Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

সা ক্ষা ৎ কা র

প লা শ   দে

কবি ও  চিত্রপরিচালক

palash

'পাগল তুমি থাকো আমার ভেতর, তুমি তো আমার একমাত্র শেষ আশ্রয়', দেবজ্যোতি মিশ্র

১। পৃথিবীর সমস্ত সুরের মাঝে তুমি অথবা তোমার ভেতরে সমস্ত পৃথিবীর সুর… কি মনে হয় তোমার!

আমাদের চারিপাশে সুর বয়ে যায়, সুর বয়েই যায়। কবে সেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল, ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়েছিল, সুর কি তখনও ছিল? মাঝে মাঝে মনে হয় সুরের জন্ম কবে? মানুষ হাঁক পেড়েছিল, তাই কি সুরের জন্ম হয়েছিল? তবে এটা বুঝি যে আমার চারিপাশে সুর বয়ে যায়, স্রোতের মতো বয়ে যায়, সেই সব স্রোত কখনও কাছের, কখনও দূরের। পৃথিবীর সমস্ত সুর একাকার হয়ে যায়, তারা পাশাপাশি দাঁড়ায়, আর হয়ে দাঁড়ায়, সোজাসুজি, কোনাকুনি। সুর গুলো জড়িয়ে যায় একে অন্যের সঙ্গে, তবে এটা বুঝি ভালোবাসা নিজেই একটা ব্যপ্ত সুর। আমি তো ভালোবাসারই মধ্য থেকে জন্মে ছিলাম, পরষ্পর আমার বাবা মা তারা নিজেদেরকে ভালোবেসেছিল, ভালোবাসা নিজেই একটা সুর, আমার জন্ম তাই সুরের মধ্যে, এই যে আমি এখন কথা বলছি, এই যে আমি লিখছি, এই সমস্ত কিছুই তো আসলে সুরের মধ্যেই ঘটে। কত রকমের সুর, কত ধরনের সুর, আমরা সুর বললে পরেই প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব, তার নিজের দেশের, তার নিজের ভাষার, তার নিজের শব্দের সুরের কথা বলে।

আরও সহজ করে বললে, আমরা সুর বললে পরে একটা গানের কথা বলি, সে তো গান এসছে অনেক পরে, কিন্ত তার আগে তো মানুষ সুরে, শুধুমাত্র স্বরক্ষেপনে গেয়েছে। পাখি শিষ দেয়, ধানক্ষেতে হাওয়া বয়ে যায়, সব কিছুরই সুর আছে, দৃশ্যের সুর আছে, সুর আবার দৃশ্য তৈরী করে। এই সব কিছুর মধ্যে আমি, আবার আমার মধ্যে সুর, অদ্ভুদ মজার ব্যাপার। মাঝে মাঝে মনে হয়, আচ্ছা এই যে কম্পোজিসনটা তৈরী করলাম, এই সুর গুলো কোথায় ছিল? এই সুর গুলো তো এই হাওয়ায়, বাতাসে, আমার স্মৃতিতে ছিল। আমার স্মৃতিতে কোথা থেকে এলো সুর, কে পুড়ে দিল আমার স্মৃতির মধ্যে সুর? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, জীবন, বিভিন্ন সুর শোনা, নাকি জিনের মধ্য দিয়ে সুর শোনা যায়? এর সঠিক কোনো উত্তর কি জানা আছে কারোর? আমারও জানা নেই। ধীরে ধীরে যখন আমার রাগ রাগিনীর সাথে পরিচয় হলো, লোক গানের সাথে পরিচয় হলো, পশ্চিমের সঙ্গীত। পশ্চিমে তো কত রকমের সঙ্গীত, তাদের পশ্চিমী দ্রূপদী সঙ্গীত, পশ্চিমের রঙ, লুজ, জ্যাজ, আরও অনেক কিছু। শুধু পশ্চিম? আমাদের প্রাচ্যের, মধ্য প্রাচ্যের, কত রকমের কত শ্রুতি, সেই সব শ্রুতিকনারা যেভাবে আমাদের জড়িয়ে রাখে, তা বলার বাইরে, আর এই সব কিছু কখন মিলে মিশে যায় মাথার মধ্যে, মাথার ঠিক কোন কোনায় থাকে কেউ জানেনা, শুধুমাত্র আমারই যে সুর আছে, আমি সুর করি বলে, তা নয়। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সুর আছে, সুরে বাধা থাকে সারা পৃথিবী, প্রতিটি ঘটনা। এইটাই আমার মনে হয় যে সুরের গল্প। সুরের মধ্যে আমি, আমার মধ্যে সুর।

