Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

মু ক্ত গ দ্য

ব র্ণা লী  কো লে

barnali

“আমার যে সব দিতে হবে”

আবেগ শেষ হয়ে গেলে কিছু থাকে? আবেগ তাহলে আমাদের মন ও দেহ নামক ইঞ্জিনের চালিকা শক্তি। সত্য কিছু নয়? সুন্দর কিছু নয়? সবই ঘোর? সবই মোহ? আজ শান্ত সন্ধ্যা। যেভাবে বরফকে স্পর্শ করা যায়, হাওয়ার উপস্থিতি স্পর্শ করে আমাদের, সেভাবেই শান্তি আজ স্পর্শযোগ্য। করতলে অনেক ধুপ ধুনো। আমার আজ নিজের কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। দূর নদীতীরে যে কুপী জ্বলে, তার আগুন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।ধ্যান ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। অথচ আমার, আমারই ফোনের গ্যালারি খুললে দেখা যাবে থরে থরে সাজানো সেলফি। অদ্ভুত আত্মপ্রেমের মোহাক্রান্ত আমাদের হৃদয়ের সম্মিলিত এক দলিল। যুগ চিহ্ন। যে মুখ আমরা দেখাতে চাইছি, তাদের আত্মপ্রকৃতিতে কেবল-ই অস্থিরতা, কেবল-ই ছোটাছুটি। মনে পড়ে নার্সিসাসের মুখ— সেই গ্রীক যুবা যে জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আত্মপ্রেমে পড়েছিলেন ও সর্বদা জলের নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

আত্মপ্রেম চিরকালীন। আমরা নিজেকে ভালবাসা মানে বুঝি নিজের বহিরঙ্গকে পরিপাটি করা। উজ্জ্বল পোশাকে,উজ্জ্বল সজ্জায়। নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা। নিজেকে ভুলে যাওয়ায় আত্মপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের গানে, “শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা”। স্রোত দেখি। চলেছে পিপীলিকার মতো। অবসানে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা হলে যেমন ঝনাৎ, ঝনাৎ শব্দ হয়, তেমন। কিছু নেই। আমির শেষে পড়ে থাকে কয়েকটি কাজ। তাও কী বৃহৎ স্রোতে খড়কুটো? কালো পোশাক পরে আমাকে কত ভালো লাগছে,সে সম্পর্কে আয়না আমাদের বারবার নিশ্চিত করে। নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি তো, দিনে কতবার আমরা সুন্দর চেতনাকে হত্যা করেছি।এবং কেন করেছি। এক ইঞ্চি জায়গা আমরা সুন্দরকে ছেড়েছি তো? বৃহৎ সুন্দর ধরে ফেলছে না তো আমাদের চালাকি? স্বার্থপরতার বিষবৃক্ষ আমাদের হৃদয়ে গ্রথিত। আমরা অতি সহজেই চিনে নিয়েছি ওপরে ওঠার সোপান। সব কিছু আমাদের আমাদেরই ঝুলিতে চাই।যা পাচ্ছি আমি তার যোগ্য তো? আমরা সহনাগরিক যে আমার থেকে অনেক দক্ষ, তারা কেবল পিছিয়ে পড়ছে না তো, তারা যোগাযোগের সোপানগুলি চেনে না বলে।আমাদের আত্মপ্রেমে কোনও আত্ম-জিজ্ঞাসা নেই। এমন কোনও শিক্ষক নেই যে আমাদের আমাদেরকে নিয়ে মোহ ভাঙবে। যদি কেউ থাকে, যদি কেউ দ্রষ্টা হয়, তাকে আমরা বলতে দেব না। মাইক্রোফোন হাতে কারা? কারা? মুখের ভিড়ে মুখ কোথায়?

