প্র চ্ছ দ কা হি নী
“১৮৫৭ সাল, সিপাহী বিদ্রোহের বছর। সেই বছরেই এই বাড়িটি তৈরি করেন বাবু নবীন চন্দ্র মল্লিক মহাশয়। তারপরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে মহারাণী ভিক্টোরিয়া হয়ে সিএমডিএ। বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলা ভাগ, শহর কলকাতার ইতিবৃত্তে অসংখ্য মিটিং-মিছিল রক্তপাত যুদ্ধ মন্বন্তর দাঙ্গা! কলকাতা তবু আছে, আছে বাবু নবীন মল্লিকের তৈরি নবীন মল্লিক লেনের এই বাড়ি।”
‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবি শুরু হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যে নেপথ্য থেকে ভেসে আসে উপরের কথাগুলি, উল্লিখিত বাড়িটির উপর ক্যামেরা ঘুরতে থাকে। আরও জানা যায়, দ্বারিক মল্লিক হলেন এই বাড়ির বর্তমান মালিক। ষোলটি কামরার পাঁচটি নিজের জন্য রেখে বাকি এগারোটিতে ভাড়া বসিয়েছেন। এ যে সময়ের কথা তখন যৌথ-পরিবার অবলুপ্তির পথে, যৌথ-পরিবারের জায়গা নিচ্ছে যৌথ-সহাবস্থান। কাল্পনিক এই দ্বারিক মল্লিকের পিতৃপুরুষেরা বোঝা যায় যৌথ-পরিবারেই থাকতেন। ক্রমে সেই দিন গেছে, ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগাভাগি হয়ে হয়তো বা দ্বারিক মল্লিকের মতো মানুষেরা সংসার-নির্বাহের জন্য ভাড়া বসাতে বাধ্য হয়েছেন পিতৃ-পুরুষের ভিটেয়। যৌথ-পরিবারের আদি অবস্থায় সকলের পেটের জন্য একটিই হাঁড়ি চড়তো। পরবর্তী কালে ভাইয়ে ভাইয়ে একসঙ্গে থাকলেও হাঁড়ি আলাদা হয়ে যায়, কিন্তু তখনও বাথরুম বা কাপড় কাচার জায়গা হয়ত থাকত একটিই। যৌথ-সহাবস্থানে অনেক সময়ই সর্বজনীন বাথরুম, সর্বজনীন কাপড় কাচার জায়গা এবং এমনকি গৃহস্থালির মধ্যেই পুরুষদের জন্য স্নান করার সর্বজনীন খোলা আকাশ পরিলক্ষিত হত। ‘একদিন প্রতিদিন’-এ এরকমই চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে বৃদ্ধ হৃষীকেশ সেনগুপ্তকে খোলা আকাশের নীচে স্নান করতে দেখা যায়। বলা-বাহুল্য নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তেরই বাস ছিল এই ধরনের গৃহব্যবস্থায়। অতিরিক্ত জল ব্যবহারের জন্য দ্বারিক খানিক ধমকও খান হৃষীকেশের কাছে। দ্বারিকের বনেদিয়ানা চলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে মেজাজটা। ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভরের মতো ব্যাপার অনেকটা। যদিও সামন্ততন্ত্র ও আধুনিকতার দ্বন্দ্বের থেকে সত্তর দশকের যৌথ-সহাবস্থানের ভিতরকার অর্থাৎ মধ্য ও নিম্নবিত্তের দ্বন্দ্ব ধারে-ভারে অনেক বেশি জটিল। মৃণাল সেনের ছবির ভুবন চিরকালই আবর্তিত হয়েছে এই মধ্য, নিম্ন-মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিতরে।
