Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

সা ক্ষা ৎ কা র

প লা শ   দে

কবি ও  চিত্রপরিচালক

palash

বিশিষ্ট পরিচালক, প্রযোজক এবং সিনেমা বিশেষজ্ঞ অঞ্জন বসুর সাথে একটি অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা।

অঞ্জন বসু

পরিচালক, প্রযোজক এবং সিনেমা বিশেষজ্ঞ
জন্ম ১৯৪৭
অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের বর্তমান কর্ণধার।
পরিচালক হিসেবে দুবার রজত কমল, ইন্ডিয়ান প্যানোরামা , দাদা সাহেব ফালকে সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।
এখনো অক্লান্ত স্বপ্ন দেখে চলেছেন বাংলা সিনেমা আবার পথ দ্যাখাবে বিশ্ব সিনেমার…

১। পৃথিবীর সমস্ত সিনেমার মাঝে তুমি অথবা তোমার ভেতরে সমস্ত সিনেমার জগৎ… কী মনে হয় তোমার!

উত্তর: আমি এমন একটা পরিবারে জন্মেছি যেটা তিন প্রজন্ম ধরে একটা বিনোদন মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত । মাধ্যমটা সিনেমা। সিনেমা একটা মানুষকে বিনোদন যেমন দেয় তেমন অনেক কিছু শেখাতেও পারে যা খারাপ হতে পারে ভালোও হতে পারে। আমি ছোটবেলা থেকে যাদের মধ্যে ছিলাম,যাদের মধ্যে বড় হয়েছি তাদের মধ্যে ছিল নতুন সৃষ্টি করার প্রচণ্ড আকাঙ্খা । সেই আকাঙ্ক্ষা দর্শককে কেন্দ্র করে সেই আকাঙ্ক্ষা নিজের উন্নতির জন্য নয়। এই কারণেই সেই সময়কার সিনেমাগুলো এখনো আমাদের মনের মধ্যে রয়ে গেছে। এখন যেসব সিনেমা তৈরি হচ্ছে সেগুলো ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের কথা ভেবে তৈরি করা হচ্ছে সেই জন্য দর্শক সিনেমা থেকে সরে গেছে। সময ঘোরে।আমি খুব উচ্চাশার লোক,আমার মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি আমরা নব প্রজন্মের হাত ধরে একটা নতুন বিনোদনের জগতে পৌঁছব যেখানে দর্শককে আমরা আমাদের সঙ্গে পাব।

২। বাংলা সিনেমা-ভারতীয় সিনেমা-আন্তর্জাতিক সিনেমা– কী অনুভব তোমার?

উত্তর: বাংলা সিনেমা আপাতদৃষ্টিতে কিন্তু দর্শকের আকর্ষণ হারিয়েছে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা সিনেমাকে নিপীড়ন করা হয়েছে,বাংলা সিনেমাকে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাক্তিগত রুজি রোজগারের জায়গা থেকে।এক্ষেত্রে দর্শককে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।তার ফলে বাংলা সিনেমা ভারতীয় সিনেমার থেকে অনেকখানি পিছিয়ে গিয়েছে। ভারতীয় সিনেমার অবস্থাও কিন্তু এখন ভালো নয়… দক্ষিণ ভারত ছাড়া। কারণ হিন্দি বা বোম্বাইতে তৈরি করা যে সিনেমাগুলো একসময় জনগণকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করত সেই সিনেমাগুলো এখন পুরনো হয়ে গেছে। এখন বিষয়বস্তু যদি শক্তিশালী হয়,তার সঙ্গে জনগণ বা দর্শক যদি একাত্ম হতে পারেন তবে সেই সিনেমাগুলি চলে বম্বেতে । যদি আলংকারিক কোনো সিনেমা তৈরি হয়…যেটা দক্ষিণ ভারত করছে…তার অনেক বেশি গ্ল্যামার…সেই সিনেমাগুলো আশ্চর্য হয়ে মানুষ দেখতে যায়।ভাষা না বুঝলেও দর্শকের কোনো অসুবিধে হয় না । আর আন্তর্জাতিক সিনেমা এখন কি খুব একটা আমরা দেখতে পাই?….দেখার সুযোগ পাই?…সেইভাবে আর বিদেশি ছবি পরিবেশনের ভাবটা নেই….আমরা যখন কলেজে পড়তাম তখন বিশেষ কতগুলো পেক্ষাগৃহে ইংরিজি ছবি দেখানো হতো,বিভিন্ন বিদেশী ভাষার ছবি দেখানো হতো। সেই ছবিগুলো আমরা দেখতাম আর আমাদের বিদেশী ছবি সম্পর্কে একটা সম্যক জ্ঞান হতে পারত। এবং তখন ফিল্ম সোসাইটির একটা মুভমেন্ট ছিল যেখানে ভালো ছবি বাইরে থেকে এনে দর্শক দেখতে পারতেন। কিন্তু এখন তো সেই পরিকাঠামোগুলো ভেঙে পড়েছে।এখন আমরা দেখতে পাই বিদেশিদের তৈরি করা কতগুলো ও টি টি চ্যানেল…সেখানে তারা যেগুলো মনে করেন আমাদের দেখবেন সেগুলো দেখানোর ব্যবস্থা করেন এবং আমরাও পয়সা দিয়ে সেগুলো দেখি। বিদেশী ছবি সেভাবে দেখানোর ব্যবস্থায়ই আর নেই আমাদের এখানে। ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টটাও ঠিক সেভাবে আর গড়ে উঠলো না।

