গ ল্প
গাঙ্গুলি পাড়া আর সিমলাই পাড়া থেকে যে বিপরীতমুখী দুটো রাস্তা এসে নোনা পাড়ায় মিশছে, উচিত ছিল সেই তিন মাথার মুখে একটা সিগন্যাল পোস্ট বসানোর। কিন্তু পাতি গলি বলে উপেক্ষা করে নোনা পাড়া থেকে যে সংকীর্ণ রাস্তাটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে বিটি রোডে গিয়ে পড়ছে, তার মুখে বছর দেড়েক আগে একটা সিগন্যাল পোস্ট বসানো হয়েছে। আর তারপরেই শুরু হয়েছে যত গণ্ডগোল। এমনিতে নোনা পাড়ার মুখ থেকে বিটি রোডের দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার মতো, তাই বাইকে পাঁচ মিনিট লাগা উচিত। কিন্তু ওই হতচ্ছাড়া সিগন্যালটার জন্য প্রায় কুড়ি মিনিটের কাছাকাছি লেগে যায়। আগে যখন লাল-কমলা-সবুজের ডিজিটাল ঝাণ্ডা ছিল না, তখন কিন্তু সময় অনেক কম লাগত। কী করে কোন অদ্ভুত উপায়ে যে তা সম্ভব হতো তা শ্লোকের জানা নেই, কিন্তু নোনা পাড়া বাজার সংলগ্ন এই সংকীর্ণ রাস্তাটা দিয়ে বেনিয়মের অলৌকিক অভ্যাসে বাইক-সাইকেল-রিকশা-ভ্যান-অটো এমনকি ৯৯-ডাবলু রুটের বাস পর্যন্ত বিন্দাস যেত-আসত; স্কুল-কলেজে পড়াকালীন তাই তার কোনোদিন কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু, এখন চাকরি জীবনে এর জন্যে প্রায় প্রতিদিনই তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমনিতে শ্লোক একটা নাম করা কোম্পানির হয়ে ইনস্যুরেন্স বিক্রি করে বলে তার নিজের কাছে তার সময়ের বিশেষ কোনো দাম নেই। কারণ তার সময় চলে ক্লায়েন্টের সময় মতো। ক্লায়েন্ট যখন ডাকবে তখনই তাকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে হবে; সে ভোর ছ’টা কিংবা রাত দশটা, উইক ডেজ অথবা উইক এন্ড, ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যা বা লু-বাহিত দুপুর কোনো কিছুতেই ছাড় নেই। না, নিজের জন্যেই নেই। এর জন্যে কখনোই কেউ দায়ী নয়। এই সব লাইনে এমনিতেই কোনো মাসে টার্গেট পূরণ হয় না, সারা বছরই অফ সিজন চলে, তাই প্রায় দিনই বসের মুখ ঝামটা দিয়ে লাঞ্চ সারতে হয়, তার মধ্যে যদি কোনো লিড পাওয়া যায়, সেটাকে আঁকড়ে ধরে দৌড়নো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এই যেমন এই মাসে আজ পঁচিশ তারিখ হতে গেল, কিন্তু সোয়া টার্গেটও পূরণ হওয়ার কোনো চান্স দেখা যাচ্ছে না। গত সপ্তাহে তো বস সুবীর আচার্য সবাইকে ডেকে পরিষ্কার বলেই দিলেন, এভাবে চলতে থাকলে আর বেশি দিন কোম্পানি টানতে পারবে না। পারফর্মেন্স চাই। যে কোনো মূল্যে টার্গেট পূরণ করতেই হবে। না হলে…
বসের অসমাপ্ত বাক্যের শেষে কী আছে, তা বোঝার জন্য ক্যালকুলাস জানতে হয় না, ছ’মাস এই লাইনে থাকলেই জানা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, জেনেও এখানে কিছু করা যায় না; দিন-রাত পরিশ্রম করে, বকে বকে মুখের ফ্যানা তুলে দিয়ে, একের জায়গায় দশটা লোককে ভিজিট করেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। লোকের পকেট থেকে টাকা বের করা যে কী কঠিন কাজ, যে করেছে সেই জানে।
