চ রৈ বে তি
হাওয়ার নকসা তোলা সোনালি বালির প্যালেটে ঢেউ ছলকানোর ছলাৎছল। ভ্রমণের এজমালি চেয়ে ভেসে গেছি সাগরবেলায়। ঢেউয়ের খাতায় কেবল ভাঙাগড়া। দু’দশ কলি লোনাহাওয়া উড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকুল পর্যটনে নাম তুলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর। সাগরের প্রাণখোলা জলছবি নিয়ে বঙ্গোপসাগর উপকুলের সংসারে অসীম আকাশ ছুঁয়ে তাজপুর।
সফর অছিলায়, যাবতীয় অবাধ্য আনন্দে, আস্ত একখানা দিন, ভোর থেকে পড়ন্ত বিকেল পর্যন্ত তাজপুরের নিরিবিলিতে দেদার প্রকৃতি উপভোগে কাটিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। ধু ধু বালিয়াড়ি। লোকজন হাতে গোনা। বালিয়াড়ির এদিক পানে কিছু সীগাল, উড়ছে আর কর্কশ স্বরে ডেকে যাচ্ছে। স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বালির বুকে হেঁটে যাওয়া। দিনভর ঝিনুক কুড়িয়ে, সমুদ্রের সঙ্গে অল্পবিস্তর খুনসুটি করে বা বালুকাবেলায় হালকা পায়ে ঘুরে বেড়িয়ে – সময় যে কোথা দিয়ে হুশ্ করে পেরিয়ে যাবে, টের পাওয়াই যাবে না। একপাশে ঋজু হয়ে আছে ঝাউবনের সারি। নিস্তব্ধতার বাতাবরণে তাজপুরের হাটখোলা সাগরতট। কাছকাছি দিঘা, মন্দারমনির থেকে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন তাজপুরের সৈকত। জলে নেমে তাবৎ উল্লাসে হুটোপাটি করা যায় নিশ্চিন্তে।
উথ্লে থাকে প্রীত সৈকত। ক্যামেরায় বন্দী হতে থাকে নিসর্গ। সেই সুনীল সাগর, ভেতরে পড়ে থাকা জাফরি কাটা নীল, নিরালা বেলাভূমি, অকৃত্রিম ঝাউ ও কেয়াবনের সারি। তাজপুরের ঝাউ বনবীথিকা অনেক বেশি ঘনসন্নিবদ্ধ। পথ হারিয়ে ফেললে বেশ মুশকিল হবে কিন্তু হোটেলে ফিরতে। কারণ সমুদ্রতট থেকে কিছু রিসর্ট বেশ দূরে দূরে আর এতোটাই জনমনিষ্যিশূন্য যে সঠিক পথটুকু বাতলে দেওয়ার মতো সহজে কাউকে পাওয়া যাবে না। আরও একটা ব্যাপার হল, হালে অঞ্চলটির প্রভূত উন্নতিসাধন হলেও বিদ্যুৎবিভ্রাট আছেই। তাই সূর্য পাটে যাওয়া মাত্রই নিশুতি আঁধারে ছেয়ে যায় তাজপুর সাগরবেলা। পূর্ণিমার ভরাকোটালে ঢেউ আছড়ে পড়ে অফুরান।
খানিক দূর থেকে দিনের আলোয় সাগরবেলার দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন রাশি রাশি লালরঙা পলাশ ফুল ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। আদপে তখন বালির বুকে ফুরফুরে কাঁকড়াদের নিরন্তর লুকোচুরি খেলা চলছে। এদের পোশাকি নাম হল ‘সন্ন্যাসী কাঁকড়া’। বালির বুকে পা রাখতেই লাল কাঁকড়ার দল শক্ত বালির নিচে সেঁধিয়ে নিমেষে ফুরুৎ। তাজপুরের সৈকতে মানুষজনের ততোটা ভিড়ভাট্টা নেই বলেই লাল কাঁকড়াদের অবাধ আনাগোনা। ভিজে বালির ওপর, এই সন্ন্যাসী কাঁকড়াদের অবাধ যাওয়া-আসার পদছাপ অপূর্ব শিল্পকর্ম এঁকে রাখছে। তবে ইদানিং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের জেরে এই লাল কাঁকড়া কিছুটা বিলুপ্তপ্রায়।
ঘন ঝাউবনের ফাঁক গলেও সৈকতে চলে যাওয়া যায়। যেখানে অনন্ত জলরাশির ঢেউ ভাঙার গান। নিশ্ছিদ্র ঝাউবনের আড়ালে-আবডালে কোথাও মাছ ধরার ডিঙিটি আলগোছে উপুড় করে রাখা। ডিঙি নৌকাগুলির কোনওটায় আলকাতরার পোঁচ। কোনটায় নীল তো কোনটায় ক্যাটক্যাটে হলুদ বা কমলা রঙ। ঝাউবনের আবডালে মাছ ধরার নৌকাগুলির এই বিজাতীয় রঙবেরঙ তকমাই যেন অন্য মাত্রা আনে। বাড়িয়ে তোলে সোনালি তটের মোহময় সৌন্দর্য।
