ক্যা ন ভা স
আমাদের আশ্চর্য লাগে এটা দেখে যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষদিকে একেবারে নতুন করে মেতে উঠলেন অন্য এক নেশায়। হয়তো অন্য এক উত্তরণের আকর্ষণেই তিনি নিবিষ্ট হন এই ছবির নেশায়। ছবির বিষয়ে কথা উঠলে তাঁর চোখে রঙের যে ধাঁধা লাগে তার কথা ওঠে । আমাদের বিস্মিত হই এটা জেনে যে বিশেষ করে লাল রঙের মতো অতি তীব্র একটা আঘাত তাঁর চোখে পড়ে না। অথচ কত ভিন্ন রঙের শব্দ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে আমাদের জানিয়ে এসেছেন । ভিন্ন ভিন্ন লাল রঙের বৈচিত্র্য কি নেই তাঁর শিল্পী জীবনের অন্তরের সবটুকু জুড়ে? অবশ্যই আছে, আর তা তাঁর কবিপ্রকৃতির আভায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলবেন লাল বলতে ঠিক যা বোঝায়, সে আভায় তাঁর দৃষ্টি ছিল ক্ষীণ, এরকম একটা ভয়ঙ্কর প্রলেপ তিনি তাঁর দৃষ্টির বাইরেই পেলেন না ! এটা সম্ভব কি যদি আমরা তাঁর আঁকা ছবির দিকে তাকাই? মনে কি হবে সত্যি এরকম টা যেন ভিন্ন কোনও রুচির প্রভাব, ভিন্ন কোনও মনের প্রভাব? এভাবে কি দেখা যায়, এমন করে কেউ কি ভাবতে পারেন নিজের জীবনে? আমরা তাঁর আঁকা একটি ছবির কথা ভাবতে পারি, যে ছবিটিতে আমরা একটি নারীকে নৃত্যের ভঙ্গিমায় দেখি এবং তার দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত এক ভিন্ন ভঙ্গিমায়।
ছবিটি একঝলক দেখে কেউ বলতে পারেন নারীমুক্তির আহ্বান বা বলতে পারেন লোকায়ত নৃত্যের আভা যেন রবীন্দ্রনাথ ওই ছবিতেও ধরতে চেয়েছেন। যার দু’ই হাতে আগুন আলোয় উদ্ভাসিত ভিন্ন কোনও নাচের উপকরণ যেন আমাদের দৃষ্টিকে আরও রহস্যময় করে তুলছে! সত্যি কি এমন করে ভাবতে পারি আমরা? যখন ওই ছবিটি ঘিরে রয়েছে অজস্র ভাবনার আগুন। মনে কি হয় তখন এই সহজ উপায় আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে? ইচ্ছে হয় ভাবতে, যেন অগ্নি বসন্তের আহ্বান করছে, রবীন্দ্রনাথ যেন বসন্তের আহ্বানে আত্মবিশ্বাসী অগ্নি-কে নৃত্যশিল্পী হিসেবে কল্পনা করেছেন, তেমনই যেন বর্ণবিন্যাস আমাদের আরও সংযত হতে বাধ্য করে। আমরা যদি ছবিটিকে একটু তলিয়ে দেখি, তাহলে রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার একটা ব্যক্তিগতকৃত পদ্ধতি অনুমান করতে পারব। রবীন্দ্রনাথ অন্য ছবির মতো এ ছবিটিও প্রথম কালি কলমে স্কেচ করেছেন তারপর রঙ ভরেছেন, ওয়াশ করছেন। কিন্তু তা তিনি করছেন সেই সময়েই, স্পেস ব্যবহার করছেন এক ভিন্ন আঙ্গিকে, আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সেইদিকে। সমস্ত ছবি জুড়ে যে তিনি ভারতীয় ছবিকে ভিন্ন এক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং আমাদের চিত্রশিল্পকে কয়েকশো বছর এগিয়ে দিলেন তাঁর মনের রঙে, যেখানে অগ্নি একদিকে প্রাণের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠছে তার আঙ্গিকে, আবার অন্যদিকে ফর্মকে ভেঙে ফেলছেন। এক ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা এক অধরার অর্তি ফুটে ওঠা দেখি সমস্ত ছবিটি জুড়ে। কখনও আবার স্কেচের উপর রঙ দিয়ে পূর্ণ করেছেন ছবির ভুবন। কখনও হাত দিয়ে, কখনও তুলির সাহায্যে ছবিকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। এই ছবিতে শুধু নয়, অন্য ছবিতেও একইভাবে রঙের আভায় ভেঙেছেন ফর্ম। এই যে তাঁর ছবি আঁকার ব্যক্তিগতকৃত পদ্ধতির কথা বলা হলো, তা তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন ভিন্ন এক ঘটনায়, যখন তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি সংশোধন করছেন, আর ছবির মতো কিছু গড়ে উঠছে সেই সময় থেকে। আমরা অনুমান করতে পারি, যদি তাঁর সেই সময়কার কিছু লেখার ভিতরে দিয়ে যেতে পারি এবং আরও আশ্চর্য হতে হয়, যখন তিনি ‘রক্তকরবী’ সংশোধন করছেন বারবার, তখনই যেন ভিন্ন ভিন্ন ছবির ফর্ম বেরিয়ে আসছে। আমরা মনে করতে পারি যখন তিনি জাপান ভ্রমণের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলেন তাঁর রেখার রহস্যময় উন্মোচন। ভেতরে ভেতরে অনুভূতি জমাট বাঁধছে তাঁর অন্তরে। যেন তিনি খুঁজে পেলেন তাঁর অন্তরজগতের আধারটি। এমন একটা বোধে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে খুঁজে পেলেন, যেন তাঁর চিত্রবোধের আকাঙ্ক্ষাটি গেল, আরও সহজ হয়ে উঠল আত্মবিশ্বাসের ছন্দ।
এমনকি এও মনে হতে পারে অগ্নি যেন ‘নন্দিনী ও দামিনী’-র আদলে বসন্তের চিরন্তন রক্তিম আকাঙ্খাই ওই ছবিটির সামগ্রিক বেদনা । যে বেদনা শুধু আমি-র দিক থেকে হয়ে ওঠে না, সে হয়ে ওঠে সমগ্রের দিক থেকে সত্যকে ছুঁয়ে থাকবার ব্যথা । আমরা যদি তাঁর অন্য একটি ছবির কথা ভাবি, যে ছবিটিতে আমরা দেখি একটি নারী ঘোমটা টানা, বাসন্তী ও ফুল, সেখানেও যেন অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে বাসন্তী নতুনের দিকে। আর ওই সময়ের জাপান ভ্রমণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘টাইক্কানের ছবি যখন প্রথম দেখলুম, আশ্চর্য হয়ে গেলুম। তাতে না আছে বাহুল্য, না আছে শৌখিনতা। তাতে যেমন একটা জোর আছে, তেমনি ‘সংযম’ চমক লাগে তাঁর গোপন পাড়ায়, চমক লাগে আমাদের মনেও একেবারে সামনের সারিতে এসে ধাক্কা দেয়। এই যে ধাক্কা দেওয়ার কথা উঠল, এ কি রবীন্দ্রনাথ ভাবেননি ওই সময়ের অন্তর দ্বন্দ্বে? একদিন তো এই আঘাতের কথাই লিখলেন চিঠিতে, সে আঘাত বাইরের আঘাত। যা আমাদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে অসীম প্রত্যাশাময় করে তুলে মনের উত্তরণ ঘটায়। তেমন করেই তো একদিন রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করে রানী মহলানবিশকে লিখলেন সে কথা, “এবার আমার জীবনে নতুন পর্যায় আরম্ভ হল। একে বলা যেতে পারে শেষ অধ্যায়। এই পরিশিষ্টভাগে সমস্ত জীবনের তাৎপর্যকে যদি সংহত করে সুস্পষ্ট করে না তুলতে পারি, তাহলে অসম্পূর্ণতার ভিতর দিয়ে বিদায় নিতে হবে। আমার বীণায় অনেক বেশি তার— সব তারে নিখুঁত সুর মেলানো বড়ো কঠিন। আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা আমার কবিপ্রকৃতি। হৃদয়ের সব অনুভূতির দাবীই আমাকে মানতে হল— কোনোটাকে ক্ষীণ করলে আমার এই হাজার সুরের গানের আসর সম্পূর্ণ হবে না।” তখন, একটু ভিন্ন কোনও প্রত্যাশা আমাদের আচ্ছন্ন করে, মনে হয় ওই ছবিটি ঘিরে রয়েছে অন্য সময়ের প্রতিধ্বনি, সমগ্র জীবনের উত্তরণের বসন্ত।