খে লা ই ডো স্কো প
এখনও চোখ বুজলে শুনতে পাই সেই মায়াময় শব্দটা, ‘মে—সি—য়া!’
শীতের রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়, লেপটা পছন্দমতো সাজিয়ে পাশ ফিরে শুই। মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ফাইনালে পেনাল্টিতে করা প্রথম গোলটা, তার পরে দ্বিতীয় গোলের সময় ম্যাক অ্যালিস্টারকে সাজিয়ে দেওয়া ব্যাকহিল। একস্ট্রা টাইমে লাউতোরো মার্তিনেজের শট লরিস বাঁচানো পরে ঠিক সময়ে বলে পা ছুঁইয়ে তৃতীয় গোল।
কিংবা ট্রাইব্রেকার শুরু হওয়ার আগে দু’বার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো। নিশ্চিন্তে গোলটা করে জিভটা অল্প বের করা। লুসেইল স্টেডিয়ামে ওই শব্দের বিস্ফোরণ! মেসি তো মেসিয়াই, যাকে বলে পরিত্রাতা। একটা প্রজন্মের হৃদয়ে লেখা রক্তাক্ষর।
বিশ্বকাপ কভার করে কাতার থেকে ফিরে এসেছি প্রায় মাসখানেক হতে চলল, এখনও পুরোপুরি মেসি-ম্যানিয়া থেকে বেরোতে পারিনি। আদৌ বেরোনো যায় কি? ওয়ান ডে-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে গোটা আটেক ক্রিকেট বিশ্বকাপ কভার করেছি। কিন্তু ফুটবলে বিশ্বকাপের উন্মাদনার মাত্রার সঙ্গে তার তুলনাই হয় না!
কাতারে পৌঁছনোর পর থেকে ফুটবল সমর্থকদের নানারকম খামখেয়ালিপনা আর পাগলামি দেখেছি। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে আর্জেন্তিনার প্রতিটি ম্যাচ দেখেছি, দেখেছি ব্রাজিলের ম্যাচও। চোখ বুজে বলে দিতে পারি, উন্মাদনা আর টিমের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যদি মাপকাঠি হয়, লা আলবিসেলেস্তে (আর্জেন্তিনা টিমের নাম) হাসতে হাসতে বাকি সব দেশের সমর্থকদের পাঁচ গোল মারবে। হ্যাঁ, ব্রাজিল সমর্থকদের কাছ থেকে দেখেই এই কথা বলছি। শুধু আর্জেন্তিনার দূতাবাসের হিসেব বলছে, প্রায় ৫০ হাজারের মতো আর্জেন্তিনীয় এসেছিলেন কাতার বিশ্বকাপ দেখতে।
ছোট্ট শহর দোহা, বিশ্বকাপের সময় হোটেল-অ্যাপার্টমেন্টের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। এসব সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে মূল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে আর্জেন্তিনীয়রা গড়ে তুলেছিলেন ছোটখাটো একটা বুয়েনস আইরেস। জায়গাটার নাম আল জনৌব, মরুভূমির কাছাকাছি। সেখানে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং ভাড়া করার পাশাপাশি তাঁবু খাটিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু খুঁজে নিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। কনকনে ঠাণ্ডায় কোনওরকমে একটা স্লিপিং ব্যাগে নিজেকে মুড়ে একটা শুকনো বার্গার চিবিয়ে রাত কাটিয়েছেন বহু আর্জেন্তিনীয়। কোনও অভিযোগ নেই, কাকুতি-মিনতি নেই, ফুটবলের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা আছে। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে মেসিরা জেতার দিন স্টেডিয়ামে আলাপ আর্জেন্তিনীয় জুটি সিজার আর ব্যালেন্তিনার সঙ্গে। কত বয়স হবে? সুপুরষ যুবক সিজার বড়জোর ২৫, প্রেমিকা সোনালি চুলের ব্যালেন্তিনা মেরেকেটে ২২! বছর চারেকের প্রেম। ভালোই ইংরেজি জানে দু’জনে, কথা চালাতে গুগল ট্রান্সলেটরের দরকার হচ্ছিল না।
চার বছর আগে রাশিয়ার বিশ্বকাপে যখন ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ হেরে ছিটকে গিয়েছিল নীল-সাদা জার্সি, বুয়েনস আইরেসে সিজারের অ্যাপার্টমেন্টে টিভির সামনে বসে কেঁদে ভাসিয়েছিল ব্যালেন্তিনা। প্রেমিকার মুখের দিকে তাকিয়ে সিজার বলে ফেলে, ‘কী একটা রাত! ওর কান্না সামলানো যাচ্ছে না। আমরা বারবি কিউ করেছিলাম, ওয়াইন কিনেছিলাম। সব পড়েছিল। কারণ, ব্যালেন্তিনা ধরে নিয়েছিল, মেসি আর পরের বিশ্বকাপে খেলবে না! তাই এ বার যখন আমরা এক বছর আগে কোপা আমেরিকা জিতলাম, ব্যালেন্তিনাই ঠিক করল, কাতার যাবে!’ সেই আমাদের অল্প অল্প করে অর্থ জমানোর শুরু। তার পরেও ডলার ধার করতে হয়েছে, কিন্তু বুয়েনস আইরেস থেকে কাতারের প্লেন ধরতে ভুল করেনি প্রেমিক-প্রেমিকা।
ব্যালেন্তিনা পাশ থেকে বলছিল, ‘ইউ নো হোয়াট? হোয়েনেভার আয়াম ইন এনি কাইন্ড অফ ট্রাবল ইন লাইফ, আই থিঙ্ক অফ মেসি! এভরিটাইম হি সেভস মি!’
