। বেশ কিছু দিন সে আহেলির শরীর পায়নি, অথচ তার মনে হচ্ছিল একটা মৈথুন ভীষণ দরকার তা না হলে ছবিটা যেন ফুটছে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে কোনো ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট না করেই আহেলি এলো এবং রুদ্রকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নিজের চোখে দেখে গেলো। রুদ্র কিন্তু নিজেকে দোষী ভাবতে রাজি নয়। আহেলি তো নিজেই বলেছে যে একটা ছবিকে বুকের গভীর থেকে তুলে আনার জন্য যা দরকার, সেটাই করবে! রুদ্র তো তাই করেছে! তাহলে ওসব কথা কি আহেলির মনের কথা ছিল না? অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও রুদ্র ব্যর্থ হয়। শেষে দু’তিন দিন আগে যখন রুদ্র খবর পেলো আহেলি বিয়ের রেজিস্ট্রি করেছে, একটি ছেলের সঙ্গে, তার আর ভালো লাগল না। ওই শহর ছেড়ে সোজা কলকাতা। চেনা শহর, স্মৃতি সবই যেন তার কাছে বিষের মতো মনে হচ্ছিল। 

কিছুটা মদ রুদ্র গলায় ঢেলে দিল। আজই দুপুর নাগাদ সে কলকাতায় পৌঁছেছে। জিনিসপত্র বেশি কিছু আনেনি। বাড়িওয়ালার কিছু জিনিস রয়েছে, এ দিয়েই তার কাজ চলে যাবে। তাছাড়া রান্নার তো কোনো ব্যাপার নেই। বাইরে থেকে কিনে এনে খাবে। 

রুদ্র  সিগারেট ধরাল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল ছবিটার মুখের দিকে। সে যেন চমকে উঠল। অথচ চমকে ওঠার তো কিছু নেই। একটি নারীর মুখ। যাকে সে কোনোদিনও দেখেনি। অথচ তার চোখে এমন কিছু আছে, যার ফলে তার চোখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না।

রুদ্রর কাজ বিকেল তিনটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তবে অফিসে অনেক সকালে যেতে হয়। মিন্টোপার্ক থেকে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র রবীন্দ্র সদনের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতায় আসার পর থেকে রুদ্র এমনই করে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো করে রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে অফিসে চলে যায় আর ছুটির পর মেট্রো ধরার আগে রবীন্দ্র সদন চত্বরে কিছুক্ষণ সময় কাটায়, চা খায়, ফাইন আর্টসে গিয়ে প্রত্যেকটা গ্যালারি রোজ দেখে অনেকক্ষণ সময় ধরে। 

একটা ছবি, চারকোলের অসাধারণ কাজ। নিমগ্ন হয়ে রুদ্র সেটাই দেখে চলেছিল। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল পাশে। বুদ্ধের একটা আবক্ষ তৈলচিত্রের সামনে এক মহিলা। কালো শাড়ি, কালো স্লিভলেস  ব্লাউজ। শৌখিনতায় একটা হলদে সানগ্লাস কপালের উপর তোলা রয়েছে তাঁর। মহিলার শরীরে এমন একটা ভাষা আছে, যা যে কোনো পুরুষকেই একবার হলেও তাঁর দিকে তাকাতে বাধ্য করবে। রুদ্র তাকিয়ে রয়েছে মহিলার দিকে। তবে শুধুমাত্র এই একটা কারণেই যে সে তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেটা নয়। আসল কারণটা হলো, তার আঁকা সেই ছবিটার সঙ্গে এই মহিলার ভীষণ রকমের মিল। একজন অচেনা, না দেখা মানুষকে সে যেন এঁকে ফেলেছে নিখুঁত দক্ষতায়। রুদ্র এগিয়ে গেল মহিলার দিকে।

