প্র চ্ছ দ কা হি নী
মশা শুধু ম্যালেরিয়া বাধায় না। সে রাজনীতিও করে। এই তো, মাস কতক আগে ডেঙ্গু না ডেঙ্গি (সম্ভবত ছেলেদের হলে ডেঙ্গু, মেয়েদের হলে ডেঙ্গি!) বিপদে ফেলছিল রাজ্য সরকারকে। শহর ও শহরতলির শয়ে শয়ে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এই রোগে। অনেকেরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। সুযোগ পেয়ে বিরোধীরাও হাতা গুটিয়ে নেমেছিলেন ময়দানে। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল, মশা নির্ঘাত প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তবে কিনা সে কেবল ক্ষমতায় থাকা রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকারের উল্টো দিকে ভন-ভন করে না, সে আদতে সমগ্র মনুষ্যকুলেরই বিপক্ষে।
মশার রাজনীতি, ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার’:
এই গ্রহে ‘মানুষের সরকার’ চলছে! অর্থাৎ কিনা মানুষই ক্ষমতায়। বাকি প্রাণীকুল রাজনীতির পরিভাষায় অতি দুর্বল ‘বিরোধী পার্টি’। মানুষ জাতটা ল্যাজে খেলাচ্ছে তাদের, যা না তাই করছে। আল্ট্রা প্রযুক্তির যুগে পশু-পাখির সঙ্গমদৃশ্যেরও রেহাই নেই, ঘোসলায় ক্যামেরা ঘুসিয়ে ছবি তুলে বিক্রি করে মুনাফা কামাচ্ছে! তলিয়ে ভাবলে, বহুকাল ধরেই নিঃশব্দে নীরবে একটা তৃতীয় ‘বিশ্বযুদ্ধ’ চলছে— ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার’! সেখানে এক পক্ষ মানুষ তথা মানব সভ্যতা। অন্য দিকে দুনিয়ার যাবতীয় অবলা প্রাণীরা। হয়তো বা যাদের ‘গেরিলা সামরিক বাহিনী’ হল গিয়ে কোটি কোটি মশা! যাক গে, আসল কথা হল, মশা মারতে কামান না দেগে উপায় ছিল না সভ্য মানুষের। আজও নেই। কারণ গত ১০ হাজার বছরের পৃথিবীতে বাঘ-ভাল্লুক-সাপ-কুমির যত মানুষকে হত্যা করেছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মানুষ মেরেছে নিরীহ মশা। বলা বাহুল্য, মশা তথা মশাবাহিত রোগ (বিশেষত ম্যালেরিয়া) এবং মানব সভ্যতা ইতিহাসের হাইওয়ে ধরে পাশাপাশি হেঁটে আসছে। কখনও দেবতার অভিশাপের মিথ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কোটি কোটি নির্ঘুম রাত, সাম্রাজ্যবাদীদের মাথা ব্যথার কারণ, শ্রমিকদের দুর্দশা, এমনকী আন্তর্জাতিক রাজনীতির, মহাযুদ্ধের কারণ হয়েছে মশা। যদিও দিন বদলেছে, মশাবাহিত জ্বরজারি নিয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে। যেমন, অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ভ্যাক্সিন, নতুন অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ড্রাগ এবং ম্যালেরিয়া জিনোম প্রজেক্টের উপর গবেষণা চলছে। মশা দিবস না থাকলেও ২৫ এপ্রিলকে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। তার মানে মশা ভার্সেস মানুষের যুদ্ধে একপক্ষ যে জিতে গেছে, এমনটাও নয়! অতএব, মশা নিয়ে কালে কালে দেশে দেশে পঞ্চায়েত পৌরসভার কর্মচারীরা পরেশান হবেন না কেন!