২। মিউজিক-কবিতা-পেন্টিং-গদ্য এতগুলো মিডিয়ামে কাজ করতে গিয়ে কি অনুভব তোমার।

মিউজিক, কবিতা, পেইন্টিং, গদ্য, আসলে সব কিছুই আমার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবনা চিন্তা, তার টুকরো টুকরো অংশ, কোনো কিছুই ঠিক করে উঠতে পারলাম বলে তো মনে হয় না। পরিমানে মিউজিক আমার অনেক বেশী, তার কারন এটা পেশা হিসেবে এসেছে। কবিতা তো ক্রমাগত চোখের সামনে জন্ম নেয়, জানিনা তার মৃত্যু আছে কিনা, কত সব দৃশ্য জন্ম নেয়, এই যে ছন্দের সাথে ছন্দ মিলে যায়, যাকে সোজা কথায় বলে অন্তমিল, রাইম, আসলে সে সবই সময়কে কেটে টুকরো করে রাখা, যেন একটা ব্লেড দিয়ে সময়কে টুকরো করে রাখা, একটা টুকরোর সাথে আর একটা টুকরো মিলে গেলে আমরা বললাম ছন্দবদ্ধ হলো। কিন্তু সেই কবিতা কোথায়? কোথায় খুঁজে পাবো? যার কোনো অন্তমিল নেই, বা অন্তমিল থাকলেও অন্তমিল দূরের নির্দেশ দিচ্ছে, আরও দূরে আরও এক প্রত্যন্ত প্রান্তে, যেখানে আর এক অন্ত আছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে যে মিলবেই এমন কোনো কথা নেই, এই যে আনপ্রেডিক্টেবল একটা জার্নি, কবিতায় যেমন আছে, সুরেও আছে। গদ্য লেখক তিনিও যেখানে গল্প ছেড়ে যান, আসলে কি সেখানেও গল্পটি ছেড়ে যায়? যদি খুব প্রকৃত অর্থে একটি গদ্য তৈরী হয়, তা আসলে কখনোই ছেড়ে যায় না, তার থেকে আরও অনেক সুতোয় সুতোয় আরও অনেক তৈরী হয় মানুষের মনে।  পেইন্টিং, ছবিরও সেই একই ব্যাপার। একটা ছবির সামনে আমি হয়তো দাঁড়িয়ে আছি। আসলে সেই দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটার সামনে আসলে অন্ধকার। আকাশ কি করে বুঝতে পারছি! মাঝেমধ্যে কিছু রং দেখা যায়। অভিজ্ঞতায় জানি মাথার উপর দেখা যায় আকাশ। কিন্তু তাই কি? আকাশ তো নিজেই ব্রহ্ম। চোখ বন্ধ করে থাকলেও, থাকে। হঠাৎ যদি মনে হয় কিছু রং কিছু আঁচড় ছেলে মানুষের মতো, দেয়ালেই আঁকলাম কিম্বা কাগজে, মাটিতে অথবা একটা ক্যানভাসে। তারও এক সুর আছে ছন্দ আছে। তারও একটা গভীরতা সমস্ত কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া আছে। সেই ছবির রং অন্যরকম। সুর যখন করি সুরের সঙ্গে থাকি তখন তো ছবি থাকে, হয়তো লুকিয়ে। কবিতা থাকে গদ্যও থাকে। তবে আমাকে সব থেকে বেশি আন্দোলিত করে অক্ষর। এবং সেই অক্ষর যখন থেকে যখন শব্দ তৈরি হয়, শব্দ থেকে আরেকটি শব্দ তারপর আরেকটি শব্দ। ক্রমাগত একটা প্রলোভন দিয়ে যায়। হাতছানি দিয়ে যায়। একটা অন্তের দিকে। যে অন্তের দিকে দেখি কোন অন্ত নেই। কবিতার সঙ্গে এক অদ্ভুত প্রেম নিবিড় প্রেম ভালোবাসা তৈরি হয়। কখনো কখনো সেগুলোকে ওই যে বললাম ব্লেডের টুকরো দিয়ে সময় কাটা… সেরকম ভাবে কিছু কিছু লেখা হয়ে যায়। সেগুলো কবিতা হলো কিনা গদ্য হলো কিনা সে দায় নেই আমার। থেকে যায়। তার মধ্যে আদর ভালবাসা সবই থাকে। আর একটা ডুকরে ওঠা কান্নাও থাকে বুঝি। যা আসলে কখনোই কাব্য হয়ে ওঠে না। কবিতার জন্ম বোধহয় সেখানেই। সুরের মধ্যে একটু সহজ বিচরণ আমার। অনেক ছোটবেলায় সেই সুরের দেখা মিলেছিল বাবার হাত ধরে ভায়োলিন শেখার মধ্যে দিয়ে। এই আজও যখন লিখছি কিছুক্ষণ আগে বিরাটিতে একটি শো করে এসেছি সেই ভায়োলিন হাতে মাইক্রোফোনের সামনে দু হাজার শ্রোতা। কি করে যে বাজিয়ে চললাম! তাই মনে হয় ছেলেবেলায় বাজানো ভায়োলিন মিথ্যে বলে না আমাকে। কি সহজে একটা তার যখন সুরে একটু নিচু হয়ে গেছে, একটু ঢিলে হয়ে গেছে… আঙুল মেপে নিয়ে নিজের সুরের সাথে মিলিয়ে নেয় সে। অভ্যেস বহু বছরের। শেষ দিন পর্যন্ত আমার হাত ধরে থাকবে সুর। একই রকমভাবে যখন আমি ছবি আঁকি। যা আঁকতে ইচ্ছে করে তা আঁকতে আরম্ভ করেও আঁকা যে কোথায় চলে যায় … যেখানে শুরু করব মনে করেছিলাম সেখানে শেষ হয় না। ছবি আঁকার তাই শুরুও নেই শেষও নেই। একটা যা হোক কিছু কাগজে কিংবা ক্যানভাসে কিংবা একটা খাতায় থেকে যায়। তার থেকে আমি মুক্তি পাব বলে কখনো সখনো ফ্রেমে বন্ধ করি। সেই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো কেউ বলেছে কখনো ‘বাহ্’।  সেই বাহবাটা মনে থেকে গেছে। পরবর্তী সময়ে ছবি আঁকতে গিয়ে কখনো স্মৃতি আমাকে তাড়না দেয়নি। নতুন স্লেটেই আবার ছবি আঁকা শুরু হয়েছে। ‘একদা জাহ্নবী তীরে’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে বা সত্যজিৎ রায়ের উপর ‘কম্পোজার সত্যজিৎ’। দুটো বই একেবারে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। একটি পড়লে নিজেই প্রায় কোথাও হারিয়ে যাই মনে হয়। তাহলে দেখুন ‘একদা জাহ্নবী তীরে’ এখানে শব্দেরা, অক্ষর… একটা ইতিহাসের নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। সত্যজিৎ রায় তার বিপরীত। সবকিছুকে ধরা দেবে বলে বসে আছে। তার কারণ সুরের গল্প লিখতে গিয়ে সুরের কাছে হেরে বসে আছি যে!