হোয়াটসঅ্যাপে ছবিটা দেখে নন্দিতা তাঁর সমস্ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ তো তাঁরই ছবি। রুদ্রর কিছুটা সংকোচ ছিল, যতোই হোক নগ্ন চিত্র, নন্দিতা কীভাবে দেখবেন ব্যাপারটা! তবে সে নিয়ে অবশ্য রুদ্রকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। 

আজকাল রুদ্রর মনে হয় আহেলির সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে ভালোই হয়েছে যেন।  ও জীবনে থাকলে নন্দিতার সঙ্গে হয়তো তার দেখাই হতো না। রুদ্র বুঝতে পারছে নন্দিতাকে তার কী ভীষণভাবে দরকার। একটু বয়সে বড় সুন্দরী মহিলাদের প্রতি রুদ্র’র বরাবরই আকর্ষণ ছিল খুব। নন্দিতা তার জীবনে প্রথম মহিলা যিনি বলেছেন, ‘রুদ্র, আমি তোমার ফ্যান হয়ে গেছি।’ 

নন্দিতার স্বামী জয়দীপবাবু কলেজে পড়ান। বছর তিনেক হল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। এখনও সন্তান হয়নি। নন্দিতা এবং জয়দীপের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সেই ছবিটা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দোতলার কোণের ঘরে টাঙানোর পর থেকে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে কি একটু হলেও চিড় ধরল! নন্দিতা অবশ্য সম্পর্কে চিড় ধরার মতো কোনো সুযোগই দিতে চান না জয়দীপকে। জয়দীপকে তিনি সোজা কথাটা সোজা ভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন, ‘জয়, আমি কিন্তু রুদ্রর সামনে কাপড় খুলিনি। দেখতেই তো পাচ্ছো, মুখ বাদে ছবিটার সঙ্গে কোনো মিলই নেই আমার। আমার বুকে তো তিল আছে, কোথায় তিল ছবিটায়? তাছাড়া আমার নাভি অনেক গভীর। ছবির মতো নয় মোটেও। আমি ওকে ভালোবাসি না জয়, ভালো তোমাকেই বাসি। আমি জাস্ট ওর ফ্যান, ব্যস এটুকুই, ওর ছবির গুণমুগ্ধ ভক্ত।’ 

নন্দিতা কিন্তু জয়দীপকে ঠকাতে চান না। কারণ জয়দীপের মতো ভালো মানুষ তেমন হয় না আজকাল। তাছাড়া জয়দীপের মতো ভালবাসা দেওয়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু রুদ্র’র প্রতি তাঁর কী যে এক আকর্ষণ, নন্দিতা এর কারণ কিছুই ভেবে বের করতে পারলেন না।

আজকাল নন্দিতার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে কিছুটা। বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়েন। বিয়ের ঠিক পর পরই জয়দীপ টালিগঞ্জে ছোট দোতলা এই বাড়িটা কিনেছেন। যাদবপুরের বাড়িটা একতলা, মাত্র দুটো ঘর সেখানে। ও বাড়ি এখন ফাঁকা পড়ে থাকে। টালিগঞ্জ থেকে মেট্রো ধরে নন্দিতা রুদ্র’র মতোই চলে আসেন রবীন্দ্র সদন। বসে অপেক্ষা করেন রুদ্র’র জন্য। অফিস শেষ করে রুদ্র চলে আসে। তারপর দু’জনের  মনের মতো করে কিছুটা সময় কাটানো। পুড়তে থাকা সিগারেটে ভাগাভাগি করে চুম্বন, আড্ডা, একসঙ্গে সিনেমা দেখা। নন্দনের নান্দনিক অন্ধকারে হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট। 

