Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

অ নু বা দ

ভাষান্তর: শী র্ষা

sirsha

থিক নাত হানের কবিতা

ভিয়েতনামের কবি থিক নাত হানকে পড়তে শুরু করি ২০১৫ থেকে। জীবনের এক অনিবার্য খাণ্ডবদাহনকে নিভিয়ে দেয় তাঁর শব্দ। ঠিক করেছিলাম কখনো ভাষান্তরের চেষ্টা করব। সেই ভাবনা থেকেই হানের কবিতাগুলির ভাষান্তর শুরু করি ২০২১-এর শেষের দিকে। আর বিশেষত এই কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলাম ২০২২-এর মার্চে। হয়তো কোনো বিশেষ কারণবশত এগুলোকে প্রকাশ করা যায়নি। যাই হোক, তখন যে ভূমিকাটা দিয়েছিলাম সেটাই এখনও রাখলাম। আমি বুদ্ধকে দেখিনি ঠিকই। কিন্তু হানের শব্দের হাত ধরে যে চিরসমাহিত বুদ্ধের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছনো যায় তা অনুভব করেছি। তাই আমার সমস্ত অনুভবকে জড়ো করা এক ভগ্নস্তুপের যাবতীয় প্রণতি এই মহাপুরুষের পায়েই রাখা থাকুক।

“যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনে। যেমনটা চলেছিল ১৯৬০ সালে। ভিয়েতনামে। শুধু স্থানবিশেষে ফারাক। আর বছরবিশেষের। এছাড়া তো আর কোনো ফারাক নেই। তখনও যুদ্ধ শূন্যতা এনে দিয়েছে। আজও তাই করে চলেছে। এটাই যে যুদ্ধের কাজ। একমাত্র কাজ। সেসময় এক মহামানবের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় যুদ্ধনিনাদ স্তব্ধ হয়েছিল। আজ তেমন কেউ আছেন কিনা আমি জানি না। হয়তো আমরা কেউই এখনও তাঁকে জানতে পারিনি। সাধারণ আপামর মানুষগুলির যন্ত্রণাবিদ্ধ এই কঠিন সময়ে তাই স্মরণ করা যাক সেই মহামানবকেই। তিনি থিক নাত হান। জন্ম ১৯২৬ সালের ১১ই অক্টোবর। সমগ্র বিশ্বে এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পরিচয় একজন জেন সন্ন্যাসী হিসেবেই। বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ মতবাদের প্রচারকার্যে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষকতাও করেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় (১৯৬৩-১৯৬৬) তাঁরই শান্তিবার্তার প্রচার সর্বজনবিদিত। কিন্তু এসবের বাইরেও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে – তিনি একজন কবি। তাঁর কবিতায় শান্তি, প্রেম এবং অহিংসা একমাত্র সত্য হয়ে ফুটে ওঠে। তাঁর লেখা ‘কল মি বাই মাই ট্রু নেমস’ (Call Me by My True Names) বইটির পাতায় পাতায় তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অহিংসার গন্ধ। দীর্ঘ রোগভোগের পর কয়েকদিন আগেই (২২ জানুয়ারী, ২০২২) এই পৃথিবী ছেড়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন তথাগতের দেশে। রেখে গিয়েছেন তাঁর চিরন্তন অস্তিত্ব। তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তাঁর কিছু কবিতার (১৯৬৪ সালে লেখা) ভাষান্তর আজ এই দুঃসহ সময়ের চিতায় অর্পণ করলাম।”

সংকল্প 

তোমরা আমাদের সঙ্গে লড়াই করো,

আমরা ঘৃণার সঙ্গে লড়ি বলে,

কারণ তোমরা হিংসা ও ঘৃণার আশ্রয় নাও 

নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য। 

 

তোমরা আমাদের অভিশাপ দাও,

কারণ আমরা কোনো মানুষকে চিহ্নিত করে 

তার দিকে বন্দুক তাক করি না।

 

তোমরা আমাদের ধিক্কার জানাও

কারণ আমাদের রক্ত ব্যবহার করে

তোমরা নিজেদের লালসার ঋণ পরিশোধ করতে পারো না;

কারণ তোমরা আমাদের সরাতে পারো না 

মানুষের পাশ থেকে,

যেহেতু আমরা সকল জীবনকে রক্ষা করে থাকি। 

 

এবং তোমরা আমাদের হত্যা করো

কারণ আমরা মাথা নত করি 

শুধুমাত্র মানুষের ভালোবাসা ও যুক্তির কাছে;

কারণ

আমরা কখনোই মানুষকে 

নেকড়ের সঙ্গে 

গুলিয়ে ফেলি না।

 

মাতৃভূমি

আমার মাতৃভূমি ঠিক এখানেই

কলাবাগান, বাঁশবন, নদী আর জইক্ষেত নিয়ে।

পায়ের নীচের মাটি ধুলোয় ঢাকা। 

কিন্তু যখনই আমি মুখ তুলে চাই, 

সর্বদাই দেখতে পাই সুন্দর তারাগুলিকে।

 

মুদ্রা 

কবির কথা শুনো না। 

তার সকালের কফিতে, এক ফোঁটা চোখের জল

মিশে আছে। 

 

আমার কথা শুনো না। 

কিছুতেই না। 

আমার সকালের কফিতে, এক ফোঁটা রক্ত

মিশে আছে। 

আমাকে বোকো না, ভাই,

কারণ আমি তরল গিলতে পারি না। 

আমার ফুসফুসে বাতাস জমাট বেঁধে গেছে।

 