আমরা আসলে আমাদের খাঁচায় কমবেশি বন্দী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”। বিশ্বলোক সম্পর্কে আমাদের স্পন্দন আছে? নতুন সকাল হলে যেসব যুবক যুবতীর মুঠোফোন ছাড়া আর কোনও বন্ধু নেই, তাদের মুখগুলি মনে পড়লে সকালের সূর্যালোকের ওপর বিষাদ পড়ে। আমরা ব্যস্ত সর্বদা নিজের স্বার্থ নিয়ে। ১৯৭৯ সালে মাদার টেরেসা তাঁর নোবেল লেকচারে বলছেন, যাদের কেউ যত্ন নেয় না, যাদের কেউ ভালবাসে না, যারা অনাকাঙ্ক্ষিত, তাদের গ্রহণ করার জন্য আমরা আছি তো? অন্যের পাশে দাঁড়ানো, অন্যের ব্যথাকে ছুঁয়ে তার জন্য আকাশ আনাও আত্মপ্রেম। আমি কোথায় থাকি? আমরা কোথায় থাকি? করতলে? নক্ষত্রের মতো থাকি। আবেগের ঘন বিভ্রান্তি ছিঁড়ে সূর্যোদয় দেখা যায়? প্রেম পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার সমাপনে কামনার চোখ ধিকিধিকি জ্বলে। আমির দহনের শেষ নেই। এত কামনা, এত বাসনা। অথচ, আমার এই দেহখানি তুলে ধরতেও হবে। তোমার দেবালয়ের প্রদীপ হতে হবে। কিন্তু আলো অন্ধকারে গেলে মাথার মধ্যে এখনও বোধ কাজ করে। বাইরের পৃথিবী তোমার সম্পর্কে উদাসীন, কিন্তু নিজের বাঁচা খুবই জরুরি। অতি ইচ্ছের সংকট হতে বাঁচা জরুরি। কেউ-ই যে তোমার অন্তরের দোসর নয়, এটা অনুভব করেও একজন শিল্পীর বাঁচা জরুরি। তোমার হাত কারো হাতে রাখতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু যে হাতের মধ্যে তুমি হাত রাখতে পারো, তেমন হাত নেই। তাই তোমাকে শক্তিশালী হতে হবে। তুমি নিজে জানো না, তুমি কত বিশাল শক্তির অধিকারী। কিন্তু কিছুতেই তুমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছ না, তুমি নিজের দিকে না তাকিয়ে, নিজেকে না দেখে অন্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছ। মনের মধ্যে একটি মন দাসের মতো বেড়ি পরে আছে, নিজেকে লুটিয়ে দেবে বলে, বিলিয়ে দেবে বলে। কিন্তু কার কাছে নিজেকে বলি দিচ্ছি, এই বিষয়ে কোনও চেতনা নেই। আধো চেনা, আধো পরিচয়। জীবন তরণী আচমকা জোর ধাক্কার মতো বিস্ফোরণে থমকে যাচ্ছে। পরের দিন আবার সকাল। সকল চিন্তার, সকল দুর্যোগের অন্তরালে একটি শান্তধারা বয়ে চলেছে। নদী বয়ে যাচ্ছে, ভোর হচ্ছে, সবুজ ঘাস আনন্দিত, ঝরনা বয়ে যাচ্ছে, চন্দ্র, সূর্য, তারা… পৃথিবীর লাবণ্য আমাদের ছোঁয় না আর। আমাদের কেবল চাই… আমিকে চাই না, রোমশ আমিকে চাই। লোম দীর্ঘ হচ্ছে, চারপায়ে চলছি আমরা। সর্বদা আঙুরফলের আকাঙ্ক্ষায় লাফালাফি। যদিও জানি সোনার হরিণ মোহ, কেবলি পালায়।

আজ এই ভালবাসার দিনে নিজেকেও ভালবাসা শুরু হোক। আমাদের শিক্ষা আমাদের বারবার যেন ব্যর্থ না করে। জ্ঞান আলো জ্বালাক। আমরা নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করি। বদলে নিই নিজেদের। ভালো করে বাঁচি। কথার স্রোতে, অলসতার স্রোতে সব যেন ভেসে না যায়। নিজেকে ধরতে হবে। আত্মগঠন করতে হবে। নিজেকে ভালবাসতে হবে। নিজেকে ভালবাসা মানে নিজেকে উন্নীত করা। আলোর দিকে যাত্রা। ভালো থাকা মানে সারাদিন কিছু ভালো কাজ করা, যার মাধ্যমে ভিতরের আমি বা বাইরের সমাজ কোথাও পূর্ণতা পাই। এই পূর্ণতার অনুভব হয়তো আমাদের ভালো রাখতে পারে।এত বিনোদনে ভরা জগতে যখন আমরা প্রতিনিয়ত একা হচ্ছি, আত্মপরিচর্যা খুব জরুরি। রবীন্দ্রগান সত্য হয়ে উঠুক, “আমার যে সব দিতে হবে”।

আরও পড়ুন...