তা বলে কি কেউ করছে না? শ্লোক আনমনে ঘাড় নাড়ল, এই তো গত মাসে অর্ক সামন্ত প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ব্যবসা দিলো। কী করে দিলো? মার্কেটিংয়ে এম.বি.এ নয়, পাতি গ্র্যাজুয়েট, আলাদা কোনো সোর্স নেই, এক্সট্রা কোনো লিডও পায় না। তারপরেও সে কী করে প্রায় প্রতি মাসে টার্গেট অ্যাচিভ করে! আগে শ্লোক ভাবতো এর পিছনে কোনো ম্যাজিক আছে, কোনো বিশেষ ট্রিক্স আছে, কিন্তু না, বেশ কিছু বছর এই লাইনে থাকার পর ও বুঝেছে, ওসব কিস্সু নেই। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, সেলস ম্যান যে কেউ হতে পারে না, হয়েই জন্মায়, ঘষে-মেজে একটু বেটার হয় আর কি। এই মোদ্দা কথা অনুধাবন করার পর শ্লোক ভালোই বুঝতে পেরেছে যে, ওর মতো মুখচোরা ছেলের পক্ষে এই লাইনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু আর কোনো বিকল্পও তো নেই, তাই লড়াই ছাড়া চলবে না। অনেক কষ্টে এই বাজারে একটা চাকরি পাওয়া গেছে, এটা গেলে কী হবে তা শ্লোকের জানা নেই। তাই সে সর্বোত্তম চেষ্টা করছে, এই চাকরিটা বাঁচানোর।
কিন্তু এতো চেষ্টা করেও কি চাকরিটা বাঁচানো যাবে? আজ যদি মিস্টার মুন্সীর সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলে এই মাসেও সে টার্গেটের ধারে কাছে পৌঁছোতে পারবে না, সেক্ষেত্রে চাকরি নট হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর যদি চাকরি নট হয়ে যায়, তার জন্য তখন সে কাকে দায়ী করবে? তার বাঁধানো কপালকে, ওই খেঁকুরে বসকে, না এই জঘন্য সিগনালটাকে? কাকে?
সেদিন সাদা গুটিটা একদম পাতি ইঞ্চিতে বসানো ছিল, ফেলে দিলেই ’নিল’। শ্লোক তাই স্ট্রাইকার বসিয়ে ভালো করে মেপে নিচ্ছিল; যুগলদা এ পাড়া তথা এ অঞ্চলের বেস্ট প্লেয়ার, পরপর দু’বার ইন্টার পাড়া ক্যারাম প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করেছে, সবাই তাই তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে, এসে দাঁড়ালেই নিজের জায়গা ছেড়ে দেয়, তা এহেন যুগাবতারকে একবার হারাতে পারলেই নিজের স্ট্যাটাসটা কোথায় চলে যাবে, ভাবলেও শ্লোকের গায়ে তখন কাঁটা দিয়ে উঠছিল। এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসে না, তাই কোনো ভুল করা চলবে না, শ্লোক নিবিষ্ট মনে সাদা গুটি আর পকেটের দিকে তাকিয়ে ছিল, সবাই শ্লোকের দিকে তাকিয়ে ছিল আর ভগবান তাকিয়ে ছিল যুগলদার দিকে। শট মারতে যাবে হঠাৎ-
‘এই গেল গেল…’ বলতে বলতে পিছন থেকে দৌড়ে আসা একটা টাক মাথা, গোলগাল চেহারার লুঙ্গি পরা ভদ্রলোকের দিকে তাকানোর ঠিক মুহূর্তে গুম করে একটা শব্দ হতেই দেখা গেল, ভানুদার প্রাগৈতিহাসিক লাল মারুতি ওমনিটার পিছনে এসে সজোরে ধাক্কা মেরেছে একটা লাল সাইকেল। একটা এক মাথা চুল, একটা মাখনের মতো গায়ের রং, একটা ভোঁতা মতো নাক, একটা… না, না, দুটো গভীর চোখ সম্বলিত একটা মেয়ে অথবা একটা পরী!
ক্যারামের উত্তেজক মুহূর্ত ছেড়ে সবাইয়ের সঙ্গে শ্লোকও রেসকিউ অপারেশনে দৌড়ে গিয়ে দেখল, মেয়েটা নিজে নিজেই সাইকেলটা তুলে দাঁড়িয়ে জামা-কাপড় ঝাড়ছে। লুঙ্গি পরা ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লেগেছে নাকি মামনি?’