কীটতত্ত্ববিদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম, অত বড় চেহারার হাতি, যার আরেক নাম ‘মহাকাল’, তাকে নিয়েও তত গবেষণা হয়নি, যত হয়েছে মশা নিয়ে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে আমেরিকার দেশগুলিতে মশা নিধনের জন্য বার্ষিক যত বাজেট ধরা হয়, পাগলা হাতি বা মানুষখেকো বাঘের আক্রমণ থেকে নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে ততো বাজেট ধরা হয় না কখনই। অতএব, সাফ হিসেব— প্রাণীটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বের বিচারে তার স্থান শীর্ষস্থানীয়। সবচেয়ে বড় কথা, অনাদিকাল থেকে মশা ও মানুষের শত্রুতা চলছে। যেমন ধরুণ, অত বড় দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তাকে পর্যন্ত নাকানিচোবানি খাইয়ে ছেড়েছিল মশা!
স্বদেশি মশা না সিকন্দর:
ভদ্রলোক অনায়াসে এ দেশটাকে কবজা করতে পারতেন, কিন্তু মশার ঝামেলায় পিছোতে হল! এই নিবন্ধে এমনি এমনি বলা হয়নি যে এরা পৃথিবীর প্রথম গেরিলা যোদ্ধা! সে যুগের সেরা অস্ত্রকেও ভয় খেতো না। ফলে বাধ্যতামূলক গ্রিকদের স্বদেশ-প্রস্থান। পথে দেহত্যাগ অ্যারিসটটালের প্রিয় ছাত্র সিকন্দারের। এই সত্য জানার পর আজ মনে হয়, আলেকজান্ডার সংক্রান্ত মিথ-বাক্যটি কালের নিয়মে খানিক কাটা পড়েছিল। আমরা জানি, ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ!’। যদিও তিনি বোধহয় বলেছিলেন, ‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ, এখানের মশককুল কি কোনও দিন হইবে না শেষ!’
ইয়ার্কি না, ইতিহাসবিদদের মতে, মশার মারণ কামড়েই ক্রমশ গ্রিক সৈন্যের সংখ্যা কমতে থাকে। আন্দাজ করা যায়, এ ঘটনা কেবল আলেকজেন্ডারের সঙ্গেই ঘটেনি, সেই সকল শাসকের সঙ্গেও ঘটেছে, যারা গত কয়েক হাজার বছরে দফায় দফায় ভারত আক্রমণ করেছে, হয় ধনসম্পদের লোভে, নতুবা ক্ষমতালিপ্সায়। এবং এদের সর্বাগ্রে স্বদেশি মশা, পরে স্বদেশি রাজার সৈন্যসামন্তের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল। যাক গে, এ তো গেল প্রাচীন ভারতের মশাদের দেশাত্ববোধক ইতিহা! কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে?
ন্যাশনাল লাইব্রেরি যান, অনামা ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্টদের রোজনামচা বা আত্মজীবনী পড়ুন। চোখ ফেটে জল পড়বে আপনার! বাপ-মা-বউ-সন্তান ছেড়ে আইসিএস হয়ে বাংলায় এসে কী বিপদেই না পড়েছিল বেচারারা। জীবনানন্দের ঢের আগে ওঁদের প্রকৃতই ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’ পাঠিয়ে ছেড়েছিল ভারতীয় মশারা। বহু ব্রিটিশ সিভিল সার্ভেন্ট মশার কামড়েই বাংলা তথা ভারতের মাটিতে সমাধিস্থ হন। অতএব, মশার দল আদি স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্বীকৃতি দাবি করতে পারে! কার্যত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে এদেশের বিখ্যাত পতঙ্গ বাহিনীই। মানুষ বিপ্লবীদের আবির্ভাব অনেক পরে। কিন্তু আসল প্রশ্ন, মশা এতখানি ভয়ঙ্কর কেন?
