Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

চ রৈ বে তি

প ল্ল বী  ম জু ম দা র

pallavi

একফোঁটা ইয়ুকসম । পর্ব ১

গরম লাগলে তিব্বত যাবার কথা সবাই বলে বটে, কিন্তু সত্যি সত্যিই যে কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট হয়ে তিব্বতের কাছে পৌঁছনো যায়, এ কথা জানে ক’জন? আমি তো অন্তত অ্যাদ্দিন জানতুম সুকুমার রায় নেহাত ঠাট্টাচ্ছলেই ব্যাপারটা লিখে গিয়েছেন। কিন্তু এ বছর প্রবল গরমে যখন কলেজ-ইশকুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে হইহই করে হপ্তাখানেকের ছুটি পড়ে গেলো, সব বাঙালি রইরই করে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ছুটতে লাগল, ওয়েটিং লিস্টেও ট্রেনের টিকিট চইচই করে নিলাম হবার জোগাড় হলো, তখন তিব্বত তিব্বত মন হওয়াতে বাসের টিকিট খুঁজতে বসে দেখলুম, পথ ওই একটাই, রায়মশাই যা বলে গিয়েছেন। সওয়া ঘণ্টার নয় অবশ্য। ঘণ্টা বারো-তেরো লাগবে বাসে। কিন্তু রাস্তা ওটাই। বাস আজকাল ট্রেনের মতোই হয়েছে। বসে বসে ঠ্যাংয়ে-মাজায় ব্যথা চাগিয়ে, রাতের ঘুম রাস্তার নামে উৎসর্গ করে, বমি করতে করতে যেতে হয় না। এ ভারি আরামের বাস। স্লিপার বাস। শুয়ে বসে যাওয়া চলে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। তারপর গাড়ি করে যে পাহাড়ে যেতে চাও যাও। 

বাস জুড়ে লম্বা লম্বা ট্রেনের মতো বার্থ নীচে ওপরে। হাঁটু ব্যথা না থাকলে ওপরেরগুলোতেই যাত্রা লোভনীয়। ডাইনে বাঁয়ে বিরাট কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে, বাড়ি থেকে আনা পরোটা-আলুচচ্চড়ি খেতে খেতে যাওয়া চলে দিব্যি। বাস ছাড়ে ধর্মতলা থেকে সন্ধে ছ’টা বা সাড়ে ছ’টায়। টিকিট অনলাইনে কেটে বাসের খোলে মালপত্তর ঢুকিয়ে চড়ে বসলেই, ব্যস! তবে যাঁদের মোশন সিকনেস আছে, তাঁরা বমির ওষুধ আর লজঞ্চুশটি পকেটে রাখবেন, কারণ কেষ্টনগর পর্যন্ত রাস্তা না সাহারার বালিয়াড়ি তা বোঝা মুশকিল। ফলে বাস বাবাজিকে ক্লাচ ও ব্রেকের ব্যবহার একটু বেশিই করতে হয়। তাতে মাথা টলমল করলে বা গা গুলোলে মুশকিল। তবে হ্যাঁ, এ বাসের অন্যতম সমস্যা হল, বাসে শৌচাগার নেই। রাস্তারগুলিই ভরসা। যদি বাথরুম নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত হন, তাহলে এ যাত্রা আপনার বাসযাত্রা হল না। ট্রেনের টিকিটের জন্য হাপিত্যেস করাই কপালে লেখা আছে।

কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় ধর্মতলা থেকে বাস নড়ে উঠল। প্রথম স্টপেজ কেষ্টনগর, শিডিউল টাইম রাত্তির এগারোটা। ধাবায় থামবে। সেখানেই হাতমুখ ধোয়া, নৈশাহার, শৌচাগার ইত্যাদি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, মহিলাদের কথা ভেবে বাস বাবাজি চাকদহে রাত দশটা নাগাদ থামলেন। সেখানকার রেস্ট এরিয়ার ঝকঝকে টয়লেটে কাজ সারা গেল আরামে। তারপর কেষ্টনগরে পেটপুজো সেরে বার্থে উঠে ঘুম। চামড়ায় বাঁধানো বালিশ, ঘন নীল হালকা কম্বলের আরামে অল্পস্বল্প ঝাঁকুনি গায়ে লাগবে না, কারণ কেষ্টনগরের পর থেকে রাস্তা মাখন। সিটও ভারি আরামের। 