‘রাত ভোর’ (১৯৫৬) থেকে ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫), তাঁর ছবিতে প্রত্যক্ষ রাজনীতির অনুপ্রবেশ তখনো ঘটেনি। কিন্তু প্রত্যেক যশস্বী শিল্পীর চেতনার কতকগুলি পিভট বা মূল থাকে, যেগুলি তাঁর কৃষ্টিতে সচেতন বা অচেতন ভাবে সবসময় রেখাপাত করে যায়। মৃণাল সেনের ক্ষেত্রে এরকম দুটি মূল হল মার্ক্সীয় চেতনা এবং নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নিরুপায় ব্যর্থ উচ্চাশা। যদিও একটু ভাবলেই বোঝা যায় এই দুটি মূল একে-অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মৃণাল সেন নিজে উচ্চবিত্তের জগতটির অধিবাসী ছিলেন না, ফলে একজন প্রত্যক্ষবাদী শিল্পী হিসেবে কোনোদিনই সেই অনধিকার চর্চার মধ্যে যাননি। উচ্চবিত্ত তাঁর কাছে হয় মার্ক্সীয় শ্রেণীবিভাজনে পরিগণিত শোষক, নয় উচ্চবিত্ত হল নিম্ন-মধ্যবিত্তের সেই আকাঙ্ক্ষিত জলাভূমি, মরুভূমিতে যাকে মরীচিকা বলে। ‘রাত ভোর’ ছবিটিকে মৃণাল নিজেই গড়পড়তা বাংলা ছবির মানে বিচার করে পরিত্যাজ্য বিবেচনা করেছিলেন। ‘২২শে শ্রাবণ’ রবীন্দ্র-তিরোধানের অশ্রুপাতে সিক্ত নয়। আসলে বড় কোনো শোকের মধ্যে অবহেলিত ছোট শোকটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কথা ভেবেছিলেন তিনি এই ছবিটিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে একজন গরিব সেলসম্যান ও তার স্ত্রীর সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার প্রদর্শনে সেই প্রথম আমরা দেখতে পাই মৃণাল সেনের অতিপ্রিয় ইতালির নব্য-বাস্তববাদের অন্যতম পুরোধা তাত্ত্বিক-চলচ্চিত্রকার সিজার জাভত্তিনির প্রভাব। রূপবান রূপবতী নয়, প্রতিদিনের মাঠে-ঘাটের নারী-পুরুষ সদৃশ নায়িকা-নায়ক নির্বাচন এবং কৃত্রিম আলো যথাসম্ভব কম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক আলোর উপর নির্ভর করে সেটের বদলে লোকেশনে শুটিং করা – নব্য-বাস্তববাদ অনুপ্রাণিত মৃণাল সেনের সঠিক যাত্রা শুরু হয় এখান থেকে। অপেশাদার অভিনেতা, লোকেশনে শুটিং, খেটে খাওয়া গরিব মানুষের গল্প – নব্য-বাস্তববাদের এই ভিত্তিগুলি মৃণাল সেনকে প্রলুব্ধ করেছিল এর সঙ্গে মার্ক্সীয় ভাবধারার অন্তর্গত মিলের কারণে। এই পর্বে ‘আকাশ কুসুম’ হলো সেই ছবি, যা পূর্বে উল্লেখিত তাঁর দু’টি মূলের দ্বিতীয়টিতে ন্যস্ত। অর্থাৎ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত যা পায় তা সে চায় না, আর যা চায় তা সে পায় না।
‘আকাশ কুসুম’-উত্তর মৃণাল সেন বহুল আলোচিত। ‘মাটির মনিষ’ (১৯৬৬) থেকে ‘ওকা উরি কথা’ (১৯৭৮), বহু বিভাগে বিভক্ত মার্ক্সীয় ভাবধারার একেকটিকে একেকটি ছবিতে প্রাণ দেওয়ার অভিপ্রায়ে তিনি ছবির আঙ্গিকে নিয়ে আসছেন যথেচ্ছ ভাঙচুর। বিষয় হিসেবে রাজনীতির সরাসরি অনুপ্রবেশ যদি ঘটে থাকে ‘মাটির মনিষ’-এ, তাহলে চিত্রভাষা নিয়ে বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯)-র হাত ধরে। পঁয়ষট্টি সাল ছিল স্বাধীন ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাল, কিন্তু