৩। তুমি তো রাজনীতি সচেতন মানুষ। ব্যক্তিগত একা একলা মানুষের রাজনীতি আর পৃথিবীর রাজনীতি কিভাবে আসে যায় তোমার কাছে?

উত্তর: রাজনৈতিক সচতনতা… এই কথাটাকে আরও সহজভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা হলো মানুষের ভালো করা,মানুষের ভালো করার চেষ্টা করা।সেইটা এখন কি সত্যি? আমরা কি সেই ধরনের রাজনীতিবিদকে পাই যারা নতুন করে মানুষের ভালো করার চেষ্টা করছে? এখন মানুষের ভালো করার কোন চেষ্টাই হচ্ছে না। তার কারণ জনসংখ্যা যেভাবে বেড়ে গেছে সে অনুযায়ী জনসংখ্যাকে শিক্ষিত করার জন্য যে সমস্ত পরিকাঠামো আমাদের তৈরি করা উচিত ছিল…এগুলো কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত… সেগুলো আমরা করিনি। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে। যেখানে অশিক্ষা সেখানে সচেতনতা আসবে কি করে? তার ফলে ৭০ বছর স্বাধীনতা হয়ে যাবার পরেও আমরা দেশে অনেক অভুক্ত মানুষ দেখতে পাই,অনেক অশিক্ষিত মানুষকে দেখতে পাই, অনেক মানুষকে দেখতে পাই যাদের নিজস্ব কোন জ্ঞান নেই…কোন একটা প্রবলেম যদি তাদের সামনে এসে পড়ে তাহলে সে দল করে মারামারি করে,সে ভাবে কোন একটা ছাতার তলায় যদি সে আশ্রয় নেয় তাহলে সে তার সংসারটাকে সুখী করতে পারবে। কিন্তু সেটা তো কোথাও হচ্ছে না ,সেটা সারা পৃথিবীতে কোথাও হচ্ছে না। অনেকগুলো ইংরেজি কথা বলা যায় অনেকগুলো রাশিয়ান কথা বলা যায় অনেকগুলো আমেরিকান কথা বলা যায়… আসল কথা হলো মানুষ আর সুখী নয়। এত দ্বিধা নিয়ে এত আশঙ্কা নিয়ে মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারবে না। পৃথিবীকে যদি সুখী হতে হয় পৃথিবীর মানুষকে হতে হবে শিক্ষিত, পৃথিবীর মানুষকে হতে হবে দৃঢ় ,পৃথিবীর মানুষকে হতে হবে প্রতিবাদের শক্তি।এসব তো নেই। অতএব আমরা যে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি সেটা ভাঙবেই। তবে আমি আশাবাদী… মানুষ আবার নিজেকে খুঁজে পাবে। ভারতবর্ষের মানুষের নিজস্বতায় দেশ একদিন স্বাধীন হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত থেকে। তেমনি নিজস্বতায় মানুষ আবার স্বাধীন হবে সমস্ত রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে গিয়ে… একটা নতুন পৃথিবী গড়বে, যে পৃথিবীতে থাকবে সুখ থাকবে শান্তি থাকবে শিক্ষা।