রামশঙ্করবাবু রুদ্র’র এই কলকাতায় পড়ে থাকা নিয়ে ভীষণ রুষ্ট। এর আগে দু’বার টাকা পাঠালেও আর তিনি টাকা পাঠাবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এসব সমস্যার কথা রুদ্র বলে চলেছিল। নন্দিতা বেশ কয়েকদিন ধরেই রুদ্রকে অফিস ছুটি নিয়ে ওঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলেন। সারাটা দুপুর নিভৃতে কাটালে দুজনেরই মন ভাল হবে। ‘কাল এসো রুদ্র, আমি অপেক্ষা করব’, বলে নন্দিতা এগোতে থাকলেন দ্রুত পায়ে। রুদ্র আর এগোল না। সিগারেট ধরাল। দু’জনেরই গন্তব্য টালিগঞ্জ, তাই রুদ্র আর নন্দিতার সন্ধ্যাগুলো একসঙ্গে মেট্রো সফরের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় রোজ।

দেখতে দেখতে বসন্ত এসে গেল। দোলটা জয়দীপ আর নন্দিতা শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এলেন দিন কয়েকের জন্য। এই সময়টা রুদ্র বেশ একাকিত্বে কাটিয়েছে। বেশ কয়েকদিন রুদ্র অফিসে যাওয়া বন্ধ করায় তার চাকরিটা গেছে। অফিসে না গিয়ে সে নন্দিতার বাড়িতে যায় দুপুরবেলা। নন্দিতা খুব অবাক হন জয়দীপের ব্যাপারে। জয়দীপ কি তাঁর চোখে চোখ রেখে বুঝতে পারেন না যে তিনি কী গভীরভাবে ডুবে আছেন অন্য এক পুরুষের প্রেমে!  অবশ্য চোখে চোখ রেখে রুদ্র’র প্রতি তাঁর ভালবাসা বোঝার দরকার হয় না, কারণ ওঁরা দু’জনে গল্প করতে বসলে আজকাল নন্দিতা বেশিটা সময় রুদ্র’র কথাই বলেন জয়দীপকে। কী অদ্ভুত মানুষ এই জয়দীপ। নন্দিতাকে নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখেন। রুদ্রর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র রাগ নেই! 

রুদ্র এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি এঁকেছে। নন্দিতার মতো মেয়ে জীবনে থাকলে সৃষ্টির একটা আলাদা উৎসাহ পাওয়া যায়। নন্দিতা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলেছেন, ‘রুদ্র, এখন আমার একটাই পরিচয়, আমি তোমার ফ্যান।’ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট দেখে এক ভদ্রলোকের কয়েকটা ছবি বেশ পছন্দ হয়েছিল। তিনি আজ কিনে নিয়ে গেলেন। অবশ্য তরুণ শিল্পীর আঁকা ছবি তো, কেউ তেমন দাম দিতে চায় না। রুদ্র’র এই টাকাটা ভীষণ দরকার ছিল। হাতের লক্ষ্মীকে সে পায়ে ঠেলতে পারেনি। 

ফাল্গুনের মাঝামাঝি গরম পড়তে শুরু করেছে। একটা পাখার দরকার হয়ে পড়ল। যদিও রুদ্র’র এখন ফ্যান কিনে পয়সা নষ্ট করার ইচ্ছে নেই মোটেও। কিন্তু কিছু করারও নেই। সন্ধ্যার দিকে রুদ্র পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ানের দোকানে গেলো। কখন যে কার হাতে কী চলে আসে, তা কেই বা বলতে পারে! আজ সকালেই নাকি এক ভদ্রলোক পুরনো একটা সিলিং ফ্যান বিক্রি করে গেছিলেন। অজিতবাবু সেটা রুদ্রকে ভাড়ায় দিতে রাজি হয়ে গেলেন। তখনই একটি ছেলেকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন রুদ্র’র সঙ্গে। পাখা লাগানো হয়ে গেলো। দু’দিন আগে ভাড়া করা পাখা নিয়ে রুদ্র’র কথা হচ্ছিল নন্দিতার সঙ্গে। নন্দিতা অবশ্য বলেছিলেন, ‘রুদ্র, দিনকাল পাল্টে গেছে, কলকাতায় আজকাল ভাড়ায় আর পাখা পাওয়া যায় না। পাখা তো দূরের কথা, দেখছোই তো এখন ঘরে ঘরে এসি।’ তারপর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটা হাইস্পিড ফ্যান কিনে দিই তোমাকে, রুদ্র?’ রুদ্র অবশ্য সেই প্রস্তাব তখনই নাকচ করে দিয়েছিল। 