এরকম বহু লেখা বিভিন্ন সময়ে লিখেছি। গদ্য পদ্য ওই লেখার অছিলা আর কি।

তাই সুর পেইন্টিং গদ্য পদ্য এগুলো আসলে মিলেমিশে যায়। একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হয় গল্প হয় ভাব হয় ঝগড়া হয়… কোন্দল করে তারা।

এইরকম… এইরকমই অনুভব আমার।

৩। তুমি তো রাজনীতি সচেতন মানুষ। ব্যক্তিগত একা একলা মানুষের রাজনীতি আর পৃথিবীর রাজনীতি কিভাবে আসে যায় তোমার কাছে।

ব্যক্তিগত একা… একলা মানুষের রাজনীতি। একটা রাজনীতি তো আছেই। একা তুমি কখনও নও আসলে। এই যে দাঁড়িয়ে আছি, বসে আছি বা এই যে আমি লিখছি এখন। এই যে চারটে দেওয়াল রয়েছে… এই construction… বহু বহু মানুষের তৈরি করা বহু বছরের তৈরি করা একটা construction এর মধ্যে বসে আছি আমি… চারটে দেওয়ালই তৈরি হয়েছে ইতিহাসের কত কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে, তাই একলা কি সত্যিই কখনও হতে পারা যায়? আমার চারপাশে টিভি চলছে… বা ফোন… এই যে আমি লিখছি… এই যে অক্ষরেরা… আমি একা কখন? এই আক্ষরদের সঙ্গে তো আমি আছি। তাই একা একলা মানুষের রাজনীতির মধ্যে গোটা ইতিহাসটাই লুকিয়ে রয়েছে আসলে। ঘরের সামনে একটা আয়না আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটা ছায়া দেখতে পারি, সেই ছায়াটা যে আমি সেটা কি করে আমি জানি, তার মানে আমার মস্তিষ্কের একটা ঘটনায় আমি চিনতে পারি ওই ছায়াটাকে আমি বলে। এটা চিনতেও তো বহু বহু বছর সময় লেগেছে। তাই আমি আসলে কখনই একা বা একলা নই, আমাকে ঘিরে রেখেছে সব কিছু। আমার এই যে বই, এতগুলো বই রয়েছে চোখের সামনে… এত কিছু রয়েছে… musical instruments রয়েছে, খাবার রয়েছে… সবকিছু… একটা বই, সেই বইটার একটা দাম রয়েছে। কোনও একদিন ঠিক হয়েছিল… সেই বইটা রয়েছে আমার। এই বই-এর rack-এ, সেই বইটা published হয়েছে একটা জায়গায় সেখানে বহু মানুষ তাদের শ্রম দিয়ে তারা তৈরি করেছে বইটা ফলে আমি একা যখন বসে আছি তখনও অসলে ইতিহাসের এবং আমার সমসাময়িক সময়ের বহু মানুষের শ্রম আবেগ এসব কিছুর সঙ্গে আমি জড়িয়ে আছি। তাই আমার একা বা একলা মানুষের রাজনীতি আসলে একলা মানুষের নয়, বহু মানুষের।

