Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

চ রৈ বে তি

ড. ফা ল্গু নী   দে

falguni_dey

শৃঙ্খলা পাহাড়ের প্রথম এবং একমাত্র শর্ত

পথের নেশাই মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু অথবা আরও দূর দিকশূন্যপুরে সে পাড়ি দিয়েছে নিজের অন্তরাত্মাকে জয় করতে। তাই খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই “কতটা পথ হাঁটলে পথিক হওয়া যায়”, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই অমোঘ প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছে দিকে দিকে। মানুষ চিরকাল সুন্দরের উপাসক এবং সত্যের অনুসন্ধানী। এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর এবং অনিত্য মানুষ তার কাছে যেতে চেয়েছে বারবার। এইভাবে একদিন পায়ের তলায় সর্ষের আয়োজনটুকু কোনোক্রমে জুটিয়ে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। আসমুদ্রহিমাচল প্রসারিত এই ভারতবর্ষের উত্তরে জাগরুক দাঁড়িয়ে আছে সুমহান হিমালয় পর্বত। বৈদিক সভ্যতার মুনি-ঋষি থেকে শুরু করে হাল আমলের ট্রেকার-মাউন্টেনিয়াররা পাহাড়ের এই বিশালতার সামনে নিজেকে সমর্পণ করেছে। এই যে পাহাড় পথে হাঁটা, রহস্যের ভেতর পথ খুঁজে খুঁজে এই যে হিমাদ্রি বেঁচে থাকা, এ তো আসলে নিজেরই বিন্দুতম অস্তিত্বের অনুসন্ধান। 

ভূগোলের পাতায় পাহাড়ের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। হিমবাহের বরফে ঢাকা উপত্যকা, খরস্রোতা বয়ে চলা নদী, সুনীল জলের সরোবর, সবুজ পাইনের জঙ্গল, বৃষ্টি অরণ্য, মেঘের আড়ালে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত, বিরল প্রজাতির জীবজন্তু পাখি ইত্যাদি মিলিয়ে এক মনোহর প্রাকৃতিক আয়োজন। অন্যদিকে এঁকেবেঁকে উপরে উঠে যাওয়া অচেনা পাহাড়ি পথ, সবুজ বুগিয়ালের বুক চিরে এক টুকরো জনপদ, ভেড়ার পাল নিয়ে পথ আগলে পাহাড়ি বেদুইন, কঠোর পরিশ্রমী পাহাড়ি জনজাতির মানুষ, এইসব নিয়েই আমাদের পাহাড় পথের সংসার। 

সমতলের দৈনন্দিন জীবনের ইঁদুর দৌড়ে যখন বুকের নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসে, মানুষ এক ছুট্টে পালিয়ে আসে পাহাড়ের কাছে। মাথার ভিতর জীবনের নানান প্রশ্নের জটিলতা যখন মাকড়সার মতো জাল বোনে মানুষ তখন পাহাড়ের বিশালতার কাছে এসে দাঁড়ায়। গৃহস্থ থেকে সংসারী, চাকুরীজীবী থেকে ব্যবসায়ী, ভবঘুরে থেকে দার্শনিক প্রায় সকলেই পাহাড়কে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজস্ব অনুভবে চিনতে চেয়েছে। 

তপস্যার দেবভূমি এই হিমালয় একদিন কালের নিয়মে প্রযুক্তির হাত ধরে ঢুকে পড়ল বিনোদনের অঙ্গরাজ্যে। পরিবেশের স্বার্থ রক্ষায় ভাটা পড়লো, গুরুত্ব পেল অর্থ উপার্জনের চাহিদা। সমতল থেকে কিলবিল সংখ্যক মানুষ পাড়ি জমালে আরও উপরে হিমালয়ের নিভৃত অন্দরমহলে। ভাবখানা এমন যেন টাকা থাকলেই পাহাড়কে কিনে নেওয়া যায়! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতায় স্বেচ্ছায় ঠকে গিয়ে একটি নদীর বিনিময়ে কিনতে চেয়েছিলেন একটি আস্ত পাহাড়। কিন্তু ভাব রাজ্যের এমন রাবীন্দ্রিক ‘বলাই’ এ পৃথিবীতে আর কয়টি আছে? 