সকাল সাড়ে সাতটায় তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডে আমাদের বমাল-সমেত নামিয়ে দিলো গ্রিনলাইনের বাস। আমরা যাবো সিকিমের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ইয়ুকসম। এ ঠিক বাঙালি ট্যুরিস্টের টিপিকাল গন্তব্য নয়, এখানে বেশি দেখা যায় ট্রেকারদের, কারণ এখান থেকেই শুরু হয় হিমালয়ের নামকরা গোয়েচালা আর জ়োংরি ট্রেক। তাই পাহাড়-চড়ার পোকা কামড়ানো দল ওঠানামার পথে থামেন এখানে, রাতটুকু জিরিয়ে নেন, ট্রেকিং সামগ্রী ভাড়া বা জমা করেন, রাস্তার রসদ তুলে রওনা দেন। আমরা আলসের ডিম, পাহাড়ে চড়ার ব্যাপারে ক্যাপটেন হ্যাডকের বাণীই আমাদের পাথেয়। পাহাড়ে উঠে লাভ কী? সেই তো আবার নেমে আসতে হবে। আমরাও মনেপ্রাণে এ বাক্যে বিশ্বাসী। তাই শিলিগুড়ি থেকে সুবাসের গাড়িতে চেপে আরাম করে ধীরে সুস্থে রওনা দিলুম ইয়ুকসমের দিকে। সেখানে আমাদের যাদবপুরের জনা তিন-চার ছেলেপুলের খোঁজ পেয়েছিলুম, যারা সকলে মিলে দারুণ এক হোটেল ব্যবসা চালাচ্ছে। ট্রেকের ব্যবস্থা তো করেই, আমাদের মতন আলসেগুঁড়িদের জন্য কাছাকাছি ঘোরার ব্যবস্থাও করে দেয়। তাদেরই একজন, কংকণ আমাদের নিতে এল শিলিগুড়িতে। কংকণ ওএনজিসি-তে বড় চাকরি করলেও আসলে সে ট্রেল-রানার, ট্রেকার, বাইকার। এই সমুদ্রে সি-সারভাইভালের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আবার এই একছুটে উঠে যাচ্ছে পাহাড়চুড়োয়। এহেন কংকণ এক মিনিটেই পুটাইয়ের কংকণমামা হয়ে গেল। সকলে মিলে রওনা দিলুম সুবাসের সুইফট গাড়িতে চড়ে। 

