কে তা বি ক থা
ভূমা
তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ে
প্রকাশক: বিদুর
৭০ টাকা
তরুণ কবি তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়ের দু’ফর্মার এই গ্রন্থটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বইটির নামকরণেই বোঝা সম্ভব যে কবি তাঁর চিন্তা, জীবন দর্শনে বহুমাত্রিক যে বোধ আয়ত্ত্ব করেছেন, তারই প্রতিফলন ধরা আছে শিরোনামহীন এই কবিতাগুলিতে। এখনকার কবিদের অনেকের মধ্যেই ছন্দকে অস্বীকার করার, ছন্দ জানতে না চাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এই কবি ছন্দের নিখুঁত ব্যবহারে বুঝিয়ে দেন যে, সঠিক প্রয়োগে ছন্দই হয়ে উঠতে পারে লেখার প্রকৃত আধার।
জন্মের প্রাকমুহূর্ত থেকে জীবনের প্রতিটি পরতে যে রহস্য, উন্মাদনা আমাদের অগোচরেই ছড়িয়ে রয়েছে, ঘোর লাগা শব্দ ও পঙক্তির ব্যবহারে কবি তা নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ছত্রে ছত্রে।
‘মাতৃজরায়ুর গন্ধ। শৃগাল পাহারা দেয় মড়া।
ধুনি জ্বলে, স্থির মাছ মগ্ন মেখে শবের হাঁ-মুখে
ঢুকে আছে। পদ্মাসনে মড়ার নাভিতে উঠে ব’সে
সহস্র দেবীর জন্য যত জপ-তপ এতকাল
শিখেছি, সমস্ত তোকে উৎসর্গ করেছি; মা রে, তুই
যে-স্তন মুখের মধ্যে রেখেছিলি তার মহাস্রোত
কুলকুণ্ডলিনী ঠেলে মণিপুরে নিয়ে গিয়েছিল।
আজ সহস্রার ভেঙে রসের উত্থান দে, মাতৃকা।’…
বইয়ের চতুর্থ কবিতার প্রথম স্তবক এটি। এক আশ্চর্য মায়ায় কবি এই অসামান্য রচনাটিতে তুলে এনেছেন মণিপুরের সমসাময়িক প্রসঙ্গ। আর তার সঙ্গে মাতৃকার বিভিন্ন রূপ, প্রকৃতি যে এভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা এই লেখাটি। আবার এরই পাশাপাশি সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়, যা ইদানীংকার লেখালিখির মধ্যে প্রবল দেখা যায়, সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই বইয়ের অষ্টম কবিতাটিতে। দেখে নেওয়া যাক-
‘অতিপ্রজ নই, হাত রতিশ্রান্ত কুকুরের মতো
নেতিয়ে পড়েছে। খাতা পঞ্চভূতে পোয়াতি বানাল।
এমন নিখাদ সত্যে আমাদের লেখা জ্বলে যায়।
মাথা শূন্য হয়, লেখা বিকট ডাকিনী যেন! মদ
যেটুকু জমানো ছিল, আগুন ছুঁতেই পূর্ণগ্রাস।
নেশা কেটে যেতে দেখি যত প্রিয় মুখ আশেপাশে
এযাবৎ ছিল, সব পুড়ে গেছে স্তবকে স্তবকে।
একাই চাঁড়াল সাজি। অস্থি তুলে রাখি লক্ষ্মীভাঁড়ে।’…
অদ্ভুত এক দ্যোতনা ধরা পড়েছে এই লেখার প্রথম অংশে। ইদানীংকার ফেসবুক জমানায় প্রচুর কবিতা আমরা পড়তে পাই। এমনকি লাইক, কমেন্ট না পেলে ক্ষোভ তৈরি হয় লেখা পোস্ট করার পরে। তার জেরে অনেক ক্ষেত্রেই দৈনিক একাধিক কবিতা পোস্ট করা, লেখা পত্রিকায় ছাপা হওয়া মাত্রই সেই ছবি তুলে ফেসবুকে সেঁটে দেওয়া ইত্যাদি প্রবণতা দেখা যায় খুব। উল্লিখিত কবিতাটি সেই প্রসঙ্গকে খুব সতর্কভাবে ছুঁয়ে গেছে, অথচ নিপুণ শব্দের ব্যবহারে। সার্বিকভাবে এই বইটির প্রতিটি লেখার শব্দ ও ভাষার ঝঙ্কার মুগ্ধ করে বারবার। এতো অল্প বয়েসে কবি অনায়াসে রপ্ত করেছেন ভাবনা, শব্দ ও তার যথাযথ প্রয়োগ। তারই প্রকৃষ্ট এক উদাহরণ আমরা দেখে নেব এই বইয়ের ১৩ সংখ্যক কবিতাটির অংশে।
‘জ্বলে জতুগৃহ। জলে ভেসে গেল কাদের কঙ্কাল?