পাহাড়ের প্রতি মানুষের টান দীর্ঘদিনের। সেই ১৯৬০ সালে পর্বত অভিযাত্রী সংঘের নন্দাঘুন্টি সফল অভিযানের মধ্যে দিয়ে বাঙালির পাহাড় চড়া শুরু। ভারতীয় ইতিহাসটি আর সামান্য কিছু পুরোনো। কিন্তু ইদানিং যেন ‘উঠলো বাই তো ট্রেকিং করতে যাই’ গোছের একটি মানসিকতা তীব্রভাবে ধরা পড়ছে চারিদিকে। কোনোরকম নিয়ম কানুন না জেনে অথবা সামান্য জেনে, আগাম শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি না নিয়ে, কাগজপত্র-বই না পড়ে, শুধুমাত্র কিছু ভুঁইফোড় ইউটিউব ভিডিওর ভরসায় মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। বিপুল অর্থ উপার্জনের এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। ফলস্বরূপ প্রতিদিন পর্যটক, পুণ্যার্থী এবং ট্রেকারদের জন্য তৈরি হল বিভিন্ন গুণমানের হোটেল, মোটেল, লঙ্গরখানা এবং হোমস্টে। গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কাঞ্চনজঙ্ঘার উঠোন অব্দি মানুষকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যন্ত্রযান হাজির হলো। সফল অভিযানের নিশ্চয়তা দিয়ে রাতারাতি তৈরি হলো ট্রাভেল এজেন্সি। পথ দেখানোর জন্য গাইড-মালবাহক। পাহাড়ের যে কোনো উচ্চতায় মনপসন্দ খানাপিনার আয়োজন কম পড়লো না। মাথার টুপি থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত ঢেকে ফেলবার নামিদামি সাজ পোশাক তৈরি হলো। রাত কাটাবার জন্য অত্যাধুনিক টেন্ট কেনা হলো। পাহাড়কে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে নেবার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হলো। হাঁটার পথে বলিউডি উল্লাসে বিনোদনের জন্য ব্লুটুথ স্পিকার এলো। যেখানে সেখানে ফেলে রাখা প্লাস্টিক আবর্জনা স্তূপ হয়ে উঠলো। কর্পোরেট দুনিয়ার ধুরন্ধর এজেন্সির কাছে অসহায় মাথা নামিয়ে বশ মেনে নিলো গ্রামীণ অশীতিপর বৃদ্ধ গাইড। নিরীহ গ্রামবাসীদের জমি ঠকিয়ে সস্তায় কিনে নিলো সমতলের জমি মাফিয়া। রাষ্ট্রের স্বার্থে বড়ো বড়ো জলাধার নির্মাণে স্থানীয়রা ভিটে-মাটি-জঙ্গল খুইয়ে রিফিউজি হলো। ভাবুন, ভালোবাসার পাহাড়কে, নৈসর্গের পাহাড়কে, জীববৈচিত্রের পাহাড়কে, সমতলের কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের সামনে বিনোদনের থালায় সাজিয়ে দিয়ে পাহাড় অথবা পাহাড়িয়াদের কি এতকিছু পাওনা ছিল? আমাদের কি তাদের কাছে একটি সবিনয় অনুমতি অথবা ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে নেওয়া জরুরি নয়? তেনজিং নোরগে তো এভারেস্ট শীর্ষ স্পর্শ করার পর সাগরমাথার কাছে চোখের জলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। তাহলে কার হাতে তিনি পরম্পরা ছেড়ে গেলেন?

সুতরাং ‘নিভৃত সেই বিজনপ্রদেশ’ বলে পৃথিবীতে তাহলে আর কিছু রইল না। একটু তথ্য পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। বিগত ৩০ বছরে (১৯৯০-২০২০) জনপদ বিস্তারের প্রয়োজনে, বাড়তি খাবারের যোগান মেটাতে এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে আমরা পৃথিবীর ১০% বিজনপ্রদেশ হারিয়ে ফেলেছি। আন্টার্কটিকাকে বাদ দিলে রাশিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ব্রাজিল এবং অস্ট্রেলিয়া- এই পাঁচটি মিলিত দেশ এমন এক ৭০% শেষতম পৃথিবীর অধিকারী যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। পৃথিবীর এই বহুচর্চিত কৌমার্যের অধিকাংশই ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য এবং নাতিশীতোষ্ণ বনভূমি দিয়ে তৈরী। গ্লোবাল ফরেস্ট রিসোর্সেস অ্যাসেসমেন্ট, ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৭ মিলিয়ন হেক্টর অরণ্য আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করে চলেছি। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র হ্রাস, বিশ্ব উষ্ণায়ন ইত্যাদির তথ্যসূত্রে তা প্রমাণিত সত্য।

জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি পরিচিত শব্দবন্ধ। একে একটি ব্র্যান্ড বললেও দ্বিমতের অবকাশ নেই। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশেষত বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে এর ব্যাপক প্রভাব আর ঠেকিয়ে রাখা গেল না। হিমালয় তথা পৃথিবীর যে কোনো পাহাড় এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জর্জরিত। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমাঞ্জারোর মাথায় হিমবাহগুলি, যা কিনা আফ্রিকার শেষতম অহংকার, হারিয়ে যাবে ২০৫০ সালের মধ্যে। আমাদের বাড়ির পাশেই হিমালয়ের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। এখানে ৬০০০ মিটার উচ্চতার আশেপাশে ঘটে চলেছে নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বুঝতে হবে পাহাড়ের চরিত্র পাল্টাচ্ছে। বুঝতে হবে শৃঙ্খলা পাহাড়ের প্রথম এবং একমাত্র শর্ত। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে বরফ গলে হিমবাহের ফাটল বেরিয়ে পড়ছে। গাছ কেটে নেবার ফলে ভূমিধ্বসের ঘটনা বারংবার ঘটছে। উলম্ব-আকাশ ভেঙে অথবা হড়পা বন্যায় জনপদ ভেসে যাচ্ছে। তুষার ধ্বসের জেরে বরফ চাপা পড়ে প্রায়শই জীবনহানি ঘটছে। সাম্প্রতিক কালের সাড়াজাগানো ঘটনা, নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং-এর পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ শিবিরে ছাত্র-প্রশিক্ষক মিলিয়ে তিরিশ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি প্রশাসনিক চেয়ার নড়িয়ে দিয়েছে। আজকের ঘটনা আগামীকাল ভুলে গিয়ে মানুষ আবার পাহাড়ের পথে বেরিয়ে পড়ছে। এইভাবে আগাম প্রস্তুতি এবং সাবধানতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাবড়ার সুজয়, কল্যাণীর অলোক, বাঁকুড়ার সুভাষ, নিমতার নির্মলরা মৃত্যু মিছিলে সামিল হয়ে যাচ্ছে। সম্মোহিত জনতার মতো, কেউ বোঝার চেষ্টা করছে না, পাহাড় কোটি কোটি বছর ধরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু পাহাড়ে জীবন ও মৃত্যু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে একটি ভুলের দূরত্বে।

আরও পড়ুন...