শিলিগুড়ির বিখ্যাত লাড্ডুগোপালের দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে টুকটুক করে পাহাড়ে উঠছি। সেবক ছাড়িয়ে রাস্তা প্যাঁচাচ্ছে, সবুজ বাড়ছে, চড়াই বাড়ছে। বাঁয়ে কুলকুল করে সঙ্গ দিচ্ছে তিস্তা। নদীর হাওয়া খাচ্ছি মন দিয়ে, আচমকা সুবাস বলে কিনা, যাবার পথে মেল্লি নামে এক জায়গায় তিস্তায় রিভার রাফটিং করা যায়, করবেন দিদি? দিদির চক্ষুস্থির। আমি? পারব? লক্ষ্মণভাই, থুড়ি কংকণভাই বলে ওঠে, ‘কেন পারবেন না? লাইফ জ্যাকেট আছে না? ডুবতে চাইলেও ডুববেন না। রাফট থেকে পড়ে গেলেও ভাসবেন।’ দিদি নেচে উঠলেন। দিদির খুদে সঙ্গী কিঞ্চিৎ ভীত। কিন্তু কংকণমামার উপর আস্থাও অগাধ। অতঃপর মেল্লিতে নেমে পড়লুম সুবাসের গাড়িতে জুতোজোড়া খুলে রেখে। বিশাল এক হাওয়া-ফোলানো রাবারের বোট জিপসির মাথায় চাপিয়ে রাফটিংয়ের দল আমাদের নিয়ে চলল অনেক নীচের তিস্তাপাড়ে। আমরা দেবা-দেবী-খুদে, সঙ্গে কংকণ আর সুবাস রক্ষেকর্তা। নৌকোয় আমাদের সঙ্গে থাকবেন দুই বাহাদুর রাফটার দীপংকর আর দীপচন্দ। জিপসি থেকে বোট নামিয়ে দীপংকর আর দীপচন্দ তরতর করে পাহাড়ি পাথুরে পথে নীচে নামতে লাগল। এদিকে আমার পা তো খোঁচা খোঁচা বোল্ডারের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত। তার ওপর খাড়া উৎরাই পথ। সুবাসের হাত ধরে কোনওক্রমে নামি। নদীর ধারও এতো পাথুরে যে পা পাতা যায় না। কিন্তু জলে পা দিতেই কাঁপুনি। কনকনে বরফগলা জল। কী যে আরাম! দীপংকর আর দীপচন্দ পাম্প দিয়ে নাও ফুলিয়ে আমাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দিল প্লাস্টিকের দাঁড়। সঙ্গে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে চলল নির্দেশনামা। পেহলা বাত, পেনিক নেহি হোনে কা। ইয়ে এক এডভেঞ্চার স্পোর্ট হ্যায়, নাও উলট সকতা হ্যায়। ঘাবড়ানে কা নেহি। পানি মে গিরনে সে নাওকি রসসি পকড় লিজিয়েগা আপ। 

শুনে শুনে যা বুঝলাম, দাঁড় বাইবে চারজন। দীপংকর, দীপচন্দ, রঙ্গন আর কংকণ। মাঝখানে বসবে সুবাস, আমাদের খুদে সদস্যকে নিয়ে। আর আমার কাজ নিজের ওজন ব্যবহার করে খরস্রোতে নৌকোটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখা, যাতে উথালপাথাল ঢেউ (Rapids) পেরতে পারে সহজে। নৌকো ছাড়ল। মিনিটখানেকের মধ্যেই Rapids-এর খপ্পরে পড়ে নৌকো ভয়ানক দুলতে শুরু করল। মনে মনে বলছি সামাল সামাল, ভয়ে বুক কাঁপছে, জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে কনকনে জলে। আচমকা বিশাল ঢেউ সামনে, পিছন থেকে দীপংকরের নির্দেশ— দিদি নিল ডাউন! নৌকোর সামনের দিকে মোটা দড়ি ধরে উপুড় হয়ে পড়লাম। নৌকো দিলো এক লাফ, ঠান্ডা জল নাক মাথার উপর দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল… চশমা খুলে যায় যায়। এক ঢেউ পেরতে না পেরতেই বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে বেমক্কা বোঁ করে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল নৌকো। আবার উপুড় হয়ে নৌকো সিধে করা। আবার ঢেউ ভাঙা। 

এভাবেই আধঘণ্টা পর পৌঁছলুম তিস্তার আর এক প্রান্তে। সেখানে পাথর কম। পাড়ে সাদা বালু। রাফটিং শেষ। জলের মধ্যেই নৌকো থেকে নেমে প্রমত্ত জলকেলি হল। তারপর উঠে এসে ভিজে গায়ে জিপসি চড়ে মেল্লিতে প্রত্যাবর্তন। খানিক শুকনো হয়ে জুতোজোড়া পায়ে গলিয়ে তিস্তাবাজারে তেনজিং হোটেলে নেপালি থালি দিয়ে লাঞ্চ সেরে তিনটে থেকে ফের ওঠা ইয়ুকসমের চড়াই পথে।

ক্রমশ

আরও পড়ুন...