৪। অরোরার ইতিহাস একটু বলো।

উত্তর: অরোরার ইতিহাস বলতে গেলে আমাকে পিছিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে… সেই ১৯০৬ সালে। তখন বাঙালি বা ভারতীয়দের বিনোদন বলতে বোঝাত থিয়েটার যাত্রা আলকাপ বাইজি নাচ উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর এবং আমরা যদি আমরা ফিরে আসি বঙ্গে…পশ্চিমবঙ্গে… তাহলে বলতে হয় এসবের আসর ছিল উত্তর কলকাতায়। উত্তর কলকাতায় রাধাকান্ত দেব বা অন্যান্য জমিদার যারা ছিলেন তাদের বাড়িতে প্রায়ই বাইজি নাচ হত।থিয়েটার ছিল….সেই থিয়েটারে ধরুন অমর দত্ত…গিরিশ ঘোষ…স্টার…ক্লাসিক থিয়েটার …নটি বিনোদিনী …তখন দর্শকের সঙ্গে বিনোদনের একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল।সেই সময় স্টিভেনসন সাহেব একটা নতুন জিনিসের পরিবেশনা নিয়ে বেরোলেন সারা পৃথিবীতে,সেটা হচ্ছে তে ঘোরানো প্রজেক্টর আর বিদেশ থেকে আনা ছবি। এই পরিবেশনার আগে একদল নর্তকী স্টেজের ওপর আবহ তৈরি করত তাদের সঙ্গীত আর নৃত্য দিয়ে। আমার খুব ভালো লাগে খুব গর্বিত লাগে স্টিভেনশন সাহেবের ক্যামেরাটা ভারতবর্ষে প্রথম ঘুরিয়েছিলেন কিন্তু হীরালাল সেন ক্লাসিক থিয়েটারে। তখন অমর দত্তের তৈরি করা থিয়েটার আলিবাবার ছবি তুলেছিলেন হীরালাল সেন। সেই সমসাময়িক কালে অরোরাও আরম্ভ করল। অরোরা সমস্ত ব্যাপারটাকে ব্যবসায়িক হিসেবে নিয়ে ছবি দেখানো শুরু করল গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মেলায় বিবাহ অনুষ্ঠানে….যেখানে যেরকম বরাত পাওয়া যেত। সিনেমার ফেরিওয়ালা…সেই সিনেমার ফেরিওয়ালা হলেন নিউজরিল এবং ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রের পুরোধা। তারপর তারা বড় ছবি করলেন ১৯২০ সালে। বড় ছবি করার মুখে তারা একটা বাধা পেলেন। সেই বাধাটা হচ্ছে…তখন দুটো টেন্ট্ সিনেমা বা তাঁবুর সিনেমা ছিল…একটা কলকাতা প্রেসক্লাবের সামনে আর আরেকটা চ্যাপলিন মানে যেটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সেইখানে…এলফিনস্টোন বলে …সেটা চালাতেন ####তিনি বম্বে থেকে নির্বাক ছবি তৈরি করে এনে সেখানে দেখাতেন এবং এইটা ভীষণ ভীষণ একটা আকর্ষণীয় বিনোদনের জায়গা হয়ে উঠেছিল।সেই সময় ১৯২০ সালে ‘ রত্নাকর ‘ নামে একটি ছবি করেন আমার দাদু অনাদিনাথ বসু। তার সঙ্গে আর একটা ছবি তৈরি হয়, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর ‘ বিলেত ফেরত’। কিন্তু দেখানোর তো জায়গা নেই… সে এক মজার গল্প…কলকাতার দক্ষিণের যাঁরা বর্ধিষ্ণু বাঙালি ছিলেন তাঁরা বললেন উত্তরেই কেন কেবল সংস্কৃতিক পিঠস্থান হবে, আমরা দক্ষিনেও করব। বলে তাঁরা রসা থিয়েটার তৈরি করলেন…..এখন যেটা পুণ্য সিনেমা।সেখানে তারা চেষ্টা করলেন নাটকের একটা আঙিনা তৈরি করতে কিন্তু হল না। কারণ তখন তো যাতায়াতের এত সুবিধা ছিল না তাই ওখানে লোক হলো না। থিয়েটারটাও চলল না। তখন অনাদিনাথ বাবু আর ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী দুজন মিলে গিয়ে তাঁদের বললেন…”ভাই এখানে তোমরা আমাদের সিনেমা দেখাতে দেবে?”তারা ইংরাজি হলেন। বললেন “ হ্যাঁ দেখাও।”

