Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

প্র সে ন জি ৎ   দা শ গু প্ত

prasenjit

আগুনের আরেক নাম: সুমেইরা ওয়ারিশ

লাহোর, সাল ২০১২। অল পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্সের বার্ষিক সম্মেলন।

সেই মিউজিক সার্কেল, ১৯৫৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ জনাব হায়াত আহমেদ খান ও মুষ্ঠিমেয় কিছু গানপাগল মানুষ লাহোরের বিখ্যাত কফি হাউসে বসে যার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। হায়াত আহমেদ নিজে ছিলেন গান্ধর্ব সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তনী।

পাঁচের দশকে তখন এক অস্থির সময় যখন একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে পাকিস্তানের সাঙ্গীতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়। শরিয়াতি ধ্যানধারণায় সম্পৃক্ত ও দেশে সমঝদার শ্রোতার অভাবে যখন চিরতরে রেওয়াজ, অনুষ্ঠান করা বন্ধ করার কথা ভাবছেন ‘মালিকা ই মৌসিকী’ রোশনারা বেগম।

পাকিস্তানে কট্টরপন্থী মানসিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাতারাতি পাক মিট্টি ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান। যখন ‘মৌসিকী’ মানেই ‘হারাম’, ‘গানা-বাজানা’র কথা শুনলে লোকে ‘তওবা তওবা’ করে, চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রক্তচক্ষু মৌলবাদীদের ‘না-পাক’ দাপট। পাকিস্তান একটু একটু করে যখন তলিয়ে যাচ্ছে অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি ও ধর্মান্ধতার অন্ধকারে… হায়াত আহমেদ পরে জানিয়েছিলেন— “We were submissive by force, not by choice. We need to find a way out.” [সূত্রঃ দ্য ডন নিউজপেপার] সেই ক্ষোভই পরে আমরা ধ্বনিত হতে শুনি বিখ্যাত এক বলিউডি থ্রিলারে।

এই মানুষ গুলিই তখন দেখিয়ে ছিলেন ‘নিশান’, দিয়েছেন ‘আলোর সন্ধান’। সরকারি শাসনতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা ও কট্টরপন্থীদের হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৬০ সালে ১৯-২৩ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত করেন ছ’দিনের সেই মিউজিক কনফারেন্স। গোটা পাকিস্তান ভেঙে পড়েছিল সেই সঙ্গীত সম্মেলনে। সেই কনফারেন্স পরবর্তী কালে ‘রৌশন’ করেছেন রোশনারা বেগম, মিঁয়া কাদের বক্স পাখোয়াজি, উস্তাদ বড়ে গুলাম, শরিফ খান পুঁছওয়ালে সহ নজাকৎ-সলামৎ, তুফৈল নিয়াজি, আমানত আলী, বড়ে ফতেহ আলী বা নাসিম বেগমের মত বিখ্যাত কলাকারেরা। বাকিটা ইতিহাস। পাকিস্তানে খুলে যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চার নয়া দিগন্ত।

ফিরে আসা যাক প্রায় দশ বছর আগের সেই ঘটনায়। পাঁচদিনের মিউজিক কনফারেন্সের শেষদিনে ছিল তালবাদ্যের প্রতিযোগীতা। ছ’জন ফাইনালিস্টের পাঁচ জন ইতিমধ্যেই পারফর্ম করেছেন। মাইকে যার নাম ঘোষণা করা হল তা শুনে চমকে গেলেন বিচারক-উপস্থিত দর্শকেরা।

মঞ্চে এলেন বছর বাইশের এক সদ্য তরুণী। সাথে তাঁর ‘ওয়ালিদ’ ওয়ারিশ উমেইদ ও ‘গুরু’ পঞ্জাব ঘরানার বিখ্যাত তবলিয়া উস্তাদ কাসিফ আলী দানি। বিচারকদের মধ্যে তখন শুরু হয়েছে জল্পনা যে এক ‘খওয়াতিন’ (মহিলা) বাজাবে তবলা! এ যে অবিশ্বাস্য! তাও এই রোগাপাতলা মেয়ে, যার মাথায় ‘হিজাব’, শরীর ঢাকা পাতলা লাহোরি কামিজে, চোখ দুটি উজ্জ্বল…তাঁদের বিস্ময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। এই তরুণীরই নাম ছিল সুমেইরা ওয়ারিশ।

পাকিস্তানে পূর্বে তবলায় নিজ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন আরেক মহিলা— আমিনা চিশতি। মার্কিন নাগরিক আমিনা ২০০১ সালে গাণ্ডা বেঁধে ছিলেন পঞ্জাব ঘরানার প্রথিতযশা তবলিয়া উস্তাদ দিলদার হুসেইনের কাছে যিনি একসময় নুসরত ফতেহ আলী খানের সাথে সঙ্গত করে বিশেষ খ্যাতি কুড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তী কালে পাকিস্তানে শাস্ত্রীয় তবলাবাদনে ঝড় তুলেছিলেন চিশতি, তবু পাকিস্তানের ‘ডটার অফ দ্য সয়েল’ সুমেইরা ওয়ারিশ-কে প্রথম পেশাদার ‘মহিলা’ তবলিয়া রূপেই এগিয়ে রাখেন সে দেশের ‘ফনকার’ ও ‘সমঝদারে’রা।