মেয়েটা উত্তর দেওয়ার আগেই শ্লোকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল, ‘খুব’।
তা লাগবে না! এমন মাঝ এপ্রিলের গুমোট সন্ধেবেলায় হঠাৎ করে যদি চোখের সামনে রং-বেরঙের বাড়িগুলো এক একটা সবুজ পাহাড় হয়ে যায়, লম্বা লম্বা বাতি-স্তম্ভ গুলো পাইন গাছ হয়ে যায়, আর ক্যারামের উপরের ঝুলন্ত ডুমটা হলুদ চাঁদ হয়ে যায়, তাহলে একটা বছর আঠেরোর সদ্যোজাত যুবকের পক্ষে নিজেকে কি আটকে রাখা সম্ভব হয়? না, হয় না। সে তখন সেই মোহময়ী কিরণের দুর্নিবার আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে না পেরে অন্ধের মতো তাকে অনুসরণ করতে থাকে, করতেই থাকে যতক্ষণ না সে রাস্তা হারিয়ে ফেলে জীবনে প্রথম বার প্রেম নামক সুগভীর উপত্যকায় গিয়ে টুক করে পড়ে; এই পতন শব্দরহিত, বোধরহিত, বেদনারহিত, কিন্তু এর অভিঘাত আকস্মিকতার রেলিং ঘেঁষে এমন ভূমিকম্প ঘটায় যে গোটা শরীর অদ্ভুত ভাবে কেঁপে ওঠে।
কিন্তু এই জালিম দুনিয়া আর সেসবের কী বোঝে? শ্লোকের উত্তর শুনে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন কোনো ভূতকে দেখছে, তাই সেও বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘লাগবে না? যা জোরে শব্দ হল!’ ওর উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে ভিড়টা পুনরায় মেয়েটার দিকে মনোনিবেশ করেছিল।
খবর জোগাড় করতে শ্লোকের দেরি হয়নি, সব বন্ধুদের লাগিয়ে দিয়েছিল ‘জানেমনের’ পিছনে এবং ফলও পেয়েছিল হাতে-নাতে। মেয়েটার নাম রিকিতা সরকার, এই বছর মাধ্যমিক দিয়েছে। একটা ছোট ভাই আছে, ক্লাস ফাইভে পড়ে। বাবা রেলে চাকরি করেন। মাস দুয়েক আগেই মন্দির পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে এনেছে। ব্যস, এতোটুকু ইনফোই একটা ছেলের পক্ষে ‘ফিল্ডিং’-এ নেমে পড়ার পক্ষে যথেষ্ট, তাই শ্লোক আর দেরি করেনি মাঠে নামতে। কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার পর টি-টোয়েন্টি ভেবে ম্যাচটা শুরু করলেও কিছু দিনের মধ্যেই শ্লোক বুঝতে পেরেছিল বল টেস্ট ম্যাচের দিকেই গড়াবে। তাই সেও কোনো তাড়াহুড়ো করেনি, সম্পর্কটাকে নিজের গতিতে চলতে দিয়েছিল। ফলও পাচ্ছিল হাতে হাতে, রিকিতা ধীরে ধীরে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছিল; ওর কথায় একটা আলগা কেয়ারিং, একটা মুচমুচে ডোমিনেশন, একটা হালকা অধিকার-বোধ ডানা মেলছিল। শ্লোক বুঝতে পারছিল, যে ঢেউ ওর বুকে উঠছে, তার স্রোত রিকিতার উঠোন ছাপিয়ে গেছে। এখন কে আগে ঝাঁপ দিয়ে অন্যকে টেনে নেবে তারই অপেক্ষা।
এইভাবে আরো কিছুদিন চলার পর রিকিতার আকার-ইঙ্গিতে যখন শ্লোক প্রায় নিশ্চিত যে এবার প্রপোজ করলে উত্তর পজিটিভই আসবে, ঠিক তখনই ব্যাড নিউজটা এলো। হঠাৎ একটা ম্যাসিভ ব্রেন স্ট্রোকে রিকিতার মা মারা গেলেন। রিকিতার বাবার ট্রান্সফারেবল চাকরি ছিল। তাই স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই ছেলে-মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি আসানসোল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর ছুটিছাটায় রিকিতা কলকাতায় আসতো, দেখা হলে টুকটাক কথাও হতো, কিন্তু সেই ব্যাপারটা আর ছিল না, আকস্মিক দুর্ঘটনায় ওদের দুজনের সম্পর্কের সুরটা কোথাও কেটে গেছিল।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ যা ঘটল, রীতিমতো চমকে দেওয়ার মত ঘটনা। রিকিতা এসে সোজা শ্লোককে বলেছিল, ‘আমাকে একটু মৌলালি ছেড়ে দেবে? খুব আর্জেন্ট। একটা ইন্টারভিউ আছে।’ তাড়াহুড়ো ছিল, কিন্তু অমনভাবে কেউ বললে শ্লোক আবার না বলতে পারে না।
‘আরে কী ভাবছিস? বাইকটা স্টার্ট দে, অরেঞ্জ হয়ে গেছে।’ সহযাত্রী এবং কলিগ সুজয় দে’র ঝাঁঝিয়ে ওঠাতে শ্লোকের চিন্তাসূত্রটা ছিঁড়ে গেল। সে তড়িঘড়ি স্টার্ট দিয়ে সিগন্যাল গ্রিন হওয়ার আগেই পিক-আপ নিলো, মিস্টার আগরওয়ালের থেকে আজ চেকটা না নিলেই নয়।
