Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গ ল্প

ম হু য়া   স মা দ্দা র

mahuya

উপহার

–“কত দিন বলেছি বাথরুম থেকে বের হলে লাইটটা অফ করবে। মনেই থাকে না নাকি? মনে থাকবেই বা কেমন করে! সারাদিন শুধু ফোনে কী ছাইপাঁশ লিখে চলেছে! আর মনে থাকে কিছু!  ছেলেটাও হয়েছে তেমনি!  বৌকে শাসন করবি কোথায়, তা নয়, মাথায় তুলে ধেই ধেই করে নাচছে। আজ বারাসত তো কাল মালদায় নিয়ে ছুটছে। বৌ নাকি সাহিত্যিক হবে! ছ‍্যাঃ। সাহিত্যিক না ছাই। 

আমরা তো কোন ছোট্টটিতেই শ্বশুর ঘরে এয়েছিলুম। তারপর থেকেই তো স্বামী, সংসার, সন্তান। এর বাইরে কিছু ভেবেছি কোনও দিন? এত ভালো গাইতাম, সেই গানও ছেড়েছি।… আর বাবু তোকেও বলি এত দামি ফোন ঘরের মেয়েমানুষের হাতে দেওয়া কেন বাপু?”

বেশ রাগত স্বরেই কথাগুলো বলছিলেন সীমাদেবী।

–“আঃ মা, তোমায় কত দিন বলেছি না এভাবে কথা বলবে না? নিজে মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে মিনিমাম রেসপেক্ট তো করো? আর রোজ একই কথা বলা কেন শুনি? ফোনটা তো ও শুধু কাজের জন্য ব‍্যবহার করে মা। পর্ণা লিখতে চায় লিখুক না। মেয়ে হলেই কি শুধুই সংসার, স্বামী, সন্তানেই আটকে থাকতে হবে? ওর গুণ আছে মা। গুণটাকে কাজে লাগানোই ভালো নয় কি?” ধীরে ধীরেই কথাগুলো বলল বিকাশ। এই রকম কথা চালাচালি রোজ চলে ছেলে আর মায়েতে। 

পর্ণা, বছর ছাব্বিশের সুন্দরী, বাংলায় এম.এ. পাশ মেয়ে। ছোট থেকেই লেখালেখি করে। নানা নামী পত্রিকায় গল্প, উপন্যাস বের হয়। নানা জায়গা থেকে ডাকও আসে। স্বামী বিকাশ কখনও এতে বাধা দেয়নি। বরং উৎসাহই দিয়েছে। শুধু পর্ণার শ্বাশুড়ি সহ্য করতে পারে না। পর্ণা বুঝতে পারে, আসলে আগেকার দিনের স্বল্প শিক্ষিত মানুষ বলেই হয়তো এমন। এমনিতে মানুষটা ভালোই। পর্ণার পছন্দের খাবার আচার, নাড়ু এসব সবসময় নিজের হাতে বানিয়ে রাখেন। পর্ণার শরীর খারাপ হলে এই মানুষটাই কি ভীষণ শান্ত হয়ে যান! 

সীমাদেবী আছেন বলেই পর্ণাকে সংসারের ব‍্যাপারে মাথাই ঘামাতে হয় না। শুধু যা একটু বকবক করেন। সব ভালো যার এটুকু তো সহ্য করে নেওয়াই যায়!  

আর দশটা মেয়ের থেকে পর্ণা আলাদা, সীমাদেবী বেশ বোঝেন। হাজার বকাবকি করলেও মুখে একটি কথাও বলে না মেয়ে। বাবু নতুন দামি ফোন কিনে দিয়েছে বলে রাগারাগি করেছেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তারিফ করেছেন ছেলের। অন্তত ছেলেটা বাবার মতো হয়নি। হাড়কিপ্টে অতুলবাবু, সীমাদেবীর স্বামী কোনও দিনই বউয়ের কোনও শখ আহ্লাদ মেটাননি। এমনকি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও বড়ই মাপা। স্বামী-স্ত্রীর যে বন্ধুত্বের সম্পর্কও হয়, তা কোনও দিনই বুঝতে পারেননি তিনি। গান গাইতে ভালবাসতেন সীমাদেবী। কতদিন বলেছিলেন, একটা হার্মোনিয়াম কিনে দিতে। কিন্তু না। কোনও দিনও দেননি। পুজোতে কোনও দিনও সীমাদেবীকে নিয়ে যাননি শাড়ি কিনতে। পাছে বেশি দামের শাড়ি দিতে হয়! সতেরো বছরে মাধ‍্যমিক পাশের পরেই বিয়ে হয়ে যাওয়া সীমাদেবী দশ জনের সংসারে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো সান্ত্বনা পাননি। বাবু সবে চাকরিতে ঢুকেছে, স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন অতুলবাবু। ততদিনে সংসারে এক হাঁড়ি আর নেই। অতুলবাবুর ভাইরা সবাই ছেলে মেয়ে ছোট থাকতেই হাঁড়ি আলাদা করেছেন। বাবুর পাঁচ বছর চাকরির মাথায় পর্ণাকে পছন্দ করে নিয়ে আসেন সীমাদেবী। 