সেই রসা থিয়েটারে রিলিজ হলো অরোরার ‘রত্নাকর’ আর ডিজির ‘বিলেত ফেরত’। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে। তারপরের তো অনেক অনেক দিন এগিয়ে গেছে। ১৯৩০ ১৯৩০ সালে নিউ থিয়েটার এসেছে।অরোরা তার দায়িত্ব নিয়েছে। তারপর ওরা নিজের স্টুডিও করেছে মানিকতলায় ১৯৩৬ সালে।তখন স্টুডিও বলতে আমরা বুঝতাম একটা সিস্টেম যেখানে আর্টিস্ট, শুটিং ,শুটিংয়ের ফ্লোর থেকে আরম্ভ করে ফিল্ম প্রসেসিং সাউন্ড রেকর্ডিং সমস্ত কিছুই একই আঙিনায় হত। দাদু মারা গেলেন ১৯৪৬ সালে। তারপরে আমার বাবা এলেন। বাবা…অজিত বসু… উনি অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তার ধারণা ছিল অন্যরকম…ততদিনে দুটো প্রজন্ম তো পেরিয়ে গেছে দাদুর সময় থেকে…তিনি চলচ্চিত্র আঙিনায় নিয়ে এলেন তিনজনকে…সত্যজিৎ রায় মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক। আরো অনেক ছবি… বিজয় বসুর ‘ভগিনী নিবেদিতা ‘ ‘ রাজা রামমোহন ‘ ‘ আরোগ্য নিকেতন ‘…কত ছবি কিন্তু সুপারহিট ছিল। আমার বাবা অজিত বসুর দূরদর্শিতা প্রখর ছিল…দর্শক ও বিনোদনকে মাথায় রেখে ব্যবসাকে কি করে ব্যবসাটাকে বড় করা যায় টা তিনি জানতেন।কিন্তু তার পরেই এলো দুর্যোগ।একটা হল বাংলাদেশ হয়ে গেল…আমরা আলাদা হয়ে গেল…৮০ ভাগ দর্শক ওদেশে চলে চলে গেল…তারা বিদেশী হয়ে গেল আর তার কিছুদিন পরেই শুরু হল রাজনৈতিক ডামাডোল।ভয় পেতে শুরু করলাম আমরা। সিনেমার সময় পাল্টে গেল… তিনটে ছটা নটা বদলে হয়ে গেল একটা চারটে সাতটা।
জনগণ সিনেমা দেখতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। বিনোদন হিসেবে সিনেমা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে লাগলো আর তার জায়গাটা নিল টেলিভিশন বা দূরদর্শন। কিন্তু দূরদর্শন ঠিক সেই ভাবে জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারল না। এখনও পারেনি। বিভিন্ন ওটিজি প্লাটফর্মে আমরা যে দেশি-বিদেশি ছবিগুলো দেখি সেগুলো কিন্তু সব মানুষকে আকর্ষণ করে না…. আকর্ষণ করে একটা বয়সের মানুষকে, সেটা দিয়ে তো আর একটা ব্যবসা চলতে পারে না । চলবেও না।