আর যদি বলা যায় যে পৃথিবীর রাজনীতি কিভাবে আসে যায় আমার কাছে তা এক এক সময় এক এক রকম। আমার ষোলো বছরের জীবনে আমি এক রকম ভাবে খবরের কাগজের খবর পড়ে আমি react করতাম। এখন হয়ত অন্যভাবে করি। হয়তো খবরের কাগজ পড়াই হয় না। হয়তো এই মোবাইল ফোনে আমি দেখছি বিভিন্ন লেখা আসছে ভাসছে যাচ্ছে এবং আমি শুনছি বিভিন্ন information আমার কাছে আসছে অথবা আমি দোকানে যাচ্ছি, একটা কিছু কিনছি, সেই কিনতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি দাম বেড়ে গেছে কিম্বা আমি জানি যে একটা lock down হল… pandemic দুটো বছর আমি জানছি যে পৃথিবীতে কি করে মানুষ তখনও ব্যবসা করছে, ব্যবসা করার কথা ভাবতেও পারছে… সে নিজেও জানে না পরের দিন সে বেঁচে থাকবে কিনা… সে ভাবছে কি করে তার ব্যবসাটা চলে… একটা ঘোরের মধ্যে বসে। Oxygen Sylinder কিম্বা Mask সংগ্রহ করছে সে। বাজার থেকে সব কটা জিনিস তাকে নিজেকে নিয়ে চলে আসতে হবে, সে যেন বেঁচে থাকে। প্রতিটি মানুষ এভাবে ক্রমাগত একটা রাজনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে পড়ছে বেঁচে থাকার রাজনৈতিক আবর্ত এবং সেই বেঁচে থাকাটা যে শুধু মাত্র physically বেচেঁ থাকা নয়… অনেক রকম ভাবে… শক্তি… power game… gender politics… সমস্ত কিছু মিলে মানুষ শেষ পর্যন্ত একটা দুটো ক্লাস… একজন oppress করে একজন oppressed হয়, এই জায়গার বাইরের দিকে বেরিয়ে আস্তে পারে না। তবুও পৃথিবী অনেকটা সময় ধরে বহু কিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই যে যুদ্ধটা চলছে … রাশিয়া বনাম ইউক্রেন, আমরা এখন আর কোনো খবরই পাইনা শুধু খবরটা যেভাবে হতে পারে বলে মনে হয়, দেশের economyটা আস্তে আস্তে আস্তে আস্তে… বিভিন্ন পৃথিবীর equation… তাদের নিজেদের দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে… আমরা বুঝতে পারি, আমাদের effect করে একটা তেলের দাম বাড়ার ওপর আমাদের জীবন যাপন বেচেঁ থাকা এবং তা দিয়ে একটা দেশের বিপরীত রাজনীতি বিপরীত narrative যেমন ভাবে তৈরী হবে তা তৈরি হয়। তাই যে কথা বলছিলাম পৃথিবীর রাজনীতি কিভাবে আসে যায় বা যায় আসে সেটা জরুরি হয়ে ওঠে তখনই যখন ঠিক আমার বাড়ির পাশে একটা ঘটনা ঘটে কিম্বা কিছু দূরে কেননা খুব বেশি দূরে ইউক্রেনে ঘটনার সঙ্গে আমি কতটা সুতোয় বাঁধা রয়েছি আমি জানি না। খুব indirectly যে সুতোয় বাঁধা থাকি সেগুলোকে আমরা বুঝে উঠতে পারিনা। আমরা theoretically বোঝবার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা বুঝে উঠতে পারিনা শুধু এটা বুঝতে পারি যে পৃথিবী কোনো মঙ্গলের দিকে যাচ্ছে না… কোনো মঙ্গল হওয়ার নয়। কিন্তু তাও তো আমরা আশা ছাড়তে পারিনা। এই যে শ্রমজীবী ক্যান্টিন আমাদের ভাবনায় উঠে এল pandemic-এর মধ্যে, lock down-এর সেই প্রথম দিকে তখন আমরা মনে মনে ভাবলাম যাদবপুরের community kitchen শ্রমজীবি ক্যান্টিন… তার এক হাজার দিন পূর্ন হল তার এক হাজার দিন পূর্ণ হল, ভেতরে কি একটা তৃপ্তি আসেনি? নিশ্চই তৃপ্তি এসেছে। বহু মানুষ খাবার পেতে পারে। বহু মানুষকে চোখের সামনে দেখেছি, অন্তত তাদের কিছুটা ক্ষুধার নিবৃত্তি দিতে পারা গেছে এটা আমার কাছে একটা বড় পাওনা। এটাও তো রাজনীতি। এখানেও তো বহু মানুষ এক সঙ্গে মিলেছে। যেরকম ভাবে যুদ্ধে বহু মানুষ এক সঙ্গে মেলে একটা ধ্বংসের জন্য। তেমনি বহু মানুষ একসঙ্গে মিলেছে একটা ভালোর জন্য, একটা মঙ্গলের জন্য। তাই আমি এই পৃথিবীর ব্যাপারে কৌতূহলী এবং কৌতূহলী থাকবও।