যে নৌকা এগিয়ে দেবে অজ্ঞাতবাসের পোড়ো খাটে,
তার নীচে ফুটো; জল পত্নীনিগ্রহের মতো ঢোকে।
জ্বলে জতুগৃহ। নাম ছাই হয়ে মহাশূন্যে উঠে
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সেজে বীজ দিতে গেল শত্রুগৃহে।
এক বীজে অন্ধ গাছ, অন্য বীজে ক্লীব গুল্ম জাগে;
দাসীগমনের বীজ যথার্থ প্রোথিত ছিল বলে
হিরণ্য শস্যের প্রেত মাথা তোলে খরার নাভিতে।’…
মহাকাব্য আর জীবন দর্শনের এই অপূর্ব মেলবন্ধন এই কবির কলমে অনায়াস হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের প্রতিটি কবিতাতেই সেই দর্শনের তীক্ষ্ণ আভাস ধরা রয়েছে। ধর্মতত্ত্বের নিগূঢ় সন্ধান কবি নিজস্ব ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন এই বইয়ের অনেকগুলি লেখাতেই। পাঠক, এই কবিতা গ্রন্থটি আপনাকে নিয়ে যাবে এমন এক জগতে, যেখানে আপনি মুখোমুখি হবেন সেই চরম সত্যের, যা আপনার জীবনকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। নিজেকে চিনতে পারা যাবে না। এই ‘আমি’ই কি প্রকৃত আমি? নাকি আমার আদলে অন্য কেউ এই জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে! আমি যা করতে চেয়েছি, তা কি করতে পেরেছি বা পারছি আদৌ? এই আমি অন্য আমি হয়েই হয়তো ফুরিয়ে ফেলব এই মহার্ঘ জীবন। আর, কবি তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায় কী চমৎকারভাবে এই বইয়ের ১৫ সংখ্যক কবিতাটিতে জীবনের সেই দোলাচল আর তার পরিণতিকে এঁকে ফেলেছেন শব্দের অপরূপ মায়ায়। কবিতাটির প্রথম স্তবকটি পড়ে নেওয়া যাক, আর খুঁজে নেবার চেষ্টা করা যাক আমার আমিকে —
‘কে আমি? কে আমি নয় ? যা জ্ঞাত তা অজানার লাশ।
তোকে বলি, “মর!’, তুই মরে গিয়ে আমি হয়ে যাস।
আমি হতে হতে তোর মনন বিকল হয়ে গেল।
সঙ্কল্পে মিথুন জাগে। রয়ি, প্রাণ বহু হতে হতে
রয়ি চাঁদ, জড়; প্রাণ রয়ির হাঁ-মুখে অন্ন দেয়। অথচ যা বহু, তাই এক, শূন্য। দ্বাদশাবয়ব,
সপ্তচক্র, পঞ্চপাদ চিরজাগরূক, তাই তুই
অহোরাত্র আমি হয়ে আমায় অপর করে দিস।’…