কারণ মশা ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, মস্তিষ্কপ্রদাহ, হলুদ জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর, পীত জ্বরের মত সংক্রামক রোগের কারণ। জেনে রাখা ভালো, জীব বিজ্ঞানের ভাষায় মশা হল নেমাটোসেরা মাছি বর্গের অন্তর্ভুক্ত পতঙ্গ। আরও স্পষ্ট করে বললে, মশা মূলত ক্রেন মাছি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কিছু প্রজাতির নারী মশাই রক্ত শোষে এবং মারাত্মক সংক্রামক রোগ বিস্তার করে। যাদের মধ্যে অ্যানোফিলিস অন্যতম। দুনিয়া জুড়ে আজ অবধি ৩,৫০০-এর বেশি প্রজাতির মশা পাওয়া গিয়েছে। যেসব মশা কামড়ায় তারা প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষের শরীরে রোগ সংক্রমণের চালক হিসেবে কাজ করে থাকে। যেসব প্রজাতি মানুষকে কামড়ায় না, তারা আবার অন্য প্রাণীদের শরীরে রোগ সংক্রমণে দায়ী।
অ্যানোফিলিস, রক্তখেকো মহিলার কামড়:
আশপাশে উষ্ণ রক্তের উৎস থাকলে প্রকৃতিগত ভাবে বুঝতে পারে মশা। বিজ্ঞানীদের জানাচ্ছেন, মশার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় প্রখর। ১০ থেকে ৫০ মিটার দূরের মানুষের বাতাসে ত্যাগ করা কার্বন ডাই অক্সাইড শনাক্ত করে ফেলে মশা। এরপর শরীরের উত্তাপ বুঝে কামড় বসায়। স্ত্রী কিউলেক্স ও স্ত্রী অ্যানোফিলিস জাতীয় মশা রক্ত পান করে। একটি মশার ওজন সাধারণত ২.৫ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। মশা ১ থেকে ৩ মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২.৫ কিলোমিটার বেগে। মশারা উড়ন্ত অবস্থায় যৌন মিলন করে এবং সেক্সুয়াল ট্রান্সমিশনের জন্য সময় নেয় ১৫ থেকে ১৭ সেকেন্ড মতো। পরবর্তী ৩ থেকে ৬ দিনের ভিতর ডিম পাড়ে। এরা একবারে ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম পেড়ে থাকে। একটি স্ত্রী মশা তার জীবদ্দশায় কম করে ১০ হাজার ডিমা পাড়ে। স্ত্রী মশার ডিম উৎপাদনের জন্য প্রচুর প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। তারা যত বেশি রক্ত চুষবে তত ডিমের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। গড়ে একটি মশা একবারে ০.০০১ থেকে ০.০১ মিলিলিটার রক্ত খেতে পারে। অর্থাৎ একজন মানুষের শরীরের সম্পূর্ণ রক্ত নিঃশেষ করতে ১২ লাখের বেশি মশার প্রয়োজন। একটি পুরুষ মশার আয়ু গড়ে ১০ থেকে ২০ দিন। সেখানে একটি স্ত্রী মশার জীবৎকাল ১০০ দিন পর্যন্ত হতে পারে।
গর্ভবতী মহিলারা মশার ‘সফট টার্গেট’। কারণ গর্ভবতীরা পরিমাণে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড (২১%-এর বেশি) ত্যাগ করেন। তাছাড়া তাঁদের দেহের তাপমাত্রাও সাধারণের চেয়ে ১.২৬ ডিগ্রি অতিরিক্ত হয়ে থাকে। ফলে মশককুলর পছন্দের। এর পরেই শিশু এবং অসুখের কারণে যাঁরা দ্রুত এবং জোরালো ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালান তাঁদেরকে কামড়ায় এরা। যাঁরা ব্যায়াম করেন তাঁদেরকেও অতি সহজে মশার ঝাঁক খুঁজে বের করে একই পদ্ধতিতে। যাঁরা মদ্যপান করেন, কিছু প্রজাতির মশা তাঁদের বেশি কামড়ায় বলেও দাবি করেন একদল গবেষক।
একটা ঘটনা প্রায়ই ঘটে, মশা কামড়ে চলে যাওয়ার পর আমরা কষে চড় মারি নিজেকে। ফলে ব্যাটারা মরে না, ফালতু ব্যথা পাই আমরা। প্রশ্ন হল, এমন কেন হয়? কারণ এরা গায়ে বসেই হুল ফোটায় না। তাছাড়া এদের শরীর প্রায় ওজনহীন হওয়ায় ছয় পা বিছিয়ে ৫ মিনিট চামড়ার ওপর বসে থাকলেও টের পাওয়া যায় না। এই সময় এরা হুল পিচ্ছিল করার জন্য মুখে লালা আনে। হুল ফুটিয়ে মিনিট তিনেক ধরে রক্ত চোষে। পেট ভরে গেলে উড়ে পালায় ডিম পাড়ার জন্যে। ওই লালার কারণে মানুষের শরীরের চামড়া কিছুটা অবশ হয়, ফলে সহজে টের পাওয়া কঠিন হয়। লালার একটি উপাদান রক্ত মিশতেই অ্যালার্জি হয় এবং চুলকায়। তখনই মনে হয় মশা কামড়াচ্ছে। কিন্তু ততক্ষণে তারা রক্ত খেয়ে পগার পার! এর উপর মশার গান!