নোনা পাড়ার সিগন্যাল গত কয়েক দিন ধরে যেন অতি মাত্রায় ভদ্র হয়ে গেছে। রেড হতে না হতেই অরেঞ্জ ছুঁয়ে গ্রিন হয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! যখন প্রয়োজন ছিল তখন কতো ভুগিয়েছে, আর এখন যখন প্রয়োজন নেই, তখন… শ্লোক সিগন্যালটাকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে ক’টা কাঁচা খিস্তি দিলো। তারপর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বল্টুকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
আসলে সে যা ভাবছে তা কি ঠিক? না, মোটেই না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আগেও এই সিগন্যালে একশো কুড়ি সেকেন্ড দাঁড়াতে হত, এখনও তাই হচ্ছে। রাস্তাটা এমন ঘোঁট পাকিয়ে থাকে যে চারটে গাড়ি সিগন্যাল পেরোতে না পেরোতেই টাইম ওভার হয়ে যায়, আর তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। ব্যাপারটা খুবই সহজ, কিন্তু এখন সব কিছুই সে যেন একটু অন্যভাবে ভাবছে। নেতিবাচক। হ্যাঁ, সে বড্ড বেশি নেতিবাচক হয়ে গেছে আজকাল। সবেতেই, সব কিছুতেই শুধু খারাপ দিকটা বড় করে দেখছে। জীবনের ইঁদুর দৌড় থেকে অকালে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে গেলে মনে হয় এই সব চিন্তা-ভাবনা ফ্রি গিফটের মতো চলে আসে। এটাকেই কি লোকে ডিপ্রেশন বলে? এমন নৈরাশ্যবাদী কি সে এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে আর কখনো হয়েছে? না, মনে পড়ে না। দুঃখ জীবনে অনেক বার পেয়েছে, কিন্তু কোনো দুঃখই, কোনো হতাশাই বেশি দিন তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি। কোনো না কোনো উপায়ে ঠিক বেরিয়ে এসেছে। মনোভঙ্গের যন্ত্রণাকে কোনো দিনই মাথায় চড়তে দেয়নি। সমূলে উৎখাত করেছে। কিন্তু, সে সময় আলাদা ছিল, নিজেকে লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে আনার বিশাল তাগিদ ছিল, কিন্তু এবারে যেন ভিতর থেকে সেই হার না মানা বাঘটার কোনো শব্দ কানে আসছে না। সে কি আদৌ বেঁচে আছে? নাকি, না খেতে পেয়ে মরে গেছে কে জানে?
দাদার এমন অবস্থা দেখে বোন কাল রাতেই বলছিল যে, এমন তো হতেই পারে। তাই, ভেঙে না পড়তে। উঠে দাঁড়িয়ে আবার লড়াই শুরু করতে।
ভুল কিছু বলেনি। চাকরি যাওয়া-আসা তো খুব কমন ব্যাপার, এই পৃথিবীতে তো সে একমাত্র মানুষ নয় যার চাকরি গেলো, তাহলে কীসের এতো কষ্ট, কীসের এত বেদনা, কেন নিজেকে এতটা অসহায় লাগছে। রিকিতার জন্য?
সেদিনের পর নোনা পাড়ার ওই কুখ্যাত রেড সিগন্যালের দৌলতে রিকিতার সঙ্গে শ্লোকের আরও কিছু দিন দেখা হয়ে গেছে; রিকিতার নতুন চাকরি, দেরি হয়ে গেলে সমস্যা হতে পারে, তাই শ্লোক ‘মানবতা’ রক্ষার খাতিরে না বলতে পারেনি, গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে খুশি মনে হেলমেট বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রথম প্রথম গোটা রাস্তা জুড়ে সৌজন্যমূলক কথা হলেও ধীরে ধীরে সম্পর্কের আড় ভেঙেছিল। বরফ সরিয়ে বছর আটেক আগের সেই প্রাণোচ্ছল দিনগুলো একটু একটু করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল। মোবাইল নম্বর বিনিময়, ফেসবুক, রাত জাগা হোয়াটসঅ্যাপ থেকে শুরু করে ফুচকার দোকান-রেস্টুরেন্ট কিংবা টুকটাক সিনেমা হল হয়ে যখন গাড়ি আবার প্রপোজ আইল্যান্ডে পার্ক করতে যাবে, তখনই একদিন বস এসে ‘সুখবর’টা দিলো, কোম্পানি আর টানতে পারছে না, অতএব…
বাকিরা জবাবদিহি চাইছিল, কেন, কেন ঠিক আমরা চার জনই কেন? ওরাও তো… কিন্তু শ্লোক নিশ্চুপ ছিল, ওর সামনে তখন একটা গোটা হিমবাহ ভেঙে পড়েছিল আর বরফ ঠাণ্ডা জলে ওর নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
‘তু মান মেরি জান…’ পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠতে শ্লোকের সম্বিৎ ফিরল।
সংকেতদা। পাড়াতুতো দাদা। ওর অফিসে একটা চাকরির জন্য বলেছিল। হয়তো সেই জন্যেই ফোন করছে। হঠাৎ একটা আশার আলো দেখতে পেল শ্লোক।
-হ্যাঁ, বলো।
-শ্লোক, তুই বি.কম তো?