সেদিন বিচারক-দের মুগ্ধ করেছিলেন সুমেইরা। ‘সুননেওয়ালে’দের চমকে দিয়ে তিন তালে তুলে ধরেছিলেন ‘লহরা’। পঞ্জাব ঘরানার বহু বিশ্রুত বোলবাট, টুকরা, পেশকার সে’দিন খেলা করেছিল তাঁর আঙুলে। এককথায় ‘সুমেইরিয় ঝড়ে’ সেদিন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন সকলে। সকলের মন জয় করে পঞ্জাব ঘরানার কিংবদন্তি খলিফা মিঁয়া কাদের বক্স খান সাহেবের নামাঙ্কিত গোল্ড মেডেল জিতে নিয়েছিলেন সেই ‘দুবলা-পাতলা’ মেয়েটি।

এরপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সুমেইরা ওয়ারিশ-কে। গত আট বছর ধরে করেছেন অজস্র অনুষ্ঠান। পেয়েছেন বহু সম্মান, খ্যাতি। অথচ এত সহজ হয়নি তাঁর তবলা-জীবন। একেই পাকিস্তানে আজও একটি বড় অংশ ‘মৌসিকী’কে ‘হারাম’ মনে করেন, সেখানে কিনা এক মেয়ে বাজাচ্ছে তবলা…এতেই রে রে করে উঠেছিলেন অনেকে।

সুমেইরার বাবা সুগায়ক এবং হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুরাগী ওয়ারিশ উমেইদ জানিয়েছেন, মেয়েকে তবলা শেখানো নিয়ে তাঁর পরিবারে ওঠে সমালোচনার ঝড়। সমালোচনা ও নিন্দা শুরু হয় সমাজেও। লোকে বলতো এ কেমন মেয়ে, ‘হিজাব’ পড়ে আবার তবলাও বাজায়। যে ‘মৌসিকী’ কিনা ‘হারাম’ তাই চর্চা করছে এই একরত্তি মেয়েটি।  ‘তবলেওয়ালি’, ‘বাজানেওয়ালি’ নাম দিয়ে শুরু হয় টিটকিরি, ঠাট্টা-তামাশা। পরিস্থিতি এমন হয় যে ঘরের বাইরে বেরনো হয়ে গিয়েছিল প্রায় বন্ধ। সুমেইরা জানিয়েছেন, “বন্ধ ঘরে বসেই রেওয়াজ চালিয়েছি। কষ্ট হতো। মন খারাপ হতো। চোখ দিয়ে নেমে আসতো জল। নোনা জল এসে পড়তো তবলায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও রেওয়াজ বন্ধ করিনি।” তিনি বলেন, “হিজাব আমার ধর্মীয় আনুগত্য ও সহনশীলতার চিহ্ন, তবলা আমার বেঁচে থাকার রসদ। এটাই আমি, এটাই আমার পরিচয়।”

সেই সময় তাঁর বাবাকে পাশে পেয়েছিল সুমেইরা। বাবা ভরসা দিয়েছিলেন, ‘ভয় পেও না, হউসলা হারিয়ো না। রেওয়াজ করে যাও।’ সুমেইরার ছোট ভাই সুলেমান ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। চমৎকার গান গায় ও হারমোনিয়াম বাজায় সুলেমান। দিদির সাথে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করে সেই। বাবার কাছে তবলায় প্রাথমিক হাতেখড়ি হওয়ার পর উস্তাদ কাসিফ আলী দানির কাছে তালিম শুরু হয় তাঁর। সুমেইরার সম্মন্ধে উচ্ছ্বসিত কাসিফ আলী দানি বলেন, “শুধু তবলাই নয়, সুমেইরা ভেঙেছেন সেই চিরাচরিত মধ্যযুগীয় মানসিকতা যে মেয়েদের গান বাজনা করা বারণ। মেয়েরা শুধুই পরিবারের চার দেওয়ালে বন্দী, স্বামী-সংসার-সন্তানের বাইরে নেই তাঁদের অস্তিত্ব, সেই ধ্যানধারণাকে তবলার বোলের মত ভেঙেচুরে নিজের মতো বানিয়েছে সুমেইরা। সে দেখিয়েছে মেয়েরা চাইলে সব পারে। তবলা শুধুই পুরুষদের কুক্ষিগত নয় তা প্রতিষ্ঠা করেছে সুমেইরা। তাঁর দেখানো পথেই নতুন করে উৎসাহ পাবে এই দেশের হিজাব, বুরখার আড়ালে ঢাকা পড়া হাজার হাজার মেয়েরা।”

আজ পাকিস্তানে নারী স্বাধীনতা ও অধিকারের আরেক নাম সুমেইরা ওয়ারিশ। তবলা যার অস্ত্র। সংগীত যার আয়ুধ। ড. অবন মিস্ত্রী, অনুরাধা পাল, সুনয়না ঘোষ, রিম্পা শিব, মিঠু টিকাদার, রত্নাশ্রী আইয়ার, পায়েল কোতগিরকর, দেব্যানী শ্যাম মিশ্র, মিতালি তেজস ভিনচুরকার, রেশমা পণ্ডিত’দের মত সেই ‘অসামান্যা’ ব্যাতিক্রমী ‘মহিয়সী’দের দলে তিনি নব্য সংযোজন।

তিনি সুমেইরা ওয়ারিশ। যিনি শিখিয়েছেন হিজাব, বুরখার আড়ালেও ঝলসে উঠতে পারে অনির্বাণ বিদ্যুৎ শিখা। অপ্রতিরোধ্য, অদম্য তবলার বোলে।

আরও পড়ুন...