যদিও ‘বেচারা’রা ইচ্ছা করে ‘ভন ভন’ গান শোনায় না। আসলে এরা কানের কাছে এলে আমরা যে শব্দ শুনি তা অতি দ্রুত গতিতে ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। মশা প্রতি সেকেন্ডে ৩০০-৬০০ বার ডানা ঝাপটে থাকে। এতো বেশি বার ডানা ঝাপটায় বলেই ওই বিরক্তিকর শব্দ! তবে এতে করে বিপদ নেই। মশাবাহিত মারণ রোগগুলোই আসল।
তবে মানুষও হাত গুটিয়ে বসে নেই। বসে ছিল না কোনও দিন। কারণ উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়া-আমেরিকা সব মহাদেশেই ব্যাটেল ফিল্ডে নামা সৈন্যবাহিনীর অন্যতম ঘাতক প্রতিপক্ষ যুদ্ধ ছিল না মোটেই, ছিল মশাবাহিত রোগ। বিশেষত ম্যালেরিয়া।
ড. লাভেরন, ক্যামেলিও গলগি:
মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তখন থেকেই শামিল সারা বিশ্ব। ফ্রেঞ্চ আর্মির ডা. আলফনসে লাভেরান এই সংগ্রামের প্রথম দিককার অন্যতম সফল ‘যোদ্ধা’। ভদ্রলোক ১৮৭৮ সালে আলজেরিয়ার মিলিটারি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাঁর কাছে যুদ্ধটা শুধু একটা রোগের বিরুদ্ধে ছিল না। মানুষের বহু ভ্রান্ত ধারণা, হাজার বছরের মগজধোলাই জনিত কুসংস্কার এবং বৈজ্ঞানিক ভিন্নমতের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। লাভেরনকে লড়তে হয়েছিল ছয় হাজার বছরের মতবাদের (‘ম্যালেরিয়া’ মানে এক ধরনের অপ বাতাস!) বিরুদ্ধে। পাশাপাশি স্বদেশী লুই পাস্তুরের প্রভাবশালী ‘জার্ম থিওরি’র সঙ্গেও দ্বিমত পোষন করার স্পর্ধা দেখাতে হয়েছিল।
‘জার্ম থিওরি’ অনুযায়ী প্রত্যেক সংক্রামক রোগের জন্য ব্যাক্টেরিয়া দায়ী। এই সূত্রে একদল বিজ্ঞানী ‘ব্যাসিলাস ম্যালেরিয়ায়ি’ নামক কল্পিত ব্যাক্টেরিয়াও আবিষ্কার করে ফেলেন। ওদিকে শত শত ম্যালেরিয়া রোগীদের পর্যবেক্ষণ করে লাভেরান একটা জিনিসই পান, তা হল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে কালো রঙের একধরনের কণিকা রয়েছে। টানা বছর দুই অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি বুঝতে পারেন, এই কালো কণিকা একধরনের পরজীবী (মনে রাখতে হবে, তখনও অণুবীক্ষণ যন্ত্রের রক্তকণিকা পরীক্ষা করার স্টেইন আবিষ্কৃত হয়নি)। সমসাময়িক বিজ্ঞানী বিষয়টি না মানলেও কাজ করে যান লাভেরন। এখানে উল্লেখ্য, ‘Malaria’ শব্দটি এসেছে ‘mal’ বা দূষিত এবং ‘Aria’ বা বায়ু থেকে। যে বায়ুর সঙ্গে জলাভূমি যুক্ত। লাভেরন জলাভূমিতে তাঁর আবিষ্কৃত পরজীবীর অনুপস্থিতি প্রমাণ করেন। এর ফলে তিনি পুরোনোপন্থীদের চরম বিরোধিতার মুখে পড়েন। অবশেষে ১৮৯৯ সালে অনুবীক্ষণ যন্ত্রে রক্তকণিকা পরীক্ষার স্টেইন আবিষ্কৃত হলে লাভেরানের আবিষ্কার যে সঠিক তা প্রমাণিত হয়। যে পাস্তুর ইন্সটিটিউট ল্যাভেরনের কাজকে স্বীকৃতি দেয়নি প্রথমে, তারাই তাঁকে প্রোটোজোয়া নিয়ে গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ১৯০৭ সালে লাভেরান নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। এর পরের ধাপে কাজ করেন ক্যামেলিও গলগি নামের আরেক বিজ্ঞানী। ম্যালেরিয়ার পরজীবীর একাধিক প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের জ্বর (কোয়ার্টান/টার্শিয়ান) সৃষ্টি করে—এই ধারণাকে হাতেকলমে প্রতিষ্ঠিত করেন ইটালিয়ান নিউরোফিজিওলজিস্ট ক্যামেলিও গলগি। যিনি ১৯০৬ সালে নিউরোফিজিওলজির জন্যে নোবেল পেয়েছিলেন।