ভ্রষ্টাচারে দেশ ততোদিনে ভুবন সোমের থেকেও বৃদ্ধ। এইসবের থেকে মুক্তি পেতে গেলে যেটা প্রয়োজন তা হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তন যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা তৃতীয় আন্তর্জাতিক অনুসারী হবে, এটাই ছিল সময়ের দাবি। মৃণাল সেনও তাই সমাজ বদলের নতুন ভাবনাকে তাঁর কৃষ্টিতে রূপ দেওয়ার জন্য ভাবতে শুরু করলেন ছবির নতুন নির্মাণকৌশল নিয়ে। শত্রুর অনুসন্ধান বা সঠিক ভাবে বললে শ্রেণীশত্রুর অনুসন্ধানে ফরাসি নব্য-তরঙ্গের আদল তাঁর কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হল ইতালির নব্য-বাস্তববাদের চাইতে। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো বা জাঁ লুক গদার’কে যেন আমরা দেখতে পেলাম মৃণাল সেন নামক গেরিলা চলচ্চিত্রকারের মধ্যে। নকল নয়, আত্তীকরণ। তার সঙ্গে প্রাণান্তকর চেষ্টা মার্ক্সবাদ নামক আন্তর্জাতিকতাবাদের উপযোগী আন্তর্জাতিক চিত্রভাষা নির্মাণ করার। গেরিলা ফিল্মমেকিং, অর্থাৎ পথ-ঘাট থেকে তুলে আনা দৃশ্যাবলী যার আগাম আভাস ঘুণাক্ষরেও থাকে না চিত্রনাট্যের মধ্যে – তাঁর একটা স্টাইল ছিল। ছবিতে গল্প বলার চিরাচরিত ধাঁচাকে ধ্বস্ত করে তার মধ্যে বিবৃতির আকারে সরাসরি রাজনৈতিক কথা বলা – স্বভাবতই প্রোপ্যাগান্ডা ও গিমিক সর্বস্বতার অভিযোগ তাঁর ছবি নিয়ে উঠতে শুরু করে। এসবকে অবশ্য তিনি কোনোদিনই তেমন পাত্তা দেননি। তাঁর বিখ্যাত কলকাতা ট্রিলজির প্রথম দুটি ছবি অর্থাৎ ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘ইন্টারভিউ’ উগ্র-বামচেতনা জাত সরাসরি সংঘর্ষের যে রাজনীতি তার প্রতিনিধিত্ব করছে, তুলনায় ‘পদাতিক’-এ বাম দলগুলির অভ্যন্তরের যে ঝামেলা সেই দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছিল। ‘পদাতিক’-এর শেষে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে লুকিয়ে আসা সুমিতকে (মায়ের মৃত্যুর পর) বাবা সাহস দেন পুনরায় ফিরে যাওয়ার।
কিন্তু বাইরের দিকে আঙুল তাক করলে তিনটি আঙুল নিজের দিকে তাক করা থাকে। এই দর্শনের প্রেক্ষিতে ১৯৭৯-এর ‘পরশুরাম’ থেকে শত্রুর অনুসন্ধানের অভিমুখ ঘুরে যায় বাইরে থেকে ভিতরের দিকে। একে মৃণাল সেন বলেছিলেন আত্ম-বিশ্লেষণের পর্ব। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই পর্বে নির্মিত ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’ (১৯৮১) ও ‘খারিজ’ (১৯৮২)-এ নিম্ন-মধ্যবিত্তের গৃহব্যবস্থার চেহারা অনেকটা একই ধরনের। গৃহস্থালির স্পেসটিকে তিনটি ছবিতেই আমরা বারংবার দেখি মাঝের ফাঁকা কলতলা থেকে টিল্ট-আপ ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলে। এই ধরনের দৃশ্য অধিগ্রহণে অধিগৃহীত বস্তুটিকে তার চেহারার থেকে বড় লাগায় তার মধ্যে একধরণের অতিরিক্ত মহিমা আরোপিত হয়। শুরুতে উল্লিখিত নেপথ্য ভাষণে দ্বন্দ্ব-সঙ্কুল যে ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যেই আছে অচেতন সাক্ষী হিসেবে এই অট্টালিকার উপস্থিতির ব্যঞ্জনা! ঠিক মতো আলো না ঢোকা স্যাঁতস্যাঁতে এই গৃহব্যবস্থা যেন নিজেই ছবিগুলির একটি চরিত্র।
