খে লা ই ডো স্কো প
খেলা খেলা দিয়ে শুরু…
জীবনের শুরু হয় খেলা দিয়ে এবং বিভিন্ন পর্যায় বিভিন্ন রকম খেলা নির্দেশ করে জীবনচক্রের পরিবৃত্তি। ছোটবেলা থেকে শুনেছি মেয়েদের খেলা, ছেলেদের খেলা বা ছোটদের খেলা, বড়দের খেলা ইত্যাদি। খেলা সব সময় আনন্দ দায়ক। গবেষণা বলছে, খেলা তিন রকমের— সুযোগ নির্ভর, কৌশলগত আর জীবনধারা
কেন্দ্রিক। অঞ্চল ভিত্তিক বা বিশেষ কোনো জনজাতির বিশেষ খেলা থাকতে পারে। সেরকমই কয়েকটি খেলার কথা বলি।
পশ্চিমবঙ্গে ওরাওঁ জনজাতির মানুষ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জেলায়। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের এক আদিম জনগোষ্ঠী ওরাওঁ। কুরুক এদের ভাষা। কুরুক শব্দের অর্থ ‘বক্তা’, যে চিৎকার করে তার বক্তব্য রাখে। ওরাওঁ শব্দের অর্থ ‘যারা ঘুরে বেড়ায়’। এই নামের কারণ তারা একসময় জঙ্গল নির্ভর ছিল এবং এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘুরে বেড়াত খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ আমলে ওরাওঁরা বাংলায় এসেছিলো শ্রমিক হিসেবে। একদল চা শ্রমিক হিসেবে স্থায়ী বসবাস শুরু করে উত্তরবঙ্গে আর একদল সুন্দরবনে। কঠোর পরিশ্রমী ওরাওঁদের কাজ ছিল জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ যোগ্য জমি তৈরি করা। ধীরে ধীরে এরা হয়ে ওঠে কৃষিজীবী।
আলিপুরদুয়ার জেলার ফরেস্ট বস্তিতে বসবাসকারী ওরাওঁদের মধ্যে দেখা যায় ‘বিট্টি খেলা’। বিট্টি খেলায় অংশ গ্রহণ করে ১০ থেকে ১২ জন কিশোর। খেলা হয় দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে। উভয় পক্ষে থাকে ৫-৬ জন। এই খেলার জন্য প্রয়োজন ৩/৪ ফুট লম্বা একটি শক্ত নীম ডাল বা অন্য কোনো গাছের ডাল, একটি কাঠের টুকরো যার এক প্রান্ত সুচালো এবং আরো একটি ছোট কাঠ। এক দলের খেলোয়াড় নীম ডাল এর সাথে আটকানো সুচাগ্র কাঠের টুকরোটি দিয়ে ছোট কাঠের টুকরোটিকে সজোরে আঘাত করবে। প্রতিপক্ষের কেউ যদি সেই টুকরোটি ধরতে পারে তাহলে সে আউট বা পয়েন্ট প্রতিপক্ষের। এই খেলাটিকে সুযোগ নির্ভর।
এই সম্প্রদায়ের আর একটি খেলার নাম ‘আলু খেলা’। এটি বিশেষতঃ মেয়েদের খেলা। দুই থেকে চার জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে এই খেলায়। মেয়েরা মাটিতে বসে তিনটি পাথর নিয়ে খেলে। এই পাথর তিনটি আসলে তিনটি আলু রূপে কল্পনা করা হয়। চার জন অংশগ্রহণ করলে, তিনজন পাথর গুলো লুকিয়ে রাখে আর একজন সেই পাথর গুলো খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। খুঁজে পেলে সে খেলায় থাকে নাহলে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়। এই খেলাটিও সুযোগ নির্ভর। যদিও কৃষিজীবী ওরাওঁ দের জীবনে সবজির ব্যবহার আশ্চর্য নয়।
সুন্দরবনের বাসন্তী অঞ্চলের ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রচলিত ‘গোজি খেলা’। এ ক্ষেত্রেও দুটো দলে অংশ গ্রহণ করতে পারে ১০-১২ জন। প্রথমে উঠোনে একটি বড় চৌকো খোপ কাটা হয়, যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে মোটামুটি ২৫ মিটার। এর মাঝে আরো চারটি খোপ কাটা হয় এবং বাইরে থাকে ২ মিটারের পথ। বড় চৌকোর মাঝখানে আরো একটি চৌকো কাটা হয় এবং সেখানে তৈরি করা হয় ছোট একটি বালি বা মাটির স্তূপ। এই স্তূপটি আসলে লবণ বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। বড় চৌকোর বাইরে উত্তর দিকে একটি খোপ কেটে তৈরি হয় গুদাম ঘর। শুরু হয় খেলা। নির্বাচিত হয় একজন পাহারাদার। তার কাজ লবণ অর্থাৎ সেই বালি বা মাটির স্তূপ রক্ষা করা। বিপক্ষের একজন সেই লবণ চুরির উদ্দেশ্যে বাইরের পথ ধরে দৌড়োতে শুরু করে আর একজনের হাত ধরে। যারা লবন রক্ষা করছে তারা চেষ্টা করে যাতে প্রতিপক্ষ ভেতরে না ঢুকতে পারে। ভেতরে ঢুকলেই মৃত্যু। যদি কেউ সফল হয় লবণ চুরি করতে তাহলে তাকে গুদাম পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। সম্ভব হলে সেই দলের জয়। এভাবেই খেলা চলতে থাকে। এই খেলা মূলত কৌশল ভিত্তিক। কিন্তু খেয়াল করলে বোঝা যায় এর সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলের জীবনধারাও যুক্ত। লবণ মানুষের জীবনে একটি অপরিহার্য বস্তু। সুন্দরবনের জলে লবণের পরিমান বেশি। সে কারণেই সেখানে বসবাসকারী মানুষ লবণ ব্যবহার করেছে খেলায়।
এভাবেই খেলা হয়ে ওঠে জীবনের অংশ। সহজ সরল আদিবাসীদের জীবনে এই খেলাগুলোই বিনোদনের একমাত্র উপায়।