৫। তোমার ভেতরে যে আশ্চর্য পাগল বাস করে সেই পাগলের কথা শুনতে চাই।

উত্তর: অরোরা অনেকদিন ছবি করেনি।৪৫ বছর বাদে আবার অরোরা ছবি করতে এসেছে। তার দুটি কারণ…এটা কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের কথা বলছি আমি…অলরেডি তৃতীয় প্রজন্মের পরেও আরো দুটি প্রজন্ম এসে গেছে…আমরা নিজেরা চলচ্চিত্রের কলা কৌশল,নানা রকম কাজ শিখেছি। আমাদের নামে বলা হয় মালিক কিন্তু আমরা তা বিশ্বাস করিনা।আমরা এই তৃতীয় প্রজন্মে চেষ্টা করছি যারা নতুন তারা লেখাপড়া শিখেছেন যারা শিক্ষিত যারা চলচ্চিত্রটা বোঝেন যারা চলচ্চিত্র তৈরি করলে দর্শক হয়তো আবার এগিয়ে আসবেন। পরীক্ষামূলকভাবে আমরা দুটো ছবি করেছি, তার একটা ছবি অনেকগুলো বিদেশি এওয়ার্ড অল রেডী পেয়ে গেছে আর দ্বিতীয় ছবিটা তৈরি হয়ে গেছে।আমরা স্টুডিও তৈরি করছি একটা যেখানে যুগোপযোগী সমস্ত কিছু থাকবে…যাঁরা নতুন আসবেন তাঁরা এখানে ছবি করবেন। আমরা জানি না একটা ছবি আর্থিকভাবে সফল হতে গেলে কি থাকতে হয়.. সেটা আমরা শিখছি আর যদি দর্শক আমাদের সঙ্গে একটু থাকেন তাহলে অবশ্যই আমরা ফিরে পাব বাংলার হৃত গৌরব।

৬। তীব্র গুণীজনদের সঙ্গে তুমি থেকেছ বিভিন্ন মাধ্যমে। সেই তেঁতুল পাতায় ন-জনের কিছু গল্প যদি বলো…