-হুমম।
-তোর চাকরির ব্যাপারে আমাদের অফিসে কথা বলেছি। এখনই একবার একটু কালীঘাট আসতে পারবি?
-হ্যাঁ, অবশ্যই।
-ঠিক আছে, তোকে তাহলে ঠিকানাটা টেক্সট করছি।
-ওকে।
কলটা কেটে শ্লোক একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে স্মরণ করল, তারপর উড়িয়ে দিল পক্ষীরাজ ঘোড়া।
গ্র্যাজুয়েশনের পর এম.কম করতে চেয়েছিল শ্লোক কিন্তু বাবা মুখের ওপর না বলে দিয়েছিল; বলেছিল, যতোটুকু সাধ্য করে দিয়েছি, এবার যা করার নিজে করে নাও। বাবার আপ্তবাক্য বুঝতে সেদিন অসুবিধা হয়নি শ্লোকের, দুঃখ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাবার ওপর রাগ হয়নি। একটা কারখানার লেদম্যান আর কত টানবে? এরপর বোনও আছে, ওর পড়াশোনা-বিয়ে… বাবার পরিস্থিতিটাও বোঝার চেষ্টা করেছিল সে, আর তাই যে কোনো একটা চাকরির জন্য পরিচিতদের তদবির করতে শুরু করে দিয়েছিল।
মাস তিনেক ধরে গোটা দশেক ইন্টারভিউ দেওয়ার পর জ্যাঠতুতো দাদার এক বন্ধু প্রণব দাস, হঠাৎ বাড়ি বয়ে এসে একটা নামি কোম্পানির হয়ে ওয়াটার পিউরিফায়ার বেচার কাজ দিয়েছিল; সেখানে বছর দুই ছিল, সেটা যাওয়ার পর কিছু দিন ক্রেডিট কার্ড বেচেছে, তারপর সেই চাকরিটা যাওয়ার পর প্রায় তিন মাস বসে থাকার পর এই কাজটা পেয়েছিল, একটা কন্সাল্ট্যান্সিকে টাকা খাইয়ে।
‘দাদা মা খেতে দিয়েছে।’
ঘড়ির দিকে তাকাল শ্লোক, আটটা বাজতে দশ। এখনই খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, না হলে রিকিতার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার চান্স প্রবল। আর সেটা সে একদমই চাইছে না। সেদিন সংকেতদার ওখানে ইন্টারভিউটা ক্লিক করেনি সম্ভবত। বলেছিল, পরে খবর দেবে, কিন্তু আজ প্রায় কুড়ি দিন হয়ে গেলো, এখনো যোগাযোগ করেনি। সুতরাং আর আশা আছে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায় শ্লোক রিকিতার সঙ্গে প্রায় সব রকম যোগাযোগই ছিন্ন করেছে। রিকিতা বারেবারে ফোন করেছে, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেছে, কিন্তু শ্লোক শুধু ‘হু হ্যাঁ’ বলে কাটিয়ে দিয়েছে। তার দায়সারা উত্তর রিকিতার কাছে যে সিগন্যাল পাঠিয়েছে, তার অর্থ যাই হোক বর্ণ নিশ্চয়ই লাল। তার চরম উদাসীনতার পরিপ্রেক্ষিতে রিকিতাও আজ না হয় কাল নিশ্চয়ই হাত তুলে নেবে, নিতেই হবে। শ্লোক নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাতটা দিয়ে সজোরে টেবিলে আঘাত করল। সম্পর্ক নামক বিষয়টার এটাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক তরফা লড়াই করে কোনো সম্পর্কই টিকিয়ে রাখা যায় না। হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত হয়তো চেষ্টা করা যায়, কিন্তু ক্রমাগত ব্যর্থ চেষ্টা মন ভেঙে দেয়, মানুষকে অসহায় করে তোলে, অবসাদে পড়ে শেষমেশ সে হাত তুলে নেয়। এই হাত তুলে নেয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ থাকে না, কোনো তৃপ্তি থাকে না, কিন্তু ওই দূরে চলে যাওয়ার মধ্যে কোনো দুঃখও থাকে না। এইটা একটা হৃদয়ের দুরূহ অনুভূতি, মিশ্র না এক পাক্ষিক আজ পর্যন্ত কেউ ঠাহর করতে পারেনি।
‘কি রে, আর কতোবার ডাকতে হবে?’ মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরল, শ্লোক তড়িঘড়ি জামার বোতাম ক’টা আটকে নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।