৪। তোমার সঙ্গে যারা মিশেছেন তারা টের পান তোমার পথ সহজিয়ার। অথচ এই পথই সবচেয়ে কঠিন তোমার জার্নি টা যদি একটু বলো।

সহজিয়া কি হওয়া যায়?  এ জীবনে আর সহজিয়া হতে পারবো না। তবে সহজিয়া যে জীবন চোখের সামনে দেখি বা যাদের দেখেছি… তাদেরকে সবসময় মাথায় করে রাখব।… আমার বাবা… আমার বাবা বললাম কেন? সেখান থেকে শুরু হয়েছিল আমার… শুধু বাবা কেন… মা। যে কথা একদম প্রথম প্রশ্নে বলেছিলাম যে আমার বাবা মা, তারা পরস্পরকে ভালোবেসে ছিলো আর তাই তো আমি। সেই বাবা আমার হাতে বেহালা দিয়েছিল… ভায়োলিন… সেই ভায়োলিন দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার যাত্রা… সুরের যাত্রা। আজও আমি… এই লেখা লিখতে বসার আগে বিরাটিতে দু আড়াই হাজার মানুষের সামনে মাইক্রোফোনে যখন ভায়োলিন বাজাচ্ছিলাম, মনে পড়ছিল প্রথম দিনের কথা… কি কষ্টে স থেকে র, র থেকে গ, একটা আঙুল থেকে আর একটা আঙুল… মনে পড়ে যায়। কিন্তু এই বাবার জীবনই তো ভীষণ একটা সহজিয়া জীবন ছিল। কি অনায়াসে খালি গায়ে একটা লুঙ্গি পরে মানুষটা টালিগঞ্জ চন্ডিতলার একটা কলোনি পাড়া এলাকায় হেঁটে বেড়াত, মানুষ সম্ভ্রম করত, শ্রদ্ধা করত কিন্তু কোথাও দূরত্ব ছিল না। আবার যখন এই টালিগঞ্জ চণ্ডীতলা পেরিয়ে ট্রাম লাইন পেরিয়ে গড়িয়ার পর  যখন লোয়ার স্ট্রিট-এ সলিল চৌধুরীর বাড়িতে সলিলদার সঙ্গে কাজ করতাম দীর্ঘ সময় ধরে দেখেছি কত সহজ জীবন একটা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ… সেগুলো দেখা একটা বিরাট বড় ব্যাপার। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছি দীর্ঘ দিন… দীর্ঘ তেরো বছর… কত ছবি, ছবির বাইরে ছবি, গানের বাইরে মাসিক অ্যালবামের গান হয়তো background score… তার সঙ্গে কাজ করেছি, বহু বহু মিউজিশিয়ান… কেরালা চেন্নাই বোম্বে ওড়িশা বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন মিউজিশিয়ানরা, কত শত মিউজিশিয়ানদের সাথে আলাপ হয়েছে পরিচয় হয়েছে… সবার মুখ না মনে পড়লেও সবাই আসলে আমাকে ছুঁয়ে আছে। তাঁরা সবাই ছুঁয়ে না থাকলে আজকে আমি যেটুক করছি সেতুক সম্ভব হত না। ভারতবর্ষের কত শ্রেষ্ঠ মিউজিশিয়ানদের দেখেছি সলিলদার দৌলতে এবং সলিল চৌধুরীর compose করা সুর স্বরলিপি করে তাদের সামনে যখন রেখেছি, তাদের চোখে আমি দেখেছি এক ধরনের স্নেহ একটা প্রশ্রয়… আমি এই যে আজকে মিউজিশিয়ান কিংবা  composer বা গান গাই যদি কখনও গেয়ে ফেলি গাইতে পারি তখন ভাবি এ তো সবই তাদের জন্য। তাদের প্রশ্রয় আমাক আরও দৃঢ় করেছে। কিন্তু ওই যে একটা কথা বললাম, বারবার করেই বলি ওই সহজিয়া জীবনই আমাকে মনে করে যে আমাকে মানুষের সঙ্গে একদম পাশাপাশি থাকতে হবে এবং আছিও তাই তার বাইরে কিছু মহান কাজ কিছু করিনি, কোনো মহান কাজ করার ইচ্ছেও নেই, শুধু ওই মহান জীবনগুলোর সাথে আবার যদি দেখা হয়, আর একটু যদি দেখা হয়… শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সেরকম একটা চেষ্টা থাকলে পরেই হবে… পথটা কঠিন, তার কারণ এমন একটা সময় আমরা বাস করি  যেখানে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত আমি… আমি হয়েই থাকি, আমরা হয়ে যেতে পারি না আর এই আমরাই পথটা তো সহজ নয়… আমিকে ভোলা কঠিন, খুব কঠিন শেষ পর্যন্ত… খ্যাতির মোহ থাকে, সেই মোহে আমি জড়িয়ে যায়, সে আমরা হতে দেয় না … সেই ঝুট ঝামেলা যে আমার মাথায় বাঁধে না তা বলতে পারি কি এত সহজে… সহজিয়া জীবন আমাকে দেখে লোকের মনে হলেও নিজেকে অনেক অনেক কিছুর মধ্যে থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত লালন সাঁঈদের কাছে বোধয় পৃথিবীর সমস্ত মুক্তির তালা চাবি। এই যে বললাম তালা চাবি… তালা চাবি দিয়ে যদি বন্ধই হলাম তাহলে মুক্ত হওয়ার এত ইচ্ছে কেন! এদিকে ওই মুক্ত হওয়ার ইচ্ছের মধ্যেই মুক্তি ঘটে। দেখা যাক এই জীবনে কোনও মুক্তি ঘটে কিনা সেরকম।