ড. রোনাল্ড রস, কলকাতা, পিজি হাসপাতাল:
এরপরেও ম্যালেরিয়ার সঙ্গে ‘দূষিত বাতাস’, জলাভূমির সম্পর্কের হাজার বছরের ধাঁধাঁ অমীমাংসিত থেকে যায়। অর্থাৎ কিনা শত্রু চিনে গেছি আমরা কিন্তু শত্রুর গোপন অস্ত্রটি তখনও অজানা। এদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তখন ব্রিটিশ। ফ্রেঞ্চদের থেকেও বড় শক্তি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘সূর্য অস্ত যায় না’! বলা বাহুল্য, ভারতও তাঁদের দখলে। তথাপি সাদা চামড়ার মানুষগুলো এই উপমহাদেশের দুটো জিনিসকে বেজায় ভয় পেত। এক, বাংলার বাঘ এবং দুই, ম্যালেরিয়া। ব্রিটিশ প্রশাসনে তখন তোড়জোড়, কীভাবে দমন করা যায় ম্যালেরিয়াকে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের চাকরির দৌলতে এদেশে আসা ডা. রোনাল্ড রস অন্য সব বিজ্ঞানীর মতো শুরুতে ডা. লাভেরানের আবিষ্কারে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু ডা. রসের গুরু স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনের (ট্রপিকাল মেডিসিনের জনক) সমসাময়িক একটি আবিষ্কার রোনাল্ড রসকে ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনই প্রথম জানান, যে জীবাণু এলিফেন্টিয়াসিস বা গোদ রোগের কারণ সেটা মশার শরীরেও থাকে। রস, স্যার প্যাট্রিক ম্যানসনের কাজের সূত্র ধরে ডা. চার্লস লাভেরনের ধাঁধাঁ’র পথে হেঁটে ম্যালেরিয়া জীবাণু কীভাবে মানুষের শরীরে আসে তা নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হন। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস তাঁকে মাদ্রাজ থেকে ম্যালেরিয়ামুক্ত অঞ্চলে বদলি করলে তিনি পদত্যাগ করতে চান। গবেষণার প্রতি এতটাই নিবেদিত প্রাণ ছিলেন ডা. রস। অবশেষে সরকার তাঁকে এক বছরের জন্য ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বর ‘ইনভেস্টিগেশনে’ বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত করে।
এরপর সেই বহুশ্রুত ঘটনা, ১৮৯৭ সালে রোনাল্ড রস কলকাতার পিজি হাসপাতালে বসে আবিষ্কার করেন– ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাসমোডিয়াম কীভাবে মশার শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। রসই প্রথম নির্দিষ্ট করে বুঝেছিলেন যে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হল এক ধরনের পরজীবী, যার বৈজ্ঞানিক নাম প্লাসমোডিয়াম। পরে একটি অ্যানোফিলিস মশার পেটে প্লাসমোডিয়ামের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে রস বুঝতে পারেন যে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু প্লাসমোডিয়াম হলেও সেটা ছড়ায় অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে। অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগীকে কামড়ালে রোগীর রক্তে মিশে থাকা