উত্তর: আমি যে গুণীজনের সঙ্গে থাকার সুযোগটা পেয়েছি সেটা কিন্তু সহজে কেউ পাবে না…কেউই হয়তো পাবে না ।কেন না সবাই ছিলেন আমার গুরুজন। সেই গুরুজনের মধ্যে অরবিন্দু মুখার্জি সেই গুরুজনের মধ্যে সরোজ দে সেই গুরুজনের মধ্যে সত্যজিৎ রায় সেই গুরুজনের মধ্যে ঋত্বিক ঘটক সেই গুরুজনের মধ্যে বিজয় বসু এবং আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো তাদের ভালো দিকটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন… আমাদের শেখানোর চেষ্টা করতেন…সেখানে কিন্তু তুমি অন্য বাড়ির তোমাকে বলে কি হবে …সেই..সেই ভাবটা কোনদিন আসেনি… প্রত্যেকেই ছিলেন আমাদের আত্মীয় এবং আমরা তাদের গুরুজন হিসেবেই স্বীকার করে নিতাম। এবার কতগুলো গল্প বলি…আমাদের বাড়ির নিয়ম ছিল যে অরোরা বাড়ির ছেলেরা ছবি করবে না,কারণ, তাহলে ব্যবসা উঠে যাবে ।আমি যখন কলেজ ছেড়ে বেরোলাম…. (যতদিন পড়াশোনা করতাম ততদিন ফিল্ম নিয়ে আলোচনা করতে দেওয়া হতো না)….তারপরে স্টুডিওয় নিয়ে গিয়ে সমস্ত ট্রেনিং দিয়ে তারপরে অফিসে আনা হয়। তখন আমি বাবাকে বললাম ছবি করব। বাবা বললেন “না তুমি ছবি করবে না”। সেইটা নিয়ে আমাদের আমাদের মধ্যে বেশ কিছুদিন দ্বন্দ্ব ছিল।শেষকালে …ছেলের কাছে বাবারা হেরে যান জেনারেলি…বললেন …আমাদের যে ক্যামেরা ম্যান ছিলেন তাকে বললেন,”এই যা টুকরো ছবি আছে ওকে ক্যামেরা দিয়ে পাঠিয়ে দাও ,তোমরা কেউ যাবে না “…আমি চলে গেলাম ছবির শুটিং করত এবং সেই ছবিটা প্রথম বেস্ট নন ফিচারফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেল। বাবা বললেন “ দেখেছো কেন তোমাদের ছবি করতে দিই না, তোমরা ছবি করলেই তোমাদের ছবির উপর টান হবে তাহলে এরপর ব্যবসাটা কিভাবে চলবে”। কিন্তু ততক্ষণে আমার মাথায় নেশাটা ঢুকে গেছে। আমি বললাম ঠিক আছে আমাকে করতে দিও না কিন্তু আমরা যে ছবিগুলো করতে পাই######### সেগুলো করতে দিও। তাই হল। তারপর একটা ছবি করলাম লেপচাদের ওপর সেই ছবি হয়তটা বেস্ট এনথ্রপলজিক্যাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেল। তারপরে একটা ছবি করলাম সেটা বেস্ট বায়োগ্রাফিকাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেল।বাবা বললো তুমি আর ছবি করবে না ।কারণ তখন সবাই ভাবছে যে আমি এবার বড় ছবি করতে যাব। কিন্তু আমার মনে কোথাও একটা দ্বিধা ছিল যে সত্যি যদি বড় ছবি করতে চাই তাহলে ব্যবসাটা উঠে যাবে। সেই জন্য আমি কোনদিনই বড় ছবি করিনি। আমি কিন্তু প্রায় একশটা তথ্যচিত্র তৈরি করেছি। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু বড় ছবি করার অনেকটা ইচ্ছে থাকলেও করিনি। এই যে মানুষগুলোর সঙ্গে ছিলাম তারা তাদের কিভাবে কাজ করতেন সেগুলো কিন্তু তারা আমায় শেখাতেন,আমি তাদের সঙ্গে সেই আবহাওয়ায় বড় হয়েছি বলে আমি জানি কিভাবে করতে হয়।এখন যারা নতুন আসছেন আমি তাদের সবাইকেই বলছি …….ভাই আমার কাছ থেকে যদি কোনো সাহায্য নিতে চাও,নাও।কিন্তু তোমরা মনে করো না যে তোমরা সব জিনিস শিখে গেছো… চলচ্চিত্র এমনই একটা জিনিস যেটা তুমি যত শিখবে তত তুমি নিজেকে উন্নত করতে পারবে। কতগুলো বিদেশি বা দেশী ছবি দেখে, অহেতুক নকল করে তোমরা দর্শককে তো দূরে সরিয়ে দিলে…. দর্শকের কাছে ক্ষমা চাও, ডেকে নিয়েছো তাদের যদি এটা ব্যবসা হিসেবে রাখতে চাও আর যদি নিজের উন্নতি করতে চাও তাহলে এইভাবে দুদিন বাঁচবে তার পরে মরে যাবে কেউ দেখবে না…কেউ মনেও রাখবে না পৃথিবীতে।

৭। বহু প্রজন্মের সঙ্গে তুমি কাজ করেছ নতুন প্রজন্মের কাজের সম্পর্কে তোমার কি মনে হয়?

উত্তর: নতুন প্রজন্মকে আমার একটা কথাই বলার আছে…তোমরা যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে বিভিন্নভাবে পারদর্শী হয়েছো তাদের কিন্তু প্রধান কাজ হবে চলচ্চিত্রকে দর্শকের সামনে নিয়ে যাওয়া। দলবদ্ধ ভাবে এই চেষ্টা যদি না করা যায় এই কাজ করা যাবে না। কারণ এখন প্রদর্শনের যে ব্যবস্থা চলছে তাতে উচ্চবিত্ত মানুষের বিনোদনের উপায় চলচ্চিত্র হতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষ…যে চাষা যে তাঁতি যে জেলে…যারা আমাদের আসল দর্শক তারা আসেনা তারা চলচ্চিত্র দেখে না । অথচ তাদেরও বিনোদনের প্রয়োজন আছে ।তাদের বিনোদনের জায়গাটা নিয়ে নিচ্ছে কতগুলো অশ্লীল ছবি…কিসের মাধ্যমে তা আমি বলতে চাইছি না।যাঁরা নতুন ছবি করতে আসছেন তাঁরা বিষয়বস্তু নিয়ে এমনভাবে ভাবুন যাতে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের বিনোদনের একটা উপায় আমরা বের করতে পারি।সেটা কমার্শিয়াল ছবি বলুন আর্ট হাউস ছবি বলুন বা এখনকার বিভিন্ন রকমের ইংরিজি বাংলা ছবি বলুন….আমরা মানুষের মন জয় করতে পারছিনা এইটা স্বীকার করে আপনারা নাবুন ।অনেক বিনীত হোন…নিজেদের অনেক বড়ো ভাববেন না…আপনারা কেউ নন…আমি গত তিনটে প্রজন্মে যাঁদের দেখেছিতাঁদের কাছে যদি একটুও শিক্ষিত হতেনতাহলে কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র আজ এই জায়গায় আসতো না।