সিজার নিজে ছোটখাটো ব্যবসা করে, কিন্তু কাতার আসার প্ল্যানে সমস্যা ছিল ব্যালেন্তিনার চাকরি। ব্যালেন্তিনার অফিস বিশ্বকাপের জন্য এক মাস ছুটি দিতে রাজি হচ্ছিল না। তার পরে?
সিজার উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, ‘ব্যালেন্তিনা এক কথায় ভালো একটা কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দিল!’
পাশ থেকে ব্যালেন্তিনা যোগ করে, ‘জব ক্যান কাম অ্যান্ড গো। হু কেয়ারস! আই লাভ মেসি। সো আয়াম হিয়ার টু উইটেনস হিস্ট্রি!’
যে মেয়ের অস্থি-মজ্জা, শিরায় শিরায় মেসি-মায়া ঢুকে পড়েছে, সে-ই তো পারে এমন পাগলামি করতে! এ পাগলামির পিছনে ভণ্ডামির বদলে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আছে, মেসি-মায়ার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা আছে, তার জন্য প্রবল বিশ্বাস আর এক আকাশ ভালোবাসা আছে।
আমি অবাক হচ্ছি দেখে সিজারকে কী একটা বলল ব্যালেন্তিনা। এ বার সিজার বলল, ‘আপনি একবার আল জনৌবে আসুন। দেখবেন কীভাবে শুধু মেসির জন্য এই বিশ্বকাপে এসেছে নতুন প্রজন্ম। দিয়েগো আমাদের দেশে ঈশ্বর, বাবা-কাকাদের কাছে ওঁর কথা শুনেছি। টিভিতে ছিয়াশির গোলগুলো দেখেছি। বিশ্বজয় দেখেছি। কিন্তু মেসি আমাদের রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। আপনাকে লুসিওর কথা বলি!’
কে লুসিও?
‘বয়স ৮২, মাস পাঁচেক আগে হাইওয়েতে গাড়ি দুর্ঘটনায় স্ত্রী, ছেলে-বউকে হারিয়েছে। ছেলে মেসির ভক্ত ছিল। এ বার বাড়ি বন্ধক রেখে বিশ্বকাপে এসেছে ছেলের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে!’ বলছিল সিজার।
কেন?
সিজার বলে ওঠে, ‘ঠিক ছিল, ছেলে বৃদ্ধ বাবাকে কাতারে নিয়ে আসবে বিশ্বকাপ দেখতে। লুসিও বিশ্বাস করে, স্টেডিয়ামে প্রতিটি ম্যাচে ছেলে ওর পাশে বসে থাকে। মেসিকে দেখে। আর্জেন্তিনাকে দেখে। রাতে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ছেলের সঙ্গে আপনমনে মেসির গোলগুলো নিয়ে কথা বলে। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচটা আমরা হেরে যাওয়ার পর সারা রাত লুসিও ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিল, বুঝিয়েছিল, কেন হাল ছাড়তে নেই!’
কীভাবে ব্যাখ্যা করি এই বিষাদময় ভালবোসার? এই চিরকালীন বিশ্বাসের? ফুটবল পারে, সব পারে। বদলে দিতে পারে জীবনের মানে!
বিরাশির লুসিওর সঙ্গে দেখা হয়নি, এই আফশোস সারা জীবন থাকবে। কিন্তু কল্পনা করতে পারি, লুসেইল স্টেডিয়ামে বিশ্বজয়ের রাতে ছেলের সঙ্গে বসে ও নিশ্চয়ই ওয়াইনে চুমুক দিয়েছে! দু’জনে হাই-ফাইভ করেছে।
কবি বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!’
লুসিও-ই আসলে প্রকৃত সারস, যে উড়ে যাচ্ছে। মেসির দিকে, ফুটবল-ঈশ্বরের দিকে!