৫। তোমার ভেতরে যে আশ্চর্য পাগল বাস করে সেই পাগলের কথা শুনতে চাই।

পাগল কি না জানি না… তবে আমার মধ্যে ইচ্ছেটা বাস করে। সে তো প্রতিটা মানুষের মধ্যেই ইচ্ছেটা বাস করে। তাদের ভেতর ইচ্ছেটা কেমন ভাবে বাস করে তো বলতে পারব না, তবে আমার মধ্যে ইচ্ছেটা কেমন ভাবে বাস করে বলতে পারি। আমার বিভিন্ন ইচ্ছেরা… তারা সকালবেলা বল্গাহীন ভাবে বেরিয়ে পড়ে, তাদের অনেক স্বাদ এবং তারা সময়োপজীব্য সমস্ত কিছু করে না। এদের উপর আমার রাশ টানা খুবই মুশকিল। আমি কখন ছবি আঁকব, কখন সুর করব, কখন আমার পরিচালক আসবেন তাঁকে শোনাতে হবে কিন্তু আমি এতটুকু তৈরী নই। কিন্তু তাঁকে দেখেই আমার ভেতরে কিছু একটা হবে আর সামনের লেখাটা সুর হয়ে উঠবে। এইটা আমি নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারব না। আর পাগল হওয়া কি এত সহজ সে তো বড় কঠিন। সেরকম পাগল নিজের মধ্যে কিছু মুহূর্ত জীবনে দেখেছি। যখন আমি বুঝতে পারি যে সারাটা দিন আমি খুব খেটেছি কিন্তু আমি বুঝতেই পারি নি যে আসলে আমি খাটছি। এবং বাইরে থেকে যারা আমাকে দেখছে তারা বলে এবং অনেক সময় বলেছে যে এত এনার্জি কি করে পাও। আসলে একটা পাগলামি থাকে। শেষ পর্যন্ত তারা করে ফেরেও। আমি রাস্তাঘাটে যখন সত্যি কারের একজন মানুষ তথাকথিত ভাবে যাকে বলা হয় মূলধারার জীবন থেলে ছিটকে গেছে আমি খুব খেয়াল করে দেখবার জন্য চেষ্টা করেছি কখনো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে মনে তো হয়নি তারা পগল। ঠিক আমার সামনে যখন আমি দাঁড়াই তখন বুঝতে পারি না কোনটা আসলে পাগলামি। হ্যাঁ এটা বলতে পারি আজও পর্যন্ত আমার কোনো কিছুর প্রতি অধিকার বোধ তৈরী হয়নি। শুধু মুখ গুলো আমার অবলম্বন। যে মুখগুলোর সাথে আমার গল্প হয় সেই মুখগুলিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। তাদের সাথে আমার অনেক রকমের কথা হয়। কোন মুখ ছাড়িয়েছি কোন রাস্তার পাড়ে সেই মুখের সাথে গল্প জুড়ে দি। মানুষ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মানুষ বলতে আমার আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুজন— তারা হয়তো আমায় দেখছে আমি মিউজিক কম্পোজ করছি আমি হয়তো ত্রিশ বছর আগে বা কত শতাব্দী ধরে জানিনা সেখানে একজনের সাথে গল্প করছি। আর অন্যরকম একটা সুর বেরিয়ে আসছে, কিংবা একটা লেখা, কিংবা একটা ছবি… আমি বলি পাগল তুমি থাকো আমার ভেতর, তুমি তো একমাত্র আশ্রয় বা শেষ আশ্রয়। সেই পাগলের কথা শুনতে পাই আমি কিন্তু আপনাদের শোনাবো কি করে আমি যে তার সবকটা কথা এখনও শুনে উঠতে পারি নি। সে রাত্রির বিভিন্ন প্রহরে ডাক দিয়ে যায়। তাকে ধরতে পারি নি কখনো কিন্তু বুঝি সে আছে। থাকুক। এভাবেই সে থাকুক আমার সাথে।

৬। তীব্র গুণীজনদের সঙ্গে তুমি কাজ করেছ বিভিন্ন মাধ্যমে। সেই তেঁতুল পাতায় ন-জনের কিছু গল্প যদি বলো…