প্লাসমোডিয়াম মশার শরীরে প্রবেশ করে। তা গ্যামেটোসাইটে পরিণত হয়ে মশার লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করে। এই মশা এবার কোনও সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার শরীরে প্লাসমোডিয়াম গ্যামেটোসাইট ঢুকে তাকে ম্যালেরিয়া রোগাক্রান্ত করে। বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ হয় নিশ্চই এ কথা ভেবে, যে ড. রোলান্ড রস-এর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সূতিকাগার শহর কলকাতা। পিজি হাসপাতাল। ১৯০২ সালে মেডিসিনে নোবেল পান ড. রস।
সন্দেহ হয়, আদৌ কি আমরা এমন এক মানুষের, এত বড় আবিষ্কারের মর্ম উপলব্ধি করেছি! তাহলে কেন রসের গবেষণাগারটি ততোখানি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল না আজও! কেন ময়দান অঞ্চলের প্রায় জনহীন একটি পথকে রোনাল্ড রস সরণি নাম দিয়ে দায় সারা হল! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন সুয়েজ খাল, পানামা খাল খননের প্রধান বাধা ছিল অসংখ্য শ্রমিকের ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু, তখন কর্তৃপক্ষ সেই মহামারি রোখার জন্য ডা. রোনাল্ড রসের শরণাপন্ন হয়। ১৯০৬ সালে মোট ২৬,০০০ শ্রমিক পানামা খাল খননে কর্মরত ছিলেন যাঁদের মধ্যে ২১,০০০ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রতি ১০০ জনে মৃত্যু হার ছিল ১১ জনেরও বেশি। পরবর্তীতে ড. রসের নজরদারিতে মশাবাহিত মারণ রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণের পর মৃত্যু হার কমে দাঁড়ায় ১ জন। এই প্রসঙ্গে আরও এক যুগ বদলে দেওয়া মানুষের কথা না বললে নয়।
যুগান্তকারী ডিডিটি ও পল মুলার:
তিনিও মশা তথা ম্যলেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে নোবেল পান, নাম- পল মুলার। চিকিৎসক না হয়েও ১৯৪৮ সালে মেডিসিনে নোবেল পেয়েছিলেন মুলার। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটির ব্যবহার যে কার্যকরী মুলার তা উদ্ভাবন করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যে উদ্ভাবন হাজার হাজার যোদ্ধার প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বলা হত, যত জন মার্কিন সেনা জাপানিদের হামলায় মারা গেছেন তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মারা যান মশাবাহিত রোগে। মার্কিন সেনার আস্ত একটি ইউনিট যুদ্ধের আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। মিত্রশক্তি যখন ইউরোপে জার্মানদের পরাজিত করে একের পর এক শহরের দখল নিচ্ছিল, তখন তারা আবিষ্কার করে, কোটি কোটি শরণার্থী, যুদ্ধবন্দি, দাস, সাধারণ মানুষ সবাই পোকা মাকড়বাহিত রোগে জর্জরিত। জার্মান গ্যাস চেম্বার যত মানুষকে হত্যা করতে পারেনি, তার চেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ আসন্ন ছিল। মিত্রশক্তির সৈন্যবাহিনী এরপর সারা ইউরোপ জুড়ে ডিডিটি স্প্রে করে। ইতিহাসে এর আগে কখনও একটা মাত্র রাসায়নিক পদার্থ কোটি (আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন) মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি। এর থেকে আরেকটা বিষয়ও স্পষ্ট, ছোট সাইজের প্রাণীটি কালে কালে নিজের জন্য সম্ভ্রম আদায় করেছে।