ব্রেকফাস্ট করে বেরোতে বেরোতে তাও পৌনে ন’টা বেজে গেল শ্লোকের। রিকিতার বাসটা নোনা পাড়া ক্রসিং পেরোয় ওই ন’টা নাগাদ, তাই আজ দেখা হয়ে যাওয়ার চান্স প্রবল। যদিও এ এক অবান্তর ভীতি, যার পিছনে কোনো সুগঠিত যুক্তি নেই। কতো দিন এভাবে পালিয়ে বেড়াবে সে? কীসের এতো ভয়ও পাচ্ছে ও। সে তো রিকিতাকে প্রপোজ করেনি আর রিকিতাও ওকে গলা জড়িয়ে বলেনি, আমাকে প্লিজ ভালোবাসো। তাহলে কীসের এতো কুন্ঠা, এতো লজ্জা, এতো ভীতি। এই ভয়ের উৎস কী? এমন তো নয় যে সে আর চাকরি পাবে না, আবার নিশ্চয়ই সে ঘুরে দাঁড়াবে, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমঘর থেকে নিজেকে ঠিক বের করবে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে হাতে বেশি সময় নেই; এটা স্কুল লাইফ কিংবা কলেজ লাইফ নয় যে, প্রপোজ করার পর পাঁচটা বছর চেয়ে নিয়ে, অনায়াসে এলিয়ট পার্কে ঢুকে যাওয়া যায়। আজ আর সেই বয়স নেই; অলরেডি ছাব্বিশ হয়ে গেছে, এখন শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় বাড়ি তোলার সময়। এখনও যদি রাস্তাই খুঁজে যেতে হয়, তবে আর মঞ্জিল আসবে কী করে?
তবে এটাই শুধু নয়, আরো একটা গুরুতর কারণ রয়েছে। শ্লোক ভাবছে, রিকিতাকে সামনাসামনি পেলে হয়তো সে নিজেকে ঠিক ধরে রাখতে পারবে না, হয়তো গলগল করে সব বলে দেবে, আর তারপর যদি রিকিতা দয়াপরবশ হয়ে, সিম্প্যাথি দেখিয়ে… হয়তো ওর মধ্যে কোনো ফিলিংস নেই কিন্তু বেসাহারা, অসহায়, বিপর্যস্ত একটা ছেলেকে জাস্ট দুধেভাতের মতো কিছু দিন আগলে রেখে তারপর… না, তার থেকে এই ভালো। যদি কোনো দিনও দেখা…
‘প্যাঁ পো প্যাঁ পো’… গাড়ির অননুকরণীয় ঘণ্টা ধ্বনিতে শ্লোকের সম্বিৎ ফিরল, সে তড়িঘড়ি বাইকটা স্টার্ট দিয়ে এগোতে গেলো, কিন্তু না, এবারেও তার বাইকের চাকা ফুট পাঁচেকের বেশি এগোতে পারল না।
তিন তিনটে সিগন্যাল খেলো, কিন্তু তাও আজ নোনা পাড়া পেরোতে পারল না? কী যাচ্ছেতাই অবস্থা। সামনেটা পুরো হযবরল হয়ে বসে আছে। অফিস টাইম, তাই সবারই তাড়া। যে যার মতো পেরেছে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে। একটা সিভিক পুলিশ মোটা লম্বা একটা ডাণ্ডা নিয়ে অসম্ভব পরিশ্রম করছে। এই ঘেঁটে যাওয়া, তালগোল পাকিয়ে যাওয়া রাস্তাটার শ্রী ফেরাতে কিন্তু পারছে না। অসহ্য ক্যাকোফোন আর অসভ্য গালিগালাজের মধ্যে তার অক্লান্ত চেষ্টা দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ হচ্ছে।
শ্লোক ঘড়ির দিকে তাকাল- ন’টা পাঁচ। সাধারণত রিকিতা ব্যাংক মোড় থেকে সোয়া আটটার বাসটা ধরে, যা যানজট কাটিয়ে নোনা পাড়ার মুখে আসতে মিনিট ত্রিশেক সময় নেয়। আর তার বেশি নিলেই রিকিতা বাস থেকে নেমে পড়ে এবং এই রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে এসপ্ল্যানেডমুখী বাস ধরে। আজ তার মানে দেখা হয়ে যাওয়ার চান্স প্রবল, কথাটা মনে হতেই শ্লোক বাইকে স্টার্ট দিলো, যেভাবে হোক এবারে সিগন্যাল পেরোতেই হবে। ভাবতে না ভাবতেই সিগন্যাল গ্রিন হলো।
শ্লোক বহু চেষ্টা করেও বেশি দূর এগোতে পারল না। সিগন্যাল থেকে ঠিক ফুট দশেক আগে শ্লোকের বাইকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আবার দু’মিনিটের ধাক্কা। ঘড়িতে ন’টা আট বাজে। আজ মনে হয় আর রিকিতাকে এড়ানো যাবে না, মুখোমুখি হতেই হবে। শ্লোকের হঠাৎ করে সিগন্যালটার উপর খুব রাগ হলো, মনে হলো, একটা গোটা থান ইট ছুঁড়ে মারে। যতো নষ্টের গোড়া এই সিগন্যালটা, এটার জন্যেই সব শুরু হয়েছিল। ভালোই তো ছিল সে রিকিতাকে ভুলে। সেদিন যদি অমন জ্যাম না থাকতো, তাহলে কি…