৮। অরোরার এখন নতুন সিনেমার জার্নি নিয়ে কিছু কথা বলো…

উত্তর: একটা সময় এই ভারতবর্ষের গণ্ডি পেরিয়ে কোন চলচ্চিত্র যে পৃথিবীর আঙিনায় যাবে এইটা লোকের কাছে স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা সাকার করে বিদেশ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে ফিরলেন সত্যজিৎ বাবু ‘ অপরাজিত ‘ ছবি নিয়ে। ছবিটা কিন্তু অরোরার করা। তারপর’ জলসাঘর ‘.. তারপর অনেক নতুন ছবি…দরজাটা খুলে গেল… ভারতবর্ষের থেকে অনেকে বাইরে যেতে শুরু করলেন…তারপর বিজ্ঞানে উন্নতি হল বিদেশি ছবি আমাদের কাছে চলে সহজে আসতে শুরু করলো…. তারপর ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট…একটা আবহাওয়া যেখানে দর্শক এবং চলচ্চিত্রকার একইসঙ্গে থাকলেন এবং দুজনের অভিজ্ঞতা নিয়েই তৈরি হতে শুরু করল অনেক অনেক ভালো ভালো ছবি। তখনকার যে কমার্শিয়াল ছবি বা তখনকার যে আর্ট হাউস ছবি দুটোই ছিল কিন্তু জনগণের বা দর্শকের মনের কাছের ছবি। দুই ধরনের ছবিই কমার্শিয়ালি চলত। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হয়েছিল কিন্তু তারপরে দর্শক তৈরি হয়ে গিয়েছিল…তারা দেখতে চাই তো তুই ধরনের ছবিই। অরোরা আবার চেষ্টা করছে সেটাই। আমি চাই যাঁরা নতুন চলচ্চিত্রকার যাঁরা নতুন ভাবে ছবি করতে চান বা প্রযোজনা করতে চান পরিবেশন করতে চান তাঁরা আসুন একসঙ্গে বসে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করি তে চলচ্চিত্র ফিরে পায় তার পুরনো গৌরব আর আবার বাংলা এর নেতা হিসেবে সকলের সামনে এগিয়ে যাক।

৯। ‘অরোরাকে সামনে রেখে বিশ্বসিনেমা আবার জয় করবো আমরা’ কী মনে হয় তোমার?

উত্তর: অরোরার নতুন সিনেমার জার্নি… নতুন সিনেমা বলতে আমি যেটা মনে করি সেটা হচ্ছে যে সমস্ত দর্শককে নিয়ে চলচ্চিত্র জগতের সমস্ত কলাকুশলীকে নিয়ে একটা সংঘবদ্ধ বিনোদনের একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরী করা হবে যেখানে দর্শক আবার আকৃষ্ট হবে , যেখানে চলচ্চিত্রে আসবে বুদ্ধিমত্তার ছাপ ,শুধু অনুকরণ নয়, দেশি-বিদেশি ছবি দেখে চুরি করা নকল ছবি নয… যেখানে থাকবে এখনকার দিনের মানুষের মনের খোরাক, যেখানে তারা আনন্দ পাবে… যেখানে তারা গান পাবে… যেখানে তারা নতুন কিছু শিখতে পারবে। সবাই মিলে আমরা যদি চেষ্টা করি… আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি বুদ্ধিমান, হাতের অস্ত্র অনেক বেশি শক্তিধর… তারা যদি সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন অরোরা তাদের সঙ্গে থাকবে।

বিশেষ ধন্যবাদ

অর্পিতা সরকার প্রামাণিক

আরও পড়ুন...