রোমান সাম্রাজ্যের পতন ও পতঙ্গ:
জেনে রাখুন, খ্রিষ্টের জন্মের ২ হাজার ৭০০ বছর আগে চিনের মানুষরা মশাকে হাড়ে হাড়ে চিনত। আগেই বলা হয়েছে, যে গ্রীক বীরেরা বার বার পরাজিত হয়েছে এই ‘দানবে’র কাছে। শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণও ছিল মশা। মিশরীয় প্যাপিরাসে, সুমেরীয় কিউনিফর্ম ট্যাবলেটে, হিপোক্রেটিসের চিকিৎসা শাস্ত্রে, সংস্কৃত সুশ্রুত-এ, শেক্সপিয়ারের অন্তত ৮টি নাটকে উচ্চারিত হয়েছে মশাবাহিত নাম না জানা একাধিক রোগের কথা। এমনকী বঙ্গ সাহিত্যও মশাকে উপেক্ষা করতে পারেন।
বাংলা সাহিত্যে মশা, ‘মশামঙ্গল কাব্য’:
সংবাদ প্রভাকরের জনক কাঁচরাপাড়ার কবি ঈশ্বর গুপ্ত কবেই লিখেছিলেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি,/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। তাছাড়া মশা না থাকলে শরৎ চাটুজ্যের অমর কীর্তি ‘শ্রীকান্ত’ লেখা হত কিনা সন্দেহ। মশার কামড় সহ্য করতে না পেরেই তো শ্রীকান্তকে সন্ন্যাসগিরিতে ইস্তফা দিয়ে সংসারজীবনে ফিরতে হল! নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদাতেও মশা আছে— বর্ধমানের মশা, চড়ুই পাখির মতো সাইজ। এমনকী মনসামঙ্গল কাব্যে মশা উপস্থিত কালকেতু আর ফুল্লরার সাংসারিক ব্যাক্যালাপে। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী ‘আলপনা’। সেখানিই ‘মশা’ গল্পে ঘনাদার সঙ্গে বাঙালির পরিচয়। সম্প্রতি নয়ের দশকের কবি অনির্বাণ দাস মশা নিয়ে লিখে ফেলেছেন আস্ত কাব্যগ্রন্থ- ‘মশামঙ্গল কাব্য’।
কেন লেখা হবে না! গত বছরেও পৃথিবীব্যাপী শুধু ম্যালেরিয়াতেই মারা গেছেন ৬ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষ। তাছাড়া ৭০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে ৩২০ কোটি মানুষ যখন মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিতে, তখন পুঁচকে মশাকে বিরাট গুরুত্ব না দিয়ে উপায় কী বলুন! অপরপক্ষে, এ দুনিয়ায় ওরা আছে বলে কত মানুষের পেট চলছে! তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
মশার কামড় আছে বলে যারা বেঁচে আছে:
টিভি চ্যানেলগুলোয় কোম্পানির পর কোম্পানি কত যে মশা প্রতিরোধক বন্দোবস্তের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে! কেউ ধূপ বেচে, তো কেউ ইলেক্ট্রিক লিকুইড, কারও স্প্রে আছে, তো কারও হাতে পায়ে মাখার মলমের ব্যবসা। ট্রেনে বাসে বাজারে এক ধরনের ব্যাটও মেলে। তাতে ফটাস ফটাস মশা মরে। তবে মশারির উপরে জাস্ট কোনও কথা হবে না!
আমার ধারণা ঘরের মধ্যে ঘর— আপাতভাবে অতি সাধারণ মশারিই মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। যা প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানে মানব সভ্যতা বিরোধী ওই প্রাণীকুলের গেরিলা বাহিনীর বিষাক্ত হুল তথা ‘ভয়ঙ্কর’ ভন-ভন থেকে আরও কয়েক হাজার বছর হেলায় বাঁচিয়ে রাখবে মানুষ জাতটাকে।