এইসব ছোটখাটো প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তিতে খুশি হওয়ার নামই জীবন। পাখার হাওয়া লেগে তার মনটা যেন ফুরফুর করে উড়ছে। নন্দিতাকে খবরটা জানানোর সে জন্য পকেট থেকে ফোন বের করল। কিন্তু খবরটা তাকে আর জানানো হল না। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট মেসেজ জমে আছে- ‘রুদ্র, পিরিয়ড মিস করেছিলাম। সন্দেহ হল, প্রেগা টেস্ট করে দেখছি আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট। রুদ্র, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কী করবে এখন তুমি?’

রুদ্র কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। তার মনে হল পৃথিবীর সমস্ত ভার যেন তারই মাথায় চেপে বসেছে। সে ফোন করল নন্দিতাকে বেশ কয়েকবার। রিং হয়ে থেমে গেল। বাধ্য হয়ে টেক্সট করল তারপর। সীন হয়ে পড়ে রইল তার সমস্ত মেসেজ। কোনও রিপ্লাই এলো না।

রাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রুদ্র’র। সে চোখ খুলে তাকাল আর নাইট ল্যাম্পের অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোয় সে দেখল মাথার উপর পাখাটা ঘুরছে বনবন করে। মৃদু আলো ফ্যানের ব্লেডে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কী এক রহস্যময় দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রুদ্র’র মনে হল সে যদি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে পড়ে তাহলে তার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হবে মুহূর্তে। তার পরেই রুদ্র’র মনে হলো কী সব ভয়ংকর কথা সে ভাবছে! তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? সে কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছে? এক লাফে সে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। দরজা খুলে এসে দাঁড়াল এক চিলতে ব্যালকনিটায়। একটা সিগারেট ধরাল। সারা রাত তার আর ঘুম এলো না। 

সারা রাতের দুশ্চিন্তা আর রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে সে পরের দিন দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু রাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। হোটেলের ঘরে এক ব্যক্তি নাকি গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল, তারপর থেকে ওই পাখা চালিয়ে যে-ই শুয়েছে তারই নাকি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে পাখা থেকে ঝুলে— এমন একটা ঘটনার কথা রুদ্র শুনেছিল। ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষণ। তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। 

কলকাতায় আসার পর প্রায় আড়াই মাস কেটে গেছে। একবারও সে বাড়ি ফেরেনি। প্রথম প্রথম মা ফোন করে খুব ডাকাডাকি করতেন, আজকাল তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতার পরিবেশ কেমন একটা দমবন্ধকর হয়ে ওঠায় রুদ্র বাড়ি ফিরেছে আজ। মা ভীষণ খুশি, ‘বাবা, তুই জানিয়ে এলে কতো কিছু রান্না করে রাখতাম, এখন আমার হুটোপাটি লেগে যাচ্ছে।’ রামশঙ্করবাবুও খুশি হয়েছেন যথেষ্ট, কিন্তু মুখে তেমন কিছু প্রকাশ করলেন না। 

রুদ্র’র এখন বাড়ি ফেরার আরেকটি কারণ হল টাকা। সে ঠিক করেই এসেছে বাবার কাছে টাকা চাইবে এগজিবিশনের কথা বলে। না পেলে সে বাবার সিন্দুক থেকে চুরি করতেও পিছপা হবে না। কারণ টাকাটা তার চাই-ই চাই। ব্যবসার কারণে রামশঙ্করবাবুকে ভালো অ্যামাউন্টের ক্যাশ রাখতে হয় নিজের কাছে। রুদ্র আসলে নন্দিতার গর্ভপাত করাতে চায়। আর এই সব ইললিগ্যাল অ্যাবরশান করাতে টাকা কেমন জলের মতো বেরিয়ে যায়, সে তো সকলেরই জানা। 