পর্ণার চোখদুটো কেমন যেন দুঃখী দুঃখী। মা মরা মেয়ে তো। বুকে কেমন যেন চিনচিনে কষ্ট হয়েছিল মেয়েটার জন্য। তাই আর বাক‍্যান্তর না করে পর্ণাকেই বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলেন। 

ওরা সেবার পুরী গেছিল ঘুরতে। সীমাদেবীকেও বারেবারে অনুরোধ করেছিল পর্ণা। কিন্তু সীমাদেবী ইচ্ছে করেই যাননি সেবার। থাক, দুটোতে ক’দিন একসাথে ঘুরে আসুক। পর্ণার ঘরেই বেশিরভাগ ওষুধ রাখা থাকে। হঠাৎ খুব পেটের গণ্ডগোল হওয়ার জন্য ওষুধ নিতে ঢুকেছিল ছেলে-বৌমার ঘরে। ওষুধ নিতে গিয়ে দেখল একটা বেশ নামকরা পত্রিকা ওদের খাটে পড়ে আছে। একা একা কাজ বিশেষ কিছু নেই বলেই হাতে করে পত্রিকাটি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তারপর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা গল্পে চোখ আটকে গেছিল। গল্পের লেখিকা পর্ণা রায়। অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প ‘ঠিকানা-চোরাবালি’। গল্পটা পড়তে পড়তে দু’চোখে জল আর বাঁধ মানেনি। একটি মেয়ের জীবন নিয়ে লেখা। কিন্তু এই মেয়েটির জীবনের সঙ্গে কোথায় যেন তাঁর জীবনের বড় মিল! তবে কি আমার জীবন নিয়েই লিখেছে পর্ণা! এত বোঝে পর্ণা আমায়!… বিড়বিড় করেছিলেন সীমাদেবী। 

 সেই শুরু। তারপর থেকেই পাড়ার মোড়ের ম‍্যাগাজিন কর্ণার থেকে সূচিপত্রে পর্ণার নাম রয়েছে সেই সব পত্রিকা সংগ্ৰহ করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেন সীমাদেবী। পর্ণাকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দেননি এসব বিষয়। কারণ, এতদিন ধরে যে লেখা নিয়ে এত গালমন্দ করেছেন, তাকেই যে আজ সীমাদেবী এত ভালবাসেন সেটা পর্ণা জানলে লজ্জা বাড়বে বৈকি। 

বিয়ের পর থেকেই পর্ণা লক্ষ্য করেছে কাজ করতে করতে সীমাদেবী গুনগুন করে গান করেন। বেশ সুন্দর গলা তাঁর। একদিন কথায় কথায় সে শুনেছিল তাঁর একটা হার্মোনিয়ামের ভীষণ শখ ছিল একসময়ে।

সীমাদেবীর শরীরটা আজ কয়েকদিন ভীষণ খারাপ। হাঁটুর ব‍্যথায় কাহিল। সীমাদেবী স্নানে গেছেন দেখে পর্ণা ভাবল, ওঁর ঘরটা একটু গোছাবে। টেবিল, খাট ইত্যাদি গোছাতে গিয়ে তোষকের একটা পাশ উঁচু দেখে সেটাকে ঠিক করতে গিয়ে দেখে কতগুলি পত্রিকা তোষকের তলায় রাখা। সেগুলি টেনে বের করল পর্ণা। 

ও অবাক হয়ে দেখল, তারই লেখা যেসব গল্প নানান ম‍্যাগাজিনে বেরিয়েছে সবগুলি সীমাদেবী নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন! –তার মানে আমার লেখা মা পড়েন! পছন্দও করেন নিশ্চয়ই। তাই জন‍্যেই এভাবে নিজের কাছে রেখেছেন!— পর্ণা বিড়বিড় করে বলল। কয়েক ফোঁটা জল চোখ থেকে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল। বাথরুমের শব্দ পেয়েই পর্ণা বইগুলি যেমন ছিল রেখে বেরিয়ে এল। 