কাছেই রয়েছে জলদাখটি নামে অতি সাদামাটা এক ধীবর গ্রাম। এখানে কিছু ভিড় থাকে মাছের ব্যাপারীদের। জেলে মহল্লার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা স্বাগত জানায়। ওপাশে জলদা নদীর মোহনা। এক মাঝিদাদা আমাদের দেখে ডাকলেন, “যাবেন তো ম্যাডাম ওপারে ?” দরদাম না করেই উঠে পড়লাম হাতে টানা নৌকায়। কাঠের তক্তার পাটাতনে পা ঝুলিয়ে বসি। জলদা নদীর মাঝ বরাবর আসতেই সাগরের ঢেউ এসে দুলিয়ে দিচ্ছিল নৌকা। ভয়ও লাগছিল, রোমাঞ্চও।
ইদানিং তাজপুরে হয়েছে নানা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের আধিক্য। কত ধরনের মজার মজার খেলা সেসব। তবে প্রায় প্রতিটি জলক্রীড়ায় জরুরি প্রশিক্ষণ বুঝে নিয়ে নামা উচিত। না হলে কোন বড়রকম বিপদ ঘটে যেতে পারে। রয়েছে সী র্যাফটিং, কোস্টাল বাইকিং, প্যারাসেলিং, সী কায়াকিং, টার্গেট জাম্পিং, জর্বিং, বানানা রাইড ইত্যাদি। বেশ উত্তেজক খেলা সন্দেহ নেই। খেলাগুলি আকর্ষনীয় হলেও খরচ কিন্তু বেশ গালভরা।
তাজপুর থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এক লুকানো অনাঘ্রাতা তথা নব্য সাগরসৈকত চাঁদপুর। অচিরেই পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে স্থান করে নেবে চাঁদপুর। আসলে এই ধীবরবস্তিটিও যে একটি পর্যটনস্থল হতে পারে আগে কেউ ভাবেইনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাজপুরেও পর্যটনের প্রসার এবং একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা রেখেছে। তাজপুর ও শঙ্করপুরের প্রায় মাঝখানে চাঁদপুর সৈকত। দুটিই সৈকত ধরে হাঁটা পথ। এখানকার কর্দমাক্ত বালুকাবেলা স্নান করার উপযোগী নয় বলাইবাহুল্য। তবে এখানে শান বাঁধানো সাগরপাড়ে বসে কেটে যাবে সময়ের অনেকখানি।
সাগরের ঐক্যতান ও তাজপুরের সঙ্গতিপূর্ণ আলাপচারিতায় জিরিয়ে নিচ্ছি। আমার এই কথা ও কলম — নির্জনতার আতুরঘরে আলাপন মূর্ত করে তুলছে ক্রমশ। সমুদ্রও কথা দিয়েছিল, লোনাবাতাস গূঢ় আয়ত্বে ভরিয়ে দেবে নিঝুম বেদনা, অবসর ঢেউ। সাধেই কী আর বলা হয় “The cure for anything is salty water.. sweat, tears and the sea…”
কীভাবে যাবেন–
দিঘা থেকে তাজপুরের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। দিঘা থেকে গাড়িতে বালিসাই পৌঁছে, সেখান থেকে তাজপুর ৫ কিলোমিটার। ভ্যানরিক্সা বা যে কোনও ছোট গাড়িতে তাজপুর। অথবা কলকাতা থেকে রেলপথে দিঘার আগের স্টেশন রামনগর নেমে শেয়ার গাড়ি বা মোটরভ্যানে সোজা তাজপুরে চলে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন–
পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের, তাজপুর প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও রয়েছে তাজপুর রিট্রির্ট, সাগর কিনারে রিসর্ট, মল্লিকা রিসর্ট, নিউ সোনার বাংলা রিসর্ট, তাজপুর নেচার ক্যাম্প, তাজপুর হলিডে ইন ইত্যাদি।
সেরা সময়–
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী সেরা সময়। তবে বর্ষায় তাজপুর যাওয়া উপযোগী নয় মোটেই।