সে বলেছিল, “আমাকে তোমার চোখ দিয়ে 

কাঁদতে দাও

কারণ আমার আর চোখ নেই। 

আমাকে তোমার পায়ে হাঁটতে দাও,

কারণ আমার আর পা নেই।”

আমার হাতদুটো দিয়ে 

আমি তোমার দুঃস্বপ্নকে স্পর্শ করছি। 

সে বলেছিল, “আমি রক্ষা পেয়েছি।

আমার আর কোনো নির্বাণের প্রয়োজন নেই।”

নির্বাণ শুধু আমাদের জন্য।

 

আমার হাতটি টেবিলের ওপরে,

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নীরব হয়ে আছে। 

বিশাল সমুদ্র এযাবৎ তার ফোঁপানি থামায়নি। 

পাঁচটি পর্বত সর্বদা আকাশ এবং পৃথিবীর 

প্রকৃত অবস্থানকে ধরে রেখেছে।  

 

আকাশগঙ্গার বহু ঊর্ধ্বে,

ব্রহ্মাণ্ডের গোপন রহস্যগুলি নিজেদের উন্মোচিত করে। 

তবুও আমার ডান হাতটা টেবিলের ওপরে–

মনুষ্যত্বের জাগরণের অপেক্ষায়। 

 

না, আমার হাতটা কখনোই এই টেবিলের ওপরে 

উল্টে যাবে না 

সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা 

আধখোলা ঝিনুকের মতো,

বুলেটের আঘাতে নেতিয়ে পড়া 

একটি মৃতদেহের মতো। 

পর্বত ও নদীর উচ্ছেদ হয়।

মহাজাগতিক কণাগুলি ভারসাম্য হারায়, 

এবং মহাসমুদ্রের চিরন্তন ফিসফিসানি স্তব্ধ হয়।

 

আমার হাতটি এখনও টেবিলের ওপরে,

এবং পাঁচটি পর্বত 

এখনও বিদ্যমান। 

গোপন রহস্যগুলি উন্মোচিত হয়নি। 

মহাজাগতিক কণাগুলি একে অপরের সঙ্গে 

ক্রমাগত কথা বলে চলেছে। 

আমার হাতটি এখনও টেবিলের ওপরেই, 

আকাশ ও পৃথিবীর সাম্যাবস্থার পরিবর্তনের 

মুহূর্তটির অপেক্ষায়– 

আমার হাত,

এই ছোট হাতটি,

যেন একখানি পর্বত।

 

শান্তির সকাল

চাঁদের দিকে যাওয়ার পথে, 

আমি পিছু ফিরে তাকাই এবং

অবাক হই। 

মহাশূন্যের সুগভীর সমুদ্রে আমি একটি

বুদ্বুদ দেখি। 

এটিই আমাদের পৃথিবী, আমাদের সবুজ গ্রহ,

তার অতুলনীয় সৌন্দর্য একাধারে ঝলমলে, গর্বে ভরা

যদিও ক্ষণিকের। 

তার মধ্যে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করি।

 

একমনে পৃথিবীর ওপরে হেঁটে চলেছি আমি,

একটি ঘাসেঢাকা পথে,

আমার পা-দুটি যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ 

প্রভাতমুহূর্তটিকে আলিঙ্গন করতে এবং

সেই মুহূর্তে শান্তির ছোঁয়া পেতে। 

 

বসন্ত ঝরে পড়ে, ঢেকে দেয় রাস্তাকে,

যেন গালিচা বিছিয়ে দেয় চলার পথে 

ধ্যানের জন্য। 

একটি লাজুক কাঠবেড়ালি, ওক গাছটির পিছন থেকে,

আমার দিকে চেয়ে থাকে, বিস্ময়ে,

তারপর দ্রুতবেগে গাছের চূড়ায় উঠে হারিয়ে যায়

একগুচ্ছ পাতার আড়ালে। 

 

আমি দেখি একটি স্বচ্ছতোয়া নদীর 

বয়ে চলা – পাথরের ফাটলের মধ্যে দিয়ে,

জলের খলখল হাস্যধ্বনি,

আর গাছেদের কলরব,

আমরা সবাই একটি শান্তির সকাল 

উদযাপন করি।

 

ঠিক তখনই,

আমি দেখতে পাই চরম দুর্দশাকেও 

যখন মানুষ মানুষকে বন্দি করে,

অন্যকে কষ্ট দেয় –

বিভাজন, ঘৃণা এবং লোভের ঢেউগুলি,

দুর্যোগের অপ্রতিরোধ্য কারণগুলি,

আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে। 

একই মুরগির শাবকেরা 

একে অপরের সঙ্গে লড়াই করার জন্য 

পৃথক রং নেয়। 

মর্মভেদী কান্না ঘোষণা করে 

যুদ্ধের সন্ত্রাসকে।

 

ভাই এবং বোনেরা,

এই সুন্দর পৃথিবীটা আমাদেরই। 

আমি একে আলিঙ্গন করি,

আলতোভাবে আঁকড়ে ধরি আমার বুকে। 

একই ছন্দে একত্রে শ্বাস নিয়ে

আমরা আমাদের শান্তভাবকে, শান্তিকে খুঁজে পাই। 

এসো আমরা নিজেদেরকে গ্রহণ করি

যাতে আমরা একে অপরকে 

গ্রহণ করতে পারি। 

এসো আমরা নিজস্ব দর্শনের বিনিময় করি,

যাতে অসীম ভালোবাসার জন্ম হয়।

আরও পড়ুন...