হ্যাঁ, সত্যিই তাই, তীব্র গুণীজনের সঙ্গে আমি কাজ করেছি বিভিন্ন মাধ্যমে। আমি যদি সঙ্গীতের কথাই বলি প্রথম দেখা আমার বিস্ময়কর মানুষ আমার বাবা। আমার বাবাকে আমি দেখেছি বাবা, বাহাদুর খাঁ, ঋত্বিক ঘটক, উদয়শংকর একসঙ্গে… খুব ছোটবেলার স্মৃতি সেসব। কিন্তু বুঝতে পারতাম আমার বাবা খুব সহজ সরল, আমার বন্ধুর বাবাদের মতো নয়। যারা স্নেহশীল, যারা সংসার দেখেন, ওই কলোনীপাড়াতেই যে যার সাধ্যমতো অফিসে যান ফেরেন, কিংবা স্কুল যান বাড়ি ফেরেন সে রকম নয়। আমি দেখেছি আমার মা প্রায় সময় উদ্বিগ্ন মুখে থাকতেন মাসের মাঝ বরাবর। বাবাকে তখন দেখেছি বাবা অবলীলাক্রমে ওয়েস্টার্ন ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে বাংলা স্বরলিপি করছেন। খুব আশ্চর্য লাগত। পরবর্তী সময়ে সেই স্বরলিপি বাজিয়েছি যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে বাবাকে একজন তীব্র গুণী মানুষ বলেই মনে হয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করতাম, এরকম একটা মানুষকে নিয়ে সংসার করতে তোমার… মনে হয় নি কখনো তোমার যে তোমার জীবন অন্যরকম হতে পারত। বাবার মৃত্যুর পর মাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা বলেছিল না রে প্রথমে ভাবতাম এসব সবার যেমন সংসার হলো আমার তেমন হলো না। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যা মানুষ আমাকে এত ভালোবাসলো তাঁর এমন কিছু জিনিস ছিল যা দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। এই কথা আজ লিখতে গিয়ে আমিও বিস্মিত হচ্ছি।

বাবার পরই মনে পড়ছে সলিল চৌধুরীর কথা। বাবা যদি হন ব্যাকরণের বই ‘রায় এন্ড মার্টিন’ সলিলদা যেন আমার কাছে শেক্স পিয়ারের সাহিত্য, তাঁর সনেট, তাঁর আলো… আমাকে সমস্ত জানলাগুলো খুলে দিল। সেই আলোয় আমি সমস্ত পৃথিবীকে দেখলাম। ওই যে গানের মধ্যে আছে না ‘কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল, সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল’… এই ভালোবাসার আলো আমি সলিল চৌধুরীর মধ্যে দেখেছিলাম। সত্যজিৎ রায়কে দেখেছি। একেবারে ভিন্ন মেরুতে। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। অবাক হতাম এত এত কাজ করে যাচ্ছেন যে মানুষটা তিনি নির্বিকার ভাবে একটা গাড়িতে করে এলেন, এইচ এম ভি-র ফ্লোরে ঢুকলেন এবং কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছেন। যে কাজ একবার করলেন সে কাজকে ফিরে আর দেখেন নি। তাঁকে নিয়ে আমার বই ‘কম্পোজার সত্যজিৎ’ বেরিয়েছে। মৃণাল সেন… এই মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বা কাজ সেই আটের দশকের গোড়ায়। সেই ছবি ‘আকালের সন্ধান’-এ। সলিল চৌধুরী তাঁর সুর পরিচালক আমি সহকারী। দেখেছি দুই বন্ধুর গল্প… সলিল চৌধুরী আর মৃণাল সেন… ভাবা যায়? দু’জনে ফ্লোরের মধ্যে যখন কাজ করছেন তখন আমরা মিউজিশিয়ানরা বুঝতেই পারতাম না যে আমরা একজন মহান পরিচালক আর একজন মহান কম্পোজিটারের সঙ্গে কাজ করছি। মনে হত যেন দুই বন্ধু কাজ করছে। তা তো সত্যি। সেই গণনাট্যের সময় থেকে তাঁরা বন্ধু। যদিও মৃণাল সেন গণনাট্যের সঙ্গে ছিলেন না কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। সে গল্প অন্য একদিন হবে। মৃণালদার সঙ্গে কাজের একটি গল্প বলি, ‘আমার ভুবন’ ছবির কাজ করছি। মৃণালদা বললেন, এই ছবিতে একটা বিশেষ জায়গায় ‘আলোর পথযাত্রী’ ব্যবহার করবেন। তখন সলিল চৌধুরী বেঁচে নেই। তাঁদের প্রবাদপ্রতিম বন্ধুত্বের গল্প। আমি বললাম, ‘এখানে কি ‘আলোর পথযাত্রী’ যাবে? এই সিকোয়েন্সে?’ উনি বললেন, ‘তাই? তাহলে এক কাজ কর অন্য কোনো মিউজিক কর’। মিউজিক করা হল। বহু পরে যখন ছবিটা দেখা হচ্ছে স্ক্রিনে, মৃণালদার ঠিক পাশে বসে আছি আমি। ভুলে গেছি আসলে কি মিউজিক হয়েছে। হঠাৎ ওই সিকোয়েন্সে দেখি ‘আলোর পথযাত্রী’ বেজে উঠল। মৃণালদা আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন ‘তুমি কিছু মনে কর না। আসলে সলিলকে আমার একটা ট্রিবিউট জানানোর কথা ছিল।’ এই যে বন্ধুত্ব… দুজন অসম্ভব গুণী মানুষ… এবং তাঁরা দু’জন বন্ধু। একজন নেই আজ, আমার শিল্প বড় কথা নয়, আমি আমার বন্ধুকে ট্রিবিউট জানাতে চাই… এই অনুভূতি… মনে হয় আজ এরকম ভাবেই থাকতে পারব তো কারোর বন্ধু হয়ে কিংবা কেউ আমার বন্ধু হয়ে।