কালের ব্যবধানে আজকের দিনে ফিরে তাকালে, আত্ম-বিশ্লেষণের এই পর্যায়ের ছবিগুলিকেই মনে হয় অনেক বেশি করে আইডিওলজি নিরপেক্ষ একটা সময়ের দলিল। পরিচালকের চিত্রভাষাও অনেক সাবলীল ও সমৃদ্ধ। ‘একদিন প্রতিদিন’ ও ‘খারিজ’ বহুল আলোচিত। ‘চালচিত্র’-এর প্রারম্ভিক পর্যায়ের সেই দৃশ্যটির কথা ভাবুন যেখানে “এমনি করে প্রায় উলঙ্গ হয়েই এতক্ষণের পোশাকি বনেদি মানুষটা গরিব হয়ে গেল…” দীপুর অফ-ভয়েসে আমরা দেখতে পাই লোকটিকে। এই ভদ্রলোক ‘আকাশ কুসুম’ ছবিটির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেন। আসলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের নিষ্পাপ অসহায়তার নানাবিধ বহিঃপ্রকাশ ছিল মৃণাল সেনের বরাবরের কৌতূহল বিষয়। যা সে সেজে থাকে তা সে নয়, এটা নিম্ন-মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে আকাশ কুসুম বাসনারই প্রতিভাস। কিংবা ‘চালচিত্র’-এর সেই ভদ্রমহিলা, ভাতের মাড় তার কাজের লোকটিই কলতলায় ফেলে বলে যিনি তিরস্কৃত হন। ‘একদিন প্রতিদিন’-এর চাকরিজীবী মেয়েটিকে যেন এখানে পুনরায় দেখতে পাই আমরা। ঘরকন্না ছেড়ে রোজগারের জন্য নারীর অফিসে, বিদ্যালয়ে পা বাড়ানো এবং একই-সঙ্গে শিশু-শ্রম— ‘একদিন প্রতিদিন’ ও ‘খারিজ’ ছবি দু’টিতে এই দুই বিপরীত ধরনের বাস্তবতাকে পিতৃতান্ত্রিকতার নিগড়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, সম্পত্তির অসম বণ্টন— কারণ যাই হোক, মৃণাল সেন ক্রমে সেই তাত্ত্বিক জায়গা থেকে সরে এসে তাঁর ছবিতে বড় করে তোলেন ছোট বড় সুখ দুঃখের মানবিক পরিসরটিকে। গৃহস্থের বাড়ির উনুনের ধোঁয়ার মতো কঠোর বাস্তবতা মৃণাল সেন ছাড়া সেই সময়ের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রকারদের কারোর ছবিতেই সেই ভাবে জায়গা পায়নি। এদিকে বার্লিন দেওয়ালের পতন তাঁকে ভাবাচ্ছে, গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈইকার ঝোড়ো হাওয়া, সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতন কেড়ে নিচ্ছে রাতের ঘুম। ওদিকে মাও সে তুং-এর রাস্তা বাতিল করে চীনের দেং জানাচ্ছেন, বেড়ালটির রঙ সাদা না কালো তার থেকেও বড় হল বেড়ালটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা! মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র চাকরিজীবী নারী কিংবা বৃদ্ধ অধ্যাপকের অনুপস্থিতির স্মৃতিকে আত্মস্থ করে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের সংকটকে সফল ভাবে যুক্ত করেছিল সারা পৃথিবীর যুগান্তকারী ঘটনাগুলির সঙ্গে। এখানেই তিনি অনন্য।