‘এই শ্লোক!’ রিকিতার গলা। শ্লোক চমকে উঠে সিগন্যালের দিকে তাকাল, অরেঞ্জ… গ্রিন। শ্লোক হুশ করে উড়ে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু একটা ট্যাক্সি এমনভাবে সামনে দাঁড়িয়ে গেল যে সে নড়তেও পারল না। আর সিগন্যাল যথারীতি রেড হয়ে গেল।
‘কী রে ডাকছি,শুনতে পাচ্ছিস না?’ রিকিতা শ্লোককে ধরে ফেলেছে।
‘না… এতো শব্দ… এতো আওয়াজ। শুনতে পাই নি রে।’ আর পালানোর উপায় নেই বুঝতে পেরে শ্লোক গাড়িটা একটা দিকে সাইড করতে করতে জবাব দিলো।
-আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন?
-কই না তো!
-একদম ন্যাকামি করবি না। অনেক দিন ধরে এসব সহ্য করছি, আর না।
রিকিতা যেন হঠাৎ আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে উঠল। ওর এমন মূর্তি দেখে শ্লোক বেশ ঘাবড়ে গেলো। ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না।
-জবটা যে আর নেই সেটা আমাকে জানাসনি কেন?
এসব খবর লুকনো থাকে না, এতো কমন ফ্রেন্ড কেউ একটা নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে। শ্লোক সামাল দেওয়ার জন্য আমতা আমতা করে জবাব দিলো, ‘না, জানাতাম তো, আসলে’…
রিকিতা তাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না, তুই আমাকে জানাতিস না, মোটেই জানাতিস না। কারণ, তুই ভাবছিস তোর জব চলে গেছে ভেবে আমিও তোকে…’ রিকিতা কিছু বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে যেন সামলে নিলো, তারপর উদাসীন গলায় বলল, ‘ছাড়, তোকে এসব কেন বলছি। তুই যা। আমারও অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ কথাটা বলেই রিকিতা দ্রুত পিছনে ঘুরে ক’পা এগিয়ে গেলো। কিন্তু বেশি দূর গেলো না, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর চকিতে ঘুরে আবার শ্লোকের কাছে এসে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘আসলে কী জানিস, তুই নিজেকে খুব মহান ভাবিস। খুব চালাক অ্যাট দ্যা সেম টাইম। আজ থেকে আট বছর আগে যখন তোর আমাকে সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখনও তুই নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলিস। আর আজও…’
‘না, তুই ভুল ভাবছিস। আমি মোটেই নিজেকে তখন দূরে সরিয়ে নিতে চাই নি।’ শ্লোক রিকিতার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমি আসলে তোকে ওই মুহূর্তে বিব্রত করতে চাইনি। তুই বিশ্বাস কর।’ শ্লোক দুটো হাত জোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল, ‘আমি তখন তোকে একটু স্পেস দিতে চেয়েছিলাম, ভুলভাল কিছু বলে তোকে চিরতরে হারাতে চাইনি।’ শ্লোক আত্মপক্ষ সমর্থন করার সর্বোত্তম চেষ্টা করল।
‘স্পেস!!! স্পেস দিতে চেয়েছিলিস আর তাই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলিস! হাসাস না শ্লোক, হাসাস না। তুই নিজে যতোই ভাবিস যে তুই সেই সময় আমায় স্পেস দিয়ে খুব মহান কাজ করেছিস, আদতে সেটা সবচেয়ে বড় মিথ্যে। সত্যি কথা হলো, তুই সেদিন পালিয়েছিলিস, যেমন আজ পালাচ্ছিস।’