বহু প্রজন্মের সঙ্গে তুমি কাজ করেছ নতুন প্রজন্মের কাজের সম্পর্কে তোমার কি মনে হয়?

বহু প্রজন্মের সঙ্গে আমি কাজ করেছি এমন ভাবলে আমার মনে হয় এই তো সবে আবার কাজ শুরু হল… ঠিক এইটাই মনে হল। হ্যাঁ, আমার সতেরো বছর বয়সে আমি সলিল চোধুরী, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়কে পেয়েছি। হ্যাঁ মাত্র সতেরো, আঠারো, উনিশ, কুড়ি বছর বয়সেই। সারা ভারতের আরও অনেক শ্রেষ্ঠ ও গুণী মানুষদের সাথে কাজ করেছি। কাজ করেছি অপর্ণা সেনের সঙ্গে, ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে। ঋতুর সঙ্গে যখন কাজ করেছি ঋতু অন্য একটা পৃথিবী তৈরী করেছিল। সলিল চোধুরী ও মৃণাল সেনের কথা যেমন বললাম তেমন বাইরের বহু লোককে বলতে শুনি আমার আর ঋতুর বন্ধুত্বের কথা। আমরা যেসব কাজগুলো করেছি সেই সব কাজগুলো মানুষ ভালোবাসছে আজ এ আমার এক পরম প্রাপ্তি। আমার বন্ধুটি নেই আর। কি বলব। আমার প্রজন্ম আর তাঁর পরের প্রজন্ম-এর যাঁদের দেখছি বহু মানুষদের মধ্যে, বহু কিশোরের মধ্যে, বহু তরুণের মধ্যে আমি অনেক প্রতিভা দেখতে পাই। সেটা কবিতায়, সেটা ছবিতে, সেটা সিনেমায়, সাহিত্যে কিন্তু যেটা বলব আরেকটু ধৈর্য আরেকটু নিষ্ঠা প্রয়োজন। পরে থাকতে হবে। লেগে থাকতে হবে সেটা প্রয়োজন। আসলে ওরা তো এই সময়ের। এই সময়টাই তো বিক্ষিপ্ত। বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে সবাইকে। তবু সবাইকে আমার ভালোবাসা। ওদের কাছে আমার চাওয়া, তোমারা আরও মন দিয়ে, আরও ভালোবাসা দিয়ে, আরও আবেগ দিয়ে তোমরা তোমাদের নিজের কাজগুলোকে জড়িয়ে ধর। তোমরা আমাদের থেকে অনেক অনেক বেশি প্রতিভা ধারণ করেছ। শুধু প্রতিভা নয় করতে হবে একনিষ্ঠভাবে পরিশ্রম।

আমি নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে করতে আশ্চর্য হয়ে যাই। আমি ভুলে যাই আমি কোন প্রজন্ম থেকে আসছি। পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ হওয়ার কোনো বাসনা নেই আমার। আমি সব সময় মনে করি জন্ম ক্রমাগত হচ্ছে এবং কোনো মৃত্যু নেই। আর তাই এই মুহূর্তে আমিও আমার সতেরো বছরকে পেরিয়ে আসিনি। তাঁকে আঁকড়ে ধরেই আমি আছি। তাই এই প্রজন্মেও আমি ওদের সঙ্গে ওদের মতো করেই থাকি। আবার কখনো সেই মানুষটা যে আটের দশক থেকে এসেছিল সে এসে উঁকি মারে। সে অনেক কথা বলে। হুকুম জারি করে। কিন্তু তাকে আমি চেপে দিই। বলি সেই সময় তুমি তো অনেক কথা বলেছিলে, তোমার নিজস্ব ভিউ ছিল… আজকের প্রজন্ম এসেছে… ওদের নিজস্ব ভিউ আছে… সেগুলোকে ভালো করে দেখ। সেগুলো থেকে শেখ।    

বিশেষ ধন্যবাদ

অর্পিতা সরকার প্রামাণিক
মোহনা মজুমদার

আরও পড়ুন...