ক্যা ন ভা স
তেইশ বছর আগের এক সকাল। সর্বরী রায় চৌধুরীর বাড়িতে আছি বিশেষ একটি কাজের সূত্রে, সর্বরী রায় চৌধুরী তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে মাটি দিয়ে একটি মূর্তি গড়ছেন তখন ।
মগ্ন এক শিল্পীর সত্তার সেই নিবিড় নির্জনতায় কোথাও একটা ভাষা গড়ে উঠছে, যে ভাষায় ওই মূর্তিটি হয়ে উঠছে । এই যে হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ এলো তা ওই মুর্তিটির হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী সত্তার যে উত্তরণ তাও তো ওই হয়ে ওঠাই একরকম, আর এ কারণেই হয়ত মাঝে মাঝে তাঁর শিল্পী সত্তার কোথাও একটা প্রবাহ আমাদের স্পর্শ করছিল।
কেননা আমরা ওই ভিন্নতা শুধু যে একজন শিল্পীর প্রবাহ হিসেবে স্পর্শ করছি তাই তো নয় বরং আমাদের চেতনায় সেই সত্তার একটা ছাপ পড়ছে ক্রমাগত ওই সময়ের, আর তার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন সত্তার প্রকাশ ‘রামদা বলতেন খেলা, নিজেকে নিয়ে একটা খেলা, বুঝলে ?” হঠাৎ যেন সেই মগ্নতা ভেঙে গেল, মূর্তিটির আশেপাশে সেই খেলার চিহ্ন যেন মুছে গেল, আর তাঁর চোখে মুখে একটা দ্বন্দ্বের আভা ছড়িয়ে পড়ল সেই মুহুর্তে। যেন কোথাও একটা গান হঠাৎ থেমে গেল।
এই যে সৃষ্টির মুহূর্ত আর তার মাঝখানে একটা সত্তার আবির্ভাব সে কি শিল্পের সত্তার আবির্ভাব নাকি তা একজন শিল্পীর সেই অভিজ্ঞতা যা সময়ের একটা ক্ষতও বলা যায়? ‘আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সেই জন্য কাউকে আমার কাজ দেখাতে চাইছি না… এখন’ বলার পরই মনের গোড়ায় এসে গেল রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিল্পবোধ, ‘আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি, তিনি আমাদের সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। বিনোদ দা বা কিঙ্করদা অনেক বড়োমাপের শিল্পী। আমি চেয়েছি গান যদি দেখতে পাওয়া যায় আমার কাজের ভিতর দিয়ে, একটা নির্জনতা যদি আমাকে জাগিয়ে রাখে, এই আর কি, এই যে নির্জন ভাষার কথা বলা হচ্ছে সেটা কেমন তাহলে? আসলে কি ভাষাটা ওই সময়ের মধ্যেই হয়ে উঠছে এটা এই মুর্তিটির একটা নিজস্ব ভাষা বলতে পারো।’ বলার পর সর্বরী রায়চৌধুরী আবার হারিয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন এই অর্থে যে সৃষ্টির মুহূর্তের সঙ্গে তাঁর আবার সংযোগ স্থাপন হলো তখন কিন্তু বাইরের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিন্ন হয়েছে।
এটাই একধরনের একজন শিল্পীর কাছে নিজের ভেতরে প্রবেশ করার একটা উপায় বলা যায়। কিন্তু এইরকম বলার অর্থ যে শিল্পী এই যে নিজের দুর্গমে প্রবেশ করছেন এর মাধ্যম হচ্ছে ওই শিল্প, আর এই আত্ম অন্বেষণ কখন উপলব্ধি হয় আমাদের ? একটু থেমে থেমে বললেন ‘আমি নিজের কাজ করতে চেয়েছি কেমন করে বলত ? আমার ভেতরে যখন… কখনও কখনও একটা আর্তনাদ হয়, ঠিক বুঝতে পারি না তবে এটা যে আমারই আর্তনাদ তা নাও হতে পারে, তখন মনে হয় একটা কিছু করি আমি ঠিক বোঝাতে পারলাম? অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইলেন যে সামগ্রিক সত্তার একটা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি আছে যেখানে একজন শিল্পী তিনি তার অংশ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সব শিল্পীর মধ্যে যে একটা সামগ্রিক ভাব আছে সেইটা আমাদের চেতনায় ধরা থাকে আর তা থাকে বলেই আমরা সেইসব শিল্পকর্মকে স্পর্শ করি নিজের জীবনবোধের আধারে।