‘না, আমি পালাচ্ছি না।’ শ্লোক আঁতকে উঠল।
‘চুপ কর, একদম চুপ করে থাক, বলতে দে আমায়।’ রিকিতা আবার শ্লোককে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আসলে কী জানিস, তোর কাছে বাকিদের ফিলিংসটা ম্যাটারই করে না, তুই যা ভাবছিস সেটাই ঠিক। তোর কাছে সামনের মানুষটার অনুভূতির কোনো গুরুত্ব নেই। তুই সব কিছুই নিজের মতো করে ভেবে নিস। তোর জগতে তুই নিজেই একমাত্র হিরো বাকি সব ভিলেন।’ রিকিতা থামল। রিকিতার চোখ চিকচিক করছে, তাই রুমাল দিয়ে হালকা করে চোখের কোলটা মুছে নিলো, তারপর বলল, ‘তোকে আমি চিনে গেছি শ্লোক, আমি তোকে খুব ভালো করে চিনে গেছি। আমি বুঝে গেছি তুই ঠিক কতটা স্বার্থপর, কতটা সেলফ সেন্টার্ড।’ রিকিতার নাকের পাটা ফুলছে, চোখে জল আবার ভরে গেছে, কিন্তু প্রাণপনে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভাঙা গলায় বলে চলেছে, ‘কিন্তু তাও আমার আর কিছু করার নেই রে। আমি একদম হেল্পলেস হয়ে পড়েছি। সব জেনে-বুঝেও আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, প্রতিদিন এই সিগন্যালটা পেরোবার সময় তোকে খুঁজি, অফিসে থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে তোর অপেক্ষা করি, তোকে বারবার ফোন করি, মেসেজ করি, তুই পাত্তাই দিস না। কিন্তু তবু এমন অবুঝের মতো কাজ করে যাই। কেন? কেন বল তো?’
এই সহজ প্রশ্নের উত্তর শ্লোক কি জানে না? জানে,কিন্তু বলতে পারে না। আগেও পারেনি, আর আজও পারল না, নিষ্পলক শুধু তাকিয়ে রইল রিকিতার দিকে।
‘কারণ আমি একটা বোকা, খুব বোকা একটা মানুষ, তাই না?’ রিকিতা এবার হাঁপাচ্ছে, ‘কিন্তু বিশ্বাস কর, তুই আমায় যতোই বোকা ভাব, ইমম্যাচিওর ভাব, আমার আর কিচ্ছু করার নেই।’ রিকিতার চোখ দিয়ে অনবরত জল বেরোচ্ছে, ওর গলা দিয়ে আর স্বর বেরোচ্ছে না, কিন্তু তবু ও কষ্ট করে বলে যাচ্ছে, ‘আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি শ্লোক। বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু তা বলে আমি তোকে জোর করতে পারি না, তোর যদি…’ রিকিতা আরো কী সব বলে যাচ্ছিল, শ্লোক আর সেসবে পাত্তা না দিয়ে ঝুপ করে ওকে বুকে টেনে নিলো। রিকিতা প্রথমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, ‘ছাড় তুই, একদম নাটক করবি না। ছাড় বলছি।’ না পেরে দুমদাম শ্লোকের বুকে মারতে লাগল, তাতেও যখন নিস্তার পেলো না, তখন সে শ্লোকের বুকে ভেঙে পড়ল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে শ্লোকের মনে হলো, বিশ্রী ক্যাকোফোন ছাপিয়ে যেন একসঙ্গে অযুত পাখি শিস দিয়ে উঠল, অজস্র রঙিন প্রজাপতি কোথা থেকে ভিড় করে এসে শহরের আকাশ ঢেকে দিলো, আর একটা পুষ্পক রথ কবেকার, গোলাপের পাপড়ি ছেটাতে ছেটাতে চলে গেলো বহুদূর। প্রথম প্রেমের পূর্ণতা প্রাপ্তির পরম আবেশে তার চোখ বুজে এলো।
ওদিকে যদিও সবই বাস্তবসম্মত ছিল, কিন্তু তবু প্রথম বারের জন্য, নোনা পাড়া ক্রসিং-এ সিগন্যাল গ্রিন হয়ে যাওয়ার পরও গাড়িগুলো নড়তে চাইছিল না।
আমার নির্দেশ মানলে যে শুধু প্রাণই বাঁচে না, গোটা একটা প্রেমও হয়, তার প্রমাণ আমি এই শেষবারের মতো দিয়ে রাখলুম, হ্যাঁ। তিনটে চোখ আমায় ভগবান এমনি এমনি দেয়নি। জ্বলছি-নিভছি, আখেরে তোমার ভালোই করছি। কোথায় কৃতজ্ঞতা জানাবে তা নয়, উল্টে গালাগাল দেয়। ছি! যতো সব বর্বরের দল!