শিলিগুড়িতে গরম নেই। পাখা চালানোর দরকার ছিল না, তবুও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই রুদ্র গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে পাখা চালিয়ে শুলো। সারারাত ধরে সে ঘুমাল, অনেকদিন পর খুব সুন্দর একটা ঘুম হল তার। 

পরের দিন সকালবেলাটা তার আশ্চর্যজনকভাবে শুরু হল। হোয়াটসঅ্যাপে নন্দিতার টেক্সট- ‘আমি দেখছিলাম তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি কিনা। নাহ্, পারলাম না। বিয়ে করবে আমাকে? মানছি জয়দীপের মতো মানুষ হয় না। কিন্তু আমাকে তো একজনকে বেছে নিতে হবে। আমি না হয় তোমাকেই বেছে নিলাম রুদ্র। তুমি নেবে না আমাকে?’

এরপরে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। ব্রেকফাস্ট করেই রুদ্র কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। অনেকদিন পর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে। তাছাড়া বাপের টাকা চুরি করেও তাকে পাপের বোঝা বাড়াতে হলো না। 

ক্লান্ত ছিলো, তবু রুদ্র’র ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে সে উঠে বসল বিছানায়। তার সারা শরীরে ঘাম। পাখাটা দ্রুত ঘুরে চলেছে। সে পাখার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাল। পাখার স্যুইচ অফ করল। তার মনে হলো সত্যিই যেন কিছু রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ওই ফ্যানের মধ্যে। সে একটা চেয়ার নিয়ে খাটের উপর রাখল। তারপর চেয়ারের উপর উঠে ভালো করে দেখতে থাকল পাখাটাকে। অনেকক্ষণ চলায় বেশ গরম হয়ে রয়েছে পাখাটা। 

পরের দিন পুলিশ দরজা ভেঙে রুদ্র’র ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে নিয়ে গেল পোস্টমর্টেমের জন্য। নন্দিতা এই খবরটা কয়েকদিন পর পেলেন। তারপর থেকে তাঁর শরীর এবং মন দুটোই খারাপ হতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। নন্দিতার আজকাল মনে হয় খুব ভুল করেছেন তিনি। জয়দীপই তাঁর প্রকৃত বন্ধু, প্রকৃত ভালবাসা। এখন তিনি তীব্রভাবে ফিরে আসতে চাইছেন জয়দীপের কাছে কিন্তু পারছেন না। কিন্তু এই সন্তানের পিতৃপরিচয় কীভাবে জানাবেন তিনি জয়দীপকে? 

জয়দীপ এখন রাতে পাশের ঘরে শোন। তার কারণ, তিনি আজকাল সিগারেট খাওয়া ধরেছেন। ধোঁয়ায় নন্দিতার অসুবিধে হোক তা তিনি চান না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে নন্দিতাকে, ওষুধ চলছে।

পুলিশের তদন্ত মিটে গেল খুব দ্রুত। এটা যে আত্মহত্যা, সে বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যে ভদ্রলোক ওই পাখাটা অজিতবাবুকে বিক্রি করে গেছিলেন, তিনিই আবার সেই পাখাটাই কিনবেন বলে দোকানে এসে হাজির। অজিতবাবু একটু অবাকই হলেন তারপর ভাবলেন, ভালই হল। ‘আপনার বাড়িটা বলে যান, আমার কাজের ছেলেটাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠাচ্ছি।’

রবিবারের দুপুর।  ভদ্রলোকটি ভাত বসিয়েছেন তখন। ইলেকট্রিশিয়ান ছেলেটি কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতে যেতে এমনিই জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, রান্নার কতদূর?’ 

হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। মুখটাকে কিছুটা চেপে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে জয়দীপ উত্তর দিলেন, ‘এখন শুধু ফ্যান গালা বাকি।’ 

আরও পড়ুন...