***

আজ পর্ণার একটি বড় উপন্যাস ভীষণ নামী একটি পত্রিকা কিনে নিয়েছে। বেশ ভালো টাকাই দিয়েছে ওরা। বাজারে এসেছে পর্ণা। সবার জন্য কিছু কিছু উপহার কিনবে। সবার জন্য এটা সেটা কেনার পর কী মনে হতে একটা হার্মোনিয়ামের দোকানে ঢুকল পর্ণা। দেখেশুনে একটা ভালো হার্মোনিয়াম কিনে বাড়ি ফিরল। 

দুপুরে শুয়ে ছিলেন সীমাদেবী। চোখটা লেগে এসেছে সবে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল তাঁর। কাকে যেন পর্ণা বলছে– “এই যে, এইদিকে। হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ এইপাশে।” আরে! তার ঘরের দিকেই তো পর্ণা কাকে যেন নিয়ে আসছে! লোকটার  মাথায় আবার কী! সেই কখন মেয়েটা বেরিয়েছে ‘একটু আসছি’ বলে। এতক্ষণে এল। তাও আবার কাকে সঙ্গে নিয়ে!   

ধড়মড় করে উঠে বসলেন সীমাদেবী। দেখলেন একটি লোক মাথায় একটি বাক্স নিয়ে এসে তাঁর খাটের এক কোণে নামিয়ে রেখে গেল। লোকটি বেরিয়ে যেতেই পর্ণা বাক্সটা খুলে একটা হার্মোনিয়াম বের করে সীমাদেবীর সামনে রেখে বলল, “মা দেখো দেখি বাজিয়ে, কেমন বাজছে।” 

সীমাদেবী চোখ বড় বড় করে বললেন– “ও মেয়ে, তুই কি লেখালেখি ছেড়ে এবার গান শিখবি নাকি?” 

পর্ণা সীমাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল– “মা, এটা শুধু তোমার। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে সংসারের পেছনেই পড়ে রইলে। কত স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছ। তুমি বলেছিলে না, তোমার খুব শখ ছিল হার্মোনিয়ামের। তাই আমার নিজের উপার্জনের টাকায় তোমার জন্য এটা এনেছি। তোমার পছন্দ হয়নি মা?” 

সীমাদেবী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছেন পর্ণার দিকে। 

 –“আমার জন্য হার্মোনিয়াম! তাও আবার ওর লেখালেখির টাকায়! যে লেখালেখিকে আমি সারাদিন গালমন্দ করি! বাবু আজ এত বছর চাকরি করছে, কই ওর তো মনে পড়েনি এই কথা! আর এই মেয়েটা সারাদিন আমার বকাঝকা খায়, তারপরেও ওর পাওয়া টাকা দিয়ে আমার জন্য এইরকম উপহার নিয়ে এসেছে!”— মনে মনে বললেন সীমাদেবী। চোখ দুটোতে জৈষ্ঠের প্রবল গরমেও শ্রাবণ নেমেছে জোর। 

দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন পর্ণাকে। পর্ণারও চোখের কোণে জল। মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল— “তুমিই তো আমার ছোট্টবেলার হারিয়ে যাওয়া মা। নইলে, আমার লেখা এভাবে সব গুছিয়ে রেখে দাও! রান্নার লোক থাকতেও আমার পছন্দের খাবার এত শরীর খারাপ নিয়েও তুমি বানাও! তুমি আমার সোনা মা।” 

বিকাশ সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একটা শান্ত, সুন্দর পরিবেশ আবিষ্কার করেছিল। তার মা সীমাদেবী নিজের ঘরে বিছানার উপর বসেছিলেন হার্মোনিয়ামটি নিয়ে— বাম হাত বেলোতে আর ডান হাতের পাঁচটা আঙুল পরমযত্নে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটা রিড থেকে আরেকটা রিডে। মাকে জড়িয়ে ধরে একনিষ্ঠ মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে বসেছিল পর্ণা। কলিং বেল-এ হাত রেখে, মায়ের ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে, কতক্ষণ যে নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিকাশ ঠিক খেয়াল নেই তার। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে এমন উপহারের জন্য প্রস্তুত ছিল না সে।  

আরও পড়ুন...